রোজা রাখতে হবে মহান আল্লাহর নির্দেশ মান্য করার জন্য। রোজা রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য। রোজা রাখতে হবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য। নিজেকে উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য। নিজের আত্মার শুদ্ধতার জন্য। রোজা রাখতে হবে ত্যাগের মহিমা পাওয়ার জন্য। রোজা রাখতে হবে তাকওয়ার মহান গুণ অর্জনের জন্য। না খাওয়ার কষ্ট। অনাহারীর বেদনা। এবং উপবাসের যাতনা বোঝার জন্য রোজা রাখতে হবে।
রোজা রাখতে হবে এবং রাখতেই হবে। কেননা এটি তাঁর বিধান, যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব জাহান। যিনি সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব জাহানের সকল কিছু।

রোজা তাঁর নিয়মে রাখতে হবে যিনি সমগ্র জগতের সবকিছুর নিয়ম দিয়েছেন। একই সাথে দিয়েছেন সকল প্রাণীর জীবন যাপন পদ্ধতি। এখানে একটি বিস্ময়ের বিষয় আছে। বিষয়টি হলো- সৃষ্টির যা কিছু আছে তার সকল কিছুই আলাদা। প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠী আলাদা। প্রতিটি প্রাণী আলাদা। পাখি আলাদা। পতঙ্গও আলাদা। প্রতিটি মানুষও আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কেউ কারো মতো নয়। কেউ কারো চেহারার মতো নয়। কেউ নয় কারো রূপের মতো। যে যার মতো প্রত্যেকেই আলাদা! এই যে আলাদা এটি শুধু দেখতে আলাদা এমন নয়। বরং চলার ধরন বলার প্রকরণ, দেহের গঠন সবই আলাদা। খাওয়া দাওয়ার নিয়ম আলাদা। বসবাসের পদ্ধতি আলাদা। এমনকি ঘুম ও জাগরণের নিয়মও আলাদা। এত বিচিত্র এবং বৈচিত্র্য আছে এসব সৃষ্টির ভেতর বিস্ময় জাগে একটু ভাবলেও। যে মানুষের সামান্য বুদ্ধি আছে সে-ই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে এই ভেবে- যে কি করে সম্ভব প্রতিটি বিষয়ে আলাদা করে সব আয়োজন করা। সৃষ্টি করা! এবং সব সৃষ্টিকে লালন করা!

যিনি সবকিছুর স্রষ্টা তিনিই তো মানুষের স্রষ্টা। তো মানুষকে যিনি বানিয়েছেন। মানুষের জন্য বিধানও দিয়েছেন তিনিই। মানুষ কিভাবে নিজের জীবন গুছিয়ে নেবে সে পদ্ধতিও দিয়েছেন তিনি। মহা বিশ্বের সবকিছুর নিয়মও তিনিই দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালার সকল নিয়ম সুন্দর ও প্রয়োজনের। যার জন্য যে নিয়ম সে নিয়ম সুন্দর ও আনন্দের সাথে তার বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। মহান আল্লাহর নিয়ম মানার অর্থ হলো নিজেকে সব চেয়ে বেশি নিরাপদে রাখা। সব চেয়ে বেশি নিরাপত্তার ভেতর থাকা। সব চেয়ে বেশি শান্তিতে রাখা।
নিরাপদ এবং নিরাপত্তার ভেতর থাকার যত বিধান আল্লাহ দিয়েছেন মানুষকে, রোজা তারই গুরুত্বপূর্ণ একটি। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই রোজা রাখতে হবে- এ কথা যেমন সত্যি। তেমনই সত্যি রোজা রাখা মানুষের নিজের জন্যই জরুরি। মনের জন্য জরুরি। আত্মার জন্য জরুরি। রোজা মানুষের মন পবিত্র করে। আত্মার পরিশুদ্ধি করে। হৃদয়ে স্বচ্ছতা জাগায়।

এখানে আরেকটি কথা ভালো করে বুঝতে হবে তা হলো- মানুষ যদি রোজা রাখে, পৃথিবীর সকল মানুষও যদি রাখে তাতে আল্লাহর কোনো লাভ নেই। একটুও নেই। সামান্যও নেই। আবার দুনিয়ার একটি মানুষও যদি রোজা না রাখে তাতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই। আসলে লাভ এবং ক্ষতি দুটোই মানুষের। দুটোই কেবল মানুষের জীবনের সাথে জড়ানো। দুটোই মানুষের মন ও আত্মার সঙ্গে জড়ানো। রাখলে লাভ মানুষের। না রাখলে ক্ষতিও মানুষেরই। মানুষ রোজা রাখলো কি না রাখলো এতে আল্লাহর কিচ্ছুটি যায় আসে না। মহান আল্লাহর বিরাট রাজত্বের কোথাও কম বা বেশি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি রাজাধিরাজ। তিনি সকল বাদশাহর বাদশাহ। তাঁর হাতে সকল ক্ষমতা। সকল ক্ষমতার উৎসও তিনি। সকল শক্তির উৎসও তাঁর হাতে। সুতরাং তাঁর হুকুম মান্য করা মানুষের কর্তব্য।
তাহলে দিনের আলোর মতো একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো- রোজা মানুষের জন্যই দরকারি। মানুষের জন্যই প্রয়োজন। এবং মানুষের জন্যই মহান আল্লাহর নির্দেশ।

এখন জিজ্ঞাসা হচ্ছে- রোজা রাখার কি প্রয়োজন আছে মানুষের! কি এমন দরকারি মানুষের রোজা রাখার!
সত্যি বিষয় হলো রোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি কেবলই আল্লাহর জন্য রাখা হয়। অবশ্য কেউ বলতে পারেন- সব ইবাদতই তো আল্লাহর জন্য। কথাটি একদম ঠিক। কিন্তু এ কথাও ঠিক অন্য ইবাদত করার সময় মানুষ দেখে। বা মানুষ জানে। যেমন নামাজ আদায় করার সময়। হজ পালনের সময়। এমনকি দান করার সময়ও কোনো না কোনো মানুষ দেখছে। দেখে। অন্তত যাকে দেয়া হলো সে তো দেখলো! কিন্তু রোজা? না রোজার বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। একেবারেই আলাদা। একদমই পৃথক। যেমন ধরা যাক, একজন রোজাদার। রোজা শুরু করলো। সকাল গেলো। দুপুর গড়ালো। বিকেল হলো। তারপর পেটের ক্ষুধা তীব্র হলো। হাতের কাছে পড়ে আছে পছন্দের খাবার। বাসায় নেই কেউ। এ অবস্থায় শুধু খাওয়ার ইচ্ছেটি করলেই হয়। অমনি খেতে পারে গপাগপ। কিন্তু একজন রোজাদার মুখে তুলবেন খাবার? না। তুলবেন না। কেনো? কারণ তিনি জানেন বাসায় কোনো মানুষ নেই ঠিক। কিন্তু একজন তো আছেন! তিনি মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি তো সর্বত্র আছেন। সবসময় আছেন। থাকেন। এবং থাকবেন।
বিশ্ব জাহানে যখন কেউ ছিলো না। তিনি ছিলেন। আবার কেউ যখন থাকবে না। তিনি থাকবেন। তিনি চিরন্তন। তিনি শুরু। তিনি শেষ। তিনি মৃত্যুহীন। চিরঞ্জীব। ঘুম নেই তাঁর। এমনকি নিদ্রাও নেই। নিদ্রা তন্দ্রা কিছুই স্পর্শ করতেও পারে না তাঁকে। সুতরাং কেউ যেখানে থাকে না। তিনি থাকেন।

ধরুন বাসায় মানুষ আছে। মানুষ দেখে যাবে বলে কেউ খেলো না। খাবারের প্রসঙ্গ গেলো। পিপাসার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। পানির প্রচণ্ড তৃষ্ণা মানুষকে কাতর করে তোলে। এমন কাতর অবস্থায় বাথরুমে যখন গোসল করে কেউ। পানি ঝরছে তার সারা শরীর বেয়ে। শরীরে পানি পড়ার সাথে সাথে বুকের ভেতরটি যেনো শুকিয়ে গেলো। পানির তৃষ্ণা চাগিয়ে উঠলো আরও। শুধু মুখটি হাঁ করে দিলেই পানি গড়িয়ে ঢুকে যাবে বুকের ভেতর। বুক হয়ে পেটের গহিনে। কিন্তু তখনও একজন রোজাদার মুখ চেপে থাকেন। অথবা মুখের এক ফোঁটা পানিও যেনো ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, এমন সতর্ক থাকেন। কেনো? কারণ সেই একটিই- এখানেও আছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। এভাবে রোজা শুধু আল্লাহর জন্য হয়ে ওঠে। শুধু আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। মহান আল্লাহ তায়ালাও বলেছেন তাই- রোজা শুধু আমার জন্য। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান।

যখন একজন রোজাদারের মনে এই ধারণা জন্মে- আল্লাহ সবখানে বিরাজিত। এবং সকল কিছু দেখেন। তখন এমন লোকের পক্ষে গোপনেও খারাপ কাজ করা সম্ভব নয়। তখন তিনি সব কাজে ভয় করবেন শুধু আল্লাহ তায়ালাকেই। যিনি শুধু আল্লাহকে ভয় করেন তিনি জগতের সেরা মানুষ। সব চেয়ে সাহসী মানুষ। সবার চেয়ে উত্তম মানুষ। মানুষেরা সম্মান করে তাঁকে। তিনি হয়ে যান মর্যাদাবান। সম্মানিত। রোজার সব চেয়ে বড় শিক্ষা এটি। এটিই একজন মানুষের জীবনে সব চেয়ে দামি বিষয়।

এছাড়া রোজার আরও অনেক শিক্ষা আছে। শরীর সুস্থ থাকে রোজা রাখলে। পেটে গ্যাস হয় না। আলসার হয় না। বদ হজম হয় না। জ্বালা পোড়াও থাকে না। বরং রোজাদারদের খাবার দ্রুত হজম হয়ে যায়। পেট পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
অভুক্ত থাকার কষ্ট বোঝা যায়। বোঝা যায়- যারা সারা বছর পেট পুরে খেতে পায় না তাদের অবস্থা কি হয়। কেমন কষ্টে থাকে ওরা। কেমন করে রাত কাটে ওদের! দিন যায় কি করে! আহা ক্ষুধার যন্ত্রণা কি কঠিন! এটি একজন রোজাদার ঠিক ঠিক বুঝতে পারেন।
রোজাদারের মন হয়ে ওঠে ফুরফুরে। আনন্দময়! অন্যের প্রতি দরদি। দায়িত্ববান। এবং কল্যাণকামী। উদার হয়ে ওঠেন তিনি। হয়ে ওঠেন সবার কাছে সততার প্রতীক। এভাবে রোজা একজন বিশ্বাসী বা মুমিনকে করে তোলে উন্নত মানুষ। তাই রাখতে হবে রোজা।

Share.

মন্তব্য করুন