বিভিন্ন পাহাড়ি জাতির মধ্যে বুনো প্র্রাণী সম্পর্কে নানা ধরনের রহস্যময় ধারণা প্রচলিত আছে। উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার অধিবাসীদের ইয়াকুতকা বিশ্বাস করে, তাদের সৌভাগ্য নির্ভর করে অশরীরীদের উপর। যারা প্র্রাণীদের রক্ষক। এই অশরীরীদের তারা এক আশ্চর্য ধরনের বুনো প্র্রাণী হিসেবে কল্পনা করত। যার মাথা কুকুরের মতো। ক্ষুর গরুর মতো। দু’টি বড় কান ঝোলানো নিচের দিকে। হিমশীতল দেশ ল্যাপল্যান্ডের অধিবাসীরা সোনালি শৃঙ্গের হরিণকে তাদের রক্ষক বলে মনে করে। তাদের পৌরাণিক কাহিনীতে আছে বুনো বলগা হরিণের পদচারণা শুরু পৃথিবীর অন্তরতম স্থান থেকে। বিশ্বের এক প্র্রান্ত থেকে অন্য প্র্রান্ত পর্যন্ত এর পদচারণা। সূর্যের চলার পথই এর পথ। তার দিকেই সে ধাবমান। তার দেহ ধপধপে সাদা আর লোম তুষারের চাইতেও রজতশুভ্র। কালো মাথা উঁচুতে বাড়িয়ে, শাখাযুক্ত শৃঙ্গ পিঠে এলিয়ে অদৃশ্য ডানায় সে উড়ে চলে দিগন্তের মুক্ত বায়ু তার শ্বাস যা তাকে উড়িয়ে নেয় দূর থেকে বহু দূরে। প্র্রাচীন মিসরের বহু দেবদেবীর আকৃতি জন্তুর মতো। আকাশ দেবতা হোরাস ছিল বাজপাখি।

কালাবাশা নামক স্থানে নুবিয়ান মন্দিরের দেয়ালগাত্রে হোরাসকে বাজপাখির মাথা বিশিষ্ট মানবদেহ যুক্ত দেখানো হয়েছে। প্র্রাচীন লেখাতে অনেক রহস্যময় প্র্রাণীদের বিবরণ দেখা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে হিব্রু বাইবেলে আছে জলদানব লেভিয়াথানের কথা। এই দানবের আকৃতি নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা রয়েছে। কারো মতে, এটা ছিল বিরাট একটা অজগরের মতো। কেউ মনে করত, এর আকৃতি ছিল অনেকটা ড্রাগনের মতো। একদল মনে করত, লেভিয়াথান ছিল বিরাট আকারে কুমির দানব। ভূমধ্যসাগরের লেভান্ট অঞ্চলই ছিল এই দানবের প্র্রধান আবাসস্থল। ইংরেজ কবি মিল্টন তার বিখ্যাত ‘প্যারাডাইস লস্ট’ গ্রন্থে এক অতিকায় জলদানবের বিবরণ দিয়েছেন। এই দানব ছিল একটা বিরাট অজগরের মতো। অত্যন্ত হিং¯্র প্র্রকৃতির ছিল প্র্রাণীটি ধারালো দাঁতের সারি। বিরাট হাঁ করা মুখের ভেতরে লকলক করত লেলিহান জিহ্বা। তার সমস্ত শরীর ঢাকা ছিল বড় বড় আঁশে। চোখ টকটকে লাল। নিঃশ্বাসে বেরুত আগুনের শিখা। ড্রাগন নিয়েও অনেক রহস্য। এই পৌরাণিক প্র্রাণীটিকে নিয়ে প্র্রচুর উপাখ্যান লেখা হয়েছে। গ্রিক শব্দ ‘ড্রাকন’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এই নামের। অনেক বর্ণনায় আগে ড্রাগন ছিল বিরাট ডানাঅলা অতিকায় বাদুড়ের মতো। যে প্র্রাণীর নিঃশ্বাস ছিল জ্বলন্ত। কারো মতে, ড্রাগন দেখতে ছিল বিরাট অজগরের মতো। কারো মতে, গিরগিটির মতো। তাদের ছিল কাঁটাযুক্ত লম্বা লেজ। চীনের ড্রাগনই বেশি সুপরিচিত। জার্মানির রূপকথায় আছে কিভাবে মহাবীর সিগফ্রিড মন্ত্রপুত তরবারি দিয়ে এক ভয়ঙ্কর ড্রাগনকে হত্যা করেছিল। তার গহ্বর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল রাজকন্যা বার্নাহিডকে।

স্ক্যান্ডেনেভিয়ার লোককথায় আছে, এক সময় নরওয়ের উপকূল অঞ্চলে ক্রাকেন নামে ভয়ঙ্কর এক জলদানব থাকত। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে এই দানবের বর্ণনা দিচ্ছেন নরওয়ের বিশপ পন্টিপিড্ডান। তিনি বলেছেন, এর বিষাক্ত স্পর্শে সমুদ্রের নীল পানি ঘন কালো হয়ে যেত। এর বজ্রকঠোর নির্মম আলিঙ্গনের মধ্যে সুপ্ত ছিল ঐরাবতের শক্তি।
সিন্দাবাদ নাবিকের দুঃসাহসিক অভিযানে আছে বিশাল আকারের রক পাখির কথা। যার পায়ের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নিয়ে সিন্দাবাদ পৌঁছে গিয়েছিল সমুদ্রের মাঝখানের দ্বীপের পাহাড় চূড়াতে রক পাখির বাসায়। সেখানে ছিল অনেক মূল্যবান রত্নপাথর। রহস্যময় প্র্রাণী হিসেবে মৎস্যকন্যা পেয়েছে দীর্ঘদিন থেকে ব্যাপক পরিচিতি। উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্র্রায় ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্র্রচলিত আছে মৎস্যকন্যার রহস্যময় উপাখ্যান। মৎস্যকন্যার নাম হলো মার্গেন। বাস করে সমুদ্রের গভীরে। সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে সে পাখনা নেড়ে ভেসে যায়। গান গায়। তার গান শুনে সহজেই মুগ্ধ হয়ে যায় নাবিকেরা। এই মৎস্যকন্যা মার্গেনের ছিল আশ্চর্য এক অতীত। এক সময় সে ছিল ছোট একটি মেয়ে। তখন তার নাম ছিল লিবান। সে তার বাবা মায়ের সঙ্গে বাস করত সাগরের তীরে। একদিন সাগর থেকে প্র্রচণ্ড এক জলোচ্ছ্বাস উঠে এলো। তাতে লিবানের সমস্ত আপনজন গেল ভেসে। লিবান গিয়ে পৌঁছল সমুদ্রতলে। তারপর কিভাবে যেন ধীরে ধীরে তার সুন্দর নরম দেহের নিচের অংশটি মাছের আকার ধারণ করলো। লিবান পরিবর্তিত হলো মৎস্যকন্যায়। তখন তার নাম হলো মার্গেন। কাহিনীতে আছে, একদিন মার্গেন ধরা পড়ল ডাঙার মানুষের হাতে। তাকে নিয়ে গিয়ে রাখা হলো বড় আকারের একটি চৌবাচ্চায়। প্র্রতিদিন তাকে সেখানে দেখতে প্র্রচুর লোক আসত। খ্রিষ্টধর্মের নিয়মে তার মাথায় জর্ডান নদীর পবিত্র পানি ছিটিয়ে তাকে বাপটাইজ করা হলো। এরপর থেকে তার নাম হলো সেন্ট মার্গেন।

স্কটল্যান্ডেও প্র্রচলিত ছিল মৎস্যকন্যার গল্প। সেখানকার পবিত্র লোনা দ্বীপটিতে নাকি একদা এক মৎস্যকন্যা সাগর থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসত। সেই দ্বীপে এক তরুণ সন্ন্যাসী বাস করত। মৎস্যকন্যা সেই সন্ন্যাসীর প্র্রতি মুগ্ধ হয়। তাকে বিয়ে করার বাসনা প্র্রকাশ করে। সন্ন্যাসী জানায়, তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে এক শর্তে। সেই মৎস্যকন্যা কোনোদিন আর সাগরে ফিরে যেতে পারবে না। মৎস্যকন্যা একে অসম্ভব মনে করে দুঃখে সাগরতলে ফিরে গেল। সেই লোনা দ্বীপে ছড়িয়ে আছে সবুজ রঙের অসংখ্য নুড়ি। স্থানীয় কিংবদন্তি বলে, এগুলো হলো সেই মৎস্যকন্যার চোখের পানি। জমে গিয়ে নুড়ির আকারে পড়ে আছে যুগ যুগ ধরে। পৃথিবীর কিছু প্র্রাচীন সভ্যতায় এমন দেব-দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় শরীরের নিচের অংশ যাদের মাছের মতো। ফিলিস্টিয়ানদের প্র্রাচীন মুদ্রাতে এমন ধরনের ছবি খোদিত রয়েছে। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার সম্পর্কে গল্প আছে, তিনি নাকি সাগরতলে অভিযান করে মৎস্যকন্যা দেখে এসেছিলেন।
রোমান লেখক প্লিনির কাহিনীতে আছে, বিখ্যাত রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের এক সেনানায়ক সাগরতলায় কয়েকটি মৎস্যকন্যাকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলেন। মধ্যযুগের এক বিশিষ্ট ফরাসি পরিবার সম্পর্কে এক কিংবদন্তি শোনা যায়। তাদের বংশে এ গল্প প্র্রচলিত আছে যে, তাদের আদি পুরুষ রেমন্ড ছিলেন একজন ডাঙার মানুষ। মাতা মিলুসাইন ছিলেন একজন মৎস্যনারী। মিলুসাইন নারীরূপে এসেছিল রেমন্ডের কাছে। বিয়ের সময় একটি শর্ত দিয়েছিল। সেটা হলো, সপ্তাহের একদিন শনিবার তাকে ছেড়ে দিতে হবে। ঐদিন তার কোনো রকম খোঁজ করা যাবে না।

দু’জনের বিয়ে হলো। একসময় মিলুসাইন একটি সন্তানের মা হলো। এদিকে রেমন্ডের কৌতূহল হলো প্র্রতি শনিবার মিলুসাইন স্নানঘরে কী করে তা জানার জন্য। এক শনিবার স্নানঘরে দেখল অদ্ভুত এক দৃশ্য। মিলুসাইন বসে আছে বাথটবে। তার শরীরের নিচের অংশটা ক্রমেই মাছের লেজের অংশে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে রেমন্ড বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল। তার চিৎকার শুনে মৎস্যনারীর দেহটা স্নানঘরের জানালা গলে বাইরে চলে গেল। হারিয়ে গেল পাশের সমুদ্রে। এরপর কোনোদিন আর সে ফিরে আসেনি রেমন্ডের কাছে।

গল্পে আছে এরপরও সেই মৎস্যনারী নাকি রাতে কখনও চুপিচুপি আসত তার ছোট্ট সন্তানটিকে দেখার জন্য। ছোট্ট শিশুর ধাত্রী দেখেছে সেই মৎস্যনারীকে। যার নিম্নাংশ নীল পাখনাঅলা মাছের মতো। উত্তর পশ্চিম স্কটল্যান্ডে এটি এক জনপ্রিয় কাহিনী। সেখানকার সাগর তীরের কিছু মানুষও দাবি করত, তাদের আদি মাতা ছিলেন এক মৎস্যকন্যা। চতুর্দশ শতকে নাইজেরিয়ার বেনিন অঞ্চলে একটি বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল। তখন বেনিনের সম্রাট ছিলেন ক্লেন। একবার বিশেষ কোনো রোগের কারণে সম্রাটের নিম্নাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সম্রাটের এই অবস্থার কথা জানতে পেরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাজকর্মচারী আর পুরোহিতরা মিলে ঠিক করল অকর্মণ্য সম্রাটকে তারা হত্যা করে নতুন সম্রাটকে বসাবে সিংহাসনে। সম্রাট এই খবর পেলেন। নিজেকে বাঁচাবার জন্য এক আশ্চর্য বুদ্ধির আশ্রয় নিলেন। সম্রাট ক্লেন রাজ্যে প্র্রচার করে দিলেন যে, সে প্র্রকৃতপক্ষে এক জলদেবতার বংশে প্র্রজাকুলের কল্যাণ সাধনের জন্য বেনিন রাজ্যের সম্রাট হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। আর সে কারণেই তার শরীরের নিচের দিকটা মাছের লেজের মতো হয়ে উত্থানশক্তি রহিত হয়ে গেছে। এটা হলো ঐশ্বরিক মহিমারই প্র্রকাশ। সম্রাট ক্লেনের নিজেকে মৎস্য অবতার রূপে প্র্রচার করার কাহিনী প্রজাদের মনে ভীতি এবং শ্রদ্ধার সঞ্চার করলো। সম্রাট ক্লেনের এ অবস্থার একটি মূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।

মধ্যযুগের ইউরোপে মৎস্যকন্যা সম্বন্ধে মানুষের বিশ্বাস অত্যন্ত প্রবল ছিল। বহু নাবিক সমুদ্র যাত্রায় মৎস্যকন্যাদের দেখতে পেয়েছে বলে দাবি করেছে। তাদের মধ্যে বিখ্যাত ওলন্দাজ নাবিক ও আবিষ্কর্তা হেনরি হুডসন। তিনি ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষণা করেন, স্ক্যান্ডেনেভিয়ার সমুদ্র উপকূলের কাছে তিনি মৎস্যকন্যা মারমেইড দেখেছেন। নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিদের পুরাণ কাহিনীতে আছে জাদুপাখির কথা। দেবতা পৌরাঙ্গহআ তাঁর হাওয়াইকির বাড়ি থেকে উড়ে যেতেন জাদুপাখির পিঠে চড়ে। সেই দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা উচ্চারিত হতো। ‘আমি আসি আমার পদপ্রান্তে জেগে ওঠে এক অজানা পৃথিবী। আমি আসি। আমার ঊর্ধ্বে গড়ে ওঠে এক নতুন স্বর্গ। আমি আসি এ পৃথিবীর বুকে।’

বাম স্টোকার বিখ্যাত হয়েছিলেন ড্রাকুলার কাহিনী লিখে। সে গল্প শুনলে গা ছমছম করে ওঠে। সেখানে আছে ভ্যাম্পায়ারদের কথা রক্তচোষা বাদুড়। অশুভ শক্তির প্রতীক। ওই প্রেতাত্মার খিদে মেটে কেবল রক্ত পান করলে। নিশুতি রাতে কবর থেকে বেরিয়ে আসে ওরা। ঘুমন্ত মানুষের শরীর থেকে রক্ত নেয় শুষে। বহু বছর ধরে ভ্যাম্পায়ারদের কাহিনী মানুষকে আলোড়িত করেছে। কোথাও কোথাও রক্তহীন ফ্যাকাশে ছেলেদের দেখলে ভাবা হতো যে তারা বুঝি ভ্যাম্পায়ারের কবলে পড়েছে। সেই সব গা শিউরানো কাহিনী। গভীর রাতে কবর থেকে উঠে আসে প্রেতাত্মা। তখন চারপাশের পরিবেশ থাকে কেমন রহস্যময়। বাদুড়ের মতো বিরাট পাখা ছড়িয়ে নিঃশব্দে উড়ে যায় ভৌতিক প্রাণী। পেট ভরে রক্তপান করে আবার কবরের কফিনের ভেতরে গিয়ে শুয়ে থাকে। রহস্য গল্পের বাইরে কি এই প্রাণীটির অস্তিত্ব রয়েছে? প্রাণিবিজ্ঞানীদের কাছে এটি খুব কৌতূহল। এক ধরনের বাদুড় রয়েছে যারা প্রাণিদেহ থেকে রক্ত চুষে খায়। রক্তচোষা বাদুড় খুব দু®প্রাপ্য প্রাণী। সহজে ওদের দেখতে পাওয়া যায় না। একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাগ্রোস উপত্যকায় আছে ওরা। এক পাহাড়ি গুহাতে ভয়ানক দুর্গম অঞ্চল। সহজে যাওয়া যায় না জায়গাটি পানামাতে। ওই উপত্যকার আশপাশের এলাকা জনমানবশূন্য। দিঘল ঘাসের বন পেরিয়ে যেতে হয়।

বরফঢাকা উত্তরাঞ্চলের প্রাণী ভালুক গোত্রের উলভেরিন। আকারে ভোঁদড় জাতীয় প্রাণীর পর্যায়ে। কালচে ও বাদামি রোমে ঢাকা শরীর। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তীক্ষè দাঁত। চতুর স্বভাবের হিং¯্র প্রাণী। এস্কিমো শিকারিদের কাছে উলভেরিনের রোম আর চামড়ার যথেষ্ট কদর রয়েছে। আলাস্কার এস্কিমোদের কাছে উলভেরিন পরিচিত কিওয়া হারকেস নামে। এর অর্থ হচ্ছে শয়তান। এস্কিমোরা বিশ্বাস করে চতুর প্রাণী উলভেরিন তাদের সাথে সেয়ানাগিরি করছে। উলভেরিনের চামড়া আর পশমের লোভে এস্কিমো শিকারিরা নানা রকমের ফাঁদ পাতে। উলভেরিনদের আকৃষ্ট করার জন্য ফাদে উপাদেয় খাদ্য দেয়া হয়। উলভেরিনের ঘ্রাণশক্তি খুবই তীক্ষè। বরফের অনেক নিচ থেকে গন্ধ শুঁকে খাবার বের করতে পারে। খাবারের বাড়তি অংশ লুকিয়ে রাখে পাথরের ফাটলে। কাঁটাযুক্ত গাছের কাছে কিংবা নরম মাটির তলায়। উলভেরিনদের ক্ষিপ্র আর চতুর স্বভাবের জন্য এস্কিমো সমাজে প্রাণীটিকে নিয়ে নানা লোকবিশ্বাস আর কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এস্কিমোরা মনে করে উলভেরিনদের ভেতরে কোনো বড় শিকারির আত্মা লুকিয়ে রয়েছে। এ শিকারির আত্মাই জীবিত শিকারিদের নানাভাবে বোকা বানাবার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয় চতুর উলভেরিনকে।

শীতের শেষে বা বসন্তের প্রথম দিকে মা উলভেরিন বাচ্চা প্রসব করে। দুম্বাটি থেকে চারটি বাচ্চা দিয়ে থাকে তারা। উলভেরিন মূলত মাংসাশী। ছোট ফলও খেয়ে থাকে। এরা সব জায়গায় বিচরণ করতে সক্ষম। সাঁতরে নদী পার হতে পারে। দুর্গম প্রান্তর, উঁচু পাহাড়, ঘন ঝোপ সবখানেই এ প্রাণীটির রয়েছে অবাধ চলাচল। একটা উলভেরিন তার শরীরের তিনগুণ বড় একটি প্রাণীর মৃতদেহ অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিতে পারে। নেকড়ে বা গ্রিজলি ভালুক হচ্ছে এদের শত্রু। জ্যাক লন্ডন মেরু অঞ্চলের একটি নেকড়েকে নিয়ে লিখেছিলেন রুদ্ধশ্বাস উপন্যাস ‘হোয়াইট ফ্যাং’। তাতে বর্ণিত ছিলো চির তুষারের রাজ্যের প্রাণী একটি নেকড়ে ছানার কথা, হঠাৎ করেই জিনিসগুলোর একেবারে সামনে এসে পড়লো নেকড়ের বাচ্চাটা। তার নিজের সতর্কতার জন্যই ঘটলো এই অঘটন। আগের সারাটা রাত সে মাংসের খোঁজে কাটানোর ফলে সকালে সে যখন পানি খেতে গিয়েছিলো তখনও ঘুমের রেশ ছিলো চোখে। তা ছাড়া জলাশয়টার কাছে আগেও অনেকবার এসেছে, কখনোই তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। ঝড়ে উপড়ে পড়া পাইন গাছটার পাশ কাটিয়ে, ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েক পা এগোতেই বিচিত্র গন্ধ পেল সে।

ঠিক সামনে উবু হয়ে বসে আছে অদ্ভুত পাঁচটা জন্তু। তাকে দেখেও লাফিয়ে উঠলো না জন্তুগুলো, দাঁত বের করলো না, এমনকি গর্জনও করলো না। বরং স্থির হয়ে বসে রইলো অদ্ভুত ভঙ্গিতে। জীবনে এই গ্রিক পুরাণের এক অলীক প্রাণী হচ্ছে ইউনিকর্ন। অবিকল ঘোড়ার মতো এই কাল্পনিক প্রাণীর কপাল ফুঁড়ে বেরিয়েছে লম্বা, প্যাঁচানো শিং। অনেকেই বিশ্বাস করত যে ইউনিকর্ন ঘুরে বেড়ায় অজানা দেশের বনে-জঙ্গলে। দূরপ্রাচ্য ভ্রমণ করে মার্কোপোলো ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে তার ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি ইউনিকর্নের বর্ণনা দিয়েছিলেন, দূরপ্রাচ্যের জঙ্গলে অনেক ইউনিকর্ন আছে। এরা হাতির চাইতে ছোট, স্থূলদেহী এবং রোমশ। হাতির মতোই এরা পুরু চামড়া আর মোটা পায়ের অধিকারী। এদের মাথার সামনে রয়েছে কালো রঙের শিং। কল্পনার ইউনিকর্নের সাথে বাস্তবের প্রাণীটির মিল খুবই কম।

মার্কোপোলো গণ্ডার দেখে এরকম বর্ণনা দিয়েছিলেন। ইউরোপে জীবন্ত গণ্ডার প্রথম পৌঁছায় ১৬ শতকের প্রথম দিকে। পশ্চিম ভারতের দেশীয় রাজা মুজাফফর পর্তুগালের সম্রাট ম্যানয়েলকে একটি গণ্ডার পাঠিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। জাহাজে করে প্রাণীটিকে পাঠানো হয়েছিল। পথে দুর্ঘটনায় পতিত হলো জাহাজটি। জেনোয়ার নিকটে লিগুরিয়ান সাগরে জাহাজডুবি হলো। গণ্ডারের লাশটি ঢেউয়ের দোলায় ভেসে সাগরতীরে এলো। স্থানীয় এক শিল্পী অ্যালব্রেশট ডুরারের নিকট পাঠিয়েছিলেন। ডুরার সেই স্কেচ দেখে তার সাথে কল্পনার ইউনিকর্নের আদল মিশিয়ে গণ্ডারের একটি কাট খোদাই ছবি আঁকলেন ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে।
তৃতীয় শতাব্দীতে চৈনিক পণ্ডিত বেগ হুগ বলেছিলেন, গণ্ডারের খড়গ দিয়ে তৈরি খলনুড়িতে বিষাক্ত ওষুধপত্র ঘাঁটলে সাদা ফেনার মতো পদার্থ তৈরি হয়। এভাবেই বিষটুকু বেরিয়ে যায়। কেউ যদি বিষাক্ত তীরের আঘাতে আহত হয় তা হলে ক্ষতস্থানে গণ্ডারের খড়গ ছোঁয়ালেই বিষ বেরিয়ে যাবে।

এভাবে প্রাণীটিকে নিয়ে নানা ধরনের আকর্ষণীয় কাহিনীর সৃষ্টি হতে থাকে। পৌরাণিক কাহিনীর ইউনিকর্ন বাস্তবের গণ্ডারের সাথে মিশে যায়। গণ্ডারের চিত্রযুক্ত সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সিন্ধুসভ্যতার পীঠস্থান মহেনজোদারোতে। এটি খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সালের।
রোডেশিয়া মোজাম্বিকের উড়–ক্কু সরীসৃপ হচ্ছে কোঙ্গামোটো। এর বর্ণনার সাথে যথেষ্ট মিল ছিল প্রাগৈতিহাসিক কালের পাখি। টেরোডাকটিলের সাথে। মাদাগাস্কারের ভোরমপাট্টা ছিল অবলুপ্ত অ্যাপিরিনাম এর মতো।
১৮১৭ সাল থেকে বিশাল সমুদ্রসপ বা সি-মনস্টার এর নানা বিবরণ পাওয়া গেছে।
অবলুপ্ত আদিম তিমি ছিল জিউগলোডন।

জার্মি দ্বীপের হিংস্র অজানা প্রাণী নিয়েও একদা ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। এই তালিকাটি প্রধান ক্রিপ্টিডদের। অর্থাৎ যেসব অজানা জন্তুর অস্তিত্ব সম্ভব বলে ক্রিপ্টোজুওলজিস্টরা মনে করে থাকেন। এ বিষয়ে তাদের ব্যাপক অনুসন্ধান চলছে। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকোতে বিরাট কালো বনবিড়াল অনজার আবিষ্কার ঘোষিত হয়েছিল।
নিউ ইয়র্কের লং দ্বীপের পূর্ব কোণে মণ্টক সমুদ্রসৈকতে এক রহস্যময় প্রাণীর মৃত শরীরকে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। অনেকটা কুকুরের মতো দেখতে বীভৎস চেহারার এক খুদে দানব। ছুঁঁচালো মুখ। নাম দেয়া হলো মন্টক মনস্টার। চিত্রগ্রাহক পাম পালোনের মতো জন্তুটার মুখ, দাঁত, থাবা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছি। কোনো পরিচিত প্রাণীর সাথেই এর মিল নেই। সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্র ধরনের এক জীব। এর পেছনের পায়ের থাবা অনেকটা ভেড়ার মতো। সামনের পায়ের থাবার নখগুলো আবার বেশি ছড়ানো। এ ধরনের বিচিত্র জীব এর আগে আর কখনও দেখা যায়নি। মন্টকের সমুদ্রসৈকতে একটি মৃত দানব ভেসে এসেছে শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হলো।
পৃথিবীতে এখনও অনেক রহস্যময় প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে বলে মানুষের বিশ^াস। যাদের রহস্য এখনও আবিষ্কৃৃত হয়নি।

Share.

মন্তব্য করুন