পরীক্ষা শেষ করে এপ্রিল মাসের তেরো তারিখে আমি যখন মামাবাড়ি এলাম, রিন্টু তখন স্কুলে ছিল। ফিরে এসে আমাকে দেখে সে তো অবাক। নিজের গায়ে চিমটি কেটে বলল, আমি ভূত দেখছি না তো? যা হোক, তুই এসে খুব ভালো করেছিস। কাল নববর্ষের প্রথম দিন- পহেলা বৈশাখ। ফুলতলির মাঠে মেলা বসবে। খেলনা বিক্রি হবে! বাঁশি বিক্রি হবে! আমরা বাঁশি বাজিয়ে সবার কান ঝালাপালা করে দেবো। ও হ্যাঁ, এবার কিন্তু বাঘ-ভালুক নিয়ে সার্কাসঅলারাও আসবে। আমরা সার্কাস দেখব। খুব মজা হবে।
পহেলা বৈশাখে ঢাকাতেও মেলা বসে। সে সব মেলায় বাঁশিঅলারা আর খেলনাঅলারা আসে, কিন্তু সার্কাসঅলা আসে না। এখানে ওরা আসবে শুনে ভালো লাগল। তাই বললাম, সার্কাস দেখতে পারলে সত্যিই মজা হবে। আমার জীবনে একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।
সকালে রিন্টু বলল, বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই। আমার সঙ্গে চল। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেলায় যাবো।
এ কথা বলে রিন্টু আমাকে মামীর কাছে নিয়ে গেল। মামী তখন ঘর গোছাচ্ছিলেন। রিন্টু বলল, মা! আমরা সার্কাস দেখতে যাবো। একশো টাকা করে টিকিট। দু’জনের দুশো টাকা লাগবে। টাকা দাও।
মামী বললেন, টাকা তো দেবো। কিন্তু এতো সকালে যেতে চাইছিস কেন? আরেকটু বেলা বাড়লে যাস।
: বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তো রোদের তেজও বাড়বে। তখন মেলায় যেতে কষ্ট হবে। প্লিজ মা, এখনই টাকা দাও।
রিন্টুর আবদার শুনে মামী আলমারি খুলে একশো টাকার দুটো নোট বের করে বললেন, এই যে টাকা। দুই ভাই যাচ্ছিস, সাবধানে থাকিস।
রিন্টু বলল, সাবধানেই থাকব। তুমি দোয়া করো আমরা যেন বিপদে না পড়ি।
দুই.
সার্কাস দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে মেলায় এলাম। কিন্তু এসেই শুনতে হলো এক দুঃসংবাদ- সকালে সার্কাস দেখানো হবে না। সার্কাস দেখানো হবে রাতে।
এ কথা শুনে আমার মন খারাপ হলো। তবে রিন্টু স্বাভাবিক রইল। সে বলল, সার্কাস-টার্কাস অবশ্য রাতে দেখতেই মজা।
বললাম, মজা তো বুঝলাম। কিন্তু এখন মাত্র সকাল। রাত পর্যন্ত আমরা কী করব?
আমার কাঁধে হাত রেখে রিন্টু বলল, কিছুক্ষণ মেলা দেখব, তারপর ফিরে গিয়ে পেট ভরে খাবো আর বিকালে আবার সার্কাস দেখতে আসব।
বিশাল মাঠজুড়ে মেলা বসেছে। আমরা ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছি আর মুড়ি-মুড়কি খাচ্ছি, আচমকা এক দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম। দেখতে পেলাম, কতগুলো মাটির খেলনা ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে আছে আর এক লোক তার পাশে বসে আছে। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
লোকটিকে দেখিয়ে রিন্টু বলল, আরে, লোকটা কাঁদছে কেন? বড়োরা আবার কাঁদে নাকি? চল তো জিজ্ঞেস করে দেখি ব্যাপারটা কী!
আমরা যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখনও লোকটি কাঁদছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কাঁদছেন কেন?
লোকটি বলল, আমার দুঃখের কথা শুনে কি করবে? আমি এক হতভাগা বাবা। আমার মতো অপদার্থ মানুষের মরে যাওয়াই ভালো।
রিন্টু বলল, এমন কথা বলবেন না। কাঁদছেন কেন সে কথা বলুন। খেলনাগুলো কে ভেঙেছে?
লোকটি বলল, কেউ ভাঙেনি- আমিই ভেঙেছি।
: আপনিই ভেঙেছেন! পাগল নাকি আপনি?
অবাক হয়ে রিন্টু বলল। সে কথা শুনে লোকটি বলল, পাগল নই বাবা। আমি এক গরিব মানুষ। অনেক কষ্ট করে মেয়েটাকে পড়াচ্ছি। এবার সিক্সে উঠেছে। বই কিনে দিতে হবে। তাই ভেবেছিলাম খেলনাগুলো বিক্রি করে বই কিনে দেবো। কিন্তু ভাগ্যে তা সইল না। বটগাছের শিকড়ের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম আর খেলনাগুলো ভেঙে গেল। এখন আমি মেয়েকে মুখ দেখাব কেমন করে, সে কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে।
: আজই বই কিনে দেবেন বলে এসেছেন?
: হ্যাঁ বাবা, আজই বই কিনে দেবো বলে এসেছি। কিন্তু তা তো হবে না। আহা রে, কতো আশা নিয়ে মেয়েটা বসে আছে। হায় আল্লাহ…
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটা কেঁদে উঠল। তাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমি বললাম, কাঁদবেন না চাচা। কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।
ডুকরে ডুকরে লোকটি বলল, মেয়েটার কথা ভেবে আমারও কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে আসছে। উহ্ আল্লাহ… কেমন করে আমি এ মুখ নিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াব?
দুই হাতে মুখ ঢেকে লোকটি কেঁদে চলল। এ সময় আমার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। কি বলে যে সান্ত¡না দেবো, কি বলা উচিত, তা ভেবে পেলাম না। তাই রিন্টুকে বললাম, কী করা যায় বল্ তো? আমার কাছে টাকা নেই। কিছু টাকা যদি লোকটাকে দেয়া যেত, তাহলে খুব ভালো হতো!
কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবল রিন্টু। তারপর বলল, তোর কাছে নেই কিন্তু আমার কাছে আছে। সার্কাস দেখার টাকাগুলো এ বেচারাকে দিয়ে দিই। অবশ্য তোর যদি আপত্তি না থাকে।
বললাম, আপত্তি থাকবে কেন! আমরা তো ভালো কাজে টাকাটা ব্যয় করতে চাইছি। দিয়ে দে, সব দিয়ে দে। কাউকে কাঁদতে দেখলে খুব কষ্ট হয়।
রিন্টু টাকা বের করে লোকটির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, এই নিন চাচা। আপনার মেয়েকে বই কিনে দেবেন।
লোকটি একশো টাকার নোট দুটোর দিকে একবার আর রিন্টুর দিকে একবার অবাক চোখে তাকাল। তারপর বলল, এতোগুলো টাকা তুমি কোথায় পেলে?
রিন্টু বলল, সার্কাস দেখার জন্য মা দিয়েছেন।
: সার্কাস দেখবে না?
: দেখব। সার্কাস তো একমাস চলবে। সার্কাস অন্য দিনও দেখতে পারব। কিন্তু বই তো আপনাকে আজই কিনে দিতে হবে- তাই না?
: হ্যাঁ, তাই বলে এসেছি। কিন্তু…
কথা শেষ না করে লোকটি থেমে গেল। তা দেখে রিন্টু বলল, কোনো কিন্তু নয়। টাকাটা রাখুন।
: রাখতে তো বলছো। কিন্তু তোমরা আমার ছেলের বয়সী। তোমাদের কাছে হাত পাতব কেমন করে?
আমি বললাম, হাত পাতার কথা বলছেন কেন! ভেবে নিন, ছেলের বয়সী দুটি ছেলে বাবার বয়সী একজন মানুষকে নববর্ষের উপহার দিচ্ছে। সব সময় তো বড়োরাই ছোটদের উপহার দেন- এবার না হয় তার উল্টো হলো।
রিন্টু বলল, রিঙ্কু ঠিকই বলেছে। প্লিজ, ছেলেদের উপহার ভেবে টাকাটা রাখুন। আমাদের ভালো লাগবে।
লোকটি বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। সে বসা ছিল, এবার উঠে দু’জনকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, আল্লাহর কী মহিমা! বিপদে পড়ে আল্লাহকে ডাকছিলাম। আল্লাহ তোমাদের মতো হƒদয়বান ছেলেদের পাঠিয়ে দিয়েছেন! এ দয়া আমি অস্বীকার করব কেমন করে? ঠিক আছে, তোমাদের টাকা আমি নববর্ষের উপহার হিসেবেই গ্রহণ করলাম। দোয়া করি, আল্লাহ যেন চিরদিন তোমাদের মন এমন সুন্দর রাখেন।