বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র সবচেয়ে বেশি খেলা হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। এ দেশের অপেশাদার ক্রিকেটারদের মাঝে ক্রিকেট মানেই ২০ ওভারের খেলা। পাড়া, মহল্লার ক্রিকেট থেকে শুরু করে স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোও হয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের। এমন একটি দেশের ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গিয়ে টি-টোয়েন্টিতে ভালো করতে পারছে না।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, শুধু টি-টোয়েন্টি কেন, সব ফরম্যাটের ক্রিকেটেই তো বাংলাদেশ পিছিয়ে। তবুও টেস্ট ৫ দিনের ক্রিকেট, সেখানে ভালো করার জন্য খেলোয়াড়দের টানা ৫ দিন সমান তালে খেলার মতো ফিটনেস, ব্যাটসম্যানদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রিজে টিকে থাকার মতো ধৈর্য, বোলারদের ওভারের পর ওভার বল করে উইকেট নেয়ার সামর্থ্য থাকতে হয়। টেস্টে ভালো করার জন্য ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের (৪ দিনের ম্যাচ) উন্নত কাঠামো দরকার।

এসব কারণে ক্রিকেট বিশে^ অপেক্ষাকৃত নতুন কিংবা দুর্বল শক্তির দলগুলো টেস্টে ভালো না করলে সেটিকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। তবে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেট টি-টোয়েন্টি আসার পর এই দলগুলো ভালো করবে এমনটা ভাবা হতো। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি জগতে পা রেখে তার আভাসও দিয়েছিল। প্রথম ৪ ম্যাচেই তিনটি জয় তুলে নিয়েছিল টাইগাররা। অনেকেই তখন ভাবতে শুরু করেন, এতদিনে বুঝি কম শক্তির দলগুলোর জন্য একটি ক্রিকেট এলো!
কিন্তু শুরুর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। সেটি এতটাই যে, পরবর্তী টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি জিততে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। সব মিলে ৯৯টি ম্যাচের মধ্যে জয় এসেছে ৩২টিতে, হার ৬৫টিতে। দু’টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে।

তবে এই ৩২ জয়ের মধ্যেও বেশির ভাগই অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দলগুলোর বিপক্ষে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৯টি, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩টি। ৬টি জয় এসেছে আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশের বিপক্ষে (কেনিয়া, নেপাল, নেদারল্যান্ডস, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত)। সহযোগী সদস্য দেশ হংকং ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে আছে পরাজয়। টেস্ট পরিবারের নতুন সদস্য আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৬ ম্যাচে ৪টিতে হার, দু’টিতে জয়। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো জয় নেই।
সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরে তিন টি-টোয়েন্টি ম্যাচের একটিতেও লড়াই করতে পারেনি বাংলাদেশ। একটি ম্যাচ বৃষ্টির কারণে কমে হয়েছে ১০ ওভারে। সেই ১০ ওভারের ম্যাচও বাংলাদেশ হেরেছে ৬৫ রানে। এ থেকেই পাওয়া যায় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের করুণ দশার একটি চিত্র।

ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকেটইনফো তাদের এক বিশ্লেষণে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের করুণ দশার পেছনে যে প্রধান দুটি কারণের কথা বলেছে, তাহলো বিশ^মানের ক্রিকেটারের অভাব ও বিগ হিটারের অভাব। এখন পর্যন্ত সাকিব আল হাসান ছাড়া বিশ^ ক্রিকেটে বাংলাদেশের কেউ খুব একটা আলোচনায় আসতে পারেননি। সবচেয়ে জমজমাট ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলে যে কারণে সাকিবই খেলছেন নিয়মিত (২০১১ সাল থেকে)। দু’ বার কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে শিরোপা জিতেছেন সাকিব। মোস্তাফিজুর রহমান আইপিএলে খেললেও শুরুতে যে আলোড়ন তুলেছিলেন সেটি ধরে রাখতে পারেননি। প্রথমবার খেলতে গিয়ে হায়দরাবাদের হয়ে শিরোপা জেতার পাশাপাশি মোস্তাফিজ সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছিলেন (২০১৬ সালে)। বাংলাদেশের অন্য ক্রিকেটারদের জায়গা হয় না এই লিগে। অথচ আফগানিস্তানের অন্তত তিনজন নিয়মিত খেলেন লিগটিতে।
বিগ হিটারের প্রয়োজন টি-টোয়েন্টিতে খুব বেশি। তারা শেষ দিকে এক-দুই ওভারে ম্যাচের চেহারা পাল্টে দিতে পারেন। ১৮ ওভার ব্যাটিং করে কোনো দল যদি ১৪০ রান তোলে, সেখান থেকে শেষ দুই ওভারে একজন বিগ হিটার সেটাকে ১৮০ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। আর এটাই পার্থক্য গড়ে দেয় ম্যাচে। এই দায়িত্বটা পালন করার মতো কোনো ক্রিকেটার আজ পর্যন্ত পায়নি বাংলাদেশ দল।

এছাড়া বোলিংয়েও দুর্বলতা রয়েছে। টি-টোয়েন্টিতে লেগ স্পিনাররা খুবই কার্যকর। রশিদ খান, শাদাব খান, পিযুষ চাওলা কিংবা আদিল রশিদরা কখনো কখনো এক-দুই ওভারেই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারেনি কোনো কার্যকর লেগ স্পিনার। অন্য বোলারদের মাঝে মোস্তাফিজ ছাড়া কারো বোলিংয়ে বৈচিত্র্য নেই।
শুরুর দিকে মনে করা হতো, টি-টোয়েন্টি মানেই ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট। ক্রিজে যাও আর চার-ছক্কা মারো। আসলে যে সেটি সত্যি নয় তা প্রমাণ হয় বিরাট কোহলি, হাশিম আমলা কিংবা বাবর আজমের ব্যাটিং দেখলে। তারা ধীরে সুস্থে খেললেও স্ট্রাইক ধরে রেখে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলেন। এখনকার সফল দলগুলোর খেলা দেখলে বোঝা যায়, ইনিংসের শুরু থেকে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলা আর শেষ দিকে দ্রুত রানের গতি বাড়িয়ে চ্যালেঞ্জিং স্কোর দাঁড় করানোই এই ফরম্যাটের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই দুর্বলতা থেকে বের হওয়ার প্রধান উপায় ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলোয়াড় তৈরি করা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বিপিএলের দলগুলো সব বিদেশিনির্ভর। সেখানে বিদেশিরাই ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেন, দেশি উঠতি ক্রিকেটাররা থাকেন পাশর্^-নায়কের ভূমিকায়। ফ্রাঞ্চাইজিগুলোও শিরোপা জেতার দিকেই সব মনোযোগ রাখে, ক্রিকেটার গড়ে তোলার কোনো আগ্রহ তাদের নেই। যে কারণে বিপিএলও ক্রিকেটার গড়ার কারখানা হয়ে উঠতে পারছে না। এসব কারণে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের এক যুগেরও বেশি সময় হয়ে গেলেও সফলতা আসছে না।

Share.

মন্তব্য করুন