স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর! বেশ লম্বা বয়স! একেই আমরা বলি অর্ধশতাব্দী। আমাদের স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পুরেছে এটি আনন্দের বিষয়! এই নিয়ে আমরা গর্ব করি। করতে পারি। এবং করা উচিতও। কেনো করবো না? নিশ্চয়ই করবো। করবো কারণ পঞ্চাশ বছর একটি বিরাট সময়। একটি দীর্ঘ পথের যাত্রা। একটি বয়সী আয়োজন। আমরা জানি এ যাত্রা খুব সহজ ছিলো না। খুব কাছেরও ছিলো না। ছিলো না নিরাপদ। এর জন্য অনেক বাধা পার হতে হয়েছে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। অনেক ত্যাগও স্বীকার করার প্রয়োজন পড়েছে। এতো কষ্ট। এতো ত্যাগ ও এতো বাধা পেরিয়ে যখন পেছন ফিরে দেখি আমাদের স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছরের এক দীর্ঘ সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ আনন্দ হয় তখন। মনে হয় আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে দাঁড়িয়েছি এবং দাঁড়িয়েই থাকবো। দাঁড়িয়ে থাকবো আমাদের সমস্ত পরিচয় নিয়ে। আমাদের আলাদা ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে। এবং আমাদের স্বতন্ত্র সৌন্দর্য নিয়ে।
স্বাধীনতা ছাড়া এর কোনোটা ভাবা যায় না। কোনোটাই কল্পনা করা যায় না। কোনোটাকেই আপন করে নেয়া যায় না। রুয়ে দেয়া যায় না নিজস্ব স্বপ্নের বীজ। বীজ থেকে বৃক্ষ এবং বৃক্ষ থেকে ফলও মিলে না। স্বাধীনতা এমনই দামি। এমনই ওজনদার। যাকে বাদ দিলে প্রকৃত মানুষ থাকাই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
সুতরাং আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা গৌরববোধ করবোই। করতেই পারি। করছিও তাই। এবং করেই যাবো। এ গৌরবের একটি চেহারা আছে। একটি রূপ আছে। একটি অবয়ব আছে। এটি আমাদের জীবনে সাহস হয়ে জেগে থাকে।

হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে- এ পঞ্চাশ বছরে আমরা স্বাধীনতার সব সুখ কি পেয়েছি? এর জবাব অবশ্যই- না। পাইনি। সব কেনো! অনেক কিছুই তো পাইনি। স্বাধীনতা ঘিরে আমাদের স্বপ্ন তো ছিলো বিশাল। কল্পনা ছিলো আকাশচুম্বী। আমরা জানি দেশ স্বাধীন হওয়া মানে স্বপ্ন স্বাধীন হওয়া। জীবন স্বাধীন হওয়া। জীবনের কর্ম স্বাধীন হওয়া এবং কর্মের অধিকার স্বাধীন হওয়া। এসব ক্ষেত্রে হয় তো এখনও আমরা আশানুরূপ সাফল্য পাইনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরা কিছুই পাইনি। আমাদের আশা বড়। স্বপ্নও বড়। বড় স্বপ্নের পথও অনেক দীর্ঘ। তাই আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে চলতে হবে পথ। চলতে হবে বিবেচনার সাথে। এ কথা সত্য- হয় তো না পাওয়ার বেদনা আমাদের কম নেই। কিন্তু স্বাধীনতার মতো সম্পদ পেয়েছি এ কথা তো সত্যি! পৃথিবীর বুকে একটি মানচিত্র পেয়েছি এ কথা তো সত্যি। একটি মুক্ত আকাশ পেয়েছি এ কথা তো সত্যি। আমাদের আলাদা একটি পরিচয় হয়েছে এ কথা কি সত্যি নয়! এ কথা খুব উচ্চকণ্ঠে বলা যায়- যে জগতের কাছে আমরা একটি স্বাধীন জাতি। স্বাধীন দেশের নাগরিক। এবং স্বাধীন পতাকাবাহী। আমাদের আছে হাজার বছরের ইতিহাস। আছে পথ চলার সাহসী গল্প। আমাদের ইতিহাসের বাঁক জুড়ে আছে বীরত্বের নিশান।

অর্ধশত বছর ধরে আমরা এ স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছি। স্বাধীন দেশের নাগরিক রূপে জেগে আছি। একটি স্বাধীন মানচিত্র জাগ্রত রেখেছে আমাদের। আছে আমাদের মুক্ত আকাশ। আকাশের উন্মুক্ত নীল। এ নীলাকাশের নিচে আনন্দ ও গৌরবে উড়ছে আমাদের স্বাধীন পতাকা। আহা আমাদের লাল-সবুজের নিশান। আমাদের মুক্তির মর্যাদার চিহ্ন। আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের সবুজ প্রকৃতি। আমাদের পলিময় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। তার ওপর বয়ে চলা স্রোতবাহী হাজারও নদী। নদীর বুকে উল্লসিত ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস। পাহাড়সম ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে নদীর কূলে। ধেয়ে আসা ঢেউয়ের গতিই যেনো আমাদের স্বাধীনতার উদ্যাম!
সেই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর কথাটি ভাবলে ভালো লাগছে খুব! ভালো লাগছে এর পথচলার চিত্র কল্পনা করে। এটি ভালোলাগার মতোই ঘটনা। শুধু ভালোলাগা নয়। খুব ভালোলাগার। এবং খুব ভালো লাগছে আমাদের। ভালো লাগছে কারণ- আমাদের স্বাধীনতা আমরা লড়াই করে এনেছি। সংগ্রাম করে এনেছি। এনেছি যুদ্ধ করে। অনেক জীবন অনেক রক্ত অনেক ত্যাগের এই স্বাধীনতা আমাদের। এ স্বাধীনতা কারো দয়ার দান নয়। কারো অনুদানও নয়। এটি একদম আমাদের অর্জন। লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন এ স্বাধীনতার জন্য। রক্ত দিয়েছেন স্বাধীনতা আনতে। দিয়েছেন জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে।
তবে যারা আমাদের এ সংগ্রামে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ঋণ স্বীকার করি। আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে এখন আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন স্বপ্ন দেখতে হবে। নতুন করে নিতে হবে পরিকল্পনা। অতীত থেকে ভুলগুলো মুছে নিতে হবে। বুঝতে হবে এ দেশকে। দেশের মাটি ও মানুষকে। বুঝতে হবে মানুষের ভাষা। নিজেদের স্বপ্নের কথা বলতে হবে মানুষের ভাষায়। মানুষের বুকের ভেতর রুয়ে দিতে হবে স্বপ্নের চারা। স্বাধীনতাকে যেমন বিশ্বাস করে তেমনি বিশ্বাস করতে হবে স্বাধীনতার সুফলকে। যা করা হয়নি আমাদের তা করার সুন্দর পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিকল্পনা নিতে হবে সময়োপযোগী। যুগের চাহিদা অনুযায়ী। আধুনিক জীবনের আকাক্সক্ষা বুঝতে হবে। সামাজিক ও পরিবার জানতে হবে। ব্যক্তির উন্নয়ন দরকার। একই সাথে পরিবারের উন্নতিও প্রয়োজন। একই ভাবে আত্মার উন্নতিও জরুরি। নিজেদের বোঝা প্রয়োজন। একই সাথে অন্যদেরও বুঝতে হবে। বোঝাবুঝির এই আয়োজনে হতে হবে চৌকস।
আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে যতদূর এগিয়েছি এখান থেকে আরও এগুতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। পুরনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে নতুন কিছু করা সম্ভব হবে না। অবশ্যই হবে না। একথাটি যত দ্রুত বোঝা যাবে ততটাই অগ্রগতি হবে। ততটাই এগিয়ে যেতে হবে সহায়ক।

এটি সত্য যে কোনো সমাজে নতুন কিছু করতে হলে আগে ব্যক্তিকে নতুন করে ভাবতে হয়। নতুন ভাবনা নতুন চিন্তা ও নতুন ভাষার প্রয়োগে নতুন কিছু করা হয়ে ওঠে। নইলে নয়!
একটি বিন্দুতে একমত হওয়া জরুরি। তা হলো গেলো তো পঞ্চাশ বছর। গেলো একরকম বা অনেক রকম করে। কিন্তু পরিবর্তন কতটা হলো। কতদূর এগুলো দেশ। মানুষ। এবং সমাজ! খুব সহজে ধরে ফেলা যায় কতদূর এগুলাম সবাই। যতদূর এগিয়েছি তা কি যথেষ্ট? না। যথেষ্ট নয়। তবে? তবের জবাব খুব সোজা- এখান থেকে নতুন পথ রচনা করতেই হবে। স্বপ্নের নতুন ভাষা দিতে হবে। যে ভাষা হবে মানুষের জীবন উন্নতির। যে ভাষা হবে জীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির। যে ভাষা হবে সৌন্দর্যের অবারিত উল্লেখ।
মানুষ যদি উন্নতির ধাপ বোঝে। যদি বোঝে স্বপ্নের বাস্তবতা তবে কেনো গ্রহণ করবে না মানুষ! কেনো চাইবে না নিজেদের কল্যাণ।

স্বাধীনতা আমাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে- যার জন্য আমাদের পথচলা। সে পথ আমাদের করে দিয়েছে যে পথে আমাদের সাফল্য। এখন এটি বুঝতে হবে নিজেদের। বুঝতে হবে সবার আগে। মন উদার করে চলতে হবে পথ। পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ ঝেড়ে দিতে হবে। বুকে মেলাতে হবে বুক। বিভেদ রেখা মুছে চলতে হবে আগামীর পথে। প্রতিহিংসার শিখা নিভিয়ে দিতেই হবে। জ্বালাতে হবে প্রেমের জ্যোতি। মানুষকে ভালোবাসার মতো ভালো কাজ কমই আছে। মানুষকে ঘৃণা করার মতো অপরাধও কম। সুতরাং যারা সমাজে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখে তাদের নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে একবার। নিজেদের মনের দিকে দেখতে হবে গভীর ভাবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশে এই বোধ জেগে উঠুক আমাদের। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে আনতে হবে নতুন দিন। মানুষের আস্থা জন্মালেই শুধু হতে পারে নতুন কিছু। নতুনের এই স্বপ্ন হোক আমাদের পথচলার নতুন আশা। কেননা স্বপ্নই মানুষের জীবনকে শানিত করে। ঠিক এ কথাই সত্য- মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।

Share.

মন্তব্য করুন