কতোই বা বয়স ছিলো ছেলেটির। চার বা একটু বেশি। স্কুলে ভর্তি হতে এসেছে। ‘সানি হিলস স্কুল’। অবসর গ্রহণের পর নতুন এই স্কুলটির দায়িত্ব নিয়েছি পাঁচ বছর হলো। বেশ লাগছে শিশুদের নিয়ে কাজ করতে।
আমার ঘরে এসে ছেলেটি নতমুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। জানতে চাইলাম-
– কী নাম তোমার?
আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই আবার মাথা নত করে ফেললো। আমি ওর ডান হাতটা ধরলাম। ঠাণ্ডা হয়ে আছে, কাঁপছে। আবার বললাম-
– কী নাম বাবা তোমার?
মাথা নত করেই জবাব দিলো-
– রাইয়ান আহমেদ তমাল।
– খুব সুন্দর নাম। তোমার বাঁ হাতে ওটা কী?
কথা না বলে এগিয়ে দিলো। রঙ করা ছবি; আকাশ-নদী-নৌকা আর কুঁড়েঘর। তমালের মা চুপ করে বসে ছিলেন। এবার বললেন-
– ওর একটু সমস্যা আছে, ও কারো সাথে মিশতে পারে না। কথা বলতে চায় না। ডাক্তার বলেছেন…
আমি থামিয়ে দিলাম। ক্লাসটিচার শামীমা নাসরিনকে ডেকে বললাম-
– ও তমাল, তোমার নতুন ছাত্র; ওকে ক্লাসরুম, প্লে গ্রাউন্ড এগুলো ঘুরে দেখাও।
মাকে বললাম-
– ও একটু স্পেশাল চাইল্ড আমি বুঝতে পেরেছি। ছেলের দুর্বলতার কথা ওর সামনে কখনই বলবেন না।
মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
– আপা আমি কী অপরাধ করেছিলাম, আল্লাহ আমাকে এমন শাস্তি দিলেন!
আমি হেসে বললাম-
– এভাবে ভাবছেন কেন! আল্লাহ এই ছেলেকে পৃথিবীতে পাঠানোর আগে মা হিসেবে আপনাকেই নির্বাচন করেছিলেন। আপনিই ওর যোগ্য মা হবেন তাই। আপনি যতটা হতাশ হচ্ছেন তমাল ততটা নয়! ওর জন্য প্রয়োজন ¯েœহ, মমতা, সাহচর্য, সহমর্মিতা আর ওকে বোঝার শত ভাগ আন্তরিকতা।
তমালের মা করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তমাল প্রতিদিন সবার আগে স্কুলে আসে। ওর লাজুক চাহনি, দ্বিধাজড়িত আচরণ ওকে সবার চাইতে আলাদা করে রাখে। ওর ক্লাসের শিক্ষক শামীমা নাসরিন আর সাবেরা হামিদ আমার নির্দেশনা মতোই ওকে দেখাশোনা করছে। ওদের কাছে শুনেছি তমালের লেখা খুব সুন্দর, দেখিয়ে দিলে ও সব কিছু করতে পারে; কিন্তু মুখে একদমই কথা বলতে চায় না।
অ্যাসেম্বলিতে প্রতিদিন আমি তমালকে লক্ষ করি। জাতীয় সঙ্গীত আর প্রার্থনার সময় কেন জানি ও চোখ বন্ধ করে রাখে। মঙ্গলবার অ্যাসেম্বলিতে শিশুদের আবৃত্তি আর গল্প বলার সময় অন্যরা বলে; তমাল চোখ মেলে দেখে আর মন দিয়ে শোনে। আমি যখন ওদের ক্লাসে যাই তখন অন্য ছেলেমেয়েরা অনেক কথা বলে আমার সাথে। তমাল নীরবে তাকায়। আমি ওর সাথে কথা বলি। ওর পিঠে হাত রেখে আদর করি। ওর চোখ দু’টি চিকচিক করে ওঠে। ছেলেমেয়েরা অভিযোগ করে
– ‘বড়ো মিস্ ও কথা বলে না।’
আমি বলি-
– তমাল তো তোমাদের খুব ভালো বন্ধু, তোমরা সবাই এত্তো কথা বলো তাই ও শুধু শোনে।
এরই মধ্যে ছয় মাস পার হয়ে গেলো। তমাল আমাকে দেখলে একটু হাসে, একটু কাছে আসতে চায়। ছুটি হয়ে গেলে ও প্রায়ই আমার রুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়। কাচের দরোজা দিয়ে আমি তাকালে ত্বরিতে সরে যায়।
এরই মধ্যে আমি জেনেছি তমাল খুব সুন্দর ছবি আঁকে। ওর বাবা ওকে আবৃত্তি করে শোনান। আবৃত্তি আর গান শুনতে ও খুব পছন্দ করে।
আমি ব্রততী বন্দোপাধ্যায়ের আবৃত্তির একটি সিডি কিনেছিলাম তমালের জন্যই। ও আমার দরোজার সামনে আসতেই আমি রঙিন মোড়কের সিডিটি দেখালাম। ও দাঁড়িয়ে পড়লো। সিডির সাথে ওর পরিচয় আছে বুঝতে পারলাম। আমি উঠে দরোজা খুলে ওর কাছে গেলাম। হাত ধরে নিয়ে এলাম আমার চেয়ারের কাছে। ড্রয়ার থেকে চকোলেট বের করে দিলাম। নিতে চাইলো না। আমি কোলের কাছে টেনে নিয়ে বললাম-
– তুমি যে খুব ভালো ছেলে সেটা তো আমি জানি। তুমি কি জানো আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!
তমালের চোখের কোলটা আবারও চিকচিক করে উঠলো। হাত দুটি ঠাণ্ডা।
– জানো তমাল ছোটবেলায় আমারও কথা বলতে ভালো লাগতো না। কিন্তু বড়ো হতে হতে তো অনেক কথা বলেছি। কথা বলে বলেই তো নিজের মনের কথা সবাইকে জানানো যায়।

তমাল আরেকটু কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। এভাবেই কেটে গেলো আরো তিনটি মাস। মঙ্গলবার। অ্যাসেম্বলিতে গল্প বলা আর আবৃত্তির সময়।
– কে কে আসবে?
সহকারী প্রধান শিক্ষক জেবুননাহারের কণ্ঠস্বর। ছয় সাতজন বলার সময় হাত উঠেছে বিশ-বাইশ জনের। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম তমাল অল্প একটু উঁচু করে হাত তুলেছে। শিশুরা ‘আমি’ ‘আমি’ করে চিৎকার করছে। আমি বললাম-
– রাইয়ান আহমেদ তমাল তুমি এসো।
শিশুরা চিৎকার করে উঠলো- ‘বড়ো মিস ও বলবে না, বলতে পারবে না। আবারও বললাম- ‘তমাল তুমি এসো।’
তমাল এগিয়ে এলো। আমাদের ছোট্ট স্কুল। মঙ্গলবারে অ্যাসেম্বলির পাশে অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে থাকেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বাবা মা।
সন্তানদের উপস্থাপনায় অনাবিল আনন্দ!
তমাল এলো। কারো দিকে তাকালো না। আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে আবৃত্তি করলো। … সুকুমার রায় এর ‘হুঁকো মুখো হ্যাংলা’… হুঁকো মুখো হ্যাংলা… বাড়ি তার বাংলা… মুখে তার হাসি নাই.. দেখেছ?…। চমৎকার তালে তালে ষোলো লাইনের ছড়াটির আবৃত্তি শুনে আনন্দ ধরে রাখতে পারলাম না চোখ থেকে গড়িয়ে এলো অশ্রু। তমালের মা অঝরে কাঁদছেন।
এ…তো করতালি, বাবাদের, মায়েদের শিক্ষকদের, শিশুদের। আমি তাকিয়ে আছি তমালের দিকে। তমাল ওর জায়গায় ফিরে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে।

Share.

মন্তব্য করুন