পুকুর পাড়ের জামগাছটায় সে বছর প্রচুর জাম ধরেছিল। ঘোমটা পরা নতুন বউয়ের মতো নুয়ে পড়েছিল গাছের ডালগুলো। জামের লোভে কামাল, মফিজ, সালেহারা সারা দিনই ভিড় জমাত গাছতলায়। আমি ওদের নির্লজ্জ বলে যতই বকাঝকা করি না কেন, ওদের তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। ওদের যেন গায়েই লাগে না। সেদিনও ওরা জাম গাছতলায় এলে আমি আম্মাকে ডেকে বলি, তুমি দেখে নিয়ো আম্মা, আজ ওদের চরম অপমান না করে ছাড়ছি না।
যে ছেলে টিকটিকির ভয়ে কান্না জুড়িয়ে দেয়, সে ছেলে যে কী করতে পারে আম্মার কী আর তা কম জানা? সে জন্যই মা আমার কথা কানেই তোলেননি। আমিও মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিই, আম্মাকে আজ দেখিয়ে দেব, আমি আর সেই ভিতু ছেলেটি নেই। ঘর থেকে তেড়েমেড়ে বেরিয়ে সোজা গাছতলায় এসে বলি, এই তোরা রোজ রোজ আমাদের বাড়িতে আসিস কেন রে? তোদের লজ্জা লাগে না? জাম খাওয়ার এতই যদি শখ, তাহলে কিনে খা না?
আমার কথা শুনে ওরা সবাই হাসতে থাকে। ওদের মধ্য থেকে কামাল বলে ওঠে, মাগনা পাইলে কিন্যা খামু ক্যান?
কামালের কথা শুনে রাগে আমার গা জ্বলে উঠল। তাই সোজা বকে দিলাম, এটা কি তোর বাবার গাছ?
এমন সময় আম্মা ডাকলেন- জামিল! ভাত খেতে আয়।
আসছি আম্মা…
ভাত খেতে বসে দেখি আম্মা পুঁটিমাছ দিয়ে চালকুমড়ো রেঁধেছেন। কিন্তু আমি যে পুঁটিমাছ খেতে পারি না। মুখ ভার করে বসে থাকি। আম্মা জিজ্ঞেস করেন, খাচ্ছিস না কেন?
আম্মা, আমি যে পুঁটিমাছ খাই না, তা কি তুমি জানো না?
আজ কষ্ট করে খেয়ে নে বাবা। কাল তোর জন্য বাজার থেকে বড় দেখে রুইমাছ আনাবো।
না, আমি পুঁটিমাছ খাবো না। আমাকে দুধ দাও।
দুধ পাবো কোথায়?
আম্মার কথা শুনে বিস্মিত হই। জিজ্ঞেস করি, কেন? হরি কাকু দুধ দিয়ে যাননি?
আম্মা বললেন, তোর হরি কাকু তো গতকালই ইন্ডিয়া চলে গেছেন।
ইন্ডিয়া চলে গেছেন! কিন্তু কেন?
দেশের অবস্থা যে ভালো নয়।
ও! আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম দেশে এখন যুদ্ধ চলছে। আচ্ছা আম্মা! ওরা আমাদেরকে শুধু শুধু মারছে কেন?
ওরা যে জালেম। তাই।
জালেম মানে কী?
যারা ক্ষমতার দাপটে, গায়ের জোরে নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার করে, তাদের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেয়, দুর্বলদের সহায় সম্পত্তি আত্মসাৎ করে, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করে তারাই হচ্ছে জালেম।
ওদের কি কোনো বিচার হবে না?
হবে বাবা, হবে।
কিন্তু কবে?
আম্মা আমার মাথায় তার ¯েœহের হাত বুলিয়ে বলেন, যেদিন তুই এদেশকে স্বাধীন করতে পারবি। সেদিনই হবে ওদের সঠিক বিচার।
আমি! আমি কি পারবো?
পারতে তোকে হবেই। এ যে তোর বাবার স্বপ্ন।
বাবার স্বপ্ন!
হ্যাঁ, স্বাধীনতা তোর বাবার স্বপ্ন, তোর মায়ের স্বপ্ন। সকল বাঙালির স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণের জন্যই তো তোর বাবা…।
আম্মা আর কিছু বলতে পারলেন না। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।

২.
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের রক্তিম আভা। মৃদু বাতাসে ঢেউ উঠেছে বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা সাদা কাশবনে। বর্ষার পানিতে বুড়িগঙ্গা থৈ থৈ। এখান থেকে আমাদের বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। আমি কাশবনের আল দিয়ে হেঁটে চলছিলাম আপন মনে। হঠাৎ গণমানুষের চিৎকারে থমকে দাঁড়ালাম। চিৎকারটা দেখছি আমাদের বাড়ি থেকেই আসছে। আমি ভালো করে তাকাতেই দেখি আমাদের দু’চালা টিনের ঘরের উপর দিয়ে আগুনের জিহ্বা আর কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ ছুঁতে যাচ্ছে। আমারই চোখের সামনে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হতে থাকে প্রয়াত দাদুর এই শেষ চিহ্নটুকু। আমি আঁতকে উঠি- আম্মু ঠিক আছে তো?
আমি বাড়ির দিকে দৌড় দিই। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারিনি। কে যেন আমাকে পেছন থেকে টেনে ধরলেন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি কাশেম চাচা। চাচা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলেন, গেরামে মিলিটারি ঢুকছে। বেবাক মানুষরে গুলি কইরা মাইরা ফেলছে। অহন গেরামে যাওন যায়বো না। ওই দেখ ঘাটে মিলিটারির নৌকা বান্ধা।
কাশবনের যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার থেকে মাত্র একশ গজ দূরে বাঁধা রয়েছে মিলিটারির নৌকাটা। নৌকায় দুই হানাদার বসে বসে গল্প করছে। চাচা আমাকে চুপচাপ বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে নৌকার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমার মাথায় খুন চেপে যায়। পায়ের কাছেই পেয়ে গেলাম একটি অর্ধ ভাঙা ইট। দ্রুত সেটি হাতে তুলে নিলাম। তারপর কালবিলম্ব না করে ছুঁড়ে মারি। ব্যস, কেল্লা ফতে। সঙ্গে সঙ্গে এক সেনা চিৎপটাং। অপর সেনাটি পেছন ফিরে তাকাতেই কাশেম চাচা তার হাতের বৈঠা দিয়ে কষে এক ঘা মেরে বসলেন। ওই নরাধমও গাঙের পানিতে নাকানিচুবানি খেতে থাকল। চাচা আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘পালা, জলদি পালা।’
আমি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে কাশবনের পাশ ঘেঁষে ছুটতে থাকি। কতক্ষণ ছুটলাম জানি না। ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠলাম। পেছনে ফিরে তাকাই। না, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটু দম নিয়ে চারপাশে ভালোভাবে তাকাতেই গা ছমছম করে উঠল। ও আল্লাহ! এ কোথায় চলে এলাম? চারদিকে কেমন বিদঘুটে অন্ধকার। বিশালাকৃতির গাছগুলো দেখেই বুঝতে পারি, এ এক গভীর জঙ্গল। ভয়ে গা ছম ছম করে ওঠে। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখে। ভয়ে আঁতকে ওঠি। পেছন ফিরে দেখি দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের একজন আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ো না খোকা। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।
অন্যজন বললেন, তোমার বাড়ি কোথায়? কোথা থেকে এসেছো?
আমি তাদের কোনো কথারই উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।
৩.
প্রায় চার মাস হলো মুক্তিবাহিনীতে এসেছি। সেদিন যে দু’জন লোক আমাকে জঙ্গল থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন রাজু ভাই আর বিনুদা। এ কয়েক মাসের ট্রেনিংয়ে আমি অনেক কিছুই শিখে নিয়েছি। কাজও করেছি টুকটাক। এই যেমন সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে শত্রুদের খবরাখবর সংগ্রহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখা। কখনো কখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু ক্যাম্পে মাইন পুঁতে দেয়া।
কমান্ডার আবু সালেহ ভাই একদিন আমাদের সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসলেন। তিনি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেন, ‘মাতৃভূমি রক্ষার্থে জীবন উৎসর্গকারী সহযোদ্ধা ভাইয়েরা আমার। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে জীবনকে উৎসর্গ করেছি। বিসর্জন দিয়েছি পরিবার-পরিজন। সে স্বপ্ন আজ দোরগোড়ায়। সুতরাং আমাদের আর পেছনে তাকাবার সময় নেই। সময় এখন বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাবার। আপনারা সাহস হারাবেন না। বিজয় আমাদের হবেই ইনশাআল্লাহ।’ সেদিন আরো অনেক প্রসঙ্গেই কথা হয়েছিল। আলোচনা শেষে আমরা খেতে বসি। খাবার পাতে বিনুদাকে বললাম, ‘আচ্ছা বিনুদা, তুমি তো দারুণ ছবি আঁকতে। যুদ্ধের পর কি আবারো ছবি আঁকা শুরু করবে?’
হ্যাঁ রে পাগলা। আর প্রথমেই আঁকবো তোর ছবিটা। তোর এক হাতে থাকবে মেশিনগান অন্য হাতে থাকবে লাল-সবুজের পতাকা। ভেবে দেখ কেমন লাগবে তখন।
হাশেম চাচা বিনুদার কথার সঙ্গে যোগ করে বলেন, ‘সত্যি, তোকে অনেক সুন্দর লাগবে রে জামিল।’
তাদের কথা শুনে এক অন্যরকম ভালোলাগায় বুক ভরে ওঠে। আমিও বুক টান দিয়ে বলি, লাগবেই তো। আমিও তো তোমাদের মতোই একজন যোদ্ধা। তাই নয় কি?
নূরনবী ভাই আমার কাঁধ চাপড়ে বলেন, আলবাত। তুই হলি আমাদের খুদে মুক্তিযোদ্ধা। শুনে রাখ জামিল, যুদ্ধের পর প্রথম উপন্যাসটা কিন্তু আমি তোকে নিয়েই লিখব। বইয়ের নাম দেব কি, জানিস?
আমি জিজ্ঞেস করি, কী?
নূরনবী ভাইয়ের চোখের নদীতে যেন চাঁদের ঝলকানি। বললেন, ‘একাত্তরের দিনগুলো’। এ বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা হবে আমাদের এ মুক্তিযুদ্ধের দিন-রাতের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার রূপকথা।
পরদিন অপারেশনের জন্য আমরা কুসুমপুরে রওয়ানা হলাম। খবর এসেছে আজ সেখানে পাক বাহিনী আস্তানা গাড়তে আসছে। আবু সালেহ ভাই আমার হাতে একটা এলএমজি তুলে দিয়ে বলেন, ‘এই দেশ তোর মা। তোর মা আজ পিশাচের কারাগারে বন্দি। তোর মাকে বাঁচাতে আজ জীবন বাজি রেখে লড়তে হবে। মাকে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। কী রে পারবি না?’
আবু সালেহ ভাইয়ের কথায় আমার শরীরে টগবগানো রক্তের ঢেউ খেলে। পিঙ্গল চোখের তারা দু’টি থেকে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে বলি, ‘পারবো ভাইয়া, পারতে আমাকে হবেই।’
আবু সালেহ ভাই আমার কাঁধ চাপড়ে বলেন, ‘মনে রাখিস, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করে কেবল কাপুরুষেরা। আর সত্যিকারের যোদ্ধারা মৃত্যু পর্যন্ত লড়ে যায়। কারণ তারা মৃত্যুকে ভয় করে না।’
আবু সালেহ ভাইয়ের হাত থেকে এলএমজি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরে প্রতিশোধের যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল, তা আগ্নেয়গিরির চেয়েও কয়েকগুণ ক্ষিপ্র। সন্ধ্যার আগেই আমরা শত্রু ক্যাম্পের চারপাশে পজিশন নিয়ে লুকিয়ে থাকি। অপেক্ষা করি আঁধার গাঢ় হওয়ার। অবশ্য শত্রুরা ইতোমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। যে দু’চারজন পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে, তাদের চোখেও ঘুম ঘুম ভাব। শীতের রাত। অথচ আমার শরীর ঘেমে উঠেছে। অস্বস্তির তপ্ত স্রােত যেন গমকে গমকে মাথায় উঠে আসছে। বুকের ভেতর অসহ্য জ¦ালা হলেও গুলি ছুঁড়তে পারছি না কমান্ডারের নির্দেশ না পাওয়ায়। সেদিন রাত যেন আকটু বেশিই কালো ছিল। মনে হচ্ছিল একটা বিশাল আকৃতির কালো কাক তার ডানা দিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে ঢেকে রেখেছে। রাতের দ্বি-প্রহরে আবু সালেহ ভাইয়ের নির্দেশ আসে। একযোগে আক্রমণ করি। অল্পক্ষণের মধ্যে শত্রুরাও গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। এলএমজির ঠা ঠা গর্জনে রাতের নীরবতা ভেঙে খান খান। শত্রুদের গুলিতে হামিদ চাচা আর রাজু ভাই শহিদ হয়েছেন। গ্রেনেড ছুঁড়তে গিয়ে আমারও একটা হাত চলে যায়। রাতভর চললো এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। শত্রুদের একজনও বাকি নেই। মৃত্যুদূত তাদের সবাইকে স্ব স্ব স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। রাজু ভাই আর হামিদ চাচাকে হারিয়ে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। সবার চোখেই বাঁধভাঙা ঢেউ। তবে এত কষ্টের মাঝেও সুখের খবর হলো, কালো কাকের ডানা থেকে ভোরের সূর্য যেভাবে বেরিয়ে এসে দিনের ঘোষণা করেছে, তেমনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে আমরাও বিজয়ের লাল সূর্যকে মুক্ত করতে পেরেছি। এদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একের পর এক বিজয়ের খবর আসতে থাকে। বিজয়ের আনন্দে আমরা মহান প্রভুর শুকরিয়া আদায় করি। আনন্দে আটখানা হই। সব শেষে আসে ১৬ ডিসেম্বর। লক্ষ লক্ষ শহিদের জীবন উৎসর্গ আর মা-বোনদের হারানো ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পাই একটি লাল-সবুজের পতাকা।
যুদ্ধ শেষে যে যার বাড়িতে ফিরে যায়। আমিও গেলাম। কিন্তু বাড়িতে কাউকেই পেলাম না। না বাবা, না মা। স্বাধীনতার চারাগাছটিকে সবুজ করতে তারাও যে নিজেদের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন!
এরই মধ্যে প্রস্তুত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। কিন্তু সে তালিকায় খুঁজে পাওয়া গেল না আমার নাম। খুঁজে পাওয়া গেল না বিনুদার আঁকা ছবি আর নূরনবী ভাইয়ের উপন্যাসের পাতায়ও। এভাবেই হারিয়ে গেছি আমি। আমার মতো আরো অসংখ্য কিশোর মুক্তিযোদ্ধা।

Share.

মন্তব্য করুন