তিতকুটে কফি খেতে খেতে রবিন ভাবতে লাগলো অদ্ভুত দর্শন নিরীহ প্রাণীটিকে নিয়ে। প্রাণীটার কি আদৌ কোনো পরিচয় আছে? নাই সম্ভবত। অ্যাকোরিয়ামে এক ধরনের ভয়ালদর্শন কিন্তু নিরীহ প্রাণী রাখা হয়। প্রাণীটি শুধু অ্যাকোরিয়ামের গায়ের ময়লা খেয়েই বেঁচে থাকে। অদ্ভুতদর্শন সামুদ্রিক এই প্রাণীটাও কি এমন? রবিন অবশ্য সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী না। কোন প্রাণীর কি হলো এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আজ ঘামাচ্ছে, কারণ যে প্রাণীটির কথা বলা হচ্ছে ওটা কেমন যেন। প্রাণীটাকে হাতে ধরার পরও দৌড় দেয় না। পদার্থের মতো নিঃসাড়। কিন্তু প্রাণীটার চোখগুলো এদিক সেদিক ঘোরে সিসিটিভি ক্যামেরার মতো।

রবিনের সহকারী সোহেল। সোহেল প্রাণীটির বর্ণনা শুনে অবাক হলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলো।
– একটুও নড়াচড়া করেনি?
– নড়েছে। তবে পালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো চেষ্টা দেখিনি।
– কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছিল প্রাণীটার?
– হুঁ, আমি যেমন তার প্রতি কৌতূহল দেখাচ্ছিলাম, সেও দেখাচ্ছিলো।
– দৈহিক গড়ন কি শক্তপোক্ত?
– না। তুলোর মতো।
– ওকে, তাহলে আরেকবার আমরা যাই, কি বলেন?
– হুঁ, যাই
গভীর সমুদ্র শান্ত। এখানে বায়ুচাপ সর্বোচ্চ। যে প্রাণীগুলো এখানে টিকে আছে তারা প্রখর চাপ সহ্য করে টিকে আছে। এ জন্য প্রাণীগুলোর গা হালকা চ্যাপ্টা ধরনের, আস্তে আস্তে দুলছে সমুদ্রের তলদেশের বেগুনি প্রবাল। যেখানে আলো প্রবেশ করে না সেখানে এই প্রবালগুলো বেগুনি হলো কেন? রবিন সমুদ্রতল নিয়ে গবেষণা করে।
সমুদ্রতলে সে এক নিরীহ দর্শন অচেনা প্রাণী পেলো। ছোট এক হাত সমান। পদার্থের মতো, চৌকোনা। হাতে তুলে নিয়ে দেখল চৌখুপির মতো তিন জোড়া চোখ। মাকড়সারও কি এতো চোখ থাকে? এতো চোখ দিয়ে সমুদ্রতলে এ প্রাণীটা কি করে? কি দেখে?
রবিন প্রাণীটিকে হাতে ধরার কিছুক্ষণ পর থেকে কেমন বমি বমি লাগছে, দ্রুত উপরে উঠতে হবে তাকে। কয়েকটা ছবি তোলা গেলে ভালো হতো। কিন্তু শরীর তো সায় দিচ্ছে না। অবশ্য হ্যাঁচের গায়ে অটোমেটেড একটা ক্যামেরা তো আছেই। উপরে উঠতে শুরু করলো রবিন। উপরে উঠতেও কম কষ্ট না, হ্যাঁচটা মাঝে মাঝে কিছুর সাথে লেগে গুঙিয়ে উঠে। একবার তো রবিনকে হাঙরের পাল্লায় পড়তে হয়েছিল। হাতের কোথায় একটু কেটেছিলো। অতো গা করে নি। মিনিট দশেকের মধ্যে হ্যাঁচের চারপাশে দুটো হাঙর চক্কর দিতে থাকলো। রবিনকে সবাই মিস্টার কুল ডাকে। হ্যাঁচ ধরে টানাটানি করছে হাঙর, রবিন ঠাণ্ডা মাথায় হ্যাঁচ উপরে তুললো। ঠিক সাবমেরিনে উঠার এক মিনিট আগে হ্যাঁচের দরজা খুলে ফেললো একটা হাঙর। কিন্তু দরজা খুলে যাওয়ার ব্যাপারটা হাঙর আসলে বুঝেনি। বুঝলে মিস্টার কুল এদ্দিনে হাঙরের পেটে।

অচেনাকে মানুষের ভয়। হাঙরকে যতোটা ভয় করেনি অচেনা ছোট্ট প্রাণীটা তারচেয়ে বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছে। দ্রুত উঠতে উঠতে তার শরীর চনমনে হলো। পানির নিচে চাপ নিতে কষ্টই হচ্ছিলো রবিনের। সে না বুঝলেও তার শরীর নিজে নিজে বুঝে নিয়ে একটা অসুখ বানিয়ে ছেড়েছে সম্ভবত। শরীরের মতো বিশাল যন্ত্রের কত রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি ইঞ্চি ইঞ্চি বুঝতে হয়, মানুষ তা বুঝতে পারে না।
রবিন সাবমেরিনের ভেতরে প্রবেশ করলো। এটি খুব ছোট সাবমেরিন, গবেষণার জন্য তৈরি। এখানে রবিন মাসের পর মাস কাটাতে পারে। সমুদ্রতল তাকে ভয়ানক আকর্ষণ করে। কি বিশাল এক অ্যাকোরিয়াম যেনো ওটা। কতো বিচিত্র সব প্রাণী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মুসা আহমেদ ছবিটি দেখে তৎক্ষণাৎ রবিনকে মেইল করলেন। রাশভারী এই মানুষটা রবিনের সব ছেলেমানুষি কর্মকাণ্ডের সমর্থক। তিনি মেইলে লিখলেন,
– রবিন তুমি যে ছবিটা পাঠিয়েছো তাতে আমি স্রেফ কালো একটা বস্তু ছাড়া কিছুই বুঝিনি। তুমি কি আরো ডিটেইল পাঠাতে পারবে?

২.
পূর্ণেন্দু রবিনের বন্ধু, পূর্ণেন্দু মানে পুরো চাঁদ। বন্ধুরা তাকে পূর্ণ ডাকে। এক সময়ের বিখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর নামে নাম রেখেছিলো তার বাবা। না, কাব্যপ্রতিভা সে পায় নি। পেয়েছে এক অদ্ভুত নেশা। সামুদ্রিক প্রাণীর নেশা। তার কাজ হচ্ছে নানান ধরনের অ্যান্টিক মাছের সংগ্রহ। সে এক মাছের জাদুঘর করে বসে আছে। সেখানে তাবৎ মাছের মধ্যে একেক মাছের একেক আচরণ দেখে সে মজা পায়। শুধু মাছ বললে ভুল হবে, সামুদ্রিক জীবের আড়ত বলা চলে তার অ্যাকোরিয়ামকে। বিশাল অ্যাকোরিয়ামের যে প্রাণীগুলো এ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না তাদের রাসায়নিক তরলে ডুবিয়ে রাখা হয়। পূর্ণেন্দুরও সমুদ্রনেশা। বাবার সমুদ্রনেশা থেকেই এই নেশা পেয়েছে। দুই বন্ধু অবশ্য দু’দিকে কাজ করে। রবিন কোনো জলজ সম্পদ নষ্ট করতে রাজি নয়। অন্য দিকে পূর্ণেন্দু চায় এসব চোখের সামনে এনে উপভোগ করতে। দু’বন্ধুর এমন বৈপরীত্যের মাঝেও একটা আপসরফা আছে। অচেনা প্রাণী দেখলে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে জানায়, জানতে চায়। রবিন মেইল করলো পূর্ণেন্দুকেও। এই প্রাণী আগে কোথাও দেখেছে কি না জানতে চাইলো।

সমুদ্র তলদেশ মানেই রহস্যের আঁধার। এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে থোক থোক রহস্য। রবিন এসব রহস্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, ভাবে। কিন্তু অদ্ভুত এ প্রাণীটাকে নিয়ে দিনরাত ভেবেও কিছু বের করতে পারছে না। প্রাণীটা কিছুই খায় না। এক জায়গায় স্থির থাকে। তার মানে কি প্রাণীটি সালোকসংশ্লেষণের মতো কোনো একটি পদ্ধতি তৈরি করে ফেলছে?
রবিন আর সোহেল আজ একসাথে সমুদ্রের নিচে নামার জন্য প্রস্তুত হলো। হ্যাঁচ খুলে একটা টানেলের মতো জায়গা আছে। ওটা পার হয়ে দু’জনের চোখ এখন সমুদ্রে। সমুদ্রের নিচে পানির প্রবল চাপে কান বন্ধ হয়ে যায়, কান যাতে বন্ধ না হয় তার কৌশল আছে। কান যাতে বন্ধ না হয় সোহেল সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই জায়গাটা খুব গভীর। কৌশল কাজে লাগছে না।
সমুদ্রতলের একদম প্রান্তে কিছু অদ্ভুত জীবাশ্ম বহু বছর ধরে তাদের বংশ বিস্তার করছে। জীবাশ্মের বংশ বিস্তার মানে হচ্ছে জীবাশ্মগুলো যে জায়গায় আছে তার পাশে আরো অনেকগুলো জীবাশ্ম জড়ো হয়েছে। রবিন ভাবছিলো, এখানেই কেন জীবাশ্মগুলোর জড়ো হতে হবে?
প্রথমত, হতে পারে ঢেউয়ের দোলায় এক জায়গায় এসে জমা হয় সব মাথামুণ্ডু। না, সমুদ্রতলে এতো পানির ঢেউও নাই। তাহলে? তাহলে বাকি থাকে আরেকটা সম্ভাবনা। এখানেই সবচেয়ে বেশি প্রাণী মারা যায়। কেন মারা যায়? সামুদ্রিক কোনো হিংস্র প্রাণী এই এরিয়ায় থাকলে তো মেরেই ক্ষান্ত হতো না বরং খেয়ে হাপিশ করে দিতো।
কিন্তু প্রাণীগুলোর শরীর তো হাওয়া হয়ে যায় না, তাহলে কি হয়? দীব্যেন্দু একটা সূত্র খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। এখানেই কেন এতো প্রাণী মারা যায়?
কোন প্রাণী এখানে মরে পড়ে নাই? ভয়ালদর্শন স্কুইড থেকে হাঙর অক্টোপাস পর্যন্ত মরে পড়ে আছে। রবিন তিনটা কাঁকড়া হাতে তুলে নিলো। কেমন নীল হয়ে আছে ওগুলো। কেন নীল হয়ে আছে? সমুদ্রের এতো নিচে বলেই কি নীল হয়ে আছে? নাকি বিষাক্রান্ত তারা, একটা কাঁকড়ার নমুনা তুলে আনলো রবিন। ঘোড়ার খুরের মতো এ কাঁকড়া খুবই দুর্লভ। পরীক্ষা করতে হবে।

৩.
রবিন সাবমেরিনে ফিরে এলো। এ পর্যন্ত চাঁদে মানুষ গিয়েছে অনেক মানুষ কিন্তু পৃথিবীর গভীরতম জায়গা মারিয়ানা ট্রেঞ্চে গিয়েছে মাত্র ৪ জন। এর মধ্যে ৩ জন বিখ্যাত। আরেকজন রবিন। রবিন সবসময় সমুদ্রে রহস্য খোঁজে। সে বলে, ৭০ ভাগ জলের মধ্যে আমরা ত্রিশ ভাগ তো সংখ্যালঘু। এই ৭০ ভাগ জল জয় করতে হবে। ছোট থেকেই তার ইচ্ছা ছিল জলের গভীর দেখে আসা। জলের তলের নানান রকম দৈত্যদানবের গল্পে সে পাত্তা দিতো না। সে জানে সমুদ্রতলে আছে অপার রহস্য।
অন্যদিকে তার বন্ধু পূর্ণেন্দুর অ্যান্টিক সামুদ্রিক জীব জমানোর অভিপ্রায় পাগলাটে রূপ নিচ্ছিলো ছোট থেকেই। সমুদ্রের হেন কোনো জীব নেই যে তার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে। এমনকি খুদে অক্টোপাসও রেখেছে নিজের অ্যাকোরিয়ামে। ভয়াল স্কুইডের চোয়াল, হাঙরের দাঁত কি নেই পূর্ণেন্দুর অ্যাকোরিয়ামে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলেছে সে শুধুমাত্র একটা অ্যাকোরিয়ামের পেছনে। অবশ্য লাভের খাতায় শূন্য রাখার মানুষ নয় সে। নানা পর্যটক এসে ঢুঁ মেরে যায় তার অ্যাকোরিয়ামে। তাতে লাভটা হচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে অ্যাকোরিয়ামের নাম। আর বিখ্যাত হয়ে উঠছে পূর্ণেন্দু।
সমুদ্র গভীর, শান্ত অথচ ভয়ঙ্কর কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। একটা প্রাণী ধীরে ধীরে তার সমস্ত শক্তি এক করছে। প্রচুর সামুদ্রিক জীবাশ্ম তার উদরে জমা, যেন বা এগুলো কাঁচামাল। এবার উগরে দেওয়ার পালা। তবে সে শুধু উগরে দিবে না, বরং জন্ম দেবে। গভীর সমুদ্রে জন্ম নেয়ায় সে প্রাণীগুলো হবে অদ্ভুত। কিন্তু এ প্রাণীগুলোর শরীরে থাকবে ডাঙার টান। উভচর প্রাণীতে পরিণত হবে অদ্ভুতদর্শন প্রাণীগুলো। এক নতুন প্রজাতির ভয়াল কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে যেন সমুদ্র।
বরাবরই সংখ্যালঘুরা চায় বেঁচে থাকতে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা চায় বিরুদ্ধ শ্রেণিমুক্ত এলাকা। পৃথিবীর ৯৪ ভাগ প্রাণী জলে বসবাস করায় যে ৬ ভাগ প্রাণী স্থলে বসবাস করে তারা সংখ্যালঘু। এ সংখ্যালঘুদের নিকেশ করার জন্য উভচর এক প্রাণী সৃষ্টি হচ্ছে। গভীর সমুদ্র, যেখানে প্রয়োজনই সৃষ্টি করে নানান নতুন প্রাণীর। এ যেন এক বিশাল গবেষণাগার।
রবিন সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধানের কাছে মৃত জলজ প্রাণীদের কিছু নমুনা পাঠাল। নমুনা মানে ছবি। মেইল করা ছবিগুলো ছিল বেশ কিছু স্কুইড জায়ান্ট শার্ক আর কাঁকড়ার। তিনি ছবিগুলো দেখলেন। সমুদ্রের এ ধরনের আচরণ একদমই অনভিপ্রেত।

ছবিগুলো খুবই নরমাল। মৃত্যু তো হতেই পারে। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যু হওয়া জলজ প্রাণীদের গায়ে ফুসকুড়ির মতো নীল নীল কিছু একটা আছে। তার মানে কোনো এক অজানা রোগে ভুগছিলো এই প্রাণীগুলো। রবিনের কাছে মেইল করলেন তিনি। মেইলে লিখলেন
‘যে অবস্থানে তুমি আছো ওখান থেকে দ্রুত সরে যাও, অজানা কোনো এক ভাইরাস ঐ এলাকায় বিস্তার লাভ করছে। নীল নীল ফুসকুড়ি চিহ্নিত জায়গায় বোঝা যায় অচেনা এ ভাইরাস সর্বগ্রাসী।’ মেইলটি যখন রবিন পেল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রবিনের সহকারী সোহেলের শরীরে দেখা দিয়েছে নীল নীল ফুসকুড়ি।
সোহেল ঘুমাচ্ছিল, গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখছিলো সম্ভবত। চরম পর্যায়ের ঘুমে চোখের পাতা কাঁপে। তার চোখের পাতা কাঁপছে। এ সময় ধুম করে তার চোখ খুলে গেল। কোথাও অস্বাভাবিকতা টের পেয়েছে তার মস্তিষ্ক। সে কান পেতে শুয়ে রইলো। কোনো শব্দ পেলো না। নড়াচড়ার কোনো আভাস পেলো না। কিন্তু খেয়াল করলো একটি আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঝিঁঝিপোকা একটানা ডাকলে মাথা যেমন ঝিম ধরে যায় অমন লাগছে। সোহেল শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। বিছানা থেকে নামতেই মেঝে থেকে কেমন আঠালো আঠালো কিছু পদার্থ তার পায়ে ঠেকল।
গভীর সমুদ্রে এমন আঠালো ভাব মোটেই হওয়ার কথা না। তারপর খেয়াল করলো কিছু একটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার মতো একটা দাগ। সোহেলের হঠাৎ মনে পড়লো দুটো গিনিপিগ রাখা ছিলো সাবমেরিনে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এগুলোকে কোনো প্রাণী মেরে ফেলেছে? তার মাথায় খেলে গেলো দুটো ক্লু। সে এবং রবিন ছাড়া তৃতীয় কোনো প্রাণীর আগমন ঘটেছে সাবমেরিনে। প্রাণীটা মাংসাশী। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মাংসাশী মানেই পরের টার্গেট তারা। সোহেল দ্রুত বিপদসঙ্কেত পাঠালো রবিনকে। রবিন তখন গভীর সমুদ্রে।
জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে অচেনা এক ধরনের প্রাণীর চিহ্ন পেলো। ব্যাঙ্গাচির মতো এক ধরনের ছোট ছোট প্রাণী ধরা হয়েছে। গবেষণাগার থেকে ভয়ানক এক তথ্য পেলো রবিন। এর মধ্যেই কোটি কোটি প্রাণীর রেণু এখন সমুদ্রে। প্রফেসরের অনুমান তাহলে সঠিক হয়ে যাচ্ছে। রবিন সাবমেরিন থেকে পাওয়া নতুন একটি ছবি বিশ্লেষণ করলো, তাতে দেখা গেলো সাবমেরিনের সামনের অংশ থিকথিকে জেলিতে ভরে গেছে। তার খেয়াল হলো এই জেলিগুলো খুব অল্প পরিমাণে ছিল।
এখন এতো বাড়লো কিভাবে? তাহলে কি এই জেলি নিজেই নিজেকে বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। রবিন খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো। পাখিগুলো জেলির মতো যে পদার্থ খাচ্ছে তা থেকে যে বিশাল সংক্রমণ হবে না তার নিশ্চয়তা কী?

৪.
চট্টগ্রাম মেডিক্যালে হঠাৎ করে অদ্ভুত ধরনের রোগী বেড়ে গেল। বলা হচ্ছে এসব রোগীর বেশির ভাগ পাহাড় ও সমুদ্র পাড়ের জেলে পল্লীর পরিবার থেকে জন্মানো হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ও পাখি খাওয়ার পর পর এমন ঘটছে। পাখিদের দ্বারা ছোটখাটো নানান রকমের রোগ ছড়িয়েছে দেশে দেশে, তবে এ রোগ একটু ভিন্ন ধরনের। চোখের পাতা সাদা হয়ে যাচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির। পিজি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যে রোগীগুলো ভর্তি হয়েছে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ঠিক কখন থেকে তারা অসুস্থ।
অসুস্থ ব্যক্তির সাথে থাকা আবদুল জলিল নামের একজন জানান, বাজার থেকে কিনে আনা অতিথি পাখি খাওয়ার পর পরই তার সারা শরীর কেমন করছিল। চোখ পিটপিট করতে করতে সাদা হয়ে গেছে। অসুস্থ আত্মীয়কে নিয়ে মেডিক্যালে চারদিন যাবৎ অপেক্ষা করছেন আবদুল জলিল। এখনো রোগের নাম পর্যন্ত জানতে পারেননি, যে কারণে চিকিৎসা হচ্ছে না।
রোগীর পাশে গিয়ে দেখা যায় তার সারা শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছে। রোগে ভুগছেন অথচ রোগের নামটি পর্যন্ত জানতে পারছেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেলো তার রোগীর অসুস্থতার ধরন ও বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়েছে গবেষণাগারে।

তবে সরকারি হাসপাতালের যে ঘিঞ্জি অবস্থা, তার থেকে একটু আলাদা পিজি। তবুও দেখা গেল এমন অচেনা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথেই অন্য রোগীদের রাখা হচ্ছে। এ থেকে যে মারাত্মক রোগ ছড়াতে পারে তা যে তারা যেন জানেই না।
পূর্ণেন্দুর অ্যাকোরিয়ামে এখন শোভা পাচ্ছে অদ্ভুত এক প্রাণী, প্রাণীটার কানকো থেকে এক ধরনের পানির ফোয়ারা বের হয় বারবার। এতে বেশ মজার দৃশ্য তৈরি হয়। পূর্ণেন্দু খুব মজা পাচ্ছে এতে। দর্শনার্থীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না, রাখতে হচ্ছে কেয়ারটেকার। তাতে কিছু গাঁটের টাকা গচ্চা গেলেও সে খুশি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা না হলেও একটা ভালো অঙ্ক ঢুকছে তার পকেটে, এখানেই তো মজা!
হঠাৎ করে অদ্ভুত এক ব্যাপার দেখা দিলো, দর্শনার্থী হিসেবে যারাই আসছে তাদের শরীরে এক ধরনের কালো কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। এই দাগ সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। শরীরে ছড়িয়ে পড়ার ফলে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ছেন ভুক্তভোগীরা। তবে আক্রান্ত স্থানে কোনো ব্যথা নেই। ধীরে ধীরে বাড়ছে অসুস্থ রোগীর সংখ্যা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানার পর পরই পূর্ণেন্দু গা ঢাকা দিয়েছে।
রবিন খেয়াল করলো যে প্রাণীটা জন্ম নেয়ার কথা ছিলো তার মতোই এই প্রাণী। তার মানে ওই প্রাণীটার সাথে এই প্রাণীর একটি মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এই মিলের ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে চাইলো রবিন। সেখান থেকে যে রিপোর্ট এলো তা একদম মিলে যাচ্ছে সোহেলের গায়ে যে ফুসকুড়ি দেখা দিয়েছিল তার সাথে।
রবিনের মনে পড়ে গেল সোহেলের মর্মান্তিক মৃত্যুটা। তখন অবশ্য সমুদ্ররক্ষী বাহিনী সমুদ্রের ঐ এলাকায় থাকা সমস্ত জেলিসদৃশ লার্ভা নষ্ট করে দিয়েছিল। তারপরও কোনোভাবে কিছু প্রাণী জন্ম নিয়েছে, যে প্রাণীগুলো এখনই শনাক্ত না করলে পৃথিবী ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। রবিন নতুন গবেষণায় হাত দিলো। এই রোগের উৎস কোন প্রাণীটা। প্রাণীটা এখন কোথায়।
নিজের মিনি সাবমেরিন থেকে তুলে আনলো নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত। প্রাণীটার যে সমস্ত চিহ্ন ছিল আর ল্যাবে পাঠানো সমস্ত লার্ভা সব নিয়ে আবার নতুন করে গবেষণায় নামলো রবিন।

৫.
সংবাদমাধ্যমগুলোতে নতুন খবর এলো। পূর্ণেন্দুর সংগ্রহশালায় পাওয়া প্রাণীটি যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় মরে গেছে। মরে যাওয়ায় এ নিয়ে গবেষণার সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে সমুদ্রের গা ঘেঁষে কিছু জেলে পল্লী আক্রান্ত হয়েছে অদ্ভুত এক অসুখে। জানা গেছে তাদের গায়েও তিলের মতো ফুসকুড়ি দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ঐ এলাকায়ও এই প্রাণীটি আছে। সুতরাং ঐ এলাকার সমুদ্ররক্ষীরা সমুদ্রের একটা নির্দিষ্ট অংশে খোঁজ চালাচ্ছে যেন সমুদ্র এই মারাত্মক এই প্রাণী থেকে রক্ষা পায়।
আরেকটি সংবাদমাধ্যমের তৃতীয় পৃষ্ঠায় অগুরুত্বপূর্ণভাবে একটি এক কলামের রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, কে জানতো এই রিপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট হয়ে উঠবে দিন দুয়েকের মাঝে।
রিপোর্টটি হচ্ছে চট্টগ্রামের খৈয়াছড়া ঝর্ণা এলাকায় হঠাৎ করে বিভিন্ন বন্য জীব মারা যাচ্ছে। জানা গেছে দু’টি বন্য হরিণ ও ৩টি বন্য কুকুরকে মরে থাকতে দেখা গেছে খালের পাড় ঘেঁষে। কিন্তু তাদের গায়ে কোনো প্রাণীর আঁচড়, আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বন অধিদপ্তর প্রাণীগুলোকে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করেছে।
ঘটনা ঘটে এর একদিন পরই। যে গোরখোদক হরিণগুলোকে গর্তে পুঁতেছে তার সারা শরীরের এক ধরনের ছোট ছোট দাগ দেখা যাচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পরই তাকে ঢাকা মেডিক্যালে স্থানান্তর জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়। দেশের সব কয়টি মিডিয়া এবার প্রাণীটির খোঁজে এই পাহাড়ের দিকে চোখ ফেরালো। দেখা গেল অবাক কাণ্ড। পুরো পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো বেশ কিছু প্রাণীর মৃতদেহ। তার মানে যারাই এই প্রাণীর সংস্পর্শে আসবে তারাই এভাবে মৃত্যুবরণ করবে।

রবিনের হাতে একটা পেপার, এই জার্নালে সে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, পূর্ণেন্দুর সংগ্রহশালায় যে প্রাণীটা পাওয়া গেছে সেটাই আকাক্সিক্ষত প্রাণীদের একটি। বহু বছর আগে থেকে প্রাণীটা সমুদ্রে ছিল, সে সময় জেলির মতো সেসব পদার্থ সমুদ্রে ভেসেছিল এ সময় অনেক পাখির মতো এই প্রাণীটাও ঐ জেলিসদৃশ জিনিসটি খায়, খাওয়ার পর তার শরীরে এক ধরনের জীবাণু সংক্রমণ করে। এই জীবাণু নানাভাবে ছড়িয়েছে দর্শনার্থী মানুষের গায়ে। তারা প্রাণীটা যে পানিতে ছিল, তা ছুঁয়েছিল। আর সমুদ্রের পাড়ে যে সমস্ত জেলে পল্লীতে এমন ব্যাপার ঘটেছে তারাও ঐ ধরনের জেলিসদৃশ বস্তু খাওয়া মাছ খেয়েছিল। পাহাড়ের যে প্রাণীগুলো আক্রান্ত হয়েছে তারা কোনো পাখির মল অথবা সংস্পর্শের কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। যে পাখি অনেক আগেই এই জেলিসদৃশ পদার্থ খেয়েছিল।
রবিনের রিসার্চ সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে পরের দিন সমুদ্রে দেখা গেল ঝাঁকে ঝাঁকে অচেনা এক ধরনের প্রাণী জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। প্রাণীগুলো ঠিক পূর্ণেন্দুর সংগ্রহশালায় থাকা সেই প্রাণীটার মতো। সমুদ্র থেকে জাল গুটিয়ে নিলো জেলেরা, এমনকি সমুদ্রে যেসব জাহাজ ছিল সেগুলোর ডেকগুলোতেও অদ্ভুত এ প্রাণীটা উঠে পড়েছে। ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে এই প্রাণীটা অনেকটা উভচর প্রাণী। রবিন নতুন করে ভাবতে লাগলো বিষয়টা। এ রকম প্রাণীর জন্ম কিভাবে ঠেকানো যায়।
সারাদিন ভাবতে ভাবতে মাথার ভেতর ঘুণপোকার মতো কি একটা যেন কুট কুট করে কামড়াচ্ছে এমন অনুভূতি হলো। তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে শুয়ে পড়লো রবিন। শরীর অসাড় হয়ে পড়ছে। নড়তে পারছে না। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। কেমন একাকিত্ব বোধ হচ্ছে তার। এমন সময় বুকের উপর থপ করে কিছু একটা লাফ দিলো। ব্যাঙ হতে পারে বলে সরিয়ে দিতে হাত দিলো, কিন্তু হাতের নিচের লোমশ জলজ প্রাণীর শরীর পাওয়াতে চমকে উঠলো রবিন। প্রাণীটা শেষ পর্যন্ত এসে পড়লো, চোখ বুজলো রবিন। আহা, চলে যেতে হবে বুঝি?

Share.

মন্তব্য করুন