ফুল ঝরে গেলেও আশা-বাসনা ঝরে যায় না। দিন চলে গেলেও আশা থেকে যায়। দিন যায়। দিন আসে। ঘুরে ফিরে আসে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ, সবার প্রিয় পহেলা বৈশাখ। সবাইকে সুরেলা শুভেচ্ছা জানাই। নববর্ষের শুভেচ্ছা। নতুন দিনের শুভেচ্ছা।
স্বাধীনতার পর পহেলা বৈশাখ উদযাপন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। আমাদের পার্বত্য তিন জেলা- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। সেখানকার উপজাতিদের প্রধান সামাজিক উৎসব বাংলা নববর্ষ বরণ নাম ‘বৈসাবি’।
গ্রামগঞ্জের মতো বর্ষবরণের চমকপ্রদ আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে দিনটির শুরু পান্তাভাত ও ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে। উৎসবের অনুষ্ঠানমালা সৃষ্টি করে এক অপূর্ব মিলনমেলা। শিশুরা খেলছে। বড়রা বেড়াচ্ছে। খুশিতে, লাবণ্যে-মাধুর্যে সমস্ত পরিবেশ ঝলমল করে ওঠে। এটিও জীবনের একটি দিক।

উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। রমনা উদ্যান, চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলা, শহীদ মিনার, টিএসসি এলাকাজুড়ে বিশাল জনসমুদ্রে প্লাবিত। মানুষের স্রোতে ওরা ভেসে আসে ফুলের মতো। শৈশব এবং মধ্যবয়স অনায়াসে মিশে যেতে পারে। সবুজ আর নীলিমার কান্তির পাশাপাশি। কিন্তু জেগে থাকে বিমূর্ত এক নৈরাজ্য, যেখানে শরীর আছে মন নাই। পয়সা আছে সম্পদ নাই। সোহাগ আছে আদর নাই। ফুর্তি আছে প্রাণ নাই।
সে যাইহোক, বাংলা একাডেমি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মসূচির মধ্যে প্রধান আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। মেলা নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। কী নেই সেখানে! স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত কৃষিজাতদ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল প্রকার হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী। শিশু-কিশোরদের রকমারি খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার সামগ্রী। থাকে লোকজ খাদ্যদ্রব্য চিঁড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা। বৈচিত্র্যময় এক সমারোহ জমে ওঠে বৈশাখী মেলায়। থাকে বিনোদনের ব্যবস্থাও। দিনভর ইঁদুরদৌড় শেষে সংসারজীবী মানুষের ঢল নামে। দখিনা হাওয়া যেন বয়ে আনে দাক্ষিণ্যের সুসংবাদ। দূর থেকে ঐ সব দেখেশোনে প্রবীণরা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত।

সুকণ্ঠী প্রতিমা ব্যানার্জীর উদাস করা সেই গানটি- ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি কই আগের মতো বাজে না, মন আমার তেমন কেন সাজে না, তবে কি ছেলেবেলা অ-নে-ক দূরে ফেলে এসেছি’! সত্যি তো কোথায় সেই ছেলেবেলা, কোথায় কৈশোরকাল! আবহমানকাল থেকে তুলে আনা সেইসব টুকরো-টুকরো ছবি ভেসে ওঠে যখন, প্রবল কষ্ট পাই। ঐ আকাশ বাউরি বাতাস নদীজল আমায় কি ফিরিয়ে দেবে স্মৃতিবিদ্ধ আঁতুড়ঘর!
গ্রাম ছেড়ে একসময় চলে আসি রাজধানী ঢাকায়। পেছনে রয়ে যায় প্রিয়বন্ধু গাছ-মাটি-ঘাস। অনন্ত অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে আসা সেই জীবন। জীবন মানে তো এভাবেই খুঁজে যাওয়া। স্মৃতি-বিস্মৃতির কুয়াশাজাল ছিঁড়ে ছেলেবেলার কত জলছবি বড়বেলায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে পড়ে গ্রামের সেই উদাসকরা নকশিকাঁথার মাঠ। মাঠজুড়ে রকমারি বৈশাখী মেলা। দৃষ্টিনন্দিত হরেক রকম হস্তশিল্প। ছোটদের জন্য মনকাড়া পুতুল ও বাঁশি। কত রকমের মিষ্টিজাত দ্রব্য। নিত্যদিনের গৃহসামগ্রী। মনের থেকে সেইসব ছবি হারিয়ে ফেলেছি।

গ্রামও এখন অনেক পাল্টে গেছে। দোতলা, তিনতলা, চারতলা পাকা বাড়ি। অচেনা অজানা অবিশ্বাস্য। কৃষকের ছেলে হাতে মোবাইল নিয়ে বাইক চালাচ্ছে। দেশের পয়সায় নয়, আমদানি করা সম্পদ। অনেক ছেলে আরব দেশে চাকরি করে।
যাইহোক, রক্তের ভেতর গুপ্ত প্রাণ। স্মৃতিকে ফিরে ফিরে দেখি। শৈশব-কৈশোরের কত স্বপ্ন, কত উত্তেজনা, কত উন্মোচন থেকে গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ জীবন। কিন্তু এখন জীবন আর সময় হেলেদুলে হাত ধরে হাঁটছে, ছুটে পালাচ্ছে না।

মাঝে মাঝে শহরের রাজপথে জেগে ওঠে বনজ বাহার। পালিয়ে যাওয়ার মতো স্মৃতি এসে দরজায় দাঁড়ায়। উদাস বাতাসে মন উড়ুউড়ু। ঐ তো দূরে সবুজ চত্বরে কয়েকটা গাছ, পুরনো একটা বেঞ্চ-আমি আর আমার চেনা সহচর কৈশোর কী সুন্দর মুখোমুখি বসে আছি। অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে সহসা আমরা যেন ভেসে এলাম যুগল আনন্দস্রোতে!
শৈশব থেকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাওয়া গূঢ় এক অনিশ্চয়তাবোধ বুঝি পিছু ছাড়ে না। জীর্ণ শাখায় গজায় প্রাণ। এ শহর ছেড়ে যেতেই হবে বহুদূর, এমন দূর যেখানে বাড়ি আছে, ঘর আছে, মানুষ আছে, প্রাণী আছে, ক্ষেত আছে, পুকুর আছে, নদী আছে- নেই শুধু দীঘি আর বাল্যবন্ধু।
নিস্তব্ধ শূন্যতায়, নিরাত্মীয় দূরত্বে যখন রাতের আকাশের মুখোমুখি হই, তারাগুলো মিটমিট করে বলছে, ‘তাড়া কিসের’? এই স্বাদু পৃথিবীর মায়াবী আলোয় নীরব আসনে বসে আছেন ধ্যানস্থ মহাকাল!

Share.

মন্তব্য করুন