বরাবরের মতোই শুরু হয়ে গেল মাসুদ ও মাসুমের মধ্যে মারামারি। গতকাল তাদের বাবা নানান রংয়ের দামি কলম এনেছেন। সেগুলোই ভাগাভাগি করছিল তারা। ভাগাভাগির একপর্যায়ে ঝগড়া লেগে যায় তাদের মাঝে। তিন বেলা খাবার খাওয়া যেমন দৈনন্দিন একটি রুটিন, ঠিক তেমনি তাদের মাঝে ঝগড়াও একটি দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই তো কয়েকদিন আগের কথা। বিদ্যালয় থেকে ভ্রমণে যাচ্ছিল এবং বাসের মধ্যে বসার স্থান নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেয় তারা। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল তিন ছেলে। তারা সুযোগটিকে লুফে নিলো। তাদের দখলে চলে গেল দুই ভাইয়ের বসার স্থান। লোকসংখ্যার তুলনায় বসার স্থানের কমতি ছিল। ফলে দু’ভাইকে দাঁড়িয়ে থেকেই সম্পূর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। এরপরও তারা ঝগড়া করার কুফল বুঝতে পারেনি। আজ আবার সামান্য কলম নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছে।
ঝগড়ার একপর্যায়ে মাসুদ কলমটিকে জানালার পাশের খালটিতে ফেলে দিল। এজন্য মাসুম দাদুর কাছে বিচার নিয়ে গেল।
দাদু নিত্যদিন তাদের এসব ঝগড়া দেখে অতিষ্ঠ। সব শুনে তিনি তাদের বললেন, ‘ঝগড়া করার ফলে দু’জনেই কলমটি হারালে। তাই, ঝগড়া করা বন্ধ করো।’
কিন্তু এতটুকুতেই তারা উপলব্ধি করার পাত্র নয়। তাই তাদের সঠিক পথে আনতে দাদু খন্দকার সাহেব একটি ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় ঘটনা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি বললেন, ‘তোমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানো। এসব ইতিহাস আমাদের কেন পড়ানো হয় জানো? কেননা যখন কোনো জাতি তার পূর্বের ইতিহাস ভুলে যায়, তখন তার পতন নিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়। আজকে মুসলিম জাতির এত অধঃপতনের কারণও এটি।
আজ মুসলিম জাতি তারিক বিন যিয়াদকে চেনে না। আজ আমরা মুহাম্মদ বিন কাসিম ও সুলতান মাহমুদের সম্পর্কে জানি না।
রাসূল (সা.) তার পুরো উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন। অথচ তোমরা তার উম্মত হয়ে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত রয়েছো। এতে করে কি তোমরা লাভবান হচ্ছো? না, বরং তোমাদের ক্ষতি হচ্ছে। আমি এখন তোমাদের একটি ইতিহাসের শিক্ষণীয় ঘটনা বলব। মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’
ঘটনার কথা শুনে দু’জনে নড়েচড়ে বসল। গল্প শুনতে তারা বড্ড ভালোবাসে যে। একজন গল্পকথকের গল্প তখনই সার্থক হয়, যখন তা কারো জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়।
দাদু বলা শুরু করলেন, ‘রমজান মাসের ১৫ তারিখ। এই দিনটি পুরো বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন কি হয়েছিল জানো? এই দিনই মুসলিমরা আইন জালুতের প্রান্তরে এমন এক বাহিনীকে চরমভাবে পরাজিত করে দিয়েছিল যাদেরকে লোকে ইয়াজুজ-মাজুজের দল বলত!’ চমকে উঠল দুই ভাই। দাদুর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
দাদু বলতে থাকলেন, ‘মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ বাগদাদ শহরসহ পুরো মুসলিম বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছিল এই বর্বর বাহিনী। এই বাহিনী হলো মোঙ্গল বাহিনী। মোঙ্গলরা খালি চোখেই কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখতে পেত!
একমাত্র মুসলিম সাম্রাজ্য হিসেবে মিসরের মামলুক সালতানাত বাকি ছিল। সেই মামলুক সালতানাতকে ধ্বংস করার জন্য মোঙ্গলরা ধেয়ে আসছিল।
যুদ্ধ শুরু হয় আইন জালুতের প্রান্তরে। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে সুলতান সাইফুদ্দিন সেনাদের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো, মোঙ্গলদের নিকট ছিল শক্তিশালী হাত কামান। তারা অনেক দূর থেকে সঠিক নিশানায় তীর ছুড়তে পারতো। মোঙ্গলদের তীব্র আঘাতে মুসলমানদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে, অনেকে আহত ও শহীদ হন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল এবারও মোঙ্গলরাই জয় লাভ করবে।
এই অবস্থা দেখে সুলতান সাইফুদ্দিন নিজের মাথার শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলে দেন এবং চিৎকার করে বলতে থাকেন, হায় আমার ইসলাম! হায় আমার ইসলাম! এরপর সরাসরি মোঙ্গল বাহিনীকে আক্রমণ করতে তিনি নিজেই চলে যান, তা দেখে মুসলিম বাহিনী উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং তারাও পূর্ণোদ্দমে আক্রমণ শুরু করে।
এই যুদ্ধ জয়ের পিছনে যে সেনাপতির সবচেয়ে বড় ভূমিকা তিনি হলেন রুকনুদ্দিন বাইবার্স। তিনি মোঙ্গলদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন; যেই কৌশলটি মোঙ্গলরা ব্যবহার করে শত্রুদের হারাত।
তিনি সৈন্যদেরকে এমনভাবে পিছু হটতে বলেন যেন মনে হয় তারা মোঙ্গলদের থেকে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মোঙ্গলরা যখন দেখল মুসলিমরা এভাবে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন তারাও খুশি হয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করলো।
হঠাৎ করে মুসলিম বাহিনী ঘুরে যায় এবং এবং মোঙ্গলদের উপর হাজার হাজার তীর ছুড়তে থাকে। মোঙ্গলদের সেনাপতি কিতবুঘা নিহত হয়। তাদের পতাকা ভূলুণ্ঠিত হলে মোঙ্গলরা পালাতে শুরু করে।
রুকনুদ্দিন বাইবার্স তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে তাদেরকে কচুকাটা করতে থাকেন। পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে দেখে যে মোঙ্গলদেরও পরাজিত করা সম্ভব। অবশ্য মামলুকদের পূর্বে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সুলতান শাহ মুহাম্মাদের ছেলে জালালুদ্দিন মোঙ্গলদের পরাজিত করেছিলেন।
এই জালালুদ্দিন সিন্ধুনদের তীরে বীরত্বের মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁর বীরত্ব দেখে সবিস্ময়ে মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান বলেছিলেনÑ বাপের তো চাই এমনই বেটা।
কিন্তু আফসোস, তাঁর সাথে তৎকালীন মুসলিম শাসকরা একতাবদ্ধ হননি। ফলে তিনি একাই মোঙ্গলদের সঙ্গে লড়াইয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। দেখেছ, একতাবদ্ধ না হলে কত বড়ো ক্ষতি হয়?
আমেরিকা তখনও আবিষ্কার হয়নি।
সেদিন যদি আইন জালুতের প্রান্তরে মুসলিমরা হেরে যেত তাহলে শুধু মুসলিম সাম্রাজ্যই ধ্বংস হতো না, মিসর জয় করতে পারলে মোঙ্গলরা পুরো ইউরোপ এবং আফ্রিকা ও দখল করে ফেলতো। তারা প্রায় সমগ্র পৃথিবী শাসন করতো। মোঙ্গল ছাড়া অন্য সব জাতির অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ত।
তাই ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মুসলিমদের এই জয়।
এটি মুসলিমদের একটি অনেক বড়ো বিজয়, সন্দেহ নেই। তোমরা জেনে অবাক হবে যে, এত বড় বিজয়ের মহানায়ক সুলতান সাইফুদ্দিন ও রুকনুদ্দিন বাইবার্স ছিলেন একে অপরের পরম শত্রু। কিন্তু ইসলামের সেই দুর্দিনে তারা নিজেদের শত্রুতা ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধ হয়েছিলেন। একটু চিন্তা করো, একতার ফলে যদি অমন অসম্ভব কাজ করা যায়, তাহলে একতাবদ্ধ হলে তোমাদের সমস্যা কোথায়?’
এতক্ষণে তারা দু’জন বুঝে গেল, দাদু কী বুঝাতে চেয়েছিলেন। চুপ করে রইল দু’জনে। দাদু বুঝে ফেললেন, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তিনি মজা করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘কি দাদুরা, আর ঝগড়া করবে?’
মাসুম বলে উঠল, ‘দুই সুলতানরা যদি একতাবদ্ধ না হতো, তবে না জানি ইসলাম ও পৃথিবীর কী হতো! আমরাও যদি একসঙ্গে না চলি, না জানি আমাদের কী হবে?’ তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। দাদু হেসে উঠলেন এবং বললেন, ‘উক্ত বিজয়ের পেছনে আল্লাহর সাহায্যও কম নয়।’
‘ইশ! এই ঘটনা যদি আমরা আগেই জানতাম, তবে আর ঝগড়া করতাম না। কলমটিও হারাতে হতো না’Ñ আক্ষেপ করে বলল মাসুদ।
দাদু বললেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম। আমাদের গৌরবগাথা ইতিহাসকে জানতে চেষ্টা করো!
যাই হোক অবশেষে তোমরা বুঝলে যে, একতাই বল।’

Share.

মন্তব্য করুন