অনেকটা পথ পেরিয়ে বুঝতে পারি স্বাধীনতার পথ কত বন্ধুর। আগামীকালের খবর কারও জানা নেই। যতদূর এগিয়েছি তার মূলে কাজ করেছিল আমাদের একত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ, শান্তির প্রতি অবিচল আস্থা ও সর্বাপেক্ষা অধিক জাতীয় সম্মানবোধ। আমাদের অর্জন শূন্য তা বলা যাবে না। যতখানি এগিয়েছি মূলে সার্বভৌমত্বের অহঙ্কার। নেতৃত্বের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তবে মূল শক্তি সাধারণ মানুষের। আজও তাই।
পাকিস্তানিরা আমাদের ধর্মের ভাই ছিল। ধর্ম কাজে আসেনি। নির্বিচারে হত্যা করেছে তারা। আজও ক্ষমা চায়নি। ধর্মের দোহাই দিয়ে কোন কিছু সফল হবে না। হতে হবে মানুষের দোহাই, হোক সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান। আসল বোধ মনুষ্যত্বের বোধ। সেটা না থাকলে আমরা হবো উদ্দেশ্যবিহীন। যে ¯্রষ্টাকে চেনে না তার কাছে স্বাধীনতার কী মূল্য তা আমি বুঝি না। যে নত হতে পারে নি, সে সমুন্নত হবে কি করে? আল্লাহ্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হলে সেই পতাকার মধ্যে আল্লাহ্র আশিস যুক্ত নেই।

সার্বভৌমত্ব একমাত্র ¯্রষ্টার। তার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করলে এর মর্ম উপলব্ধি করব, তার আগে নয়। মুসলমানরা একমাত্র আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করে, আর কারও কাছে নয়। সম্পদের কাছে, পরাশক্তির কাছে, মাথা নোয়ায় না। যদি প্রাণ যায় তাতে মুসলমানরা শঙ্কিত নয়। এখন পৃথিবী ব্যাপী যে ব্যাপক মানুষে মানুষে সংঘর্ষ তার মধ্যে যেমন আছে জাতি বিদ্বেষ, তেমনি স্বজাতির মধ্যেও নানা সংঘর্ষের খবর। মক্কা শরিফে গিয়ে কাবার সামনে জায়নামাজ পেতে দি’। অদূরেই বোমার গর্জন। শত্রু পক্ষ থেকে নয়। মুসলমানরাই মুসলমানদের কতল করছে সামান্য কারণে। সামান্য কারণেই বা কিভাবে বলি। এটা হলো এক পক্ষের অন্য পক্ষের উপর প্রভুত্ব করার ইচ্ছা। কখনও এটি রূপ নিয়েছে শিয়া-সুন্নি বিরোধে, কখনও বা এক রাজশক্তি আরেক রাজশক্তিকে দমন করার জন্য প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে লক্ষ মানুষের। রাতের গভীরে নিরাশ্রয় নারী ও শিশুরা রওয়ানা দিয়েছে সমুদ্রপথে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে। লক্ষ লক্ষ মানুষ।

জাতিতে জাতিতে চলছে যে প্রতিযোগিতা, এর সমর্থন নেই কুরআনে। ‘আত-তাকাসুর’-এ (১০২:১) সুনির্দিষ্ট বাণী। আল্লাহ্ বলছেন: ‘সম্পদ বাড়িয়ে তোলার ইচ্ছা (তাকাসুর) মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে এমন প্রতিযোগিতা, যা তাদেরকে নিয়ে চলে বক্রপথে (পৃথিবীর সম্পদ আহরণ করে তা বাড়িয়ে তোলার জন্যে ও অন্যকে নিজ অধীন করার প্রতিযোগিতায় চলতে থাকে অন্যায় কার্যক্রম)।’ ইতিহাসে যা পাঠ করেছি এতদিন ধরে তা হলো: সম্পদ বাড়িয়ে তোলার প্রতিযোগিতা, এক দেশকে অন্য দেশের গোলামে পরিণত করার প্রতিযোগিতা। এটি সফল হবে না কোনদিনই। বারে বারে ধ্বংস হবে এই প্রক্রিয়া। সূরাটির শেষাংশ ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ পড়ে দেখুন। বারবার পড়–ন। কুরআন ব্যাপী খুঁজে পাওয়া যাবে শক্তিধরদের ভূলুণ্ঠিত হওয়ার খবর। নিজেদেরকে সার্বভৌম ভেবেছিল তারা। অথচ তাদের খুঁটি যে কত নড়বড়ে ছিল তা তারা একমুহূর্ত আগেও বুঝতে পারেনি। মিসরে গিয়ে সভ্যতা দেখে এসেছি, ইরাকের ব্যাবিলনেও। সব ধসে পড়েছে। সা’ল তুশ্তারি এটাকে স্পষ্ট করেছেন। বলছেন: ইয়াকিন আগুন, জিহ্বা হচ্ছে ফাতিলা, আর কর্ম হচ্ছে এর তেল (জাইত) দৃঢ় প্রত্যয়ে দেখা শুরু হবে এর উন্মোচনে (মুকাসাফা), তারপর আসবে দেখা (মুআইনা), এরপর চাক্ষুষ প্রত্যয়ে দেখা (মুশাহাদা)। আল্লাহু আকবার।

নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ্র অহঙ্কার। নমরুদ, হিটলার, মুসুলিনি এরা সবাই ভেবেছিল যে সর্বময় ক্ষমতাটি তারা পেয়েই গেছে। তাদের পরাজয়ের গ্লানি ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে। এই কারণেই ইতিহাস পড়ি। যে সামান্য সুখভোগে মত্ত আমরা, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ব্যবহার করছি ব্যক্তিগত কোষাগারের মত, তা হবে ধুলায় ভূলুণ্ঠিত। আল্লাহ্ বলছেন: ‘সেদিন অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে তোমাদের সুখভোগ সম্পর্কে (যা নিয়ে মত্ত ছিলে পৃথিবীতে)।’ (১০২:৮) সা’ল তুশ্তারি বলছেন: সুখভোগ এমনটিই: রাত্রি বা দিনের একটি ঘণ্টাও অতিবাহিত নয় যখন আল্লাহ্তায়ালা মানুষ ও জিনদের উপর তার অধিকার সম্পর্কে অনবহিত, তারা জানুক বা না জানুক। শেষ বিচারে সবই অন্তর্ভুক্ত।

স্বাধীন ছিলাম না। নজরুলের গানগুলি গাইতাম সারাদিন ধরে। ওগুলো গাওয়ার পরই রক্তে আগুন ধরে যায়। নজরুল একমাত্র কবি যিনি কারাগারে গিয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লেখার জন্যে। জেলখানায় বিষধর সাপ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। ধরিয়ে দেয়া হল গ্রামোফোন কোম্পানির চাকরি যাতে সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি বাইরে থাকেন। সর্বশেষে তার ঘাড়ে আঘাত। কবি হলেন নির্বাক। এগুলো সবই ইতিহাস। যদি না জেনে থাকো তা হলে অনুগ্রহ করে পাঠ করো নজরুলের জীবন নিয়ে প্রথম ও একমাত্র উপন্যাস: ‘পুড়িব একাকী’। জানতে পারবে স্বাধীনতার রক্তঘন উপলব্ধি কিভাবে কবিকে করেছিল দিনরাত্রির জন্যে উদ্বিগ্ন। কেউ তার সঙ্গী হয়নি।
স্বাধীনতা জানতে হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে হবে। ওদের রক্তদানের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে নতুন দিনের নাগরিকদের। ওরা এই আত্মদান সম্পর্কে অবহিত, নির্জীবভাবে। নেই প্রগাঢ় উপলব্ধি। উপলব্ধিকে তাদের মধ্যে সম্পৃক্ত করতে হলে আনতে হবে অরাজনৈতিক উদার দৃষ্টিভঙ্গি।

জাতীয় নেতা একদলের নেতা হতে পারে না। উনি সবার নেতা। কট্টর মুসলমানরা প্রিয় নবীকে ভাবেন শুধু তাদের রাসূল। আর কাউকে তার ভাগ দেবেন না। তা তো নয়। উনি সমস্ত পৃথিবীর জন্য রহমতের নবী হিসেবে এসেছেন। মুহাম্মদ (সা.) শুধু মুসলমানদের জন্য নন। দৃষ্টিভঙ্গি করতে হবে উদার, যেমনটি করেছেন মওলানা জালালউদ্দিন রুমি। তিনি নবী (সা.)-কে পৌঁছে দিয়েছেন সমস্ত পৃথিবীর দ্বারপ্রান্তে প্রথমবারের মত। বিশ জন অনুবাদক মসনবি অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে, ফরাসি ভাষায় জার্মান, জাপানি ও রুশ ভাষায়। মওলানার আট শ’ বছর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পৃথিবীতে তিনিই এখন সর্বাপেক্ষা সমাদৃত কবি। তার বইয়ের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য কবি পেছনে আছেন (রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সমেত)। যারা নবী (সা.)-কে চিনতেন না, তারা দেখছেন রুমির চোখ দিয়ে। রুমি উপস্থাপন করেছেন তার ভালোবাসার অন্তরঙ্গ রূপটি, যেখানে মানবিক প্রেম রূপ নিয়েছে ঐশ্বরিক প্রেমে।
১৬ই ডিসেম্বরের পর কয়েকজন ভারতীয় মেজর আমার বাসায় আসেন। চা-টা খান, গান শুনতে চান, গান শোনাই। পরে হাসতে হাসতে বলেন, তোমাদেরকে আমরা স্বাধীন করে দিলাম। আমি কিছুই বললাম না। তবে যাওয়ার আগে খুব চাপা গলায় বললাম, তোমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছ মুক্তিবাহিনীর সহায়তায়। যদি কোনদিন তেমন দিন আসে, বাঙালিদের কোনদিনই পরাজিত করতে পারবে না।

Share.

মন্তব্য করুন