ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম। সেই গ্রামের শেষপ্রান্তে রায় চৌধুরীদের জমিদারবাড়ি। সেই বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। তাই সারাটা বাড়ি চেনা-অচেনা গাছ আর ঝোপঝাড়ে ছেয়ে আছে।
জমিদারবাড়ির পেছনে একটা ঝিল রয়েছে। হয়তো কোনো এক সময় সেখানে পদ্মফুল ফুটতো, তাই ঝিলটাকে সবাই পদ্মঝিল নামে ডাকে। কিন্তু এখন পদ্মঝিলে একটাও পদ্ম ফুল নেই। আছে শুধু কচুরিপানা।
পদ্মঝিলকে ঘিরে যে কতো কচুগাছ হয়েছে, তার হিসাব জানা নেই। কচুগাছ হতে হতে সেখানে ছোটখাটো একটা কচু বনই হয়ে গেছে। সেই বনে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আর ব্যাঙ বাস করে। ব্যাঙদের ভেতর ঘ্যাগো একজন। বাবা-মায়ের সঙ্গে বড়ো একটা কচুগাছের নিচে থাকে সে।
ঘ্যাগো খুব ছোট ব্যাঙ। বয়স কম। বাবা-মা তাই ওকে একা একা কোথাও যেতে দেয় না। কিন্তু ঘ্যাগোর খুব ইচ্ছে করে চারপাশটা ঘুরে দেখতে। ঘ্যাগো ভাবে, এ পৃথিবীটা নিশ্চয়ই কচু বনের মতো এতো ছোট নয়। নিশ্চয়ই ব্যাঙ ছাড়াও আরো অনেক প্রাণী আছে এই পৃথিবীতে। সে সব দেখতে কেমন? কাকে জিজ্ঞেস করলে এ প্রশ্নের জবাব পাবো? মাকে জিজ্ঞেস করবো? মাকে তো একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম কচু বনের ওপাশে কি আছে। মা বলেছিলো, এতো কিছু যে, বলে শেষ করা যাবে না।
আসলে কি জানিস? এ পৃথিবীটা অনেক বড়ো। কোনো ব্যাঙ জন্মের পর থেকে পৃথিবী দেখা শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত দেখে গেলেও পৃথিবী শেষ হবে না।
: ওরে বাবা! তাহলে তো এ পৃথিবীটা কচু বনের চেয়ে বড়ো।
মা, আমি এই পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখবো। মানা করবে না প্লিজ।
আবদার ঝরে পড়েছিলো ঘ্যাগোর কণ্ঠে। আর তা শুনে মা ঘ্যাগোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, একা একা পৃথিবী ঘুরে দেখতে পারবি না বাছা। হাজারটা বিপদ ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে। না বাবা, তোকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।
মাকে রাজি করাতে না পেরে ঘ্যাগো ঠিক করলো কথাটা সে বাবাকে বলবে। সেদিন দুপুরে বাবা কচুগাছের নিচে আসতেই ঘ্যাগো বললো, বাবা তুমি কোথা থেকে এলে?
বাবা বললো আমি পদ্মঝিল ডোবাতে গিয়েছিলাম।
বাবার কথা শুনে ঘ্যাগো বললো, আমিও পদ্মঝিলে ডোবাতে যাবো।
ঘ্যাগোর কথায় বাবা রাজি হলো না। সে বললো, এখন না। বড়ো হওয়ার পরে যতো ইচ্ছে ডোবাডুবি করিস।
যে বাবা পদ্মঝিলে ডোবাতে দিতে চায় না, সে যে পৃথিবী ঘুরে দেখতে দেবে না- এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি ঘ্যাগোর ছিলো। তাই ঘ্যাগো আর কথা বাড়ালো না। মন খারাপ করে বসে রইলো।

দুই.

কয়েক দিন থেকেই ভ্যাপসা গরমে সবাই অতিষ্ঠ ছিলো। বাবা-মা ঘ্যাগোকে পদ্মঝিলে নেমে ডুবোতে দেয় না। এ কারণে ঘ্যাগোর শরীর তেতে থাকে। আজ মনে হচ্ছিলো গরমে ঘ্যাগোর দম বন্ধ হয়ে যাবে। তবে তেমন খারাপ সময় আসার আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো।
মাত্র পনেরো দিন আগে ঘ্যাগোর জন্ম হয়েছে। জন্মের পর থেকে ভ্যাপসা গরমের মাঝেই ঘ্যাগোর দিন কেটেছে। আজ যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো, ঘ্যাগোর ছোট্ট শরীরটা ভিজে জবজবে হলো, ঘ্যাগো তখন ভীষণ অবাক হলো।
মা ব্যাঙ কচু পাতার নিচে বসে চোখ বুজে ঝিমোচ্ছিলো। ঘ্যাগো মাকে বললো, মা গো! এই যে আকাশ থেকে ঝিরঝির করে পানি পড়ছে, এরও তো একটা নাম আছে, তাই না?
মা ব্যাঙ বললো, হ্যাঁ, নাম তো আছেই। এর নাম বৃষ্টি।
: বৃষ্টি? বাহ্! কি সুন্দর নাম! আচ্ছা মা, বৃষ্টিরা কি আকাশে থাকে?
মা ব্যাঙ বললো, হ্যাঁ। প্রথমে ওরা মেঘ সেজে আকাশে ঘুরে বেড়ায়। তারপর বৃষ্টি হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। সেই পানি গড়িয়ে গড়িয়ে খাল বিল পুকুর আর নদীতে গিয়ে পড়ে। তখন খাল বিল পুকুর আর নদী পানিতে পানিতে থইথই করে। তারপর পানি চলে যায় সমুদ্রে।
ঘ্যাগো বললো, বাহ্, বৃষ্টির পানির কি মজা! কোথা থেকে কোথায় ঘুরে বেড়ায় পানিগুলো। জীবনে এই প্রথম আমি বৃষ্টি দেখলাম।
মা ব্যাঙ বললো, হ্যাঁ। তোর জন্মের পর আজই প্রথম বৃষ্টি নামলো।
: আগে নামেনি কেনো?
: নামেনি। কারণ নামার উপায় ছিলো না।
: উপায় ছিলো না কেনো, মা? বৃষ্টির বাবা-মা নিষেধ করেছে?
ঘ্যাগো ড্যাবড্যাবে চোখে মায়ের দিকে তাকালো। ছেলের কথা শুনে মা ব্যাঙ হেসে ফেললো। সে বললো, কি যে বলিস! বৃষ্টির বাবা-মা আছে নাকি যে নিষেধ করবে! আসলে সবাইকেই নিয়ম মেনে চলতে হয়। এখন আষাঢ় মাস। এখন মাঝে মাঝেই বৃষ্টি নামবে। বৈশাখে হবে কালবৈশাখী।
: ওরে বাবা! ওটা আবার কি?
কালবৈশাখী কি, ঘ্যাগো তা জানে না, তবুও কোন্ এক অজানা ভয়ে সে আঁতকে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে মা ব্যাঙ বললো, বৈশাখ মাসে ঝড় আর বৃষ্টি একসঙ্গে নেমে আসে। বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম করে আর ঝোড়ো বাতাস বহে শনশন করে। তখন সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
: তার মানে, কালবৈশাখীর চেয়ে বৃষ্টি অনেক ভালো। তাই না মা?
: অনেকটা তাই।
: অনেকটা না মা- পুরোপুরি তাই। বৃষ্টি ভালো বলেই তো বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটা চনমন করে উঠেছে? আমার এখন ঘুরে ঘুরে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। তো মা, একটা গান গাই?
মা ব্যাঙ বললো, গা। তবে সুর-তাল ঠিক রেখে গাইবি।
: আচ্ছা। চেষ্টা করবো ঠিক রেখে গাইতে।
এ কথা বলে ঘ্যাগ্ ঘ্যাগ্ করে ঘ্যাগো গেয়ে চললো:
আয় বৃষ্টি আয়
চড়ে মেঘের নায়,
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং
আমি ছোট ব্যাঙ।
আয় বৃষ্টি আয়
বেলা বয়ে যায়।
আমি ছোট ব্যাঙ।
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং…
ঘ্যাগো গান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটলো। পদ্মঝিলের চারপাশে যতো ব্যাঙ ছিলো, ওরাও ঘ্যাসঘেসে কণ্ঠে ঘ্যাগোর সঙ্গে কণ্ঠ মিলালো। ফলে যা হবার তাই হলো- ঘাবড়ে গিয়ে ঘ্যাগো থেমে গেলো।
মা ব্যাঙ বললো, থামলি কেনো?
ঘ্যাগো ফিসফিস করে বললো, গান গাইছিলাম আমি- এখন গাইছে সবাই। ওরা কারা?
মা ব্যাঙ কান খাড়া করে একটু শুনে নিলো। তারপর বললো, ওরা তোর খালা, ফুপু আর চাচী। অবশ্য তোর মামারাও আছে ওদের সঙ্গে।
: মামা শব্দটা মায়ের মতো। মামা কাকে বলে?
মা ব্যাঙ বললো, মায়ের ভাইকে মামা বলে। বোনের বাচ্চাদের জন্যে ওদের মনে খুব মায়া থাকে। তাই তো রোজ ভোরে ঝিলের ওপার থেকে জিজ্ঞেস করে, ব্যাঙুদি! আমার ভাগনে কেমন আছে?
: তাই? আহা রে, মামাদের মনে কতো মায়া! মা, আমি পদ্মঝিলের ওপারে যাই? মামাদের দেখে আসি?
মা ব্যাঙ বললো, না বাছা, এখন না। এখনো বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো শক্তি হয়নি তোর। পদ্মঝিলে সাপ আছে। ব্যাঙ পেলেই গপ্ করে গিলে খায়। তোকে খেয়ে ফেলবে।
ঘ্যাগো বললো, গিলে খেতে চাইলেই হলো? আমি ত্রিং করে লাফ মেরে অনেক দূর চলে যাবো।
মা ব্যাঙ বললো, লাফ মেরে যেতে পারলে তো ভালোই হতো। কিন্তু সাপের সামনে পড়লে ব্যাঙরা লাফ-ঝাঁপ ভুলে যায়। সেই সুযোগে সাপেরা ব্যাঙদের গিলে খায়।
ঘ্যাগো বললো, ওরে বাবা! তাহলে আমি একা যাবো না। তুমিও চলো আমার সঙ্গে।
মা ব্যাঙ বললো, তোর বাবা বাসায় নেই। তাকে জিজ্ঞেস না করে ওপারে যাবো না।
: যাবে না? তাহলে আমি যাই।
আমি যাই বলেই ঘ্যাগো এক লাফে পদ্মঝিলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

তিন.

অনেক দিন আগে মা যখন ডিম ছেড়েছিলো তখন ডোবার পানিতেই ঘ্যাগোর জন্ম হয়েছে। তবে বড়ো হবার পর এই প্রথম পানিতে নামা। তাতে অবশ্য ঘ্যাগোর কোনো সমস্যা হলো না। সাঁতরাতে সাঁতরাতে সে পদ্মঝিলের মাঝামাঝি চলে এলো। আর তার পরপরই একটা নতুন দৃশ্য ওর চোখে পড়লো। ঘ্যাগো দেখলো কচুপাতার মতো সবুজ, চকচকে সুন্দর লিকলিকে শরীরঅলা একটা প্রাণী সাঁতরে সাঁতরে ওর দিকে আসছে।
ঘ্যাগো মায়ের কাছে সাপদের অনেক বদনাম শুনেছে। কিন্তু কোনো সাপকে দেখেনি। তাই ওটা যে সাপ, ঘ্যাগো তা বুঝতে পারলো না। বরং সাপটার রং দেখে সে মুগ্ধ হলো। ঝিলের মাঝখানে থেমে গিয়ে সাপটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
এক সময় সাপ কাছাকাছি এলো। তখন ঘ্যাগো সাপের মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? কি সুন্দর চকচকে লিকলিকে শরীর তোমার! কী নাম তোমার ভাই?
একটা ব্যাঙের বাচ্চাকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে দেখে সাপটা রীতিমতো হকচকিয়ে গেলো। যা কখনো শোনেনি, যা কখনো কোনো সাপের জীবনে ঘটেনি, তাই ঘটে গেছে আজ- ব্যাঙের ছেলে সাপের সঙ্গে কথা বলেছে। সাপটা তো হকচকিয়ে যাবেই।
সাপ এতোটাই অবাক হলো যে, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। সে বোকার মতো ঘ্যাগোর দিকে তাকিয়ে রইলো।
সাপের কাণ্ড দেখে ঘ্যাগোর রাগ হলো। ঘ্যাগো চেঁচিয়ে বললো, নাম কি তোমার? কোন্ জাতের প্রাণী। পেশা কি- এসব বলো।
সাপ বললো, আচ্ছা বলছি। আমার নাম হিস্হিস্। জাতিতে সাপ। বংশে গোখরো। পেশা ব্যাঙ ধরে খাওয়া।
: এ পৃথিবীর যতো পেশা আছে, এটা হলো তার মাঝে সবচেয়ে বাজে পেশা।
মুখ বাঁকিয়ে ঘ্যাগো বললো। আর ওর কথা শুনে রীতিমতো অবাক হলো হিস্হিস্। একটা ব্যাঙের বাচ্চা। সে তাকে ভয় তো পাচ্ছেই না, উল্টো তুচ্ছ করে কথা বলছে- এ কেমন কথা?
হিস্হিস্ বললো, আমার পেশাকে বাজে বলবে না। তোমার পেশা কি?
ঘ্যাগো বললো, আমার কোনো পেশা নেই। সম্ভবত ব্যাঙদের কোনো পেশার দরকার হয় না।
: তাই? তোমার নাম কি বলো তো?
: আমার নাম ঘ্যাগো। জাতিতে ব্যাঙ।
হিসহিস বললো, আমাকে আর ব্যাঙ চেনাতে হবে না। দিনে তেরোটা ব্যাঙ খেতে হয় আমাকে। এখন পর্যন্ত সাতটা খেয়েছি। আরো ছয়টাকে খাবো।
: তাই?
: হুম। এখন আমি ব্যাঙ ধরবো আর খাবো- খাবো আর ধরবো। আচ্ছা, এসব শুনে তোমার ভয় লাগছে না?
কথাটা বলে হিসহিস পিটপিট করে ঘ্যাগোর দিকে তাকালো। তবে ঘ্যাগো ভয় না পেয়ে বললো, ভয় লাগবে কেনো? তোমার কাজ তুমি করবে- আমার কাজ আমি করবো।
: তোমার কি কাজ?
: আমার কাজ হলো পালিয়ে বাঁচা। তুমি যখন আমাকে ধরতে চাইবে, আমি তখন লাফ মেরে দূরে সরে যাবো। জানো তো, ব্যাঙরা খুব ভালো লাফাতে পারে।
ঘ্যাগোর কথা শুনে হিসহিস ফ্যাসফ্যাস করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, তুমি বললে ব্যাঙরা লাফাতে পারে! কই, এ জীবনে তো কোনো ব্যাঙকে লাফাতে দেখিনি! এই যে তোমার সাথে কথা বলছি, কেনো যে এখনও তোমাকে গিলে খাচ্ছি না, আমি তা ভেবে পাচ্ছি না!
: আমি ভেবে পাচ্ছি। আসলে তুমি নিজেকে যতোটা হিং¯্র ভাবো ততোটা হিং¯্র নও। আর কি সুন্দর এঁকেবেঁকে সাঁতার কাটো! হাত নেই পা নেই, অথচ সাঁইসাঁই করে ছুটে চলা- এ কি চারটিখানি কথা?
ঘ্যাগোর মুখ থেকে ঝুরঝুর করে প্রশংসা ঝরে পড়লো। সেই প্রশংসা হিসহিসের মন থেকে সব হিংসা মুছিয়ে দিলো। হিসহিস জিজ্ঞেস করলো, সত্যিই কি আমি খুব সুন্দর? সত্যিই কি আমার সাঁতার কাটা তোমার ভালো লেগেছে?
ঘ্যাগো বললো, এতো ভালো লেগেছে যে, আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার বন্ধু হয়ে যাই।
ঘ্যাগোর কথা শুনে হিসহিস মুগ্ধ হলো। সে ভাবলো, সাপ-ব্যাঙ মুখোমুখি হওয়ার পরও সাপে ব্যাঙ খায়নি- এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটলো। আবার জন্মের শত্রু সাপকে ব্যাঙের প্রশংসা করা- এটাও প্রথম ঘটলো। আর সব চেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হলো, পুঁচকে ব্যাঙটা সাত ফুট লম্বা সাপটার বন্ধু হতে চাইছে! দুজন দুজনার যদি বন্ধু হতে পারে, তবে একটা ভালো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা যাবে।
এসব ভেবে হিসহিস বললো, সত্যিই যদি তুমি আমার বন্ধু হতে চাও, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। তো বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় যাচ্ছো?
ঘ্যাগো বললো, মামাদের কাছে। পদ্মঝিলের ওপারে।
: এখনো বেঁচে-বর্তে আছে তো, না খেয়ে ফেলেছি?
: বেঁচে-বর্তেই আছে। রোজ সকালে আমার খোঁজখবর নেয়।
হিসহিস বললো, তুমি আমার বন্ধু। তাই তোমার চাচা-মামাকেও খাবো না।
ঘ্যাগো বললো, অন্য ব্যাঙদেরও খেও না। তো আমি এবার যাই। ওই যে কচুগাছটা দেখতে পাচ্ছো, ওটার নিচে আমাদের বাসা। মাঝে মধ্যে এসো।
হিসহিস বললো, আসবো। আমিও যাই। আবার দেখা হবে।
এ কথা বলে হিসহিস এগিয়ে চললো। আর ওর ছিপছিপে শরীরটার দিকে ঘ্যাগো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।

চার.

পদ্মঝিলের ওপারে ছোট্ট একটা ঘর ছিলো। এক গরিব চাষি তার বউ আর মেয়েকে নিয়ে সেই ঘরে থাকতো। সেই ঘরের সামনে এসে ঘ্যাগো ভাবলো, আমরা কচুগাছের নিচে থাকি। মামারা ইঁদুরের গর্তে থাকে। চাচারা থাকে কড়ই গাছের খোঁড়লে। আর মানুষেরা থাকে ঘরের ভেতর। কিন্তু কি করে যে তারা এতো উঁচু উঁচু ঘরের ভেতর থাকে, দেখা হয়নি কখনো। ব্যাপারটা একটু দেখা দরকার।
এ কথা ভেবে ঘ্যাগো আর মামাদের বাড়িতে গেলো না। এক চাষির ঘরে ঢুকে পড়লো।
চাষির ঘরের বেড়া ভাঙা আর চাল ফুটো ছিলো। সেই ফুটো দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছিলো। এক ছোট্ট মেয়ে ছোটাছুটি করে ফুটো বরাবর হাঁড়ি-পাতিল পেতে রাখছিলো। কিন্তু সে ঘর ভেজা থামাতে পারছিলো না।
এই দৃশ্য দেখে ঘ্যাগো যেমন মজা পেলো তেমন দুঃখও লাগলো। ঘ্যাগো ভাবলো, মেয়েটার সঙ্গে একটু কথা বললে মানুষদের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারবো।
থপ্থপ্ করে লাফ মেরে ঘ্যাগো মেয়েটির পায়ের সামনে গিয়ে থামলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, কি করছো ছোট্ট মেয়ে?
ছোট্ট মেয়েটি তো জানতো না ওর ঘরে ঘ্যাগো ঢুকেছে। তাই চমকে উঠে সে ডানে-বামে তাকালো। তখন দেখলো, একটা ছোট্ট ব্যাঙ ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে! ব্যাঙটা এতো সুন্দর যে, ইচ্ছে হচ্ছে ছুঁয়ে দেখতে।
ছোট্ট মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে গো?
ঘ্যাগো বললো, আমি এক ছেলে ব্যাঙ। আমার নাম ঘ্যাগো। তোমার নাম কি?
ছোট্ট মেয়ে বললো, আমার নাম পরী। এই ঘরে বাবা আর মায়ের সঙ্গে থাকি। মা রান্নাঘরে রান্না করছেন আর বাবা কাজে গেছেন। আমি বৃষ্টির পানি আটকাতে চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। সব ভিজে যাচ্ছে।
ঘ্যাগো বললো, বৃষ্টিরা মানুষদের খুব ক্ষতি করে।
পরী বললো, এ কথা ঠিক না। কোনো কোনো সময় বৃষ্টি আমাদের উপকারও করে। শুকনো নদী-নালাগুলো ভরে দেয়। সময় মতো বৃষ্টি না হলে ফসলের খুব ক্ষতি হয়। তাই বৃষ্টির প্রয়োজনও রয়েছে আমাদের জীবনে।
: তাই তো দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। এই বৃষ্টিতে আমার কি করতে ইচ্ছে করছে জানো, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে।
: গান? তুমি গান গাইতে পারো?
ঘ্যাগোর কথা শুনে পরী বিস্ময়ে থ হয়ে গেলো। ওর দিকে তাকিয়ে ঘ্যাগো বললো, গাইবো একটা গান? শুনবে তুমি?
পরী বললো, শুনবো।
পরী গান শুনবে জেনে ঘ্যাগোর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। জীবনে এই প্রথম একজন আগ্রহ নিয়ে ওর গান শুনতে চাইছে- এ কি কম ভাগ্যের কথা?
দ্রুত ভেবে নিয়ে কেশে-টেশে গলা পরিষ্কার করে ঘ্যাগো গান ধরলো:
তেড়েনেড়ে তেড়েনেড়ে
গান গাই গলা ছেড়ে
বৃষ্টিতে সুখ পাই
এ সুখের শেষ নাই-
তেড়েনেড়ে তেড়েনেড়ে
আমাকে দে না ছেড়ে
নাচি আর গান গাই
এ সুখের শেষ নাই- নাই রে…
এ সুখের শেষ নাই নাই রে বলে ঘ্যাগো এমন টান দিলো যে, টানের চোটে ঘ্যাগোর চোখ দুটো বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হলো। ছোট্ট হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ঘ্যাগো বললো, নিজের বানানো গান। কেমন লেগেছে গানটা?
পরী বললো, খু-উ-ব ভালো। ব্যাঙরাও যে গাইতে পারে, আমার তা জানা ছিলো না। তবে তোমার চোখ দুটো যখন উল্টে গিয়েছিলো, তখন ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো চোখ দুটো বেরিয়ে আসবে।
: তুমি মনে হয় জানো না, ব্যাঙদের চোখ অমনই হয়! আচ্ছা পরী, তুমি গান জানো?
পরী বললো, জানি। তবে এখন গাইবো না। কাঁথা-বালিশ ভিজে গেছে। শরীরটাও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে।
: মায়ের কাছে শুনেছি, বৃষ্টিতে ভিজলেই মানুষদের জ্বর হয়। কিন্তু সারাদিন ভিজলেও আমাদের জ্বর হয় না।
খুব গর্বের সঙ্গে কথাটা বললো ঘ্যাগো। আর পরী বললো, আমি জানি, ব্যাঙদের সর্দিও হয় না। তো ঘ্যাগো, পরিচয় যখন হলো, মাঝে মধ্যে এসে বেড়িয়ে যেও।
ঘ্যাগো বললো, হ্যাঁ, আসবো। আমি এখন যাই। মামা-মামীকে দেখার জন্যে মন আনচান করছে।

পাঁচ.

ঘ্যাগো ওর মায়ের কাছে শুধু শুনেছিলো মামা-মামীরা পদ্মঝিলের অন্য পাড়ে থাকে। এর চেয়ে বেশি কিছু শোনেনি। ঘ্যাগোর ধারণা ছিলো পদ্মঝিল পেরিয়ে এপারে এলেই মামাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু ঝিলের পাড় ধরে একটু এগোতেই দেখতে পেলো দলে দলে ব্যাঙ আর ব্যাঙিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের পেছনে পেছনে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে তাদের কাচ্চাবাচ্চারা। এতো ব্যাঙের মাঝ থেকে নিজের মামাদের চিনে বের করবে কেমন করে, কিছুতেই ঘ্যাগোর তা মাথায় এলে না। তাই দিশেহারা ঘ্যাগো সরু পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লো।
সেই পথ দিয়ে লপোঝং টপোঝং করে লাফাতে লাফাতে উঠতি বয়সের সাত-আটটা ব্যাঙ আসছিলো। চোখের পলকে ওরা ঘ্যাগোকে ঘিরে ধরলো। ওদের দলে সবুজ রঙের ব্যাঙটি গুণ্ডাদের মতো চোখ পাকিয়ে ঘ্যাগোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কে রে ট্যাগো? ওকে তো কোনোদিন দেখিনি! ওর নাম-ধাম জিজ্ঞেস র্ক।
ট্যাগো ঘ্যাগোর পেটে খোঁচা দিয়ে বললো, নাম-ধাম, বংশ পরিচয় বল্। এ পাড়ায় ঘুরঘুর করছিস কেনো সে কথাও বল্। কোনো কথা বাদ দিবি না। আমাদের লিডারের মাথায় কিন্তু রক্ত চড়ে গেছে।
ট্যাগোর কথা শুনে সবাই ঘ্যাগঘ্যাগ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে আবার কোনো কোনো ব্যাঙ ঘ্যাগোকে ঘিরে নাচতে লাগলো। এ সব দেখে ঘ্যাগো বললো, তোমরা আমার সঙ্গে এমন করছো কেনো?
সেখানে মোটা একটা ব্যাঙ ছিলো। ঘ্যাগোকে ভেঙিয়ে সে বললো, অন্য পাড়ার ব্যাঙদের সঙ্গে আমরা এমনই করি।
: কিন্তু আমরা তো এমন করি না! অন্য পাড়ার ব্যাঙদের আমরা বসতে দিই, খেতে দিই।
বললো ঘ্যাগো। তা শুনে মোটা ব্যাঙ বললো, তোরা ওসব করিস, কারণ তোরা ব্যাকডেটেড। তুই তো পদ্মঝিলের ওপার থেকে এসেছিস্? কেনো এসেছিস সে কথা বল্।
ঘ্যাগো বললো, মামার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি। তবে মামার নাম-টাম জানি না।
: নাম জানিস না! দেখতে কেমন? আমার মতো মোটা- না তোর মতো শুকনো? নাকি কয়লার মতো কালো?
একের পর এক প্রশ্ন করে চললো একের পর এক ব্যাঙ। এলোমেলো প্রশ্নের সামনে ঘ্যাগোর নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। তাই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।
ছোট্ট একটা ব্যাঙকে অমন করে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে দেখলে যে কারোরই মায়া লাগার কথা। কিন্তু এই দুষ্টু ব্যাঙগুলোর একটুও মায়া লাগলো না। বরং ঘ্যাগোকে কাঁদতে দেখে ওরা তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে লাফাতে ছড়া ধরলো:
এলাটিং বেলাটিং
টেলাটিং টং
পুঁচকে কাঁদছে
কি মজার ঢং!
লামপিং টামপিং
চামপিং টং
ভেউ ভেউ কান্না
কি মজার ঢং!
এমন বিদঘুটে ছড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘ্যাগোর কান্না বেড়ে গেলো। তাই এবার আর ডুকরে নয়, ঘ্যাগো ভ্যাকভ্যাক করে কেঁদে উঠলো।
সেই সময় একটু দূর দিয়ে ঘ্যাগোর সাপ বন্ধু হিসহিস যেনো কোথায় যাচ্ছিলো। যেতে যেতে মাথা তুলতেই সে ঘ্যাগোকে দেখতে পেলো। সে দেখলো, তার বন্ধু অঝোর ধারায় কাঁদছে আর ওকে ঘিরে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে কয়েকটি ব্যাঙ।
ব্যাঙগুলোকে লাফাতে দেখে পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেললো হিসহিস। সে তখন ফণা তুলে তার জিভ বের করে এমন ভাবে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো যে, সেই শব্দ শুনে ব্যাঙগুলো চারদিকে ছিটকে পড়লো। চোখের পলকে জায়গাটা ব্যাঙশূন্য হয়ে গেলো। শুধু কান্না ভেজা চোখ নিয়ে ঘ্যাগো দাঁড়িয়ে রইলো।
ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে কান্না থামিয়ে চোখ মেলে চাইতেই ঘ্যাগো দেখলো ওর পাশে একটাও ব্যাঙ নেই- শুধু ফণা তুলে হিসহিস দাঁড়িয়ে আছে!
ঘ্যাগোকে চোখ মেলতে দেখে হিসহিস বললো, খুব বুঝি জ্বালাতন করছিলো ওই বখাটেগুলো? আহা রে, কেঁদে একেবারে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছো।
ঘ্যাগো বললো, কান্নার জন্য নয়, আমাদের চোখ অমনই- একটু ফোলা ফোলা ড্যাবডেবে। তো তুমি এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছো সাপ বন্ধু?
হিসহিস বললো, খিদে পেয়েছে। খাবারে খোঁজে যাচ্ছি।
: ব্যাঙ ধরতে?
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো ঘ্যাগো। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা পেয়ে হিসহিস বললো, কি যে বলো! তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পরেও ব্যাঙ ধরে খাবো, আমি কী এতোটাই বিবেকহীন? আমি তো ঠিক করেছি এখন থেকে শুধু ইঁদুর-টিদুর খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকবো। কষ্ট করবো কিন্তু ব্যাঙ খাবো না। কারণ চারদিকে তোমার আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে আছে। শেষে কাকে খেয়ে বসবো, তুমি দুঃখ পাবে, তাই।
হিসহিসের কথা শুনে খুব ভালো লাগলো ঘ্যাগোর। ঘ্যাগো বললো, সবাই তোমাকে হিং¯্র বলে গলি দেয়। অথচ তুমি কতো নরম তোমার মন!
হিসহিস বললো, কারো কাছে ভালো ব্যবহার পেলে হিং¯্ররাও ভালো হয়ে যায়। তুমি আমাকে দেখে ভয় পাওনি, আমার রূপের প্রশংসা করেছো, বন্ধু বলে কাছে ডেকে নিয়েছো, সে সব যে আমার কতো ভালো লেগেছে, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। সাপেরাও যে ভালোবাসতে পারে, বন্ধুত্বের মূল্য দেয়ার জন্য খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস বদলাতে পারে- কেউ তা ভাবতেও পারে না। এটা সাপদের জন্য খুব দুঃখের ব্যাপার।
: আর কোনো কোনো সাপ যে ব্যাঙদের দেখলেই তেড়ে আসে- এটা ব্যাঙদের জন্য দুঃখের ব্যাপার।
খুব বুদ্ধি করে নিজেদের সমস্যার কথা জানালো ঘ্যাগো। তা শুনে হিসহিস বললো, তুমি আর আমি মিলে এসব নিয়ম বদলে দেবো। বিশ্বাস করে মনের কথা খুলে বললে, ঘৃণা না করে কাছে টেনে নিলে শত্রুকেও যে বন্ধু বানানো যায়, তুমি আর আমি তা দেখিয়ে দেবো। তো এখন কি করবে? মামাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ঘ্যাগো বললো, না ভাই। তার আগেই বখাটে ব্যাঙগুলো আমাকে ঝেঁকে ধরেছে। সময় মতো তুমি এসে না পড়লে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়তো।
হিসহিস বললো, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। নইলে তুমিই বা এখানে থাকবে কেনো- আমিই বা এখানে আসবো কেনো? তবে ভবিষ্যতে ওই বদমাশগুলো তোমার সাথে আর দুষ্টুমি করতে সাহস পাবে না।
: এ শুধু তোমার জন্য।
খুব তৃপ্তি নিয়ে কথাটা বললো ঘ্যাগো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর কথা ফিরিয়ে দিয়ে হিসহিস বললো, না, তা নয়। আসলে ওরা দুষ্টুমি করতে সাহস পাবে না তোমার আর আমার বন্ধুত্বের জন্য। বুঝলে ঘ্যাগো, মিলেমিশে থাকার সুখই আলাদা।

ছয়.

কচুগাছের নিচে এসে মায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো ঘ্যাগো- এ কি অবস্থা হয়েছে মায়ের? মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে! গালে হাত দিয়ে বসে আছে চোখ বুজে। ব্যাপার কি?
ঘ্যাগো জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে মা? তোমার মন খারাপ?
মা ব্যাঙ নিজের চিন্তায় এতোটাই ডুবে ছিলো যে, ঘ্যাগোর কথা শুনে হাত-পায়ে চমকে উঠলো। তারপর ঘ্যাগোকে দেখে বললো, তোর কথা ভাবছিলাম। এতো বারণ করার পরেও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লি। কতোক্ষণ হয়ে গেছে অথচ ফিরে আসছিস না- এসব ভেবে বুক কাঁপছিলো। এতো দেরি হলো কেনো? মামা-মামী বুঝি ছাড়ছিলো না?
ঘ্যাগো বললো, মামা-মামীর সঙ্গে দেখা হয়নি মা। সময়ই পাইনি। দেরি হয়ে যাচ্ছিলো তাই চলে এলাম।
মা ব্যাঙ অবাক হলো ছেলের কথা শুনে। জিজ্ঞেস করলো, সময় পাসনি কেনো? তাহলে এতোটা সময় কোথায় কাটিয়ে এলি?
ঘ্যাগো বললো, পদ্মঝিলের ওপারে কাটিয়ে এলাম। কতো কিছু দেখেছি! জানো মা, হিসহিসের সাথেও দেখা হয়েছিলো। কি যে ভালো সে! আমাকে গুণ্ডা ব্যাঙদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
মা ব্যাঙ বললো, কে তোকে বাঁচিয়েছে? হিসহিস না কি যেনো বলছিলি, সে আবার কে?
ঘ্যাগো বললো, লিকলিকে ইয়া বড়ো এক সাপ। বংশে গোখরো।
: সা-প! তাও আবার গোখরো? সেই সাপের সামনে পড়েছিলি তুই?
প্রায় চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো মা ব্যাঙ। কিন্তু খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো- শুধু সামনে পড়া বলছো কেনো? সাপের সঙ্গেই তো এতোক্ষণ কাটিয়ে এলাম! হিসহিস খুব ভালো সাপ মা। আলাপ-পরিচয় হলো। বন্ধুত্ব হলো। ঘুরে বেড়ালাম অনেকটা সময়। তাই একটু দেরি হয়ে গেলো।
মা ব্যাঙ বললো, দেরি হোক। তুই সাপের কথা বল্। সাপটা তোকে তেড়ে এসেছিলো?
: না মা, তেড়ে আসেনি। শুধু লাজুক চোখে তাকিয়েছিলো। হিসহিস ব্যাঙ ধরে খায়, তবে অভদ্র নয়। বলেছে এখন থেকে সে আর ব্যাঙ খাবে না। এখন শুধু পোকামাকড়, ইঁদুর আর গিরগিটি খাবে। ওর কথা শুনে আমি প্রশংসা করলাম। ব্যস, বন্ধু হয়ে গেলো। একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে বলেছে।
গড়গড় করে সাপের কথা বললো ঘ্যাগো। আর তা শুনে মা ব্যাঙের ভয়ে রক্ত জমে যাবার মতো অবস্থা হলো। সে বললো, এখানে আসবে বলেছে নাকি?
ঘ্যাগো বললো, বলেছে মা। আজ সময় ছিলো না বলে আসেনি। তবে একদিন এসে সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাবে। কাল ওকে নিয়ে আসবো, মা?
ঘ্যাগোর কথা শুনে মা ব্যাঙ বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলো। ছেলেটার সঙ্গে নাকি সাপটার বন্ধুত্ব হয়েছে। আবার নাকি সে এখানেও আসতে চাইছে! এ কি করে সম্ভব?
মা ব্যাঙ আদুরে গলায় বললো, তোর কথা শুনে আমার খুব ভয় লাগছে বাবা। সাপরা ভয়ঙ্কর প্রাণী। সাবধানে থাকিস।
ঘ্যাগো বললো, তুমি সাপদের যতো খারাপ বলছো, সাপেরা ততোটা খারাপ নয়। একটু আদর করে কথা বললেই ওরা বন্ধু হয়ে যায়। শুনলে না, হিসহিস আমার বন্ধু হয়ে গেছে!
মা ব্যাঙ কণ্ঠে বিরক্তি ঝরিয়ে বললো, শুনলাম তো! কিন্তু সাপের সঙ্গে ব্যাঙের বন্ধুত্ব হয়েছে, কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছি না। ওরা তো ব্যাঙদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
ঘ্যাগো বললো, তোমরা কেউ সাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব করোনি, তাই ওরা শত্রুতা করেছে। এখন থেকে ওরা আর শত্রুতা করবে না।
মা ব্যাঙ বললো, না করলেই ভালো। শত্রুতা আমরাও চাই না। তোর শরীরটা তো এখনো ভিজে আছে। যা, রোদে গিয়ে বোস।
অনেকক্ষণ আগে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিলো, মেঘের আড়াল থেকে রোদ নেমে এসেছিলো। লাফাতে লাফাতে ঘ্যাগো সেই রোদে গিয়ে বসলো।

সাত.

হিসহিসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর নিজেকে ভীষণ সাহসী মনে হলো ঘ্যাগোর। ঘ্যাগো এখন একাকী চলাফেরা করে। দূরে দূরে যায় আর সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করে। আশপাশের ব্যাঙরা তাই ঘ্যাগোকে খুব ভালোবাসে।
একদিন মা-বাবা আর ঘ্যাগো বসে গল্প করছে, এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো! মুহূর্তের মধ্যে কচুগাছের ডগা বেয়ে পানি নেমে এসে গাছের তলাটাকে স্যাঁতস্যাঁতে করে দিলো। কিছুক্ষণ পর কচুপাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি এসে ঘ্যাগোদের ভিজিয়ে দিলো।
বৃষ্টি এলে ব্যাঙরা খুশি হয়। কিন্তু আজ ঘ্যাগোদের মন বিরক্তিতে ছেয়ে গেলো। বাবা ব্যাঙ বললো, কি অলক্ষুণে বৃষ্টি! শুকনো শরীরটা ভিজিয়ে দিলো।
মা ব্যাঙ বললো, এই কচু গাছটার পাতা যেনো দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। এক গাছের নিচে পুরো পরিবারের জায়গা হতে চাইছে না।
বাবা ব্যাঙ বললো, গাছ ছোট হচ্ছে না- ঘ্যাগো বড়ো হচ্ছে। তাই বাসাটা একটু আঁটসাঁট লাগছে।
মা ব্যাঙ বললো, এর পর যখন আরেক জন আসবে, আমাদের বেঙ্গী বউমা, তখন তো একসঙ্গে বসাও যাবে না।
মায়ের কথা শুনে ঘ্যাগো লজ্জা পেলো। মনে মনে ভাবলো, মা খুব দুষ্টু। বাবা এমন নয়।
ঘ্যাগোর ভাবনার মাঝখানেই বাবা ব্যাঙ বললো, ঘ্যাগোকে বিয়ে করিয়ে একটা নতুন বাড়িতে তুলে দেবো। ওরা ওখানে থাকবে। মাঝে মধ্যে এখানে বেড়াতে আসবে- আমরা ওখানে বেড়াতে যাবো। তখন খুব মজা হবে, না রে ঘ্যাগো?
মায়ের কথা শুনে ঘ্যাগো শুধু লজ্জা পেয়েছিলো- বাবার কথায় শুনে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেলো। ঘ্যাগো ভাবলো, বাবাটাও দুষ্ট!
বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছিলো ঘ্যাগো। ফিরে এসে মাকে বললো, মা! তোমাকে একটা কথা বলবো। ভেবে দেখলাম সত্যি সত্যিই আমি বড়ো হচ্ছি। একসঙ্গে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আমি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করলে এ কষ্ট হতো না।
মা ব্যাঙ চোখ বড়ো বড়ো করে ঘ্যাগোর দিকে তাকালো। কিন্তু সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ঘ্যাগো ভয় পেলো না। সে বললো, তোমাকে তো বাবার সাথে থাকতেই হবে। আমিই বরং অন্য কোথাও চলে যাই।
: কোথায়?
মা ব্যাঙ জিজ্ঞেস করলো। ঘ্যাগো বললো, বেশি দূরে নয়। ওই পথটার পাশে শিমুল গাছের পাশে কয়েকটা ঝোপ আছে। ওখানে থাকবো ভাবছি। অবশ্য যদি তোমরা অনুমতি দাও।
মা ব্যাঙ বললো, এতো করে যখন বলছিস তখন তাই হবে। তুই সুখে থাকলেই আমাদের সুখ।

আট.

মা-বাবাকে ছেড়ে এসে ঘ্যাগো যে ঝোপের নিচে বাসা বানিয়েছে- টুনু সেই ঝোপের ডালে থাকে। টুনু এক টুনটুনি পাখি। ঘ্যাগো ঘ্যাগোর ঘ্যাগোর করে কথা বলে আর টুনু বলে টুনটুন করে। দুজনার ভাষা দুজনার বোঝার কথা নয়, তবে ওরা তা বোঝে। বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ইচ্ছে নিয়ে একজন অন্যজনার ভাষা শিখে নিয়েছে। এখন ঘ্যাগো ঘ্যাগোর ঘ্যাগোর করে যা বলে- টুনু তা বোঝে। আবার টুনু টুনটুন করে যা বলে- ঘ্যাগোও তা বোঝে। এতে সুবিধা হয়েছে দুজনারই। অবসর সময়গুলো ওরা গল্প করে কাটাতে পারছে।
আজ সকালে চোখ মেলে প্রথম পাখা ঝাঁপটালো টুনু। তারপর সূর্যের দিকে তাকালো। সূর্যটা আজ তালগাছের মাথার ওপর থেমে আছে। তার মানে আজ টুনুর ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়েছে। ঘ্যাগো দাদা কি চলে গেছে?
টুনু দেখতে পেলো, ঘ্যাগো কোথাও যায়নি। চুপ করে বসে আছে।
টুনু ঘ্যাগোকে চমকে দিয়ে বললো, সুপ্রভাত ঘ্যাগো ভাইয়া- গুডমর্নিং টু ইউ। হাউ আর ইউ? ভালো আছো তো?
ঘ্যাগো উপর দিকে তাকিয়ে দেখলো টুনটুনিটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে কথাটা টুনটুনিই বলেছে।
ঘ্যাগো বললো, হ্যাঁ বোন, ভালো আছি। এই বুঝি ঘুম থেকে উঠলে? আমি কিন্তু অনেক আগেই উঠেছি। সূর্য তখনো ভালো করে ওঠেনি।
টুনু বললো, ব্যাপারটা কি অদ্ভুত ভেবে দেখেছো? দুজনাই আজ উল্টো কাজ করেছি। তুমি ব্যাঙ হয়েও আগে উঠেছো আর আমি পাখি হয়েও পরে উঠেছি। আল্লাহই জানেন দিনটা আজ কেমন যাবে।
ঘ্যাগো বললো, দিন ভালোই যাবে। যারা অন্যের ক্ষতি করে না তাদের দিন কখনো খারাপ যায় না। তুমি খুব ভালো আর সুন্দর পাখি।
: তুমিও খুব সুন্দর ব্যাঙ।
বললো টুনু। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর কথার প্রতিবাদ করে ঘ্যাগো বললো, শুধু তোমার আর আমার সাপ বন্ধু হিসহিসের চোখে আমি সুন্দর। অন্য কেউ তো আমাকে সুন্দর বলে না। কাল দুপুরে যখন পুকুরে সাঁতার কাটছিলাম তখন হাঁসটা কি বলেছে জানো? বলেছে, তুই যেমন ব্যাঙ- তোর চেহারাটাও হয়েছে তেমন ব্যাঙের মতো। কথাটা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছি।
টুনু বললো, ব্যাঙের চেহারা তো ব্যাঙের মতোই হবে। এটা টিপ্পনী কেটে বলার কি আছে!
ঘ্যাগো বললো, জানো টুনু, আমি সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই। কিন্তু অনেকেই আমার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায় না। ওরা বলে, আমি দেখতে নাকি যাচ্ছেতাই।
টুনু বললো, অন্যের কথায় মন খারাপ করো না। আমার কাছে তোমাকে সুন্দর লাগে, তাই তুমি সুন্দর। বাদ দাও এসব কথা। এবার একটা কথার জবাব দাও- আজ কি কোথাও যাবে?
ঘ্যাগো বললো, না, কোথাও যাবো না। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।
টুনু বললো, আমিও কোথাও যাবো না। এসো আমরা গল্প করি। জানো ভাইয়া, একেক সময় তোমাকে হিংসে হয়। কি ভাগ্যবান তুমি! থপ্থপ্ করে লাফাতে পারো। তিড়িংবিড়িং করে ছুটতে পারো। চড়চড় করে গাছে উঠতে পারো আবার সাঁইসাঁই করে সাঁতারও কাটতে পারো। ছোট্ট একটা প্রাণী, অথচ কতো গুণ তোমার! আমি সাঁতার কাটতে পারি না।
ঘ্যাগো বললো, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু গুণ তোমারও কম নেই বোন। কি সুন্দর ডালে ডালে নেচে বেড়াও! কি মিষ্টি সুরে গান গাও! তোমার গান শুনে কলিরা পাপড়ি মেলে ফুল হয়ে যায়। মানুষরা যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়। তারা তন্ময় হয়ে তোমার গান শোনে। সবার ঘুম ভাঙে তোমাদের গানের সুরে সুরে। আর…
: আর? আর কি, বলো? বানিয়ে বানিয়ে শুধু প্রশংসাই করে যাচ্ছো! বন্ধু হয়েছো বলে বুঝি বানিয়ে বলতে হবে?
মিটিমিটি হেসে বললো টুনু। তার জবাব দিতে গিয়ে ঘ্যাগো বললো, একটুও বানিয়ে বলছি না। যা সত্য তাই বলছি। একটা গুণের কথা বাদ আছে এবার সেই কথাটা বলি- তুমি কি সহজ ভাবে হাওয়ায় ভেসে বেড়াও! যখন পাখা মেলে ওড়াউড়ি করো, তখন আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। কি করে হাওয়ায় ভেসে বেড়াও, টুনু?
টুনু বললো, তুমি যেভাবে পানিতে ভেসে বেড়াও- আমিও সেভাবে হাওয়ায় ভেসে বেড়াই।
কথাটা শুনে উচ্ছল হাসিতে ভেঙে পড়লো ঘ্যাগো। হাসতে হাসতে বললো, কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছো? আল্লাহ্ প্রায় সমান সমান ক্ষমতা দিয়েছেন তোমাকে আর আমাকে। তুমি ডালে ডালে লাফাতে পারো- আমি মাঠে-ঘাটে লাফাতে পারি। তুমি সরু কণ্ঠে গাইতে পারো- আমি মোটা কণ্ঠে গাইতে পারি। তুমি আকাশে ভেসে বেড়াও- আমি পানিতে ভেসে বেড়াই।
: ঠিক বলেছো। এই যে পাখি আর ব্যাঙের মিল, সুবিধা-অসুবিধার সমতা- এ থেকে কিন্তু একটা কথা বোঝা যায়, আল্লাহ্ কাউকে কম আর কাউকে বেশি গুণ দিয়ে এ পৃথিবীতে পাঠাননি। যার যা দরকার, তাকে তাই দিয়েছেন।
বুদ্ধিমতীর মতো গুছিয়ে কথাগুলো বললো টুনু। একটু থেমে কি একটা ফলের ওপর কুটকুট করে দুটো ঠোঁকর মেরে সে বললো, পাখির সাথে ব্যাঙের বন্ধুত্ব হয়- এমন কিন্তু হয়নি কখনো। চিঁ…চিঁ…চিঁ..
টুনু আর ঘ্যাগোদের ঝোপের উল্টো দিকে একটা শিমুল গাছ ছিলো। সেই গাছের ডালে বাসা বেঁধে থাকে এক খয়েরি চিল। টুনুর চিঁ…চিঁ হাসির শব্দে সেই চিলটার তন্দ্রা ভেঙে গেলো। অমনি বিরক্তিতে রেগেমেগে নিচের দিকে তাকাতেই টুনুর ওপর ওর চোখ পড়লো। দেখলো টুনু হাসছে আর ঘ্যাগো হাততালি দিয়ে নাচছে!
ঘ্যাগোর সাথে টুনুর বন্ধুত্বটাকে কখ্খনো ভালো চোখে দেখেনি চিল। আজ আবার দুজন মিলে তার ঘুম ভেঙে দিয়েছে, চিলের মেজাজটা তাই সপ্তমে চড়ে গেলে। সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে বললো- এ্যাই নোংরা ডোবার পুঁচকে ব্যাঙ! সাতসকালে চেঁচামেচি করছিস কেনো?
ঘ্যাগো বললো, চেঁচামেচি করছি না। একটু আনন্দ করছি।
চিল বললো, পরের ঘুম নষ্ট করে আনন্দ করা উচিত নয়, তা জানিস?
ঘ্যাগো বললো, জানি। কিন্তু এতো বেলাতেও তুমি ঘুম থেকে ওঠোনি, তা জানতাম না।
ঘ্যাগো এমন মজা করে কথাটা বললো যে, টুনু আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। তাই কিচকিচ করে হেসে উঠলো সে। সেই হাসির শব্দে আবার চিলের মেজাজ বিগড়ে গেলো। চিল বললো, দাঁড়া, ঠোকর মেরে তোদের দেশছাড়া করবো।
ঘ্যাগো বললো, এতো বাহাদুরি দেখাবে না। রেগে গিয়ে আমরাও কিন্তু যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে বসবো।
: কি কাণ্ড ঘটাবি? দাঁড়া, আমি যদি তোর ঠ্যাং ভেঙে দিচ্ছি।
এ কথা বলে চিল ঘ্যাগোকে তাক করে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু ঝাঁপ দেয়ার আগেই টুনু চেঁচিয়ে বললো, সাবধান চিল ভাইয়া। আমার বন্ধুর গায়ে হাত দেবে না। তাহলে আমিও তোমাকে ছেড়ে কথা কইবো না।
ঝাঁপ দেয়ার ঠিক মুহূর্তে টুনুর মুখে এমন কথা শুনে চিল অবাক হলো। প্রথম তো ভেবেই পেলো না ব্যাঙের মতো মাটিছোঁয়া প্রাণীর পক্ষ নিয়ে টুনটুনি কথা বলে কোন্ রুচিতে? পরে প্রশ্নটা টুনটুনিকেই করলো সে- এ্যাই টুনু। কি উদ্ভট রুচি রে তোর? পাখি হয়ে বন্ধুত্ব করেছিস একটা ব্যাঙের সঙ্গে!
টুনু বললো, বন্ধুত্ব করেছি তো কি হয়েছে? বুঝিয়ে বলবে তো!
চিল বললো, তুই বোকা নাকি! কি করে নিজের সম্মান রাখতে হয়, তা জানিস না? ব্যাঙরা হলো নিচু জাতের প্রাণী। নালায় ডোবায় থাকে। আমরা গাছের উঁচু ডালে থাকি আর আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়াই। মাটিছোঁয়া ব্যাঙের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা কি আমাদের মানায়?
টুনু বললো, মেনে নিলেই মানায়। বন্ধুত্ব হয়ে গেলে দুজন দুজনার সমান হয়ে যায়। আর তুমি শুধু ব্যাঙ ব্যাঙ করছো কেনো? ভেবে নাও আমি ব্যাঙের সাথে বন্ধুত্ব করিনি- বন্ধুত্ব করেছি সুন্দর একটা মনের সাথে।
ঘ্যাগো বললো, আর আমি বন্ধুত্ব করেছি মিষ্টি একটা মনের সাথে।
: তাই বলে ব্যাঙে আর পাখিতে বন্ধুত্ব? এ কখনো হয়?
ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলো চিল। তা শুনে টুনু বললো, হবে না কেনো? আমার বন্ধু ঘ্যাগো হিসহিস নামের এক সাপের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করেছে, তা জানো? ঠিক বলিনি ঘ্যাগো ভাইয়া?
ঘ্যাগো বললো, হ্যাঁ, সেই সাপ বন্ধু আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে। যেতে-আসতে আমার খোঁজখবর নেয়। তার চেয়েও বড়ো কথা, হিসহিস অন্য সাপদের বলে দিয়েছে এ এলাকার ব্যাঙদের না খাওয়ার জন্যে। কেউ আর আমাদের খাবে না।
: তাই নাকি? সাপ হয়ে ব্যাঙদের খাবে না- এ কি করে হয়?
ঘ্যাগো বললো, কি করে হয়, কেনো হয়, সে কথা তো বলতে পারবো না। আমি শুধু জানি, বন্ধুত্বের একটা দারুণ শক্তি আছে। মনের মিল থেকে বন্ধুত্ব হয়। আর বন্ধুত্ব হলে ঘোড়া, পাখি, উট, ব্যাঙ সব সমান হয়ে যায়। দেখছো না, টুনু আপু পাখি আর আমি এক ছোট্ট ব্যাঙ। অথচ আমরা কতো ভালো বন্ধু।
: বুঝলাম তোরা ভালো বন্ধু। কিন্তু বন্ধুত্ব করে কি লাভ হয়েছে তোদের?
জিজ্ঞেস করলো চিল। ঘ্যাগো বললো, লাভ তো হয়েছেই। এখন আমরা সুখ-দুঃখের কথা বলে সময় কাটাতে পারছি। বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়াতে পারছি। বন্ধুত্ব করার কারণে আমাদের জীবন সুন্দর হয়ে গেছে।
টুনু বললো, এখন আমরা শুধু নিজের কথা ভাবি না- বন্ধুর কথাও ভাবি। দেখলে না, ঘ্যাগো ভাইয়ার হয়ে তোমাকে কি রকম ধমকে দিলাম? এটা করেছি শুধু ঘ্যাগো আমার বন্ধু বলে।
: বন্ধুর জন্য তুই আমার মতো একটা বড়ো পাখিকে রাগিয়ে তুলতে পারলি?
: পারলাম তো! বন্ধুর জন্য আমি জীবনও দিতে পারি। ঘ্যাগোও আমার জন্য জীবন দিতে পারে, তাই না ঘ্যাগো?
: হ্যাঁ। যে কোনো মুহূর্তে জীবন দিতে পারি।
ঝটপট জবাব দিলো ঘ্যাগো। আর সেই জবাব শুনে গোল হয়ে গেলো চিলের চোখ দুটো। চিল বললো, অবাক হচ্ছি তোমাদের কথা শুনে। কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে এমন ভাবে বদলে যায় জীবন?
টুনু বললো, হ্যাঁ, এমন ভাবেই জীবন বদলে যায়।
টুনুর কথা শুনে কি যেনো ভাবলো চিল। তারপর বললো, আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? মনে র্ক এমন কেউ, যে তোদের সঙ্গে একটু রেগে রেগে কথা বলেছে, সে যদি বন্ধু হতে চায়, তোরা কি তাকে ফিরিয়ে দিবি?
ঘ্যাগো আর টুনু কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললো, বন্ধু হতে চাইলে কাউকে আমরা ফিরিয়ে দেবো না।
চিল বললো, তাহলে আমাকেও তোরা বন্ধু করে নে।
: টুনু বললো, কোনো আপত্তি নেই। যে কেউই আমাদের বন্ধু হতে পারে। তবে…
: তবে কি?
দুরুদুরু বুকে চিল টুনুর দিকে তাকালো। টুনু বললো, বন্ধু আমাদের যে কেউই হতে পারবে। তবে তাকে একটা শর্ত মানতে হবে।
: কি শর্ত?
: শর্ত হলো, যে বন্ধু হবে তাকে মন থেকে হিংসে আর রাগ মুছে ফেলতে হবে।
চিল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, তোদের বন্ধু হবার জন্যে এ শর্ত মেনে নিচ্ছি। কথা দিলাম, আর কাউকে হিংসে করবো না।
: বুঝলাম হিংসে করবে না। চোখ রাঙাবে? ধমক দেবে?
: না না। কারো দিকে চোখ তুলেও তাকাবো না। ধমকও দেবো ন। কথা দিলাম।
প্রায় মরিয়া হয়ে কথাটা বললো চিল। আর তা শুনে মিটিমিটি হাসলো টুনু।
ঘ্যাগো বললো, বন্ধু না হতেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে তোমার। আমাদের বন্ধু হলে আরো বদলে যাবে। আচ্ছা চিল ভাইয়া, তোমার কি কোনো নাম আছে?
চিল বললো, না ভাই, নাম তো নেই। কেনো, বন্ধু হওয়ার জন্য কি একটা নামের খুবই প্রয়োজন?
ঘ্যাগো বললো, চিল, ব্যাঙ, পাখি- এসব হলো একেকটা জাতির পরিচয়। বন্ধুদের কি আর এভাবে ডাকা যায়! বন্ধুদের জন্যে নামের প্রয়োজন হয়। যেমন আমার নাম ঘ্যাগো, টুনটুনি বোনের নাম টুনু আর সাপ বন্ধুর নাম হিসহিস।
: কিন্তু আমার তো নাম নেই। তাহলে কি আমি তোমাদের বন্ধু হতে পারবো না?
মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করলো চিল।
ঘ্যাগো বললো, পারবে। যে কোনো একটা নাম রেখে নিলেই হলো। দাঁড়াও, একটু ভেবে নিই। তোমার নাম.. নাম…নাম হবে চি- শুধু চি।
: চি? বাহ্! সুন্দর নাম তো!
বললো টুনু। ঘ্যাগো ওকে সমর্থন করে বললো, শুধু সুন্দর না- এর একটা মানেও আছে। যেমন আমি ঘ্যাগর ঘ্যাগর করে ডাকি, তাই আমার নাম ‘ঘ্যাগে।’ টুনটুনি টুনটুন করে কথা বলে, তাই সে ‘টুনু।’ আমাদের সাপ বন্ধু হিসহিস করে, তাই তার নাম ‘হিসহিস।’ আর তুমি চিঁ…ই বলে চিৎকার করো, তাই তোমার নাম চি। ঠিক আছে?
: খু-উ-ব পছন্দ হয়েছে। এখন থেকে আমি আর মনে হিংসে পুষে রাখবো না। কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলবো না। আর চি বলে ডাকলে সুন্দর করে জবাব দেবো। বলবো, ঘ্যাগো ভাইয়া, টুনুদি, তোরা কি আমাকে ডাকছিস?
: এমন করে বলবে তো? তাহলে আমরা তোমাকে খু-উ-ব ভালোবাসবো।
চিল বললো, ভালোবাসবি? ইস, কি মজা হবে। আমার যে আর দেরি সইছে না রে! আমি ভাই তোদের বন্ধু হয়ে গেলাম।
এ কথা বলে চিল এসে ঘ্যাগো আর টুনুর পাশে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে ওরা বন্ধু হয়ে গেলো।

Share.

মন্তব্য করুন