আলী বাবা হচ্ছে আমার চাচা, বুঝলি? আমার ওই একটাই চাচা। দেশে-বিদেশে ঘোরা লোক। পণ্ডিত মানুষ। আমি কতো কি শুনেছি, জেনেছি তার কাছ থেকে। আর উনার মাথায়, বুঝলি, দুনিয়ার জ্ঞান। তুই আমাকে বলিস না, এত ম্যাপ দেখে কী মজা পাস? ম্যাপ দেখা তো আমি শিখেছি ওই আলী বাবার কাছেই।
রতন জিজ্ঞেস করে তুই রোজ ম্যাপ দেখিস? মুন্না বলে, রোজ না; তবে প্রায়ই দেখি। খালি দেখি না। আমি তো একদম বইপড়ার মতো করে, ম্যাপ পড়ি। ম্যাপ পড়লে কি হয় জানিস?
কী হয়?

আরে বুদ্ধু! ম্যাপ পড়লে দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা তৈরি হয়। ম্যাপে দেখবি রাস্তাগুলো, রেললাইনগুলো এঁকেবেঁকে কোথায় চলে গেছে। তোরও চলে যেতে ইচ্ছা করবে ট্রেনে চড়ে। আর কতো রকমের যে নাম আছে জায়গার। অদ্ভূত সব নাম। যেমন? রতন জানতে চায়।
যেমন- গোয়ালিশান্ডা, বড়খাতা, নাইখংছড়ি। বড়খাতার নাম শুনে রতনের কৌতূহল বেড়ে যায়। জায়গায় নাম? হেভি মজা তো! হা হা বড়খাতা!
মুন্না বলে, আমাদের কুড়িগ্রাম শহর থেকে বেশি দূরে না। ম্যাপে দেখবি লালমনিরহাট থেকে যে লাইনটা বুড়িমারির দিকে গেছে, ওই লাইনেই বড়খাতা স্টেশন।
বুড়িমারি! বুড়িমারি! রতন বিড়বিড় করে। বাহ্ এটাও তো মজার নাম। জানিস মুন্না বাবাকে বলেছি ম্যাপ এনে দেয়ার জন্য। বাবা বলেছে, কাল-পরশুর মধ্যেই কিনবে। খালি বাংলাদেশের বড় ম্যাপ না; ম্যাপের একটি বইও আনবে। মুন্না জেনে খুশি হয়। খুব ভালো হবে। দু’জন মিলে আজব-আজব সব নাম বের করবো। আর জায়গা খুঁজে বের করা খেলবো।

রতন মুন্না দু’জনেই ক্লাস এইটে পড়ে। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে দু’দিন আগে। স্কুল বন্ধ এক সপ্তাহের জন্য। দু’বন্ধু খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে। মুন্না তো হাওয়ায় উড়ছে। আগামী বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে সে বাবা মা খালামণিদের সাথে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। সেখান থেকে যাবে কক্সবাজার।
মনোয়ারা বেগম, মুন্নার মা একটা ট্রেতে লুচি হালুয়া দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রতন আত্মমগ্ন হয়ে কী যেন ভাবছিল। এখন লুচি চিবাতে চিবাতে বলে, তোর ওই চাচা অনেকদিন আসেন না, না?
নাহ্। উনি এখন খুব ব্যস্ত মানুষ। বড় সাংবাদিক তো আমাদের আলী বাবা!
রতন বলে, আলী বাবা! আচ্ছা, নামটা উনার কে রেখেছে রে?
কেন? খারাপ নাকি নামটা?
না না, খারাপ না। এরকম নাম তো শোনা যায় না!
আরে ঘটনা হলো, মুন্না বলে, চাচা তো রাশিয়ায় ছিলেন বহুদিন। ওখান থেকে সাংবাদিকদের বড় ডিগ্রি এনেছেন। চাচার আসল নাম হচ্ছে, মোহাম্মদ আলী সরকার। তো, উনার ওখানকার বন্ধুর তাকে আলী বাবা বলে ডাকতো। দেশে ফিরে সেই গল্প উনি করেছেন। তারপর থেকে আমাদের কাছেও উনি আলী বাবা।
রতন প্রশ্ন করে, শুধু আলী না বলে আলী বাবা কেন? ওই যে! আলী বাবা চল্লিশ চোরের গল্প আছে না? ওখান থেকেই আলী বাবা…।
আরব্য রজনীর সেই দারুণ গল্পটা রতনেরও পড়া ছিল। এবার সে বুঝতে পারে। এবার সে আসল মজাটা পায়। মুন্নার কী মনে হয় কে জানে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বন্ধুকে বলে, আচ্ছা, তোর দাদাবাড়ি তো বরিশালে, না? নানাবাড়িও বরিশালে?
হ্যাঁ, না , নানাবাড়ি ঝালকাঠি।
আচ্ছা, তুই ট্রেনে চড়েছিস?
একবার। আমার ছোটখালার তো বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহ শহরে। আমরা ট্রেনে করে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। মুন্না জিজ্ঞেস করে, ট্রেন খুব মজার না?
ট্রেনভ্রমণ ভালোই। কিন্তু অনেক শব্দ…।

মুন্না বলে, ও-ও তোর তো অভ্যাস নাই। তোরা লঞ্চে যাতায়াত করিস তো! লঞ্চ থেকে কতো কি দেখা যায় কতো স্টেশন! কতো রকমের মানুষ!
রতন শুধু বলে, হ্যাঁ সেগুলো খারাপ না। শুধু অতো বেশি শব্দ যদি না থাকতো, তাহলে খুব ভালো হতো।
মুন্না এ মুহুর্তে নিজের ভেতর ঢুকে গেছে। আলী বাবা বিদেশ থেকে ফিরেছেন এক সপ্তাহ। তাকে ঘিরে বাড়িতে এখন উৎসব। উনি আগে থেকেই ফর্শা। বিদেশ ফেরত তাকে আরও ফর্শা লাগছে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন তাকে দেখতে আসে যেন নতুন বউ এসেছে বাড়িতে। আলী বাবা ছোটদের সাথে গল্প করতে ভালোবাসতেন। কিন্তু একটানা কয়েকদিন ছোটরা তার কাছে গিয়ে বসার সুযোগই পায়নি। মুন্না দেখেছে, বড় কেউ না কেউ তার সামনে বসে আছে, খোশগল্প করছে। আলী বাবা তার গল্পের মাঝখানে মজাদার কিছু একটা বলে অট্টহাসি দিয়ে উঠছেন। তারপর দাদিমা শাক সব্জির স্যুপ রান্না করে তাকে এক থালা সব্জি খেতে দিয়েছে। আলী বাবার দুপুরে ওই সব্জি খাচ্ছেন। ভাত খাচ্ছেন না। পাশের বাড়ি থেকে আসা দু’একজন অবাক চোখে তার ওই খালি সব্জি খাওয়া দেখছে। আলী বাবার গল্প চলে। ট্রেন থেকে কতো কিছু দেখা যায়। খোলা জানালা থেকে কাছে দূরের কতো ছবি। ইউরোপের ট্রেন কিন্তু এরকম না। জানালা একদম বন্ধ থাকে। ট্রেন এত জোরে চলে যে, তোমরা কাছে তাকালে কিন্তু দেখতে পাবে না। দেখতে পাবে, যদি দূরে তাকাও। কিন্তু সেই দৃশ্যও খুব দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে যাবে। আর একটা ব্যাপার আছে সেটা কী? সেটা হচ্ছে ওসব ট্রেনে ভেতর থেকে শব্দ শোনা যায় না। মানে শব্দ এত কম।
মুন্না স্মৃতি থেকে জেগে উঠে রতনকে এখন বলে, এরকম ট্রেন কোথায় পাবি বাংলাদেশে? ওগুলো আছে ইউরোপ আমেরিকায়।

ওই ট্রেনের কথা বলতে গিয়ে আবার আলী বাবার কথা মনে পড়ে গেল মুন্নার। বড় বিছানার মাঝখানে তাকে ঘিরে বসেছে বাচ্চারা। অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে বসা ছোটদের চেহারায় কৌতূহলের ছবি। একটা গল্প শেষ করে কী যেন ভাবছেন আলী বাবা। শিশুরা তার চুপচাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গাঢ় নীল জামা গায়ে দেয়া রাজপুত্রের মতো সুদর্শন, রাশিয়া ফেরত আলী বাবা ফের কথা বলতে শুরু করেছেন, তোমরা দেখছি ক’দিন ধরে খালি আমার গল্প শুনছো। সকালে, সন্ধ্যায় খালি গল্প-গুজব। পড়তে বসছো না?
মালা দুলিয়ে লিলি বলে, আমাদের স্কুল এখন বন্ধ।
লিলির বান্ধবি রিতা বলে, আংকল, আমাদের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হলো তো। এক সপ্তাহ পরে রেজাল্ট দেবে। ক্লাসও শুরু হবে তখন।

এই দলের সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটার নাম রিংকু। গোলগাল নাদুসনুদুস চেহারা ওর। মুন্নার আম্মা ওকে আদর করে ডাকে ভূতির মা। তো সেই রিংকু বলে উঠে, আমরা এখন পড়তে বসিই না…।
আলী বাবা বলেন, না না, সেটা করা যাবে না। স্কুল বন্ধ থাকলেও পড়তে হবে। পড়ার টেবিল থেকে একদম দূরে থাকা ঠিক হবে না। শোনো বাবুরা, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হলে রোজ পড়তে হয়। তোমরা ভালো করতে চাও না পরীক্ষায়?
বাচ্চারা একসাথে বলে ওঠে, হ্যাঁ, চাই তো। আলী বাবা বলেন, বেশ। কাল থেকে সকালে-সন্ধ্যায় তোমরা পড়তে বসে যাবে।
মনোয়ারা বেগম খাবারের ট্রে ও গ্লাস নিতে এসে বলে, কিরে, গল্প একেবারে মজে গেছিস তোরা। খেলতে যাবি না আজ?

যাবো মা। বলেই নিঃশব্দে হাসতে আরম্ভ করে মুন্না। অনেকক্ষণ ধরে হাসেন।
রতন উৎসুক হয়, কী হলো? এমন করে হাসছিস যে!
আর বলিস না, মজার একটা কথা মনে পড়ে গেছে। রতন, তুই কখনো শুনেছিস মানুষ পাখির গু খায়? ধেৎ, কী বলিস?
বিশ^াস হলো না তো? শোন তাহলে এটাও আলী বাবার গল্প। বলেছেন আলী বাবা, কিন্তু ঘটনা সত্যি। নেদারল্যান্ডস নামে একটা দেশ আছে। ওখানকার লোক করে কি, পাখির বাসা গাছ থেকে পেড়ে আনে। পাখির বাসায় তো পাখির গু-ও থাকে। ওরা ওই বাসাগুলো পানিতে দিয়ে চুলায় জ¦াল দেয়। তারপর সেই জ¦াল দেয়া গু তৃপ্তির সাথে খায়। ওটা নাকি দারুণ একটা স্যুপ!
রতন প্রথমে ‘ছিঈ’ বলে। তারপর হাসতে থাকে। হাসতেই থাকে। হাসি সহজে থামতে চায় না। মুন্না ততক্ষণে ভেতরের রুমে ঢুকে গেছে ফুটবল আনতে। এখন বিকাল পাঁচটা। ফজলু, খায়ের, রনুজরা নিশ্চয় এতক্ষণে মাঠে খেলতে এসে গেছে।

Share.

মন্তব্য করুন