বাংলা সাহিত্যের একজন বড় উপন্যাসিক ও গল্পকার হাসান আজিজুল হক। তাঁর বয়স এখন ৮২ বছর। লেখালেখি করেন সেই ছোটবেলা থেকে। একইসাথে তিনি একজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক। কথা বলেছেন তাঁর শৈশব-কৈশোর নিয়ে। বর্তমান প্রজন্মের সাথে তাঁদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠার কালের কতটা পার্থক্য সে বিষয়েও কথা বলেছেন তিনি। কিশোর পাতার পক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান সাইদুল

কেমন আছেন?
ভালো আছি। এ বয়সে যতটা ভালো থাকা যায়।

আশি-ঊর্র্ধ্ব বয়সে আপনার শৈশব কৈশোরের কথা কেমন মনে পড়ে?
তা পড়ে। একটা প্রবাদ মনে পড়ে। সেটি হচ্ছে সবারই এক অবস্থা, কৈশোর-শৈশবে ফিরে যেতে চাওয়া। আমারও সে ইচ্ছে করে। মন চাইলেও কিন্তু সব করা যায় না। আমার বেলায়ও না। তবে এটা বলা যায় আমার শৈশবটা সুন্দরভাবে কেটেছে।

বর্তমানে যাদের শৈশব কাটছে আর আপনাদের শৈশবের মধ্যে কতটা পার্থক্য দেখতে পান?
অনেক পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ তো বলে বর্তমান প্রজন্ম আর আমাদের শৈশব-কৈশোরের মধ্যে রাত দিন পার্থক্য। কোনটা ভালো কোনটা খারাপ সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলো যদি ব্যাখ্যা করে বলতেন?
অনেক রয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে দু’টি বিষয় চোখে পড়ে তা হচ্ছে, এক. খেলার মাঠ ও দুই. নদী। আমার কিংবা আমাদের সময়কার শৈশব- কৈশোরের কথা বলতে গেলে তো খেলার মাঠ ও নদীর কথা আসবেই। আসতেই হবে। আমরা বন্ধু সমপাঠীদের নিয়ে মাঠে খেলতে যেতাম। নির্দিষ্ট কোনো মাঠ না থাকলেও এখানে সেখানে খেলতে যেতাম নিজেরাই মাঠ বানিয়ে নিতাম। এখনকার প্রজন্ম তো এটি ভাবতেই পারবে না। কিংবা অনেকাংশ বুঝবেও না যে মাঠের মর্মটা কী? আর নদীর কথা কী বলবো? এ সময়ে শৈশব-কৈশোরের মধ্যে কতজন সাঁতার জানে? এটা আমার একটি প্রশ্ন। নদীতে কত রকম খেলা আছে বলে শেষ করা যাবে না যা আমরা খেলতাম। নদীতে দলবেঁধে গোসল করার মজা এখনকার প্রজন্ম কী বুঝবে?
তবে আমি প্রজন্মের দোষ দেবো না। তারাও তো ভালোই কাটাচ্ছে তাদের স্বাদে। পরের প্রজন্ম হয়তো আরও ভালো কিছু পাবে যা তাদের জন্য আনন্দের ও স্বাদের হবে।
কিন্তু আপনাদের শৈশব-কৈশোর ও বর্তমান শৈশব-কৈশোরের মধ্যে বড় পার্থক্য তো প্রযুক্তি…
এটি খুব বড় রকমের পার্থক্য আমি বলবো না। প্রযুক্তি আমাদের সময়ও ছিলো এবং যা ছিলো তাতেই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিলো। ধরো, চিঠিও কিন্তু একটি প্রযুক্তি। এর আনন্দ কী এ প্রজন্মে বুঝবে? রেডিও, এন্টেনার টেলিভিশন এগুলো আমাদের জন্য কম কি ছিলো। তার পর পত্রিকা, ম্যাগাজিন এগুলোও আমাদের কাছে বড় রকমের প্রযুক্তি বলবো।
আপনারা সব মন ও মগজে রেখেছিলেন। যেমন জ্ঞান ধারণ করতেন স্মৃতিতে, মুখস্থ করে। এখনকার প্রজন্ম তো সেরকম রাখতে পারছে না। তারা সবকিছু খোঁজে গুগুলের কাছে…
তোমার কথা যে সম্পূর্ণ সঠিক তা বলবো না। আছে, ভালো অবশ্যই আছে। সব দশকে কিংবা সবারই কৈশোরে ভালো থাকে, মন্দও থাকে। ভালোমন্দ মিলিয়েই চলছে সময়। যুগের এবং অবস্থার পরিবর্তনের কারণে অনেক কিছু বদলে যায়। বদলে যাওয়াটা খারাপ কিছু নয়। সময়ই তো মানুষকে বদলে দেয়!

আপনার কৈশোর-শৈশবের ঈদের দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে?
তা পড়ে। পড়বে না কেন? বছরের দুটি ঈদের জন্য আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকতাম। নতুন টাকা নতুন জামা কাপড়ের বিষয়টি সবারই জানা। আমার বেলায়ও তাই। ঈদের দিন সমপাঠীরা মিলে ঘোরাফেরা করার বিষয়টি এখনও আমার মনে পড়ে। ঈদ হোক আর যে কোনো উৎসবে হোক আমাদের বাড়ির আশপাশের মেঠোপথে দৌড়ে যাওয়া। গ্রামীণ খেলায় মেতে ওঠা ছিলো আমাদের নেশা। এটি এখন নেই বললেই চলে।

আপনাদের শৈশব-কৈশোরের পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশের কোন পার্থক্যটা আপনাকে খুব ভাবায়?
আসলে দিন যত যাবে মানুষ বদলে যাবে সেই সাথে পরিবেশও বদলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিছু বিষয় তো আছে চোখে পড়ার মতো। আমাদের বেড়ে ওঠা সময়গুলোতে এখনকার মতো এতো দালান-কোঠা ছিলো না। এতো ঘনবসতি ছিলো না। রাস্তায় এতো জ্যাম শব্দদূষণের বিষয় তো ভাবাই যেতো না তখন। এখন এগুলো অহরহ হচ্ছে। এমন অনেক পার্থক্য আছে আবার ভালো বিষয়গুলোও তো কম না। যেগুলো বলে শেষ করা যাবে না।
সুতরাং ভালো বিষয়গুলো গ্রহণ করতে হবে। খারাপগুলো ছাড়তে হবে। যারা ভালো হতে চায় তাদের ভালো হওয়ার পথ সবসময় খোলা। খারাপ হতে চাইলেও পারবে। কেননা, সে পথও খোলা।

Share.

মন্তব্য করুন