কাঁঠালচাঁপা ফুলটির নাম বোধ করি সবার জানা। বাংলাদেশের গ্রামে বনে বাদাড়ে এ ফুলের দেখা মেলে বেশ। বড়সড় গাছ। ফুলটি প্রায় সোনালি। ঘ্রাণ কি যে মন সয়লাব করা। যারা একবার শুঁকেছে ভুলবে না নিশ্চয় কোনোদিন। ভোলারও নয়। কি করে ভুলবে! এ যে মনের গহিনে প্রবেশ করে। তারপর দাগ কাটে মনের পর্দায়। সুতরাং এ ফুলের সৌরভ ভোলার মতো নয়। আল মাহমুদের গল্পটিও কাঁঠালচাঁপা নিয়ে।
বছর কয়েক আগের কথা। গ্রামের বাড়িতে। গ্রাম মানেই তো সবুজের আনন্দ। সবুজ বিস্তৃতি। সবুজের আনন্দ নিতে নিতে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর। যেতে যেতে কত পাখি। কত ফুল। কত গাছালির ছায়া। লতা পাতার দোলানি। বুনো ফুলের গন্ধ। এই নিয়ে চলছি। চলতে চলতে নেমে এলো সন্ধ্যা। এর মধ্যে আকাশ কালো করে তুললো মেঘ। এক সময় শুরু হলো ঝড়ের বাতাস। একটু পরই বৃষ্টি।

হঠাৎ বৃষ্টিতে আশ্রয় নেবার সুযোগ তো গ্রামে নেই। হয় কোনো গাছের নিচে। নয় তো কারো ঘরের ভেতর। কিন্তু আকস্মিক কারো ঘরে যাওয়া উচিত হবে কি? ফলে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট বেশ জোরেশোরে। ফলে গাছের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি। কি করা এখন? এভাবে ভিজলে তো চলবে না এ সন্ধ্যাবেলায়। একটি উপায় তো বের করতেই হবে। এবং খুব দ্রুত। বৃষ্টির বর্ষণ বেড়েই চলছে। একটু দূরে দাঁড়ানো একটি বাড়ির দিকেই নজর পড়লো। উপায় না দেখে সেদিকেই দৌড়। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে ছুটলাম। পৌঁছে গেলাম একটি টিনের চারচালা ঘরের ডেরায়। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘরের পেছনের অংশে। ভয়ও করছে- যদি কেউ চোর ভেবে বসে তো বিপদ। নিজেকে সাধু প্রমাণ করার কোনো হাতিয়ার নেই। আবার চলে যাবো এমন সুযোগও মিলছে না। একে তো সন্ধ্যা। আবার সঙ্গে মানিব্যাগ, মোবাইল, ঘড়ি। এসব ভিজলে কোনোটাই ঠিক পাওয়া যাবে না। ফলে রিস্ক নিয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম চুপটি করে।

একটু পরই ভেতরে কক্ষটিতে লাইট জ্বলছে। জ্বলছে অবশ্য হারিকেনের আলো। বিদ্যুৎ চলে গেছে ঝড়ের ঝাপটায়। হারিকেনের টিমটিমে আলোর রেখা বাঁশের বেড়ার ফুটো গলে বেরিয়ে এলো। চিকন চিকন মৃদু আলোর রেখা আমার গায়ে এসে পড়ছে। বেশ লাগছিল আমার। একদিকে টিনের চালার ঝুমঝুম বৃষ্টি। অন্যদিকে হারিকেনের টিমটিমে আলো। এ সময় আমার নাকে এসে ঢুকলো কাঁঠালচাঁপা ফুলের মায়াবী ঘ্রাণ! মনে হচ্ছিলো আমার ভেতরটি তাজা হয়ে উঠলো। খুঁজছিলাম কোথায় কাঁঠালচাঁপা গাছটি। বৃষ্টির অঝোর বর্ষণের সাথে অন্ধকার মিলে যে পর্দা তৈরি হলো তাতে কোনো চাঁপা গাছ খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ নয়। কিন্তু চোখ গাছ না দেখলে কি হলো- ঘ্রাণ তো পাচ্ছি বেশ। মন ভরে উঠছিলো। আর অন্যরকম আনন্দ অনুভব করছিলাম।
ঠিক এসময় কক্ষটি থেকে একটি মেয়ে শিশুর কণ্ঠ ভেসে এলো-
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
শুনে আমি খানিকটা বিস্মিত! অবাক। একদিকে আমি কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ নিচ্ছি। অন্যদিকে কাঁঠালচাঁপার কবিতা শুনছি।
মেয়েটি বেশ আনন্দ নিয়ে পড়ছে। পড়ছে মানে মুখস্থ করছে। বলছে বারবার- পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
একটু দূর থেকে সম্ভবত অন্য কোনো রুম থেকে মেয়েটির মা বলছেন- কবির নাম বলো।
সাথে সাথে মেয়েটি বললো- কবি আল মাহমুদ।
কি অদ্ভুত মনে হচ্ছিলো। কবিতাটি শিশুদের কোনো একটি ক্লাসে পাঠ্য বইয়ে আছে। সে সূত্রেই পড়ছে মেয়েটি।
আল মাহমুদের নাম বলছে। সেই সাথে পড়ছে কবিতাটি।
আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো পুরো কবিতাটি পড়ুক মেয়েটি। কিন্তু না প্রথম চার লাইন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ছিলো সে। বারবার পঠিত লাইনগুলোই শুনছি আমি। কয়বার পড়ার কারণে চারটি লাইন মুখস্থ হয়ে গেলো মেয়েটির। চিৎকার করে বললো- মা চার লাইন মুখস্থ হয়েছে আমার।
জবাবে মা বললেন- পরের চার লাইন পড়ো। মেয়েটি আবার পড়ছে-
আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
বেশ কবার পড়লো আবৃত্তির ঢঙে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে মুখস্থ হচ্ছে না মেয়েটির।
মাকে আবার ডেকে বললো- মা এবার পুরো কবিতাটি পড়ি?
মা খানিকটা শাসনের সুরে বললেন- না।
চার লাইন চার লাইন করে মুখস্থ করো।
মায়ের শাসনের স্বর মেয়েটিকে আবার পড়তে বাধ্য করে। পড়তে পড়তে একসময় বললো- মা এ চার লাইনও মুখস্থ হয়ে গেছে।
মা বললেন গুড মামণি। এবার পরের চার লাইন মুখস্থ করো।
মেয়েটি দম নিয়ে আবার শুরু করলো-
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়
দুধ ভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায়।
আমার মনে তখন গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ। বৃষ্টি ঝরছে এ শব্দ ভুলে গেলাম। আমি যেনো মেঘহীন আকাশে পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ভাসতে থাকলাম।
এভাবে বার কয়েক পড়ে মেয়েটি উঠে গেলো পড়ার টেবিল থেকে।
মা বললেন- কি হলো উঠে গেলে কেনো? বললো মেয়েটি- এ চার লাইনও মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। কিন্তু আজ আর পড়বো না।
মেয়েটির মাও আর জোর করলো না। ফলে মেয়েটির মুখে কবিতার বাকি অংশ শোনা হলো না।
এর মধ্যে বৃষ্টিও থেমে গেলো। ধীরে নেমে পড়লাম। পা বাড়ালাম বৃষ্টির পানিতে। মনে তখনো কবিতার ধ্বনি ঝংকার তুলছিলো। থেকে থেকে বলছিলো-
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
ভাবলাম আল মাহমুদ সত্যিই একজন ভাগ্যবান কবি। যার কবিতা থেকে ছড়িয়ে পড়ে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ!

Share.

মন্তব্য করুন