কিশোরকালটা সবসময় মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। কখনো কখনো অনুভব করি সেই সময়গুলো। ভাবলে মাঝে মাঝে মনও খারাপ হয়। সবার এমন হয় কিনা জানি না। আমার হয়। কৈশোরকাল আসলেই আনন্দের কাল। ঘুরে বেড়ানো, পাড়ায় পাড়ায় যাওয়া, দল বেঁধে খেলাধুলা করা- এসব ছিলো আনন্দের। কৈশোরের আনন্দের সাথে যোগ হতো ঈদের আনন্দ। ঈদ ছিলো আমার খুবই আকাক্সক্ষার। খুবই প্রত্যাশার। ঈদ আসবে এমন কথায় আমরা খুব উৎফুল্ল হতাম।

মজার বিষয় হলো, আমি ছোটবেলা থেকেই রোজা রাখি। এবং যখন থেকে রোজা রাখি, রাখিই। রোজা আর ভাঙতাম না। সবসময় রোজা রেখেছি। রোজা রাখার কষ্ট আছে, এটি ঠিক। কিন্তু ইফতারির নানারকম আয়োজন দেখে দূর হয়ে যেতো সেই কষ্ট। ইফতারিতে কী যে মজা ছিলো। সারাদিন না খেয়ে না দেয়ে যখন মজার এবং স্বাদের জিনিশ সাজানো থাকতো। দেখেই মন ভালো হয়ে যেতো।
আসলে রোজা রাখাটাই ছিলো একটি অসাধারণ ব্যাপার। আবার এক সাথে ইফতারিরও ছিলো অন্যরকম। ছোলামুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, সেমাই, পায়েশ, ফলফলাদি এবং শরবত থাকতো। আহা, সে আনন্দটা ছিলো একেবারেই আলাদা রকম। এখনও ইফতার করি, এখনও আনন্দ পাই। ইফতারির আনন্দ আছেই। থাকেই। রোজাদার এর মজা পাবেই। কিন্তু কৈশোরকালের রোজা ভাঙার আনন্দ। ইফতারির আনন্দ একদম অন্যরকম। অন্য আনন্দের। এর সঙ্গে আর কোনো বয়সের তুলনা চলে না।
রোজা পুরা করার স্বপ্ন ছিলো তখন। ত্রিশটি রোজা বা সবক’টি রোজাই রাখবো- এমনি স্বপ্ন ছিলো আমার। এবং তাই হতো। তিশটি রোজাই রাখতাম।

রোজার শেষ দিন ইফতার করে মাগরিবের নামাজ পড়তাম। তারপরই শুরু হতো চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা। কার আগে কে চাঁদ দেখবে। আকাশের কোন জায়গায় চাঁদ উঁকি দিচ্ছে- দেখার প্রতিযোগিতা ছিলো আমাদের। দেখতাম। কখনও আগে, কখনও পরে। চাঁদ দেখলেই মনের ভেতর জেগে উঠতো ঈদের আনন্দ। আহা, সে কি আনন্দ ঈদের! প্রস্তুতি চলতো আগে থেকেই। নতুন জামা-জুতা কেনার পালা আগেই শেষ হতো। বিশেষ করে রোজার ঈদে নতুন জামা কিনতাম। কিনে দিতেন আমার বাবাও। নতুন জামা ছাড়া ঈদ করার কথা ভাবতেই পারতাম না। অবশ্য এই বিষয়টি শুধু আমার একার ছিলো না। পরিবারের সবাই নতুন জামা পেতো। সবার জন্য কেনা হতো জামাকাপড়। নতুন জামার আনন্দ ছিলো সকলের।
সহপাঠী এবং খেলার সাথী যারা ছিলো, তারাও নতুন জামা কিনতো। ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে নিতাম। গোসল করেই নতুন জামা-কাপড় পরতাম। নতুন জামার আতর অথবা পারফিউম মেখে নিতাম। তারপর ছুটে যেতাম ঈদের মাঠে। ঈদগাহ বলি আমরা।
আমার বাড়ি চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে তখন বেশির ভাগ ঈদের জামাত হতো মাঠে। কোনো কোনো মাঠ শুধুমাত্র একদিনের জন্য ঈদের হয়ে উঠতো। ঈদের জামাত হয়ে গেল ওই মাঠ ব্যবহৃত তো অন্য কাজে। আবার কোনো কোনোটি ঈদগাহ হিসেবেই পরিচিত ছিলো। আমি সবসময় ঈদের নামাজ মাঠেই পড়েছি। নামাজ শেষে কোলাকুলির ধুম। বড়-ছোট-মাঝারি, ছেলে-বুড়ো সবার সাথে কোলাকুলি। সবাই বুক পেতে দিতো। বুকে বুক রেখে আমরা আনন্দ প্রকাশ করতাম। বড়রাও তাই করতো। হিংসা-বিদ্বেষ ছিলো না কোনো। পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলি হতো। বড়লোক, ধনী-গরীব সবাই সবার হয়ে উঠতো। এ দৃশ্যটি বড় দারুণ ছিলো।

ঈদের মাঠ থেকে ফিরে আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে ছুটতাম বাড়ি বাড়ি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এরকম করে করে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বাড়ি যেতাম। যার বাড়ি যা রান্না হতো তার থেকে একটু খেয়ে নিতাম। একজনের বাড়িতে খেয়ে সে সহ আরেকজনের বাড়ি যেতাম। এভাবে সবাই সবার বাড়ি যেতাম। কেউ যাওয়ার বাকি থাকতো না। কারো বাড়িও বাকি থাকতো না। একটি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো। আনন্দ কাজ করতো। এ খাওয়াদাওয়া শুধু সকালেই শেষ নয়। কারো বাসায় সকালে। কারো বাসার দুপুরে। আবার কারো বাসায় রাতে যেতাম। আসলে যাওয়া আর কি, এত বাসায় তো আর খাওয়া যায় না। একটু চেখে দেখা। নতুন কোন আইটেম পেলে মুখে দেয়া। এভাবে বেড়াতাম, ঘুরতাম, আড্ডা দিতাম। আড্ডা মানে বন্ধুরা মিলে একসাথে সময় কাটানো। একসাথে বসা। কে কেমন জামাকাপড় পড়লো তা নিয়ে আলোচনা করা।
ঈদের খাবার সাধারণত কমন খাবার। শিরনি, ফিরনি, সেমাই, জর্দ্দার পিঠা। মাংস এবং রুটি-পোলাও-রোস্ট এসবই ছিলো। সবার বাসায় রান্না হতো এমন খাবার।

সমাজে সবসময়ই গরীব মানুষ ছিলো। গরীব মানুষেরা সবসময় নতুন জামাকাপড় জোগাড় করতে পারতো না। তাদের বাড়িতে সেমাই ফিরনি তেমন করে রান্না হতো না। আমরা ঈদে তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। গরীবদের সাহায্য করলেও এক ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। ভালো লাগতো খুব। আজও এ আনন্দ পাই। রোজার ঈদের আনন্দটা বেশি ছিলো। কারণ দীর্ঘ এক মাস রোজা রেখে তারপর ঈদ আসতো। আসলে এক মাসের প্রস্তুতি শেষে আসে রোজার ঈদ। পুরো একমাস রোজা পালন করে তারপর হঠাৎ সেই ঈদের সকাল এলে আনন্দটা অন্যরকমই লাগতো। এখনও লাগে।
কোরবানের ঈদে গরুর হাটে যাওয়া। গরু কেনা এবং গরু জবাইয়ের আনন্দ আছে। গরুর গোশত খাওয়ারও আনন্দ আছে। কিন্তু রোজার ঈদের আনন্দটাই বেশি। সবচেয়ে বেশি। এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে ভাবি সেই কৈশোরকাল কত না উচ্ছলতায় ভরা ছিলো। কত না স্বাধীনতার আনন্দ ছিলো। এখন যারা কিশোর, বিশেষ করে শহরে বসবাস যাদের, তারা আমাদের কিশোরকালের মতো আনন্দ দেখেনি। সেই উদ্যম আর সেই সুন্দর দেখছে না। আমরা যেসব বিষয়ে আনন্দ পেয়েছি এখনকার কিশোরেরা সেসবে আনন্দ পায় না। এখনকার কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোন। ভিডিও গেম আর নানারকম কার্টুনের সমাহার তাদের কাছে। অবসরে আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। বই পড়েছি। এখনকার কিশোরেরা ঘুরে বেড়ানোর কথা কল্পনাও করে না। আর বই পাঠ তো মাথায়ই আসে না তাদের। তারা ভিডিও গেম, ইউটিউব, ব্লগ আর কার্টুনে মজে থাকে। এসবে যদি খুব বেশি জড়িয়ে যায় তাহলে আমাদের কিশোরেরা ভালো মানুষ বা অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ হতে পারবে না। পারছে না। কিশোরদের প্রতি নজর দিতে হবে আমাদের। তারা আনন্দে বেড়ে উঠতে পারে। সত্যিকারের মানুষ হতে পারে।

Share.

মন্তব্য করুন