দুপুরটা আজকাল একেবারেই কাটতে চায় না ঝুমির। এই কিছুদিন আগেও ভাত খাবার পর মুঠো মুঠো ঘুমে ঢুলে আসত দু’চোখ। ঘুম আসবে না? সেই কোন ভোরে স্কুলে গেছে। বাড়িতে ফিরে আসার পর মায়ের রুটিন ফলো করতে হয়। স্কুলের ড্রেস পাল্টাও, হাত মুখ ধোও লেবুর শরবতটা খাও। ইমন বলত, ‘ওয়েট অ্যা বিট মা, একটু পরে। মা বলত, ‘নাহ্ এক্ষুনি করো, শরবতটা খেয়ে একটু রেস্ট নাও।’
ফ্রিজের ঠাণ্ডা পুডিং খেতে দেবে না মুনা। তাই আগে থেকে বের করে রাখে।
‘প্লিজ মা, একটুখানি কোক দাও।’
‘নাহ্, কিছুতেই না। ভালো জিনিস মোটেও খেতে চাও না, খালি বাজে খাবারের দিকে লোভ।’
ইমন ছোট, তাই মায়ের কাছে অনুনয় করে। ঝুমি বড় হয়েছে, ক্লাস ফোরে পড়ে। ওর শুধু মনে হতো, মা যদি এভাবে অর্ডার না করে বলত, ‘আর ইমন, তোমাদের যা করতে ভালো লাগে তাই করো।’ তাহলে তো বিছানায় ডিগাবাজি খেত ইমন, বালিশ ছুঁড়ে মারত দিদির দিকে। আর সে? চিতপাত হয়ে বিছানায় শুয়ে আকাশের মেঘ দেখত। রূপকথার বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখত। কিন্তু তা তো হবার নয়।

মুনা ছেলেমেয়েকে নিয়ে খেতে বসতো। করলা ভাজি দেখে ভাই-বোনের মন খারাপ। মা বলে, ‘করলা ভাজি দিয়ে ভাত মেখে খাও। এটাতো লিভারের খাদ্য। ভাতের পাতে প্রথমেই তেতো খেতে হয়।’ ঝুমি বলত, ‘আমাকে চিকেন দিয়ে দাও মা।’
‘স্যালাড নিবি না?’
‘এইটুকুন দাও।’
‘আর মাছ? মাছের ঝোল খাবি না?’
‘না মা, প্লিজ।’
অসহায় চোখে মুনা তাকিয়ে থাকতো ছেলেমেয়ের দিকে। কেউই সবজি খেতে চায় না, মাছ খাবে না ওরা। ওদের স্বাস্থ্য ভালো হবে কি করে?
মায়ের বকুনি আর চোখ রাঙানোর ভয়ে জোর করে করলা-মাছ খেতে হতো। এরপর ঘুম ঘুম আর ঘুম।

সেই ছককাটা রুটিনের দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল? আর কি ফিরে আসবে না সেই দিনগুলো? মায়ের শাসনে, গাদা গাদা হোমওয়ার্কের চাপে যে দিনগুলোকে কষ্টকর মনে হতো- সেই দিনগুলো কোন দিনও বুঝি ফিরে আর আসবে না!
দু’চোখে ভোরের জড়িয়ে আসা ঘুম, বিছানার আদুরে আরাম ফেলে টেনে তুলতো মুনা। কান্না পেত ঝুমি আর ইমনের। আজ এই রোদ ঝকমকে দুপুরে সেই দিনগুলোকে ফিরে পেতে বড্ড ইচ্ছে করছে ঝুমির। ইমন দু’পা ছড়িয়ে চিতপাত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু মেঘার যে একেবারেই ঘুম আসছে না, কী অদ্ভুত এই সময়টা। শুধু বাসায় বসে থাকো, খাওয়া-দাওয়া করো- ব্যস, এমনই করেই দিন কেটে যাচ্ছে।
দরজা-জানালা সব বন্ধ। খুব দরকারে বাড়িতে যে আসে, তার মুখে মাস্ক। মা-পাপা-দাদু, যে-ই কথা বলে, মুখে মাস্ক থাকে। চলতে ফিরতে সারাক্ষণই স্যানিটাইজার, ডেটল নয়তো লাইফবয় সাবান দিয়ে, হাত ধোয়া; এই চলছে।
মাঝে মধ্যে খুব রাগ হয় মেঘমালার।
‘একটু আগেই না ভালো করে হাত ধুয়েছি মা। আমি তো নোংরা ঘাটিনি।’
সুদীপ দাদু বলেন, ‘তা বললে কি হয় ঝুমি? করোনা ভাইরাসকে আমরা চোখে দেখিনি। দুষ্টু ভাইরাসটি কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে কে জানে। তাইতো আমাদের সাবধান থাকা। দ্যাখো না টিভিতে বারবার সতর্ক করে বলতে থাকে, মাস্ক মাস্ক এবং মাস্ক।
সত্যি কী হয়ে গেল। মা আগের মতো আর হাসে না। ভোরবেলা উঠে আগের মতো আর রেওয়াজ করে না। মায়ের দুই বন্ধু কাকরাইলের নীলো আন্টি, নিউ ইস্কাটনের আইভি আন্টি কেউ আর আসে না। নীলো আন্টির মেয়ে খুশবু আর মেহেখ, আইভি আন্টির ছেলে দীপক, মেয়ে অথৈ; কারোর সঙ্গে এখন আর দেখা হয় না ওদের।
দুষ্টু করোনার জন্যই যাওয়া আসা একেবারেই বন্ধ। ঝুমঝুম ভাবে আমি নিজেকে মেঘা ভাবছি কেন? মেঘমালা তো আমার স্কুলের নাম। প্রায় বছর হয়ে গেল আমরা স্কুলে যেতে পারছি না। ক্লাসমেট রিমিআর রুমকির কথা খুব মনে পড়ছে আজ। একটুতেই ওদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি হয়ে যেত।
‘এই তুই আমাকে ম্যাথের রেজাল্টটা বললি না কেন? চুপ করে আছিস কেন? খুব চালাক হয়েছিস- তাই না।!’
‘তুই ভীষণ পাজি। রঙ পেন্সিলটা দিতে বললাম, দিলি না তো।’
এমনই ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি হতো রুমকি আর রিমির সাথে।

নেমে এসেছে সোনালি বিকেল। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। আজ এই দু’টি পাজি বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে। মন কষাকষি তারপর আবার ভাব। স্কুলের নয়না ম্যামের কথাও খুব মনে পড়ছে। ভীষণ কড়া ম্যাম। কথায় কথায় বলতেন, ‘হোয়াট আর ইউ ডুইং মেঘমালা? ক্লাসে এত কথা বলো কেন? দাঁড়াও গার্জেন কল করব।’
দারুণ ঝগড়াটে দুই বন্ধু আর ম্যামকে খুব মিস করছে মেঘা। ইসস, কী চমৎকার দিনগুলো ছিল। আনন্দের সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। বিছানায় এখনও শুয়ে আছে ইমন।
‘কি রে উঠবি না?’
ক্লান্ত সুরে ইমন বলে, ‘উঠে কি করব রে দিদি? হরলিকস খাব, তারপর পড়তে বসব। কী পড়বো বলতো স্কুলের পড়া নেই, হোমটাস্ক নেই, সিটি নেই।’
ডাইনিং স্টেজ থেকে সুদীপ বলেন, ‘কি দাদু ভাই, সিটি আবার কি?’
‘ক্লাস টেস্ট দাদু ভাই।’

মুনা বলে, ‘হরলিকস দিয়েছি, ঝুমঝুম-ইমু চলে এসো- চিকেন স্যান্ডউইচ করেছি।’
ভাইবোন এসে স্যান্ডউইচ হাতে নেয়। দু’জনের মুখই মলিন। টম্যাটো স্যস মাখিয়ে খাবে, তাও বেমালুম ভুলে যায়। মুনা বলে এত মন খারাপ করছ কেন? সারা পৃথিবীতে ভাইরাসটি চষে বেড়াচ্ছে। আবার ঠিক হয়ে যাবে সব।
‘কবে মা? ঝুমি বলে, দাদু ভাই, তুমি যখন খবরের কাগজে ভাইরাসটির কথা জানলে, তখন বলেছ, ও হলো দূরদেশের ভাইরাস। চীন দেশ থেকে আমেরিকা-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া যাবে। আমাদের দেশে দুষ্টু ভাইরাসটি আসবে না। বলোনি দাদু?’
সুদীপ মাথা লেড়ে কনফেস করেন, ‘হ্যাঁ বলেছি, পজেটিভ চিন্তা করেছি। ভেবেছি আমরা নিরাপদে থাকব। বিজ্ঞানীদেরও অ্যাসেসমেন্টে ভুল হয়, আমি তো সাধারণ এক মানুষ। আমার পরিচয়টা কি? মেঘমালা আর ইমনের দাদুভাই। ঝুমঝুম আর ইমুর বেস্টফ্রেন্ড।’
ইমু স্যান্ডউইচে বাইট দিয়ে বলে, ‘মোটেও তা নও তুমি। কত নামি কলেজে তুমি ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে।’ টুকটাক কথাবার্তা বলে ওরা পড়ার টেবিলে যায়। হয়তো কিছুটা পড়বে, হয়তো বই-খাতাপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করবে- দাদুভাই সুদীপ, পাপা, সুমিত আর মুনা তা জানেন। পড়াশোনা তেমন এগোবে না।
সময়টা একেবারেই অন্যরকম। সুদীপ রিটায়ার করেছেন তা সত্যি, তবে সকাল-বিকেল হাঁটাহাঁটি, টুকিটাকি বাজার করা এতো ছিলই। এখন একেবারে সব বন্ধ। বয়স্ক মানুষের নাকি বেশি ভয়। করোনা নাকি খুব তাড়াতাড়ি জাপটে ধরে ওদের। বুড়োদেরকে বেশি ভালোবাসে নাকি?
পাপা অফিসে যান ডাবল মাস্ক পরে। ফিরে আসার সময় হলেই মুনা গিজার চালিয়ে দেয়। কাপড় চোপড় ছেড়ে ভালো করে ¯œান করে তবেই বেডরুমে ঢোকা। এ ছাড়া তো সারাক্ষণ স্যানিটাইজার হাতে মাখো, সাবান দিয়ে হাত ধোও। অদৃশ্য জীবাণুগুলোকে ভ্যানিশ করা যায় না?
মায়ের মেজাজ সারাক্ষণ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। ঝুমঝুম বুঝতে পারে, মায়ের ওপর সাংঘাতিক চাপ যাচ্ছে। বাজার থেকে সবজি-মাছ কোনো কিছু এলেই ভিনিগারে ডুবিয়ে রাখো, তারপর রানিং ওয়াটারে ভালো করে ধুয়ে জল ঝরিয়ে, ন্যাকড়া দিয়ে মুছে তবেই না ফ্রিজে তোলা।
সারাক্ষণই অদ্ভুত এক আতঙ্কের মাঝে দিন কাটায় সবাই।
এমন কি ভালো লাগে? এসব ভাবলে বড্ড কান্না পায় ঝুমঝুমের। ছককাটা রুটিনের দিনগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল। আর কি ফিরে আসবে না আগের মতো হাসিখুশি ভরা দিনগুলো? মেঘমালা নামে কেউ আর ডাকবে না? ঝুমঝুম বলে, ‘দু’হাজার বিশ সালটা কেন এলরে ইমন? চারদিকে অসুখ বিসুখ। রোজ কত লোক মারা যাচ্ছে। এসব খবর দেখা যায়? খুব মন খারাপ হয় আমার।’
‘হ্যাঁ জানি তো, টিভির স্ক্রলিংয়ে রোজ দেখি। সেই মার্চ মাস থেকে স্কুল ছুটি। ভাল্লাগে না। ফয়সাল, তামিম, টিটো, ইমতি কারোর সঙ্গে আর দেখা হচ্ছে না। জানিস দিদি সবাই মিলে কত্তো ফুটবল আর ক্রিকেট খেলেছি। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে কত মজা হতো। ইসস্, ফুল অব ফান। একজনের টিফিন আরেকজন খেয়ে নিয়েছি। কুস্তি লড়েছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি- মজার দিনগুলো হারিয়ে গেল দিদি।’
ঝুমঝুম বলে, ‘জানিস, আমাদেরও তাই হতো। খুব রাগ করত মমতাজ- বলতো, তোরা ছোঁচা। আমরাও বলতাম, বেশ করেছি টিফিন খেয়েছি। ওর দিকে তাকাতাম না পর্যন্ত। ছুটির ঘণ্টা পড়লে চেঁচিয়ে বলতাম, এই মম, কাল এগ রোল নিয়ে আসবি। ও হাত নেড়ে বলত, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আসব, অফকোর্স।’
জলভরা চোখে ইমন বলে, ‘ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না- তাই রে দিদি?’
‘দূর বোকা।’
মন খারাপ মেঘমালারও। তবু সে ছোটভাইকে সান্ত¡না দেয়, ‘অসুখ কি চিরকাল থাকেরে? দুষ্টু ভাইরাসটি এসেছে, আবার চলেও যাবে। আগের মতো দিনগুলো আবার ফিরে আসবে। হোপ ফর দ্য বেস্ট।’
বাড়ির সবার আদরের ঝুমঝুম আবার মেঘমালা হয়ে উঠবে। ও বড় ভাবুক মেয়ে, ভাবতে ভালোবাসে।

হারিয়ে যাওয়া খুশির দিন

সময় যেন আর কাটতেই চায় না।
নিচতলায় ভাড়াটেরা থাকে। ওরা থাকে দোতলায়। ছাদে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনতলায় মায়ের তানপুরা, হারমোনিয়াম, জাদুর লাইব্রেরি- কী চমৎকার দিন ছিল। কোভিড নাইনটিন এই মহামারী রোগটি তখনও পা রাখেনি। কী সহজ জীবন ছিল ওদের। শুধু ওদের কেন, সবার। ফেলে আসা দিনের কথা বড্ড মনে পড়ে ঝুমঝুমের। সবসময় জমজমাট থাকত ওদের সেগুনবাগিচার তিনতলার বাড়িটি, নয়তো কাকরাইলে যেত নীলো আন্টির বাড়ি, নয়তো নিউ ইস্কাটনে খুশবু-মেহেখের বাড়ি। মা, নীলো আন্টি আর আইভি আন্টির অনেক পুরনো বন্ধুত্ব। উনাদের বাবারা সরকারি চাকরি করতেন। পাবনার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি হন তারা।
ইমন মাঝে মাঝে অবাক হয়ে প্রশ্ন করত। ‘তোমরা সত্যি ছোট ছিলে মা? চুলে ঝুঁটি বাঁধতে? বিনুনি করতে?’
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তেন মুনা।
হাসি সামলে বলত, ‘নাহ, আমরা কোনোদিন ছোট্ট ছিলাম না। জানিস আমরা ফ্রিল দেয়া ফ্রক পরেছি, লাল ফিতে দিয়ে চুল বেঁধেছি।’
‘এরপর আবার কোথায় দেখা হলো মা?’
‘বাবার বদলির চাকরি তো, বদলি হলেন কিশোরগঞ্জ। খুব মন খারাপ আমার। নীলো আর আইভির সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব ছিল, আর তো জীবনে ওদের সঙ্গে দেখা হবে না। পড়তে ভাল্লাগে না, খুব মন খারাপ আমার।’ ঝুমঝুম বলল, ‘তাহলে তুমি আমাদের বকো কেন? দ্যাখো, মন ভালো না থাকলে পড়ায় একদম মন বসে না।’ মুনা মুখ ভরে হেসে বলেন, ‘দু’তিন বছর পর বরিশাল বদলি হলেন বাবা। প্রভাতি স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে দেখি নীলো আর আইভিও একই স্কুলে!’
ইমন বলে, ‘তার মানে ঘুরে ঘুরে তোমাদের দেখা হয়ে গেছে? ইসস্, কী মজা!’
বিছানার চাদর টানটান করে পেতে মুনা বলে, ‘তাই তো দেখলাম। অনেকদিন পর ঢাকা এসে আবার দেখা হলো ইডেন কলেজে।’
ঝুমঝুম তো তাজ্জব।
‘এটা কি করে হলো মা?’
মুনা ¯িœগ্ধ স্বরে বলে, ‘পৃথিবীটা গোল তো, তাই হয়তো ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখা হয়ে গেছে।’
মা-পাপা অনেকের সাথে মেলামেশা করেন কিন্তু এই তিনটি পরিবার একসাথে মিশে একই পরিবার হয়ে উঠেছে। বিপদ-আপদ অসুখ-বিসুখে একে অন্যকে সাহায্য করে। তিনটি পরিবার মিলে একটি। দাদুভাই প্রায়ই বলেন, ‘নীলো, আইভি, মুনা যেন আমার তিনটি মেয়ে। কতো আসা যাওয়া ছিল এই সেগুনবাগিচার বাড়িতে। কী যে হয়ে গেল।’ গভীর নিঃশ^াস ফেলেন সুদীপ। ‘কী যে হয়ে গেল’ মানে- উদ্ভট এই করোনা ভাইরাসকে উদ্দেশ্য করে বলা।
পাপাও মাঝে মাঝে দুঃখ করেন।
কত খারাপ সময় গেছে আমাদের। বাবার অসুখ, সিরিয়াস অপারেশন, টাকা-পয়সার টানাটানি কিন্তু কখনই এত মন খারাপ হয়নি। কোভিড নাইনাটিন আসার পর কী যে এক ভয় আর আতঙ্ক সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে। পৃথিবীটাই এখন বিষণœ হয়ে গেছে। সত্যিই তাই ঝুমঝুম আর ইমনকে সারাক্ষণ শুনতে হয়- গেট খুলে একদম বের হবে না। নিরাপদ থাকতে হবে। ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স মেনটেন করবে।

ইমনের প্রশ্নের আর শেষ নেই।
‘স্যাভলন-হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে কতক্ষণ হাত ধুতে হবে মা? ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স কতটুকু মেনটেন করতে হবে?’
‘কেন তিন ফুট। টিভিতে সারাক্ষণ তো বলে।
‘মাস্ক কি ঘরেও পরব?’
পাপাকে অফিসে যেতেই হচ্ছে। ভর দুপুরে মায়ের রাজ্যের কাজ। এর মাঝে ইমুর অগুনতি প্রশ্ন। মুনা বলে, এত প্রশ্ন করিস কেন রে?
‘বাঃ রে, জানতে হবে না আমার। দারোয়ান আসে, সবজিওয়ালা আসে, আমাকে তো তিন ফুট দূরে দাঁড়াতে হবে। স্কেল দিয়ে মেপে দাঁড়াব মা?’
মুনা রেগে বলে, ‘খুব জোরে থাপ্পড় মারব কিন্তু ইমন। সারাক্ষণ কোশ্চেন কোশ্চেন আর কোশ্চেন। ছেলের কোনো হেলদোল নেই বকুনি খেয়ে।’
ইনোসেন্ট মুখে বলে, ‘আমি যদি কোশ্চেন না করি তবে অ্যানসার কি করে জানবা মা?’
দাদুভাই বলেন, ‘সত্যিই তো মুনা, মাকে কি ধৈর্য হারালে চলে? অনেক জ্যান্ত থাকতে হয় মাকে।’
‘কেন বাবা, ওর পাপা বাড়িতে থাকলে তো ছেলের প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারে। তা দেবে না, মুখের ওপর ফাইল নিয়ে বসে থাকবে, নয়তো টিভিতে খবর দেখবে। খালি বলবে- ‘মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ’ -বলো তো কে বলেছেন কথাটি? কেন বাবা, কথাটি নেপোলিয়ান বলেছেন- এ কথাটি বলতে পারে না আপনার ছেলে? তার মানে পাপারা কেনো দায়িত্ব নেবে না।’
হো হো করে হেসে উঠেন সুদীপ।
‘কথাটি ঠিক বলেছ মুনা।’
‘আপনিই বলুন বাবা, সব দায়িত্ব মাকে কেন নিতে হবে?’
পাপার ওপর মা রেগে গেলে মনে মনে বেশ মজা পায় ইমন। দাদুভাই মিষ্টি করে বলেন, ‘সত্যি মুনা, সব কিছু আমরা মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেই। আর ইমুর কথাও বলি, সুমিত বা আমাকে প্রশ্ন করতে পারে। তা করবে না, দেখি তো তোমার আঁচল ধরেই টানাটানি করে। আসলে ও তোমাকে বেশি ভালোবাসে।’
ইমন বলে, ‘পাপা আসলে অফিস ছাড়া কিছুই বোঝে না।’
‘তা বুঝবে কেন? তোমার পাপা তো ফাঁকিবাজিতে ওস্তাদ।’
দাদুভাই আর ইমন খুব হাসল মায়ের কথা শুনে। প্রাণখোলা এই হাসিতে ঝুমঝুমের বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। ইসস্, কতো দিন ওরা হাসে না এমন করে। লুডো খেলতে বসে ছক্কা না মেরে মিছেমিছিই বলা এই যে এক ছক্কা এই যে আরেক ছক্কা মেরেছি দাদু। চোখ পাকিয়ে ঝুমঝুম বলত একদম চোট্টামি করবি না ইমু। মা বলত, খেলায় অমন একটু আধটু হয়েই থাকে। দাদুভাই মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলতেন, ‘তুমি এই চোট্টামি আর মিথ্যে বলাকে সাপোর্ট করো মুনা?’
মধুর আনন্দের সেই দিনগুলো আর কি ফিরে আসবে না? ভাবতে ভাবতে উদাস হয়ে যায় মুনা।
ইমু সারা ঘর জুড়ে ওর ছোট-বড় গাড়িগুলো ছড়িয়ে খেলছে। ‘এ্যাই এ্যাই ডাইনে বাঁয়ে, আর একটু বাঁয়ে, অ্যাই যে নিশান সানি আসছে, বাব্বা, এতো জ্যাম, উল্টো দিক থেকে আসছে টয়োটা করোলা।’…
দুপুরে এই সময়টা কিছুতেই যেন কাটতে চায় না। রং পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে বসেছে ঝুমি, একটু পরে আর ভাল্লাগে না। পাপা অফিসে, দাদুভাই এসময় খবরের কাগজ পড়তে পড়তে ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দেন। সামনে রাখা খবরের কাগজটিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন।
মুনা এ সময় খুব ব্যস্ত থাকে। ওয়াশিং মেশিনে জামাকাপড় কাচা হচ্ছে। টাইম সেট করে দিয়ে মা এখন রাঁধছে। কাজে সাহায্য করত শিউলির মা, তাকেও ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে করোনার জন্য। লিকলিকে বেত দিয়ে করোনা ভাইরাসকে খুব জোরে মারতে ইচ্ছে করছে ঝুমঝুমের। ঠিক এ সময় মোবাইল বেজে ওঠে। মুনা কথা বলে আইভি আন্টির সাথে। একই কথা।
‘আজকে অনেক মারা গেছে রে মুনা। খুব ভয়ে ভয়ে আছি। রাঁধা-খাওয়া আর শোয়া। এভাবে কি দিন কাটে বল? এমন একঘেঁয়েমি আর ভালো লাগে না।’…

আন্টি আর মায়ের কথা শুনতে শুনতে দম আটকে ঝুমির। বছর দেড়েক আগে নীলো আন্টি এমনই ফোন করেছিল। তখনও রোদ পোড়া ঝাঁ ঝাঁ দুপুর ছিল।
‘জানিস ঝুমঝুম। আমরা না কিছুদিনের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি।’
হ্যাঁ খুশবুর মামা থাকেন অস্ট্রেলিয়াতে। ইসস্, ওদের কী মজা। ফিরে এসে গপ্প করে কান ঝালাপালা করে দেবে।
ইমনও বায়না ধরল, আমরাও বেড়াতে যাব মা। মাঝে মাঝে বাইরে কোথাও না গেলে ভালো লাগে বলো? শুধু স্কুলে যাওয়া-আসা, পড়া আর পরীক্ষা। দাদু বলেছিলেন, ‘মুনা সুমিতকে বলো, ক’টা দিন বাইরে ঘুরে আসতে। সত্যিই তো কোথাও ওরা যায় না।’ মুনা রেগে বলে, ‘আপনার ছেলে তো অফিসে সেঁটে থাকে বাবা। অস্ট্রেলিয়া-কানাডা না যেতে পারি, সিলেট থেকে মা আর ওদের মামুকে নিয়ে আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে তো যেতে পারি।’
মুনার প্ল্যান শুনে দু’ভাই-বোন দারুণ খুশি। তখন করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে আসেনি। কী চমৎকার আনন্দমাখা দিন ছিল। পাপা কখন অফিস থেকে ফিরবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসেছিল ওরা। সুদীপ বলেছেন, ‘তিন চার দিন তোমরা ঘুরে এসো ওদের নিয়ে। আমি বাড়ি পাহারা দেব।’ মুনা বলেছিল, ‘এ হয় না বাবা, আপনিও সঙ্গে যাবেন। সবাই মিলে না গেলে কি আনন্দ হয়?’
খুব খুশি হয়েছিলেন দাদু ভাই। অনেকদিন গাঁয়ে যায় না মুনা। গেলে খুব আনন্দ হবে।
মুনা মন খারাপ করা সুরে বলে, ‘আপনাকে একা ফেলে যাব এও কি হয়? সবাই মিলে গেলে তবেই না আনন্দ হবে। একঘেঁয়ে জীবন কারো ভালো লাগে না বাবা।’ সুদীপ বলেন, ‘তাও ঠিক। দ্যাখো, আমার ছেলে অফিস থেকে এসে কি বলে। ও ছুটি নিলে তো অফিস করা হয়ে যাবে। সবাই বসে রইল পাপার আসার অপেক্ষায়। ফুলকো লুচি, আলুর সাদা তরকারি আর মিষ্টির প্লেট সাজিয়ে মুনা বসে রইল। ডোর বাজে একসময়। সুমিত ঘরে ঢোকেন। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসেন ফ্রেশ হয়ে। লুচি তরকারি খেতে থাকেন রেলিশ করে।
খেতে খেতে সবার মুখের দিকে তাকান একবার। ঝানু ব্যাংকার তো বুঝতে পারেন কিছু একটা ব্যাপার আছে। সবাই এমন করে তাকিয়ে আছে কেন?
‘কি ব্যাপার মুনা। এই ঝুমঝুম ইমু কি হয়েছে বল। স্পিক আউট।’
ইমন এক নিঃশ^াসে বলে, ‘আমরা ছয় সাত দিনের জন্য মামাবাড়িতে যাব পাপা। খুশবু আপা, মেহেখ আপা ওরা অস্ট্রেলিয়া মামুর বাড়িতে যাচ্ছে। আমরা কোথাও যাব না?’
ধোঁয়া ওড়া গরম চায়ের পেয়ালা নিয়ে এসেছে মুনা। আওয়াজ করে আয়েশি চুমুক দিয়ে পাপা বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া যেতে পারব না সত্যি কিন্তু আতাসন গাঁয়ে যেতে পারব। উই হ্যাভ টু গো। কালকেই ছুটি ম্যানেজ করব। প্রমিস।’
এরপর শুধু আনন্দের হৈ চৈ। ট্রলি ব্যাগ নামানো হলো। সবাই খুশিতে মাতোয়ারা।
সেদিন বাইরে ছিল। ¯িœগ্ধ বিকেল। ভাবতে গিয়ে এখনও আনন্দে শিউরে ওঠে শরীর। দাদুভাই প্রায়ই বলেন।

আনন্দ হলো টনিকের মতো।
সত্যি তাই। কাচের মতো ঝকঝকে ফেলে আসা দিনগুলো ঝুমঝুমের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। পারাবত ট্রেনে যেতে যেতে ভাই-বোন গেয়ে উঠেছিল- ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার
নেই মানা মনে মনে-’
কুলাউড়া জংশনে নেমে ট্যাক্সিতে করে সোজা মামাবাড়ি। গাঁয়ের নাম আতাসন।
বড়রা সবাই মিলে গল্প করতে থাকে মণিমালা দিদা আর মন্টি মামুর সাথে। বাড়ির সামনে ছুটোছুটি করতে থাকে ঝুমঝুম আর ইমু। ইসস্, কী খোলামেলা মাঠ। কুশিয়ারা নদী তিরিতিরি করে বইছে।
গালে আঙুল ঠেকিয়ে বড়দের মতো ইমন জিজ্ঞেস করে, ‘আতাসন নামের মানে কি রে দিদি?’ ঝুমঝুম ভুরু কুঁচকে বলে, ‘একদম কোশ্চেন করবি না ইমু। টম-ডিক-হ্যারি এই নামগুলোর মানে কি আমরা জানি? জানি না তো, আতাসনও তেমনই একটা নাম।’
সময় যেন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে যেতে চায়। কিছুতেই সময়টাকে মুঠোর মাঝে ধরে রাখতে পারছে না ওরা।
গাঁয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশে সোনালি আভার গোল চাঁদ। আলোর ফিনকি উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওরা দু’জন মিলে ছুটছে। মুখে গান- ‘আহা কী আনন্দ আকাশে- বাতাসে।’

মুনা বলে, এখন ঘুম আসছে না তাই না? ঢাকায় বই নিয়ে বসলেই ঘুম।
সুদীপ ¯েœহমাখা সুরে বলেন, ‘এমন করে বলো না মুনা। হোমওয়ার্ক, স্কুল, ক্লাস টেস্টের মাঝেই তো ঘুরপাক খায় ওরা। ক’টা দিন ওদেরকে অন্যরকম কাটাতে দাও।’
মণিমালা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ান। দুঃখ করে বলেন, ‘এখন ওদের শৈশব তো নেই-ই। ছোটবেলার আনন্দ কি, তা ওরা উপভোগ করেনি কোনদিন, এখন শুধু ছোটা। ফার্স্ট হও। নাইনটি সেভেন পারসেন্ট মার্কস পেতে হবে। আবৃত্তি-গান সব শিখতে হবে। এ যুগে অলরাউন্ডার নাহলে কি চলে?’
পাপা বলেন, ‘পাঁচ-ছয়টা দিন একটু অন্যরকম কাটাক না!’
ঘন দুধে সবরি কলা মেখে খাইয়ে দেন দিদা। এরপর দিদার বুকের কাছে শুয়ে রূপকথার গল্প শোনা। কমিকস নয়, নন্টে ফন্টে নয়, টম অ্যান্ড জেরির গল্প নয়, ফেয়ারি টেইল নয়- একেবারেই অন্যরকম রূপকথার গল্প। সে রাতগুলো অন্যরকম সুগন্ধিতে মাখা।
তেপান্তরের মাঠ, ময়ূরপঙ্খী নাও, গা ছমছম করা রাক্ষস-খোক্কস, ব্যঙ্গমা, দুধসাগর, ক্ষীরসাগর আরও কত কী? রাক্ষসীরা খোনাসুরে বলে, ‘হাউ মাউ খাউ, মানুষের গন্ধ পাউ।’
মাথায় ঝলমলে মুকুট পরা রাজপুত্র টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে আসে। তলোয়ার নিয়ে রাক্ষস-রাক্ষসীদের দিকে এগিয়ে যায়। ইসস্, গল্প শুনে শিউরে উঠে ঝুমি আর ইমু। কী চমৎকার গুছিয়ে বলেন মণিমালা দিদা।
ইমু মাকে বলে, ‘আমি রূপকথার দেশে চলে যাব মা।’
‘সে তো যাবিই রে। তার জন্য তো পড়াশোনা করতে হবে। নয়তো তলোয়ার-মুকুট-ঘোড়া কোথায় পাবি?’
ঝুমঝুম খিলখিল করে হাসে।
‘ইমুটা কী বোকা মা!’
মুনা বলে, ‘মোটেও বোকা নয় ইমন, ও কল্পনা করতে খুব ভালোবাসে। সেটা তো রূপকথার গল্পতেই শুধু পাওয়া যায়। এখন আর গল্প শোনার সময় কোথায়?’

মামা বাড়িতে মাত্র দিন কয়েক থেকে কত কিছু দেখল ওরা। ঘরে ঢোকার মুখে নকশা করা উঁচু কাঠ। মন্টিমামু বলে, এটা হলো চৌকাঠ বুঝলি ইমু। এতে পা ঠেকাতে নেই। একটা পা অল্প উঁচু করে ঘরের ভেতরে ঢোকো। বেরোবার সময়ও পা অল্প উঁচু করে বাইরে এসো। দারুণ ব্যাপার। দিদা বলেন, হালফ্যাশনের বাড়িতে ওসব থাকে না, কিন্তু থাকলে ভালো। সাপ-ব্যাঙ-পোকামাকড় কিছুই ঘরে ঢুকতে পারে না। পাপা বলেন, দিজ ইজ প্রটেকশন।
দাদুভাই বলেন, নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে খেয়াল করে দেখেছেন ভেন্টিলেটর নেই। অথচ ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে বাইরের ফ্রেশ হাওয়া আসে। এখন পবিত্র বাতাস আর কোথায় ঝুমঝুম বলে, ইউ আর সো স্যাড দাদুভাই। ইমন বলে, ইয়ু আর আনহ্যাপি দাদু। সত্যিই তো চৌকাঠ নেই, ভেন্টিলেটর নেই, আমিও দাদু ভাইয়ের মতো রাগ করেছি।
বিকেলের চায়ের আসরটা বড্ড বেশি মনে পড়ছে ঝুমির। চওড়া বারান্দায় বসে মা, বাবা, দাদুভাই, দিদা আর মামু চা খাচ্ছেন। কী এলেবেলে গল্প। মজাদার গল্প। মন্টিমামু মানেই হাসির ফোয়ারা। সুড়–ৎ করে মামু চায়ে চুমুক দিতেই ঝুমি বলেছিল, ‘ডোন্ট সাক টি মামু।’
‘কোথায় সাক করেছি। আরাম করে খাচ্ছি আর কি।’
ইমন লুচি-পায়েস খেতে খেতে বলে, ‘এবারে তাহলে চায়ের একটা গল্প হয়ে যাক মামু।’
‘শুনবি? তাহলে শোন।’
পাপা বলেন, ‘তোমার স্টকে কি গল্পের শেষ নেই।’
‘না সুমিতদা। তাহলে শুনুন। সে অনেক আগের কথা। চা কিভাবে খেতে হয়, গাঁয়ের মানুষ কেন শহরের লোকই জানত না।’
‘ব্রিটিশ আমলের গল্প নাকি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ শোনই না। এসেই বলল, উই ওয়ান্ট টু ড্রিংক টি। জুৎ করে বসে মামু বলতে থাকে, সাহেব সুবেদারেরা আসলে গাঁয়ে এসেছে পাখি শিকার করতে। শীতের সময় হাওরের দিকে বালিহাঁসের খুব আনাগোনা। সাহেবদের তো আপ্যায়ন করতে হয়। খাবারের সঙ্গে চা পরিবেশন করতে হবে।’
ইমু বলে, ‘চা কেন, কফিও তো দিতে পারত।’
‘আরে ব্যাটা ভাগনে, অনেক আগের গল্প। চায়ের কথাই শোনেনি আবার কফি। সাহেবরা নিজে থেকে খেতে চেয়েছে। ঝুমি বলে, একদম কথা বলবি না ইমু। মামু তুমি বলতো।’
মন্টি বলে, ‘অনেক বছর আগের কথা তো, কফির সিস্টেম তখন চালু হয়নি। ঘুম থেকে উঠে চা খাওয়ার রেওয়াজই ছিল না।
ঘুম থেকে উঠে গরম ভাত, নয়তো পান্তা ভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। গাঁয়ের বড় একটি দোকানে খুঁজে খুঁজে ছোট্ট এক চায়ের প্যাকেট পাওয়া গেল। কী খুশি সবাই।
বাড়িতে মহা হট্টগোল। চা পাতা তো এলো, এবার প্রিপারেশনটা কী করে হবে?
মুনা হাসতে হাসতে বলে, ‘মন্টির যত আজগুবি গল্প।’
পাপা বলেন, ‘সত্যি না আজগুবি সেটার বিচার পরে হবে, তবে মনে হচ্ছে খুব ইন্টারেস্টিং স্টোরি।’
মন্টিমামু গল্পের মেজাজে রয়েছে।
‘শুধু চা পাতায় তো আর চা তৈরি হবে না, মিষ্টি নিশ্চয়ই দিতে হবে। তাই দোকান থেকে আনা হলো আখের গুড়। রাঁধুনি হলো সবজান্তা, ও গুড় আর চা পাতা আচ্ছাসে চটকাতে থাকে। কুক ছাড়া রেসিপি তো আর কেউ জানে না।
ঝুমি আর ইমু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
মুনা বলে, ‘কোত্থেকে যে মন্টি খবরগুলো পায় কে জানে।’
‘না দিদি, সত্যি বলছি। ঘটনাটা ঠিক এরকমই ঘটেছিল। চা পাতা আর গুড় মাখানো লাড্ডু দেখে সাহেবরা বলে হোয়াট ইজ দিজ? দিজ ইজ লাড্ডু লাড্ডু।’
ওরা খেতে খেতে বলে, ‘ওহ ফ্যানটাসটিক, অসম, ইয়ামি!’
কত কিছু দেখেছে ওরা আতাসন গাঁয়ে। বড় হাঁড়িতে থই থই করছে গরুর দুধ। বাঁশের ঘুটনি দিয়ে কী যে ম্যাজিক করল দানা দানা হয়ে দুধের ওপরে মাখন ভেসে উঠেছিল। দিদা মিছরি দিয়ে মাখন খেতে দিয়েছিল। কী যে মজা। গল্পের পাহাড় জমে উঠেছিল বুকের ভেতরে। গাঁ থেকে ফিরে এসেও ভুলতে পারেনি তাকে। ঝুমঝুম প্রায়ই আবৃত্তি করে-
‘আতাসন গাঁয়ের কথা
ভুলতে কি আর পারি?
এ যে আমার প্রাণের কাছের
প্রিয় মামার বাড়ি।
মেহের আর খুশবু যখনই সিডনির গল্প বলত ঝুমঝুম আর ইমন থামিয়ে দিত ওদের।
‘তোরা সুপার্ব বিচেস দেখেছিস, আইকনিক অপেরা হাউজ দেখেছিস কিন্তু চৌকাঠ কি দেখেছিস?’
‘চৌকাঠ? এটা আবার কি রে বাবা? কি বললি- চৌকাঠ?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ চৌকাঠ, রুমের সামনেই থাকে চৌকাঠ। শোন মেহেখ, এগুলো দেখতে হলে গাঁয়ের বাড়িতে নয়তো ছোট শহরে যেতে হয়। কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হয় না।’
ক্লাসমেট মমতাজ হেলেদুলে এসে বলে, ‘মেঘমালা, হাই মেঘমালা- বেশি কটকট করে কথা বলবি না। বল তুই, নায়াগ্রা ফলস দেখেছিস? দেখিসনি তো।’
‘তুই আগে বল মম, ঢেঁকি দেখেছিস? গাই দোয়ানো- তাও তো দেখিসনি। দুধ থেকে মাখন তোলা দেখেছিস? দেখিসনি তো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, তিনি অনেক দূরের পর্বতমালা দেখতে গিয়েছেন, সিন্ধু দেখতে গিয়েছেন কিন্তু ঘরের কাছে যে ঘাসের ওপরে শিশিরবিন্দু ঝলমল করে, তা দেখেননি। তাই বলছি, তোমরা নিজের দেশকে আগে দেখো; চেনো। কথাগুলো মনে করে কান্না পেতে থাকে মেঘমালার।
আমাদের এই হাসিখুশির জীবনে তুমি হঠাৎ করে চলে এলে কেন কোভিড নাইনটিন? শোন মি. নটি ভাইরাস। তোমার জন্য লকডাউন হয়ে গেল। সবাই ঘরবন্দী। দরজা জানালা বন্ধ। করোনা জীবাণু হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে। তোমাকে দেখতে পাই না, লুকিয়ে আছ কেন তুমি?
ঝুমঝুম জিজ্ঞেস করে, ‘ও কি সবখানেই ঘুরে বেড়াবে দাদুভাই?’
‘হ্যাঁ ঝুমি, পাজিটা বিশ^ পরিভ্রমণ করতে বেরিয়েছে।’
এখন মামাবাড়ির দিনগুলো, চা দিয়ে লাড্ডু বানানোর গল্প, স্কুলের আড়ি আর ভাব, খেলার মাঠে মেঘমালার ছুটে বেড়ানো, সব কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয়।

স্বপ্নমাখা দিন

ঝুমঝুমের ঘুম ভাঙে মিষ্টি এক সুরের ছোঁয়ায়। সকাল এখনও হয়নি। বাইরে আলো আঁধারের খেলা। এ সময়টাকে বলে ভোর। তবে দাদুভাই অনেক কিছু জানেন। বলেন, তোরা মুখে শুধু ‘ভেরি গুড মর্নিং’ বলিস। আসলে তেমন কিছুই শিখলি না রে ঝুমি।
ঝুমঝুম দাদুর কাছে হার মানে না।
‘তুমি জিজ্ঞেস করো দাদুভাই, দ্যাখো আমি ঝটপট অ্যানসার দিয়ে দেবো। প্রশ্ন করো, কুইক কুইক!’
‘ঠিক আছে। তাহলে এবার বলো তো ঝুমি, আঁধার পুরোপুরি কাটেনি আবার সকালের আলোও ফোটেনি। এই আলো-আঁধারি সময়টাকে কী বলে?’
গম্ভীর হয়ে ঝুমঝুম বলে, ‘তুমি অনেক হার্ড কোশ্চেন করো দাদু।’
হাসিমুখে সুদীপ বলেন, ‘আলো-আঁধারের এই সময়টাকে বলে ঊষা। পারলি না তো।’
‘ঊষা ঊষা।’
মিষ্টি করে উচ্চারণ করতে থাকে ঝুমি।
সুদীপ ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘তোদের ইশকুলে কী পড়ায় রে দিদিভাই? বইখাতার ব্যাগ নিয়ে যাওয়া আর টিফিন খাওয়া।’
‘পড়ায় দাদুভাই, পড়ায়। ইংরেজি পড়ায় তো ম্যাম, এ সময়টাকে ডন্ (উধহি) বলে- তাই তো?’
ঠা ঠা করে প্রাণখোলা হাসি হাসেন সুদীপ।
‘ডনই তো বাংলায় ঊষা।’
বুক ভেঙে নিঃশ্বাস আসে ঝুমঝুমের। বেশিদিন আগের কথা তো নয়। দু’হাজার বিশ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। ওর ঘুম ভেঙেছিলো দাদুভাইয়ের কলিগের চেঁচামেচিতে। পারেও বটে আকমল দাদু।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়েছিলো সেদিন আকমল সাহেব।
‘এই ব্যাটা, এখনও ঘুমোচ্ছে! এই সুদীপ মিয়া, আর কত ঘুমাবা? ওঠো ওঠো। মানুষ মর্নিং ওয়াক কইরা ঘরে ফিইরা আইতাছে, এই নবাবের আর ঘুম ভাঙে না।’
সুদীপ ভোরবেলা উঠে ওভেনে জল গরম করে গ্রিন টি তৈরি করেন, হাতে লাঠি নেন, শীতকাল বলে শার্টের ওপরে ভারী সোয়েটার পরেন। টুকটাক আওয়াজে ঝুমির ঘুম ভাঙে না। আকমল দাদুর চেঁচামেচিতে সেদিন ঘুমের চটকা ভেঙে গিয়েছিলো। মনে হয়, এই তো সেদিন। মায়ের কামরা থেকে মিষ্টি সুরের আওয়াজ রিনরিন করে ভেসে আসছে। মুনা তানপুরা নিয়ে বসেছেন। মা গাইছে সকালের রাগ- ভৈরবী। কী চমৎকার সুর। ঝুমির বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। ভোরের ¯িœগ্ধ হাওয়ায় মায়ের গলার সুর মিশে একাকার হয়ে গেছে।
সন্ধ্যার রাগ হলো ইমন। সব সুরই ভারি মিষ্টি। মুনা অবশ্য বলেন, এ হলো ইয়ামন। আমরা বলি ইমন। তোমার পাপা গজল শোনে না- ‘দিল দুখানে কো লিয়ে আ যা।’ এ গানটি ইয়ামন সুরের ওপর। ইয়ামন থেকে ইমন।
হ্যাঁ, পাপা গানটি প্রায়ই শোনে। গান শুনতে খুব ভালো লাগে ওর। ঘরে সুর খেলা করে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই যে কাঁচাভোরে তানপুরা নিয়ে মায়ের সুর সাধা- সারা ফ্ল্যাট জুড়ে চমৎকার এক আবহ তৈরি হয়।
পাপা গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি করেন। মা তানপুরা ছাড়াও সময় পেলেই হারমোনিয়াম নিয়ে গান করেন। ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এলে মা কী চমৎকার গেয়ে ওঠেন!
ঝুমি আর ইমনকে বুঝিয়ে বলেন, বর্ষার দিনের রাগিণী হলো- মেঘমল্লার। আর উচ্চারণ হলো- মিয়া কি মাল্হার।
দাদুভাই প্রায়ই বলেন, যারা গান ভালোবাসে, ফুল ভালোবাসে, ওরা খুব কোমল স্বভাবের হয়।
মায়ের গান শুনতে শুনতে এলেবেলে কতো কথাই না ভাবতে থাকে ঝুমঝুম।
দাদুভাই আকমল দাদুর সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। ইমন এখনও ওঠেনি। ঝুমঝুম শুধু ভাবে, শুধুই ভাবে। ভাবনাগুলো এমনই মেঘের গুচ্ছের মতো একের পর এক আসতেই থাকে।
বালিশে মাথা রেখে গোপনে নিঃশ^াস ফেলে ঝুমঝুম।
এখন আর আকমল দাদু রাস্তায় দাঁড়িয়ে হৈচৈ বাধিয়ে দেন না। কারণ কেউ তো আর মর্নিং ওয়াক করতে বেরোয় না।
‘এ্যাই ব্যাটা সুদীপ মিয়া, আর কত ঘুমাবা? উইঠা পড়ো।’ -কথাগুলো শোনার জন্য কান পেতে থাকে ঝুমঝুম।
মুুনা গান করছেন সত্যি, কিন্তু আগের মতো সুরের সেই ভালো লাগাটুকু নেই। ওদের হোমওয়ার্ক নেই, স্কুল নেই, ক্লাস টেস্ট নেই। আছে শুধু অনলাইনে ক্লাস করা।
মুনা মাঝে মাঝে ফোনে বলেন, ‘অনলাইন ক্লাস কি আমরা কখনও শুনেছি? এখন দ্যাখো, কী এক অদ্ভুত ব্যাপার। কী এক করোনাভাইরাস এলো, গোটা পৃথিবীটাকে যেন তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে।’
পাপা বলেন, ‘গেলো আর কোথায়? কতদিন ভোগাবে কে জানে!’
২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন লকডাউন হলো- কী মজা ওদের। স্কুল নেই, হোমওয়ার্ক নেই, ভোরে উঠে ছুটোছুটি নেই। কিন্তু এখন আর কারোরই ভাল্লাগছে না। সময় যেন একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছে।
হাসি-খুশির মজার দিনগুলো দুষ্টু করোনা এসে দূরে বহু দূরে কোথায় যেন নিয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে এখনও মনে হয় কারা যেন ডাকছে- ‘মেঘমালা, এই মেঘমালা’ বলে। কখনও মনে হয়, বেস্ট ফ্রেন্ড কুমকুম আর টুঁই ডাকছে- ‘মেঘা, এই মেঘা-শুনতে পাচ্ছিস?’
ঝুমঝুম জানে, এ ওর মনের ভুল।

দাদুভাই বলেন, ‘তুমি স্কুলে যাচ্ছ না অনেক দিন। ক্লাসের বন্ধুদের কথা তোমার মনে হয়- তাই তো? এক মায়া মোহের মাঝে তুমি রয়েছো। তাই মনে হয়, মেঘমালা নামে ওরা তোমাকে ডাকছে। এ হলো ইলিউশন, দিদিভাই।’
এই তো কিছুদিন পরই নীলো আন্টি, খুশবু, মেহেখ- ওরা চাঁদ দেখবে। এরপরই রমজান মাস শুরু হবে। ওরা দু’ভাই-বোন অপেক্ষা করছে, কবে নীলো আন্টি ওদের জন্য ইফতারি পাঠাবে। কি আনবে- পিয়াজু, চটপটি, দহিবড়া, মিষ্টি? ভাবতে ভাবতেই মিষ্টি মিষ্টি বিকেলে মাঝে মাঝেই চলে আসতো খাবার।
আচ্ছা সত্যি, এই ইমন আর ঝুমঝুম এসব ভাবছে- এগুলো কি কখনও হয়েছে? না রূপকথার দেশের কোনো গল্প, তা তো নয়!
২০২০ তো চলেই গেছে মন খারাপের খেয়া বেয়ে। ২০২১ এসেছে, নতুন বছর। তারপরও কি ওরা হাসতে পারবে না, আনন্দ করতে পারবে না, ইশকুলে যেতে পারবে না?
এভাবে আর কতদিন চলবে মা?
শুধু মা কেন, এ কথার জবার কেউ জানে না। ছোট-বড় সবাই তাকিয়ে দেখে টিভির খবর। তারপর উঠে যার যার কাজে চলে যায়। সবার মুখের হাসি করোনা যেন ম্যাজিক স্টিক দিয়ে উধাও করে নিয়েছে।

ফুল ফোটার দিন

আজকাল রাতে তেমন ঘুম হয় না দাদু ভাইয়ের, বয়স হলে এমনিতেই ঘুম কমে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসেন।
সেগুনবাগিচার এই তিনতলা বাড়িটি তার প্রাণের সাথে মিশে আছে। নিজের হাতে তৈরি করা বাগানটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কত রকমের গোলাপ, অতসী, অপরাজিতা, দোপাটি জুুঁই দোলনচাঁপা, সন্ধ্যামালতী খুব যত্ন করে লাগিয়েছেন। সপ্তাহে মালী দু’দিন এসে প্রয়োজন মতো পাতাগুলো ছেঁটে দেয়, গোড়ার মাটি খুঁড়ে দেয়। বাগানের দিকে তাকিয়ে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। মহামারী করোনার কথা ভুলে যান ফুলের ম ম গন্ধে।
হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় ঝুমঝুমের জন্মের কথা। আজ চার এপ্রিল। এদিনে দিদিভাই তো পৃথিবীর আলো হাওয়ায় মুখ দেখেছিল। প্রতি বছর জন্মদিনে কত আনন্দ হয়, কত উৎসব। ওভেনে, প্রেসার কুকারে, ন্যানস্টিক প্যানে কত রান্না। মিক্সিতে মসলা মিহি করে বাটা হয়। বলতে গেলে সকাল ন’টা থেকে সরগরম হয়ে ওঠে বাড়িটি।
সুমিত অফিস থেকে লাঞ্চ আওয়ারেই বাড়ি ফিরে আসে। মুনার বেস্ট ফ্রেন্ড দু’জন তো আগে আগেই চলে আসে। আইভির সাথে আসে ওর স্বামী এডওয়ার্ড প্রদীপ, ওদের দুই ছেলে-মেয়ে অলিভার-দীপক। নীলোর সাথে আসে ওর স্বামী তানভীর, ওদের দুই মেয়ে, খুশবু আর মেহেখ।
ভোরের বাতাসে সুদীপের বুক ভাঙা নিঃশ্বাস বাতাসে মিশে যেতে থাকে। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিলের এই দুঃসময়ে ঝুমঝুমের কি বার্থডে পার্টি হবে, না হওয়া উচিত? গত বছর হয়নি, এবারও কি হবে না? জীবন থেকে হাসি কি মুছে যাবে? রোজ সকালে মুনা আদা খেতো লিকার চায়ে দিয়ে। অবাক হয়ে সুদীপ দেখেন, এলাচি লঙ্কা দারুচিনি আর দুধ মেশানো সোনালি রঙের পেয়ালা। সুদীপ আস্তে করে বলেন, ‘মুনা আজ তো দিদিভাইয়ের জন্মদিন।’
‘তাই তো দুধ চা দিয়ে সেলিব্রেট করছি বাবা।’
সুমিতও ব্যালকনিতে চলে এসেছেন। চমৎকার এক প্রপোজাল রাখেন তিনি।
‘আচ্ছা, ঝুমি আর ইমন ওরা তো অনেকদিন থেকেই মনমরা হয়ে আছে। ওদেরকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?’
মুনা বলেন, ‘তার মানে?’
‘শুধু নীলো আর আইভিদের ফ্যামিলি এলো। ওরা তো ফ্যামিলি মেম্বারদের মতোই। বাইরের তো আর কেউ নয়। একটা দিন অন্তত এনজয় করুক ওরা।’
ঝুমঝুম আর ইমন যেন স্কুলের মেঘমালা আর মুকুট হয়ে যায়। এইটুকুন আনন্দ কি কম? মানুষের কাছ থেকে তিন ফুট দূরে দূরে থাকো, মাস্ক পরো- এই ভয় আর আতঙ্কের মাঝে পাপা-দাদুভাই-মা যে ওদের কথা ভেবেছে এ কি কম কিছু? বাইরের কাউকে ডাকছেন না পাপা, শুধু নীলো আন্টি আর আইভি আন্টির পরিবার। দাদুভাই তো সবসময় বলেন, ‘মুনা, আইভি আর নীলো আমার তিন মেয়ে।’

দুই বাড়িতেই ফোন করে মা। আইভি বলে, অনেকদিন পর দেখা হবে আজ। কী যে বন্দী হয়ে আছি বাড়িতে, আসব না মানে? অবশ্যই আসব। দীপু আর অথৈ আনন্দে চেঁচামেচি করতে থাকে। নীলো আন্টি খুশিতে আটখানা হয়ে বলেন, ‘তুই ডেকেছিস মুনা, খুশবু আর মেহেখকে নিয়ে আসব না- এ কি হতে পারে?’
রোজকার মন খারাপের দিনটি হয়ে যায় ফুল ফোটার দিন। নীরব বাড়িটি হাসিখুশিতে গমগম করে। রোদে ঝকঝক করছে ছাদ। এখন সবাই ছাদে বাগান করে। সেখানেও রয়েছে অনেক ফুল ফল গাছের বড় বড় টব। দাদুভাই বলেন, ‘বেড়াতে এসেছ বলে করোনা ভাইরাসের কথা ভুলে যেও না।’
মেহেখ বলে, ‘একটুও ভুলিনি দাদু। দ্যাখো মাস্কটা নাকের ওপর দিয়ে একেবারে থুতনি পর্যন্ত রেখেছি। ফিজিক্যালি ডিসট্যান্সও মেনটেন করছি।’ আইভি বলে, ‘খুব ভালো মেহেখ, টিভিতে যা বলে তা আমাদের ফলো করতে হবে তো, না হলে আমরা ভালো থাকব কি করে?’.
নীলো গ্রিন টিতে আয়েশি চুমুক দিয়ে বলে, ‘দ্যাখো তো কি বিচ্ছিরি ব্যাপার, সারাক্ষণ মুখে মাস্ক পরে থাকো। কী দিন যে এলো! কেউ কারো পুরো মুখটি দেখতে পাচ্ছি না।’ তানভীর বলেন, ‘এই ভাইরাস আসার পর কাছের মানুষরা কেমন যেন পর হয়ে গেল। কেউ কারো বাড়িতে আসে না।’ কিচেন থেকে আইভি চেঁচিয়ে ডাকে, ‘এই নীলো, খুব গপ্পো করছ, না? চিকেনের চাপ বসাতে হবে না? গপ্পো না করে চলে এসো, ফাঁকিবাজি করো না।’
‘তাই তো।’
তিনজন মিলে দারুণ উৎসাহ অনেকদিন পর রাঁধছে। আজ অন্যরকম একটি দিন।
ঝুমঝুম ছয় ছাঁটের কল্লিদার ফ্রক পরে দীপু, অথৈ, ইমন, মেহেখ, খুশবু সবাইকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে যাচ্ছে, নিচে নেমে আসছে। কোনো কারণ নেই তবু খিলখিল করে হাসছে ওরা। গাইছে- ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা…।’
মুনা, আইভি নীলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে ছেলেমেয়েদের। কত অল্পতেই খুশি ওরা। এডওয়ার্ড প্রদীপ বলেন, ‘শুধু ঝুমঝুম মামণির বার্থডে বলে এলাম। লকডাউনে তো খুব দরকার নাহলে বাইরেই যাইনি। এখন শুধু অফিস আর বাড়ি। কে আর বাইরে গিয়ে এই নটি ভাইরাসকে ওয়েলকাম করবে বলো!’
সুমিত বলেন, ‘এমন তো কখনও হয়নি মুনা, আমাদের ছেলেমেয়ে কারোর অসুখ হয়েছে কিংবা কোনও আনন্দের দিন এসেছে, আমরা আসিনি কিংবা তোমরা যাওনি।’ মুনা বলে, ‘মেয়েটা এমন মনমরা হয়ে থাকে, শুধু ঝুমির কথাই বা বলছি কেন, এই পৃথিবীর সব ছোটরাই তো এই দুঃসময় পার করে যাচ্ছে। তাই ভাবলাম, ঝুমির জন্মদিনে সবাই মিলে একটু আনন্দ করি। ঝুমঝুম বলে, দাদুভাইও খুব মন খারাপ করে বসে থাকে। খবরের কাগজ পড়া আর টিভির স্ক্রলিং এ খবর দেখা। শুধু কোভিড নাইনটিনের খবর। ভালো লাগে বলো?’ আইভি-নীলো বলে, ‘কবে যে আবার আগের মতো স্বাভাবিক দিনগুলো ফিরে আসবে।’ তানভীর বলেন, ‘একশ বছর পরপর তো আবার মহামারী আসবে।’
প্রদীপ ঠা ঠা করে হেসে ওঠেন।
‘আরে বাবা, একশ বছর পর এপিডেমিক আসবে- ওই ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।’
‘কেন কেন, তুমি ভয় পাচ্ছ না কেন?’ নাটকের ডায়ালগ আওড়ানোর মতো প্রদীপ বলেন, ‘কারণ এতদিন আমরা বাঁচবই না।’ একসাথে হেসে ওঠে সবাই।
ইসস্, কতদিন পর গমগম করছে সারা বাড়ি খলখল হাসির আওয়াজে বাতাসও যেন হেসে ওঠে।
দাদুুভাইয়ের মেজাজ চনমনে।
‘সুমিত যেই আমাকে প্রপোজাল দিল আমিতো অমনই রাজি হয়ে গেলাম। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের ছুটোছুটি আর হাসিখুশিতে পাজি ভাইরাসটি পালাবার পথ পাবে না। তাই ভাবলাম জন্মদিনে অন্তত সবাই আসো। আগের মতো আবার আমরা এক পরিবার হয়ে যাই।’
প্রদীপ বলেন, ‘খুব ভালো হয়েছে। এই আনন্দটা মনে থাকবে বহুদিন। কেউ কারো বাড়িতে যাই না কেউ আসে না। কোথা থেকে যে করোনা ভাইরাসের জার্ম চলে আসবে কে জানে। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার। লিফটে একসঙ্গে কয়জন উঠতে গেলেই ভয় লাগে।’
আইভি আন্টি নিজের হাতে তৈরি করে নিয়ে এসেছে ভ্যানিলা আর ফ্রুটস কেক। ঘর ভরে আছে ড্রাই ফ্রুটস আর ভ্যানিলার ম ম গন্ধে।
নীলো বলে, ‘এই ছোটরা এর ধারে কাছেও যেও না। সন্ধ্যায় সেলিব্রেশন হবে।’ দুপুরবেলা বাসমতী চালের ভাত রুই মাছের ফ্রাই আলু দিয়ে মাটন কারি হলো। শেষে পাতে মিষ্টি দই। দাদুভাইয়ের জন্য পুডিং। পুডিং তৈরি করে নিয়ে এসেছেন নীলো। সন্ধ্যায় সবাই খাবে। দাদুভাইয়ের জন্য শুধু নিয়ম ভাঙা হলো। তিনি পুডিং খুব পছন্দ করেন তাই।

আজকে যেন দুপুর আর বিকেলটা ফুরোতেই চাইছে না। এক সময় ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। নানা রঙের বেলুন আর রঙিন কাগজের শিকলে ঝলমল করতে থাকে ড্রয়িংরুম। এ রাত শুধু অন্য রাতের মতো নয়, এ এক স্বপ্নপুরী।
ছোট-বড় সবারই মনে হতে থাকে এ যেন রূপকথার দেশ। ভয়, মন খারাপ আর আতঙ্কের মাঝে থেকে থেকে আজকের দিনটা একেবারেই অন্যরকম কেটেছে। সোনার রঙে মোড়া এই সন্ধ্যা।
সুরে-বেসুরে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ঝুমঝুম’ গাওয়া হলো। ছোটরা হই-হুল্লোড় করে কেকের ক্রিম মাখাতে থাকে সবার মুখে।
তানভীর চেঁচিয়ে বলেন, ‘এনজয় করো। লেটস্ এনজয়।’
মুনা যত্ন করে চিংড়ি আর চিকেন দিয়ে তৈরি করেছেন ফ্রায়েড রাইস, চিকেন চাপ রেঁধেছেন নীলো, মাটন রেজালা করেছেন আইভি। চিনিগুঁড়া চাল দিয়ে পায়েস রেঁধেছেন ঝুমঝুমের বাবা সুমিত। মুনা বিরক্ত হয়ে বলেছে, ‘তুমি আবার মেয়েদের মাঝে ঢুকতে গেলে কেন?’ সুমিত জবাব দিয়েছেন, ‘ফাইভ স্টার হোটেলে পুরুষরাই তো রাঁধে। ঝুমির বার্থডেতে এইটুকুন আমাকে করতে দাও প্লিজ।’ আজকের দিনটাতে করোনাকে ভুলে গেল সবাই। আজ শুধুই আনন্দ।
অসুখের কথা কেউ বলতে গেলেই প্রদীপ বলেন, ‘নো টক অ্যাবাউট করোনা ভাইরাস।’ সুদীপ খেতে খেতে বলেন, ‘হ্যাঁ ভাইরাসটির কথা শুনতে আমাদের ভালো লাগে না। তা ঠিক। তবে আমরাই তো এই দুঃসময়ের জন্য দায়ী, এডওয়ার্ড প্রদীপ।’
তানভীর বলেন, ‘এই যে সবুজ বন, গাছগাছালি কেটে ফেলা, ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে আকাশছোঁয়া বিল্ডিং তৈরি করা। এসব কাজ তো ঠিক হয়নি।’
ইমন বলে, ‘জানেন আঙ্কেল, সেগুনবাগিচার মোড়ে অনেকখানি জায়গাজুড়ে বিশাল এক বাড়ি ছিল। ঝাউ গাছ, কৃষ্ণচূড়া-আমলকি গাছ ছিল বাড়িতে। কত পাখি এসে বসত।’
ঝুমঝুম বলে, ‘ভাই ঠিকই বলেছে। বাড়িটি যখন প্রমোটার নিয়ে নিলো। গাছগুলো কেটে নিলো ওরা। নাহলে তো অনেকগুলো ফ্ল্যাট হবে না। গাছগুলোর জন্য মা কেঁদেছে, আমরাও খুব কেঁদেছি। কিন্তু ছোটদের কথা তো কেউ শোনে না।’
দাদুভাই বলেন, ‘আজকাল তো শুনছ তোমরা প্রায়ই ভূমিকম্প হয়, সুনামি হয়। তাছাড়া কত রকমের ভাইরাস আসছে আমরা কি করে ভালো থাকব বলো। ন্যাচারকে শেষ করে দিয়ে কি শান্তিতে থাকা যায়?’
গম্ভীর গলায় সুদীপ বলেন, ‘কিছুই করার নেই। এ আমাদেরই কর্মফল। আমরা কি আগের মতো আর পুণ্য মৃত্তিকা পাব? নীল ঝকঝকে নীল আকাশে এখন কি আর দুধের মতো মেঘের গুচ্ছ ভাসে? বাতাসও এখন পলিউটেড। কালো ধোঁয়া, দূষিত আর নোংরা পদার্থে বাতাসও আর আগের মতো পবিত্র নেই।’

ছোট-বড় সবাই মন দিয়ে শুনছে দাদুভাইয়ের কথা। তিনি অনেক পড়াশোনা করেন। জানেন ও বোঝেন অনেক।
‘ছোটবেলায় ভোরবেলা উঠে বুক ভরে নিঃশ^াস নিতাম। শরীরটা তরতাজা হয়ে উঠত। পুকুর খাল বিল নদী যা-ই বলো না কেন, টলটলে জল কি আর আছে? কিছুই আর আগের মতো নেই আইভি।’
নীলো বলে, ‘আঙ্কেল, মানুষকে তো করোনাভাইরাস এখন ঘরবন্দী করে ফেলেছে। প্রকৃতি কী চমৎকার হয়ে উঠেছে, মুনা খেয়াল করে দেখেছিস আগেও তো চাঁদ উঠত আকাশে, কই এতো ভালো লাগেনি। টিভিতে দেখিসনি আইভি, লাল কাঁকড়াগুলো মনের আনন্দে টুকটুক করে হাঁটছে। ডাঙায় উঠে বাচ্চা কচ্ছপগুলো ছুটছে তো ছুটছেই, একদম থামছে না। পরিবেশ দূষণ নাকি অনেকটা কমে গেছে। করোনাভাইরাস এসে মানুষকে ঘরবন্দী করেছে তো, গাছগাছালি, ফুল-ফলে-পাখি-কাঁকড়া সব যেন পাগলপারা হয়ে উঠেছে।’
তানভীর বলেন, ‘তাহলেই বোঝো, আমরা মানুষরা আসলেই ব্ল্যাকশিপ।’
এডওয়ার্ড প্রদীপ বলেন, ‘সব মানুষকে বলো না তানভীর, বেশির ভাগ মানুষই তো পরিবেশ রক্ষা করার কাজ করেন। গাছগাছালির কত যত্ন করেন। প্রকৃতিকে সজীব রাখার কত চেষ্টা করেন।’
‘তা ঠিক।’
ঝুমঝুম ভাবুক মেয়ে। বড়দের কথা শুনতে শুনতে ওর মনে নতুন এক ভাবনার জন্ম হয়। মানুষ কি ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে ঝড় বৃষ্টি আনতে পারবে। সুনামি আনতে পারবে। চাঁদমাখা রাত কিংবা কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটাতে পারবে?
নাহ- তা তো পারবে না।
এই যে আচমকা ভূমিকম্প হয়, জলোচ্ছ্বাস হয় সে তো প্রকৃতিই করে। তাহলে মানুষ কেন গাছগাছালি কেটে ফেলে, ইট-কাঠ-বালি-সিমেন্ট দিয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলা ঘর বানায়? এতে যে ড্রাই হয়ে যাচ্ছে ন্যাচার। প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে ফেরে ঝুমি।
জমাটি আড্ডা হচ্ছে ড্রয়িং রুমে।
সুমিত বলেন, ‘আমরা এখন বিশ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া রপ্ত করেছি- অভ্যাসটা বেশ ভালো। কাঁচাবাজার থেকে কেনাকাটা করে এসে ভিনিগার মেশানো জলে সবজি মাছ সব কিছু ভিজিয়ে রেখে ভালো করে ধুয়ে নেয়া- দিজ ইজ অলসো গুড হ্যাবিট। আমাদের এখন থেকে সব সময় তা করা উচিত।’
মেহেখ বলে ওঠে, ‘দু’হাজার বিশ সাল চলে গেল, ভাবলাম একুশ সালে ভাইরাসটা ফিউজিটিভ হয়ে যাবে। তাতো হলোই না, এখন আবার বেড়ে যাচ্ছে।’
ইমন বলে, ‘জুন-জুলাই মাসে দেশটা অফকোর্স আগের মতো হয়ে যাবে।’
খুশবু আনন্দে দু’হাত তুলে বলে, ‘আমরা সবাই মিলে খুশি খুশি গলায় গান গাইব- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি।’…

খুশিতে পিচ্চিদের দল বলে ওঠে, হিপ হিপ হুররে- দীপক আর খুশবু সুমিতকে জিজ্ঞেস করে, ‘আঙ্কেল ঠিক বলতে পারবেন। আপনার কি মনে হয় সুমিত আঙ্কেল?’
সুমিত বলেন, ‘আমি কি হাত গুনতে জানি রে? তবে আশায় মানুষ বেঁচে থাকে। আমাদের ঝুমিও শুধু স্বপ্ন দেখে।’
আইভি আন্টির দুই ছেলেমেয়ে অলিভার দীপু আর অথৈ চেঁচিয়ে ওঠে।
ঝুুমিদিদি স্বপ্ন দেখে
আশা নিয়ে বেঁচে থাকে।
ঝুুমিদিদি ঠিকই বলে
আমরা তাই তার দলে।
দাদুভাই বলেন, ‘এই যে বাতাস বয়, রোদ ওঠে, বৃষ্টি ঝরে, চাঁদ ওঠে- একটা নিখুঁত নিয়মে এই পৃথিবীটা চলতে থাকে। একজন সর্বশক্তিমান রয়েছেন অদৃশ্য হয়ে। তাঁকে আমরা দেখতে পাই না ঠিক কিন্তু এই বিশ^ব্রহ্মাণ্ড তাঁরই নির্দেশে চলে। এসো সবাই ঝুমঝুমের জন্মদিনে তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করি।’
এডওয়ার্ড প্রদীপ বলে ওঠেন, ‘অ্যা ভেরি গুড আইডিয়া।’
মুনা বলে, ‘ঝুমি-ইমন, সেই সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে আকুল হয়ে প্রার্থনা করো। খুশবু-মেহেখ, তোমরা দু’হাত তুলে মোনাজাত করো। দীপু-অথৈ কোথায়- তোমরা প্রেয়ার করো। একমনে প্রেয়ার করো।’
তানভীর বলেন, ‘বলো, আমাদের রক্ষা করো। পৃথিবীতে আগের মতো আমাদের সুখ ফিরিয়ে দাও।’

রূপকথার দেশে

বিদায় নিতে গিয়ে আইভি আর নীলো দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইল মুনাকে। ইমন সতর্ক করে, ‘নো আন্টি, নট অ্যাট অল।’
সত্যিই তো আমরা আগের মতো একে অপরকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতে পারি না। তিন বন্ধুই সরে গেলো দূরে। পিছিয়ে গেল তিনজন। কেউ খেয়াল করলো না।
শুধু মেঘমালা দেখলো, মায়েদের করুণ মুখ! অপলক তাকিয়ে থেকে চোখের কোলে ওর কান্না জমে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
গাড়িতে উঠে হাত নাড়ে ছোটরা। দাদুভাই রসিকতা করে বলেন, ‘তোদের সুন্দর মুখের পুরোটা দেখতে পেলাম না রে, খুশবু আর মেহেখ দিদিভাই।’
বাড়ি এখন ফাঁকা। সারাদিন কচিকাঁচাদের হৈচৈ, সিঁড়ি ভাঙার আওয়াজে সেগুনবাগিচার বাড়িটি নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো। এবার নীরব হয়ে গেছে আগের মতো।
সারা বাড়ি জুড়ে এখন কেক-চকোলেট আর পায়েসের মনকাড়া মিষ্টি গন্ধ। এখানে ওখানে দুলছে রঙিন কাগজের শিকল আর নানা রঙের বেলুন। বন্ধুরা চলে গেছে বলে ওদের মন ফাঁকা হয়ে আছে। বড্ড একা একা লাগছে।
দাদুভাইয়ের দু’আঙুল ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওরা ছাদে ওঠে। টবের ফুল থেকে বাতাসে মিশে আছে ফুলের গন্ধ। খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। খইয়ের মতো অনেক তারা। দাদুভাই বলতে থাকেন, ‘ন্যাচার ইজ নো বিউটিফুল। প্রকৃতি আমাদের ডাকে না। আমরাই প্রকৃতির কাছে চলে যাই। মুগ্ধ হয়ে চাঁদ তারা দেখি। গোলাপ-জুঁই-দোলনচাঁপা ফোটে, কিন্তু ওরা তো ডেকে বলে না, তোমরা আমাদের কাছে এসো। ওদের মিষ্ট গন্ধে আমরাই ছুটে যাই। চাঁদ বলে না, দ্যাখো- আমি দুধের বাটির মতো গোল হয়ে উঠিনি? আহ, কক্ষণও বলে না এ কথা। খইয়ের মতো তারারা কি ডেকে কিছু বলে? ওরা এতো ভালো! ফুুল গন্ধ ছড়ায়, চাঁদ সোনালি আলো দেয়, অথচ আমরা ন্যাচারকে কষ্ট দিয়েছি।’
ইমন জিজ্ঞেস করে, ‘কি করে দাদু?’
‘করিনি? কোদাল দিয়ে যার যার প্রয়োজনে মাটি কেটেছি, গাছ কেটেছি, গাছ তো আকসার কাটা হচ্ছে। খাল-বিল-নদী-পুকুর ভরাট করে ইয়া বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করছি। প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে।’
ঝুমঝুম কথার রেশ ধরে বলে, ‘মিমিদের বাড়ির সামনে কামরাঙা আর হরিতকির গাছ ছিল- তাই না রে ইমু?’
‘হ্যাঁ দিদি। ফ্ল্যাট বাড়ি করার সময় ওদের অনেকগুলো গাছ কাটা পড়েছে।’
ঝুমঝুম বলে, ‘কাক-চড়–ই পাখিদের এখন আর দেখতে পাই না। ন্যাচার এখন রিভেনজ নিচ্ছে, তাই না দাদু?’
দাদুভাই খুব খুশি খুশি গলায় বলতে থাকেন, ‘টিভিতে দেখালো- সমুদ্রের তীরে লাল কাঁকড়াগুলো হাঁটছে, বাচ্চা কচ্ছপগুলো কী ম্যারাথন দৌড় দিচ্ছে। লকডাউন চলছে। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাচ্ছে না। চারপাশ স্বচ্ছ, গাড়ির কালো ধোঁয়া নেই। ফুলেরা দ্যাখো মাথা দুলিয়ে কী চমৎকার করেই না হাসছে। যেন বলছে, দ্যাখো হে মানবজাতি, কেমন লাগে এখন তোমাদের! দাদু অদ্ভুত সুন্দর করে কথাগুলো বলতে থাকেন। ঝুমঝুম আর ইমন দু’চোখ ভরে দেখতে থাকে দাদুভাইকে। বরাবরই তিনি ওরকম। সাধারণ কথা বলেন, অথচ অপলক তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, মন দিয়ে।’
বলেন, ‘তোমরা সাদামাটা জীবনযাপন করবে, উন্নত কিছু ভাববে। প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিঙ্কিং।’
‘এই দিদি, সাদামাটা মানেটা কী?’
‘সিম্পল থাকা।’
‘উন্নত ভাবনা! বাবা, কী ডিফিকাল্ট ওয়ার্ড বলেন দাদুভাই।’
‘শুনতে পাসনি? দাদুভাই তো বলে দিল- হাই থিঙ্কিং।’
ঝুমঝুম নিমগাছের চিরল পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। হাওয়ার সাথে পাতাগুলো সরসর আওয়াজে কথা বলছে।
দাদুভাই বলেন, ‘আমাদের বাড়ি যেমন আছে তেমনই থাকবে। বাড়ি আমি প্রোমোটারের হাতে দেবো না। ঝুমি আর ইমু গাছপালা দেখে বড় হবে না, এও কি হয়? দে উইল গ্রোন আপ উইদাউট ন্যাচার? নো নো! ইট কান্ট বি। এমন হতেই পারে না।’
ঘুঘুর ঘু ঘুঘুর ঘু- অচেনা এক সুরে পাখি ডেকে ওঠে।
খুশিতে দাদু বলে ওঠেন- ‘ঘুঘু ডাকছে রে। ঘুঘুর ডাক অনেকদিন শুনিনি। আনন্দে রাতেও ডেকে উঠেছে।’
ইমু বলে, ‘গুলতি মেরে দুষ্টু ছেলেরা পাখিদের তাড়িয়ে দেয় দাদুভাই।’
‘ওহ সো স্যাড!’
সুদীপ বলেন, ‘এবার চলো।’
ছাদের রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ঝুমঝুম। গলির শেষ মাথা থেকে এক রিকশাওয়ালা আসছে। সওয়ারি নেই, ফাঁকা রিকশা। ক্লান্ত একটি মানুষ।
কে রিকশায় চড়বে এখন? অজগরের পিঠের মতো ছড়ানো রাস্তায় মানুষজন নেই।
পাপা আর মা উঠে এসেছেন ছাদে।
‘কি রে চল, ঘুমোবি না?’
ঝুমঝুম বলে, দেখতে পাচ্ছো মা, ওই রিকশায় কেউ নেই। রাস্তা একেবারে ফাঁকা।
মুনা বলেন, ‘সময়টা যে বড্ড খারাপ মা। কোভিড ভাইরাসের জন্য সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। এটা তো হার্ড টাইমস মামণি।’
ঝুমঝুম করুণ সুরে বলতে থাকে, ‘ওর রিকশায় কেউ তো চড়ছে না মা, তাহলে তো ও চাল-ডাল-মাছ কিছুই নিয়ে যেতে পারবে না বাড়িতে। রাতে ওরা কি খাবে মা? উপোস করবে? ঝুমঝুমের এই প্রশ্নটি মা-বাবা-দাদুভাইয়ের বুকের ভেতরে গিয়ে বিঁধে।’
পাপা প্রায়ই বলেন, ‘ঝুমঝুম হ্যাজ অ্যা গোল্ডেন হার্ট। সোনার হৃদয় তার।’
মুনা মাঝে মাঝে বলেন, ‘আমার মেয়েটা খুব পরিণত।’
দাদুভাইও বলেন, ‘তুমি সত্যিই বলেছ মুনা, সবে এগারো বছর বয়স, অথচ কী ম্যাচিওরিটি।’

একটা নয়, দুটো খালি রিকশা গলি দিয়ে আসছে, হয়তো বড় রাস্তায় যাবে।
ইমন চেঁচিয়ে ডাকে, ‘ও রিকশাওয়ালা ভাই, এই বাড়িতে আসুন তো।’
দাদুভাইও ডাকেন, ‘আরে এসো এসো, গেট খুলে ঢুকে পড়ো।’
দারোয়ান গেট খুলে দিলে রিকশা দু’টো নিয়ে ওরা ভেতরে ঢোকে। বোকার মতো চারদিকে তাকায়।
ছাদ থেকে নেমে আসে সবাই।
ফুলবাগানের মাঝখানে দু’টি মোড়া দেয় ইমন।
‘বসো বসো রিকশাওয়ালা ভাই।’
ওরা ফ্যালফ্যাল করে বাড়ির চারপাশটা দেখে। সবার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকায়।
ঝুমঝুম বলে, ‘আজকে অনেক খাবার রয়ে গেছে মা। ওদের দু’জনকে ভাগ করে দাও না প্লিজ।’
মুনা দুটো প্লেটে সবকিছু গুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘ভালোই হলো রে, জন্মদিনে অচেনা দু’জনকে খাবার দেবার সুযোগ পেয়েছি। এমন ভাগ্য সবার হয় না।’
খাবার দেখে দু’জন তো তাজ্জব। মাছ-মুরগি-চিংড়িমাছ, এও কি হতে পারে?
দাদু ভাবতে থাকেন, ‘পেন্ডামিক সময়টাতে মানুষের রোজগার তো তেমন নেই। পেট ভরে খাক ওরা।’ বুকের ভেতরটা আনন্দে ভরে যায় তার।
পাপা বলেন, ‘খাও খাও, পেট ভরে খাও।’
ইমন ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মাই গড, দিদির বার্থডেটা কী চমৎকারই না কাটলো!’
ফ্রায়েড রাইস দিয়ে ইলিশ ভাজা, চিংড়ির মালাইকারি, চিকেন চাপ, মাটন রেজালা, আলাদা করে মেখে খেতে থাকে দু’জন। পেটে বড্ড খিদে। সারাদিনে হয়তো চা-বিস্কিট ছাড়া তেমন কিছু খাওয়াই হয়নি।
রিকশা টেনে টেনে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিলেও ওদের কপালে জোটে কত বকুনি। ঠিকঠাক টাকাও সবসময় পায় না। কোটরে ঢোকা দু’টি চোখে কান্নার দানাগুলো চিকচিক করে ওঠে। ঝুমঝুমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
দাদুভাই বলেন, ‘আমার নাতনির জন্ম হয়েছিলো এই দিনে। পেট ভরে তোমরা খাও, দু’টো নাতি-নাতনিকে শুধু দোয়া করো।’
মুনা বলে, ‘তোমরা পেট ভরে খাও তো। ছেলেপুলেদের জন্য প্যাক করে দেব।’
খাবারের সাথে কেক-চকোলেটও দিয়ে দেয়।
মুনা বলে, ‘ছেলেপুলেদের ভাগ করে দিও- কেমন!’
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ওরা বাড়ির মানুষদের দিকে। এমনও হয়, না হতে পারে?
ভেজা চোখে রিকশার প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলতে থাকে, ‘আম্মাগো, এমুন মানুষ কুনুদিনও দেহি নাই।’
দাদু বলেন, ‘তোমরা শুধু দোয়া করো।’
‘আমরা কুনুদিনও এই রাইতটারে ভুলুম না সাহেব।’
আনন্দের অশ্রু বুঝি এমনই হয়, খেটে খাওয়া দু’টি মানুষের তামাটে গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরতে থাকে।
এমন চমৎকার বার্থডে আগে কখনও আসেনি।
ইমন মৃদু স্বরে ডাকে, ‘ঘুমোলি দিদি?’
‘না রে ইমু। জানিস আমি ভাবছি, বাড়িতে ফিরে ওরা যখন কেক-চকোলেট-খাবার ভাগ করে দেবে- কী আনন্দ হবে। ওদের বাচ্চারা কত খুশি হবে বল।’
মুনা তানপুরা নিয়ে বসেছে। দরবারি রাগে সুর ধরেছে। মন ভালো থাকলে মা তারপুরা নিয়ে বসেন। সুরের জাদুতে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে ঝুমঝমের। ইমন বকবক করেই চলেছে।
‘দাদুভাই ঘুমোবার আগে রোজ আমাদের বলে, সুইট ড্রিম দেখবে।’ মিষ্টি স্বপ্ন দেখব সারারাত।
কাচের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ছলকে পড়ছে চাঁদের আলো। আজ কী মিরাকল হয়ে গেল। মন খারাপের বিষণœ দিনেও ম্যাজিকের মতো চলে এলো মুঠো মুঠো আনন্দ! এমন করেই প্রজাপতির মতো হঠাৎ করে ছুটে আসবে চমৎকার দিন।
করোনাভাইরাস হঠাৎ করেই দূরে বহুদূরে পালিয়ে যাবে। ঝনঝন করে দারোয়ান খুলে দেবে ইশকুলের বিশাল গেট। ড্রেস পরে ছোটরা ছুটবে স্কুলের দিকে। অনলাইন পড়াশোনার কথা বেমালুম ভুলে যাবে ছোটরা।
পেন্ডামিক এই সময়ে সবাই বুঝতে পেরেছে, এমন কিছু করা উচিত নয় মানুষের, যাতে ন্যাচারকে রিভেনজ্ নিতে হয়। দাদুভাই কথাটি প্রায়ই বলেন।
জানালা দিয়ে আসছে ফুলের গন্ধমাখা হাওয়া। দিদার বলা রূপকথার গল্পের মতো মনে হচ্ছে- ¯িœগ্ধ নীল আলো জ্বালা এই ঘরটিকে।
এমনই করে আবার র্ফিরে আসবে হাসি খুশি মাখা দিন। রিনিরিনি বৃষ্টি হলে ইশকুলে রেনিডে’র ছুটি হয়ে যাবে। মায়ের সাথে গোল্লাছুট খেলার মতো ছুট ছুট করে ইশকুলে যাওয়া। টিফিন বক্স খুলে বন্ধুদের সাথে কাড়াকাড়ি করে খাওয়া। পুডিং আর পাস্তা খেয়ে বলবে- ইয়ামি ইয়ামি।
মা বলে, রাত যত গভীর হয়, বুকের ভেতরে কান্না নিয়ে আসে দরবারি রাগ। সত্যি, ঝুমির বুকের ভেতরটা কাঁদছে গুনগুনিয়ে। বিন্দু বিন্দু ঘুম নেমে এসেছিল ইমনের চোখের পাতায়। মায়ের সুরের ছোঁয়ায়, দু’জন রিকশাচালককে খাবার দেবার আনন্দে বিছানায় বসে থাকে ইমন। আজকের রাত ম্যাজিকের রাত।
‘লেট আস সেলিব্রেট দিজ ফ্যানটাসটিক নাইট।’
ইমন গেয়ে উঠে জাস্টিন বিবারের গান-

Ooh, ooh,
Across the ocean, across the sea

Over the mountains, across the sky
Need to see your face.

ছুটে আসে মুনা আর সুমিত। পাপা ছেলেমেয়ের সাথে গান ধরলেন :
Cause everything gonna be alright, ai ai ai
Be alright, ai ai ai aight
মুনা ঝুমি আর ইমুকে জড়িয়ে ধরে গায় :
Through the sorrow
And the fights
Don’t you worry
Cause everything’s gonna be alright, ai ai ai

রাত বাড়ে, চাঁদ হাসে। চমৎকার সময় কাটে। সুরে সুরে সময় কেটে যেতে থাকে। পাপা বলেন, ‘এবার ঘুমোতে যাও। রাত অনেক হলো।’ মুনা দু’জনের বিছানা টানটান করে পেতে, মশারি গুঁজে বলে, ‘এবার যাই, ঝুমঝুম-ইমু। শুভরাত্রি।’
দরজা ভেজিয়ে দেন পাপা।
চাঁদের আলো শরীরে মেখে দু’জন গুনগুন করে-
Through the sorrow, and the fight, Don’t you worry…
ঘুম নেমে আসছে। দাদুভাইয়ের কথা ঝমঝম করে কানে বাজে- ‘সুইট ড্রিম, দিদিভাই।’
টলটলে জোছনায় রূপকথার মতো সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে থাকে মেঘমালা।

Share.

মন্তব্য করুন