সকালটা ভালোই কেটেছিলো। নতুন দিনের স্বপ্ন, জীবনের ঝুঁকি আর টানটান উত্তেজনা। সাঁতরিয়ে খাল বিল নদী পার হওয়া। কচুরিপানার ফাঁকে নাক উঁচিয়ে রাত কাটানো। পাটক্ষেতের মশা, আঁচাপোকা আর ব্যাঙ-জোঁকের সাথে বসবাস। শেয়াল-খেকশিয়ালের ছোটাছুটি দেখা। সাপ-বেজির যুদ্ধখেলা এনজয় করা। এ বয়সে শুনতেও বেশ রোমাঞ্চকরই বটে। তারুণ্য মানেই তো নতুনের আবিষ্কার। তারুণ্য মানেই তো সাহসের প্রদীপ উচ্চকিত করা। তারুণ্য মানেই তো ভাঙাগড়ার খেলায় জীবনের তৃপ্তি খোঁজা। গল্পগুলো শুনতে শুনতে নিজেকেই সেখানে আবিষ্কার করে ফেলেছিলো সায়েম।

ওর চেয়ে তখন দাদুর বয়স একটু বেশিই ছিলো। তবে তা আর কতো। বড় জোর তিন কি চার বছর। দাদু তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। আর সায়েম এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সায়েম সবে তারুণ্যে পা দিলেও দাদুর তারুণ্য অবশ্য তখন উপচে পড়েছিলো। তাই দাদুর চেয়ে সায়েমের মনের ধারটা একটু বেশিই তীক্ষè।
দাদুকে সবাই সানুবীর বলে ডাকে। সানোয়ার হোসেন নামটাকে আদরে আদরে সানু করে ফেলেছিলো তাঁর বাবা। ছেলে ডাক্তার হবে অথবা হবে ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তা না হয়ে তিনি এখন সানুবীর। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন বলে সবাই তাকে সানুবীর বলেই ডাকে। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না মিললেও স্মৃতিগুলো আজও তাঁকে সান্ত¡না দেয়। তাঁর গল্পে উজ্জীবিত হবার সাথে সাথে নতুন ভাবনাও গিলে ফেলে সায়েমকে।

আচ্ছা দাদু, তখন তোমাদের কষ্ট মনে হয়নি? সারারাত পাটক্ষেতের মধ্যে কাটানো। জঙ্গল আর কবরের মধ্যে শুয়ে থাকা। শীতের রাতে সাঁতরিয়ে নদী পার হওয়া। যদি কিছু ঘটে যেতো। সাপ বিচ্চু কামড়ে দিতো, শেয়াল ভয় দেখাতো, জিনভূতের ভয় তো আছেই। ওরে বাপরে বাপ!
কষ্ট মনে হবে কেন? কষ্টগুলো দূর করার জন্যই তো আমাদের এ যুদ্ধ। সাপ বিচ্চুর চেয়েও যে ওরা হিংস্র। আর ভূত তাড়ানোর জন্যই তো আমাদের এ যুদ্ধ। ওরা আমাদের কত বড় শত্রু জানো?
কত বড় শত্রু দাদু?
ভীষণ; ভয়ানক শত্রু ওরা। ওরা আমাদের উপর খবরদারি করতো। আমরা স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারিনি। আমাদের উৎপাদিত জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে ওরা মজা করে ব্যবহার করতো আর আমরা সেটা কিনতাম বেশি দামে। কথায় কথায় আমাদের উপর অত্যাচার করতো। যুদ্ধের সময় আমাদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে নির্যাতন করতো। নির্মমভাবে হত্যা করতো। মা বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতো। তাই আমরা মুক্ত আকাশের জন্য যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করেছি। ওদের তাড়িয়ে দিয়েছি আমাদের স্বদেশ থেকে।

ওরা তোমাদের দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে, তাই না দাদু? মৃদু হেসে প্রশ্ন করে সায়েম।
ভয়ে মানে কি, একেবারে লেজ গুটিয়ে।
ওহ! তখন খুব মজা হয়েছিলো না দাদু! আমি যদি থাকতাম তাহলে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলতাম। আর বলতাম, ব্যাটা হানাদার। ধর ধর ধর। ওরা দৌড়ে পালাতো আর আমরা খুব মজা করতাম।
আমরাও তো সে রকমই মজা করেছি। স্বাধীন আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর থেকেছি। নিজের দেশে নিজেরা সগৌরবে বেঁচে থাকবো। দিনরাত সমান করে নির্ভয়ে নিরাপত্তার সাথে রাস্তা-ঘাটে চলাচল করবো। ভোট আর ভাতের অধিকার নিশ্চিত হবে আমাদের। জীবনের কোন ভয় থাকবে না। কেউ চোখ রাঙাবে না। আমাদের উৎপাদিত পণ্য আমরাই ব্যবহার করবো। কেউ তাতে ভাগ বসাতে পারবে না।
কথাগুলো বলতে বলতেই ক্রমশ উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে দাদুর। মেঘলা আকাশে সন্ধ্যে নামার মতো মুখটা ক্ষণিকেই মলিন হয়ে যায় তার। চোখের কোনায় পানি এসে ভর করে বানের স্রোতের মতো।
একঝাঁক কালো মেঘ এসে আচমকা ঢেকে দেয় সায়েমের সমস্ত মুখও।

নীরবতা চলে বেশ কিছুক্ষণ। একেবারে পিনপতন নীরবতা। কারণ আগামীকাল ২৭ মার্চ। ২০১০ সালের এই দিনে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন সায়েমের ছোটচাচা মনোয়ার হোসেন। কাল তার শাহাদত দিবস। বাসার অনতিদূরেই নিজের কেনাজমিতে বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে চাঁদাবাজদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেই সর্বসাধারণের সামনে তাঁকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা।
ঘটনার দিনে বাসাতেই ছিল সায়েম। ঠিক দুপুর বেলা। সাড়ে বারোটার মত সময়। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসতেই ঘটানাটি ঘটে যায়। বারান্দায় এসে শুধু হৈ চৈ শুনতে পেয়েছিল সে। চাচ্চুকে মেরে যাবার সময় ওদের একজন চিৎকার করে বলেছিল, শালা রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার; টাকা দেবে না। এখন ঠেলা বোঝো। চাঁদা না দেয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধা সানুবীর দাদুর ছেলেও ‘রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার’ বলে খেতাব পেলেন। সেই থেকেই কচিমনে ভীষণ ক্ষোভ আর ঘৃণা জড়ো হচ্ছে তার। দাদুর নীরবতায় ক্ষোভগুলো হাজারো প্রশ্নের ঝড় হয়ে ওঠে সিয়ামের মনে। একপর্যায়ে বিনয়ের সাথে দাদুর কাছে প্রশ্ন করার অনুমতি চায় সে। মাথা নেড়ে সায় দেন দাদু।

দাদু, আমরা কি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়েছি? আমরা কি নিরাপত্তা পেয়েছি? আমরা কি হানাদার মুক্ত হয়েছি? আমরা কি কথা বলার অধিকার পেয়েছি? ভোট আর ভাতের নিরাপত্তা পেয়েছি? সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো কালো বলার সাহস পেয়েছি? আমাদের মা বোনের ইজ্জতের নিরাপত্তা কি নিশ্চিত হয়েছে? মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আপনি রাজাকার, তাহলে ওরা কারা? একসাথে প্রায় ডজনখানেক প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে।
কোন জবাব দেন না দাদু। শুধু চোখের কোণে ভাসতে থাকে মনোয়ারের মায়াবী মুখ। বৌমা সামিয়ার ছলোছলো চোখের কাতর চাহনি। নিষ্পাপ রাফার পবিত্র মুখের নিষ্প্রাণ হাসি। প্রতিরাতেই সে বায়না ধরে বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর জন্য। বাবা ফিরলেই নতুন লাল জামা আনবেন সাথে করে। আর কতকাল মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সময় পার করবে তারা!

হৃদয়ের কোণে জেগে ওঠে হাজারো কষ্ট। মনে মনে ভাবতে থাকেন ছেলে-বৌ সামিয়ার কথা। সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না তিনি। মামলা তুলে নেয়া হচ্ছে না বলে তার উপর হুমকি আসছে প্রতিদিন। রাস্তায় পেলেই তাকে অপহরণ করা হবে। রাফাকে সামনে পেলেই হত্যা করার হুমকি দিয়েছে তারা। সেই ভয়ে বৌমা সামিয়া রাফাকে নিয়ে তার ফুফুর বাসায় নিরুদ্দেশ হয়ে আছেন প্রায় এক বছর থেকে। বারবার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও কোনো লাভ হয়নি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের বাইরে চোখ ফেরান দাদু। সায়েমও একটু নড়েচড়ে বসে। দাদুর প্রতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সানুবীর মাথা নেড়ে জবাব দেন, হ্যাঁ পেয়েছি; খুব পেয়েছি। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময়ে আশা আর সম্ভাবনার স্বপ্নটাই পেয়েছি। স্বাধীনতার সুবাতাস শুরুর আগেই দুপুরের খট্খটে রোদ তাকে আবারো তামা বানিয়ে দিয়েছে। প্রতারণা আর শঠতা আমাদের জীবনকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। আর ঐ চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা? ওরাই তো স্বাধীনতার সোনার ছেলে। মাসল আর অস্ত্রের জোরে ওরাই এখন দেশের সবকিছু।
আর কোন কথা বলতে পারলেন না দাদু। চোখ মুছতে মুছতে অন্য ঘরে চলে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের সংজ্ঞা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো সিয়ামের তারুণ্যছোঁয়া চিন্তায়। আকাশের কোলে স্বাধীনতার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে একই চিন্তার ভারে বিকেলের সূর্যটাও অস্তমিত হয়ে গেল নিঃশব্দে।

Share.

মন্তব্য করুন