বেলুনটা গেলো ফটাস করে ফেটে। মন খারাপ হওয়ারই কথা। রঙিন বেলুন। অন্য সবার চেয়ে বেশ খানিক আলাদা। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, সাদা, কালো। ডোরাকাটা দাগ। পরিপূর্ণ ফুলে উঠলে চোখ জুড়িয়ে যায়। অন্যের চেয়ে আলাদা বলেই ওটা সাকিবের বেশি পছন্দ। ঈদগাহ মাঠের খেলনা বাজারে গিয়ে কেনা বেলুনঅলা বাঁশি। বেলুন ফুলিয়ে আঙুলের চাপ খুলে দিলেই শুরু হয় বাঁশির পোঁ। ভেতরের বাতাস না ফুরানো পর্যন্ত বাজতেই থাকে। বাজতেই থাকে। এক সময় চুপসে যায় বেলুন। থেমে যায় বাঁশি। তারপর আবার গাল ফুলানো ফুঁ। আবার পেটমোটা বেলুন। আবার বাঁশির পোঁ। সাকিব ছিল খুব আনন্দে। কিন্তু হঠাৎ এটা হলো কী! একেবারে ফটকা ফটাশ। হবে না ফটাশ? শিমুল তাকে বহুবার সাবধান করেছে। বলেছে- ফেটে যাবে কিন্তু! অত ফুলাসনে। সাকিব শোনে কারও কথা! ফাটা বেলুনের দিকে তাকায়। হাতের মুঠোয় ধরা অচল বাঁশিটা দ্যাখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। তারপর সেটা ছুড়ে ফেলে দেয়। রতনের বাঁশি তখনো বাজছে পোঁ পোঁ। রতন হাসছে হি হি করে। কাঁহাতক সহ্য হয় সাকিবের। রেগেমেগে তেড়ে যায় রতনের দিকে। রতন তখন ভোঁ দৌড়। এরই মাঝে সাকিবের পথ আগলে দাঁড়ায় শিমুল। হাতে পিস্তল। হাত উঁচিয়ে তাক করা। এই গুলি ছুড়লো বলে। সাকিব জানে গুলি ফুলি কিচ্ছু নেই, খেলনা পিস্তল। বড়জোর পটকা ফোটা শব্দ হবে। তবু চটজলদি দাঁড়িয়ে পড়ে। বুক চিতিয়ে বলে, গুলি করবি নাকি?

পিস্তলের ট্রিগারে আঙুল লাগানোই ছিল শিমুলের। ফলে মুখে উত্তর দেওয়ার কোনো গরজ অনুভব করে না। আঙুল টেনে ঘোড়াটা ছেড়েই দেয়। গর্জে ওঠে পিস্তল- ঠাস! একটুখানি ধোঁয়াও বোরোয়। সাকিব গোঁয়ারের মতো রুখে ওঠে, সত্যিই গুলি করলি আমাকে?

হ্যাঁ। তুই কেন রতনের পেছনে লাগতে গেলি?
তাই বলে তুই গুলি করবি!
বেশ করেছি। তুই তো আর মারা যাসনি?
ঠিক আছে। রতনের বেলুন-বাঁশি কোথায় রাখে দেখছি।
সাকিবটা ওই রকমই। কোনো কিছু সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। শিমুল, শফিক, রতন, রঞ্জু সবাই সেটা জানে। একই পাড়ার বন্ধু ওরা। ঝগড়াঝাঁটি নয়, কথাকাটাকাটি হয় মাঝে মধ্যে তবু গলায় গলায় ভাব। রঞ্জুর দাদু ওদের দেখলেই পঞ্চপাণ্ডব বলে। কেন বলে, সে কথা ওরা কেউ জানে না। দাদুকে শুধাবে কে! রঞ্জুকে একবার দায়িত্ব দেয়া হয়। অর্জুন, ভীম, নকুল- তিনটি নাম বলার পর আর মনে পড়ে না তার। অথচ দাদুর কাছে শিখে আসে পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটি নাম। ভাই না-ই হোক, ওরা বন্ধু তো বটে পাঁচজন। মনে মনে একরকম মনে করে নেয় পঞ্চপাণ্ডবের নাম। সাকিবের গোঁয়ার্তুমিতে বিরক্ত হয় চারজন। তবু সবাই মানিয়ে নেয়। কিন্তু আজ শিমুলের এমনই রাগ হয় যে আবারো গুলি করে। সাকিব ফোঁস ফোঁস করে ফোলে দু’মিনিট। তারপর বলে, থামলি কেন? আরও গুলি কর!
গুলি আর ছোড়ে না শিমুল। বরং হেসে ফেলে ফিক করে। সাকিব আবারও বলে, কই গুলি কর!
নাহ্! ঈদের দিন আর গোলাগুলি নয়। শিমুল সহসা উদার আহ্বান জানায়- আয় ঈদের কোলাকুলি করি।

সে তো একবার সকালেই করেছি।
এতক্ষণে শফিক একগাল হেসে এগিয়ে আসে। সাকিবের কাঁধে হাত রেখে বলে, ঈদ মানেই তো কোলাকুলি। সারা দিন আনন্দ। আয়, হাত মেলাই।
সাকিব হাত বাড়িয়ে দেয়। এমনকি শফিকের সঙ্গে কোলাকুলিও করে। কিন্তু গজর গজর করে জানিয়ে দেয়- রতনের সঙ্গে কথা নেই। ওই আমার বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ। সবাই অবাক! রতন কখন ফাটালো বেলুন! এতক্ষণে রঞ্জুর বগলের তলা থেকে পাতিহাঁস ডেকে ওঠে- প্যাঁক প্যাঁক। ছোটবোন অঞ্জুর জন্য কিনেছে প্লাস্টিকের পাতিহাঁস। সেই হাঁস যে এখনই এভাবে ডেকে উঠবে, কে জানতো! সাকিব আবার তেতে ওঠে, ভালো হবে না বলছি!
রঞ্জু বলে, তুই অত ক্ষেপছিস কেন?
ত্ইু তাহলে হাঁস বাজালি কেন?
শিমুল এবার পিস্তল পকেটে রাখে। হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলে, তুই কি সেন্টু হয়ে যাচ্ছিস সাকিব?
মানে! সেন্টু কিসের?
সেন্টু মানে সেন্টিমেন্টাল। তোর কি মন খারাপ?
শফিক হা হা করে হাসে। পরিবেশ কিছুটা হালকা হয়। সে হই হই করে ওঠে, ঈদের দিনে মন খারাপ কিসের, এ্যাঁ!
অন্যেরাও আনন্দে হই হই করে। রতন ঘোষণা করে- ‘নো মন খারাপ’।
ইংরেজি মেশানো বাক্য শুনে সবাই একযোগে হেসে ওঠে। সাব্বিরও যেন সহজ হয়ে যায়। সে-ই প্রস্তাব রাখে, চল রঞ্জুদের বাড়ি থেকেই শুরু হোক ঈদের খাওয়া-দাওয়া।
রঞ্জুর আপত্তি নেই মোটেই। ঈদের দাওয়াত সব বাড়িতেই। এখান থেকে রঞ্জুদের বাড়ি সব চেয়ে কাছে। কাজেই ওই বাড়ি থেকে শুরু হওয়াই স্বাভাবিক। সবাই মেনেও নেয় ঐ প্রস্তাব। হঠাৎ রতন এক সমস্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে ভয়ে ভয়ে বলে, রঞ্জুর দাদু যদি পঞ্চপাণ্ডবের নাম জিজ্ঞেস করেন?
মাথা খারাপ! রঞ্জু আপত্তি জানায়, ঈদের দিনে আবার পাণ্ডব-ফাণ্ডব! চল সবাই। শফিক এ সমস্যার নতুন সমাধান দেয়, আরে ধ্যাৎ! দাদুর নামটিও পাণ্ডবের মধ্যে ঠিক চালিয়ে দেবো দেখিস। হ্যাঁ!

এবার সবাই একযোগে হো হো করে হাসে। সেই হাসিতে ঈদের দিনের ঝলমলে রোদ্দুর নেচে ওঠে, উথাল-পাথাল বাতাস নেচে ওঠে। ওরা সবাই নাচতে নাচতে এ বাড়ি যায় ও বাড়ি যায়। যেটুকু পারে সেটুকু খায়। ছোট্ট পেটে আর ধরে কতটুকু! খাওয়ার চেয়ে বাড়ি বাড়ি যাওয়াতেই আনন্দ অধিক। ওরা পাঁচ বন্ধু সারা দিন হই হই করে সেই আনন্দ উপভোগ করে। ঈদের এই আনন্দের সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হয় শিমুলদের বাড়ি এসে। সে কী আনন্দ! ঈদ উপলক্ষে শিমুলের নতুন দুলাভাই এসেছেন। আনন্দের ফোয়ারা বয় সেই দুলাভাইকে ঘিরে। শিমুলের বড় বোন শিপ্রা আপুই সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন- সাকিব, রতন, রঞ্জু, শফিক…। দুলাভাই মিষ্টি হাসেন। বলেন- ‘ফাইভ স্টার’। তখনই রঞ্জুর দাদুর ফর্সা ধবধবে মুখ মনে পড়ে যায় সবার। আর মনে পড়ে পঞ্চপাণ্ডবের কথা। না, বুড়ো আজ কাউকে পঞ্চপাণ্ডবের নাম জিজ্ঞেস করেননি। বলেছেন, আয় তোদের সঙ্গে কোলাকুলি করি। ছোট মানুষের সঙ্গে বুড়ো মানুষের কোলাকুলি- সে এক অভিনব দৃশ্য বটে! এদিকে শিমুলদের বাড়িতে ঘটে উল্টো ঘটনা। নতুন দুলাভাইয়ের সঙ্গে সবাই আড়ি দিয়ে বলে- ‘ঈদ-বোনাস’ না পেলে কেউ হাত মেলাবে না। সকালে ঈদের ময়দানে যাওয়ার আগে সালামের সঙ্গে সঙ্গে আদায় হয়েছে ঈদ-সেলামি। এখন হচ্ছে ঈদ-বখশিশ। মুখে বলে ঈদ-বোনাস। শিপ্রা আপু ফোড়ন কাটেন, তোরা কি চাকরি করিস যে বোনাস পাবি!
প্রথম প্রতিবাদ করে শিমুল নিজেই, আপু, তুমি বেশি কথা বোলো না। ফেঁসে যাবে কিন্তু! তার মানে! শিপ্রা আপু তেড়ে ওঠেন, আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে?

এতক্ষণে দুলাভাই ঢুকে পড়েন ছোটদের মধ্যে, বলেন ফাইভ স্টার যে! একসঙ্গে জ্বলে উঠলে উজ্জ্বল দেখাবেই।
সবার পক্ষ থেকে জবাব দেয় শিমুল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঈদ বোনাস না দিলে আমরা সবাই এক সঙ্গে জ্বলে উঠবো।
এদিকে উঠোনের এক কোণে কাঠের ঘোড়া নিয়ে খেলছিল শিমুলের ছোট ভাই পলাশ। ঘোড়ার পিঠে ওঠার খুব চেষ্টা তার। কী বুঝে সে ভাইয়াদের জ্বলে ওঠার কথা শুনে ফিক করে হাসে। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে খেলনা ঘোড়া পেয়েছে, সেটাই তার বোনাস। এই ঘোড়ায় একবার চড়ার জন্য অবুঝ বায়না ধরেছে দুলু, উঠোনের ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে, চিলচিৎকার কান্নায় সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। কিন্তু দুলুর দিকে তাকাবে কে! ওর মা কাজের মানুষ, কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এরই এক ফাঁকে দ্রুত পায়ে ছুটে এসে দুলুর পিঠে দু’চার ঘা বসিয়ে তিনি নিজের কাজে চলে যান। নিষ্প্রাণ কাঠের ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে দুলু কাঁদতেই থাকে বিরতিহীন।
ঈদ বলে তো শুধু নয়, শিমুলদের বোনাস দাবির পেছনে আরও যুক্তি আছে। শিপ্রা আপুর লেখাপড়া শেষ না হতেই বিয়ে হয়ে গেলো মাত্র ক’মাস আগে। বিয়ের পরপরই সরকারি চাকরি হলো- প্রাইমারি স্কুলে। এই তো ক’দিন আগে তিনি জীবনের প্রথম বোনাস তুলেছেন। এখন স্বামীর পক্ষ নিলে শুনবে ফাইভ স্টার! বোনাস কিংবা বখশিশ যে নামেই হোক, ওদের তো সন্তুষ্ট করতেই হবে।

দাবি-দাওয়া নিয়ে বিস্তর দরকষাকষি চলে দুলাভাইয়ের সঙ্গে। অবশেষে শিপ্রা আপুর ইঙ্গিতে সারেন্ডার করেন দুলাভাই। হাত তুলে সব গোলমাল থামিয়ে দেন। তারপর জানতে চান- বলো তোমাদের দাবিটা কী! কী চাও?
তাই তো! কী দাবি জানাবে! একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, কোনো সিদ্ধান্ত তো ঠিক করা হয়নি। ফলে এক-একজন এক এক রকম কথা বলে। কেউ জানায় টাকার দাবি। কেউ বলে ভালো করে খাওয়াতে হবে। কেউ তোলে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব। আবার বিতর্ক- বেড়াতে গেলে সেটা কোথায়।
নানাজনের নানা মত। শেষ পর্যন্ত শিপ্রা আপু সোজাসুজি ঘোষণা দেন- কাল সকালে সবাই মিলে শিলাইদহ যাবো। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী দেখবো। ফেরার পথে ছেঁউড়িয়ায় লালন মাজার। সকাল আটটায় মাইক্রো ছাড়বে। সবাই রেডি থাকবি কেমন!

অত্যন্ত হাসিমুখে ঘাড় দুলিয়ে দুলাভাই জানান- এবার এই ঈদে এটাই তোমাদের ঈদ-বোনাস, এই আনন্দ ভ্রমণ। কী, খুশি তো সবাই?
সবাই একযোগে বলে, ঈদ মানেই তো খুশি। আমরা সবাই খুশি।
কিন্তু সবার মধ্যে রতন কই?
দূরে নয়, রতনকে পাওয়া গেলো উঠোনের কোনায়। বসে বসে বাঁশি বাজানো শেখাচ্ছে দুলুকে। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বেলুন ফোলাতে পারছে না দুলু। তবু খুশির বন্যা উপচে উঠেছে তার চোখেমুখে। খানিক আগের কান্না কোথায় হারিয়ে গেছে তার ঠিক নেই। সাকিব দৌড়ে এসে রতনকে শুধায়, বেলুন বাঁশিটা ওকে দিয়ে দিলি?
রতন খুব আনন্দের সঙ্গে জানায়, হ্যাঁ দিলাম। ওটাই দুলুর ঈদ বোনাস। দুলুর আনাড়ি হাতে ঠিক তখনই বাঁশিটা বেজে ওঠে- পোঁ …ও…ও…।

Share.

মন্তব্য করুন