স্বাধীনতা শব্দটি বিশেষ্য পদ। বিশেষণ পদ স্বাধীন; অর্থ বাধাহীন, মুক্ত, স্বচ্ছন্দ, সার্বভৌমত্ব। স্বাধীন শব্দের পরিষ্কার দৃষ্টান্ত হচ্ছে পাখি। পাখি এমনই স্বাধীন প্রাণী যে, আকাশ বা মহাশূন্যের কোথাও উড়তে তার কোনো বাধা নেই। দিবা-রাত্রি যেকোনো সময় পাখি মনের আনন্দে গান গাইতে পারে। মানুষেরও স্বপ্ন থাকে পাখির মতো স্বাধীনভাবে বাঁচার। প্রতিটি মানুষ স্বাধীন হতে চায়; মুক্ত থাকতে চায়। নিজের মতো করে চলতে চায়। যা চিন্তা করে তা বলতে চায়। সব কিছুতেই স্বাধীনতাকে ভোগ করতে চায়। মানুষ ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনতা যেমন চায়, তেমনি চায় সমাজজীবনে এবং জাতীয় জীবনেও। মানুষের ব্যক্তিজীবনের পরিসীমা সংক্ষিপ্ত কিন্তু জাতীয় জীবনের পরিসীমা নির্ধারিত হয় না। জাতীয় জীবন হয় দীর্ঘ, প্রলম্বিত। জাতীয় জীবন বলতে একটা জাতির বেঁচে থাকা বা টিকে থাকাকে বোঝায়। একটা জাতি যখন স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকে তখন সে জাতির বেঁচে থাকা সার্থক হয়। স্বাধীনভাবে বাঁচতে না পারলে, পরাধীন থাকতে হয়। পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকাটা, শুধু বেঁচে থাকা হয়; সার্থক হয় না। যেমন বাঙালি জাতির হয়েছিল ইংরেজ আমলে। জাতিগতভাবে ইংরেজরা এদেশের মানুষ ছিল না। তারা ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ইউরোপ মহাদেশ থেকে এসেছিল। তখন মোগল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকাল। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা ভারতের সুরাটে প্রথম বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করে।

তখন থেকে বাংলায় ইংরেজদের আগমন শুরু হয়। তারা ব্যবসা করতে আসে অথচ এ রাষ্ট্রের কর পরিশোধ করে না। সে সময় এদেশের নবাব ছিল সিরাজউদ্দৌলা। নবাবের সাথে ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের যুদ্ধ হলো। পলাশীর যুদ্ধ। যুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিল লর্ড ক্লাইভ। এ যুদ্ধে নবাব পরাজিত হলেন। দেশের মানুষ স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলল এবং বাঙালি জাতি ইংরেজ জাতির অধীন হলো। ইংরেজরা ইচ্ছেমতো মানুষের উপর অত্যাচার করতে লাগল। জোর করে নীল চাষ করাতো। ঘন ঘন খাজনা বাড়িয়ে দিত। প্রজাদের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত দাম না দিয়ে তারা গুদামজাত করত। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। বাংলা ১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষ। ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে এ দুর্ভিক্ষ পরিচিত। লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা গেল। এই দুর্ভিক্ষ বিশে^ ইতিহাস হলো। এভাবে দু’শ বছর কেটে গেল। মানুষ ইংরেজদের অত্যাচার থেকে বের হতে চাইল। নবাবের আমলের মতো স্বাধীন থাকার স্বপ্ন দেখতে লাগল এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকল। বাঙালি মুসলমান হিন্দু সকলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহস সঞ্চয় করতে থাকল। ভারত পাকিস্তান উভয় থেকে নেতৃত্ব দিলেন মওলানা আজাদ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, হুসাইন আহমাদ মাদানি, উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজী, নবাব আবদুল লতিফ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহ্রুসহ আরো অনেকেই। অবশেষে ইংরেজরা ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি দেশে বিভক্ত করে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেল। মানুষ স্বাধীন দেশ পেল। নবগঠিত পাকিস্তান নামে দেশটি দুটি অঞ্চলে পরিচিত হলো। একটি পশ্চিম পাকিস্তান অন্যটি পূর্বপাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ববঙ্গও বলা হতো। এই দুই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই জাতিতে মুসলিম; কিন্তু তাদের ভাষা আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে গণপরিষদে আলোচনা শুরু হলো। সিদ্ধান্ত হলো উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। তারাও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলল। এ দাবিকে পাকিস্তান সরকার গ্রাহ্য না করলে শুরু হয়ে যায় বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানিদের দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব থেকেই বাঙালি স্বপ্ন দেখে ছিল একাত্তরে স্বাধীনতার।

বাংলা ভাষার দাবিতে দ্বন্দ্ব এক সময় সঙ্ঘাতে রূপ নেয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান নিয়ে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি চালায়। দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল। শহীদ হয় রফিক উদ্দীন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, মুহাম্মদ অহিউল্লাহসহ আরো অনেকেই। যে স্বপ্ন, যে আশা, যে সাধ, যে চেতনা নিয়ে ইংরেজ থেকে স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তান তা আর থাকল না। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে তৈরি হলো অবিশ^াস ও বৈষম্যের প্রাচীর। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হলো পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে লাগল। রাজনীতির অধিকার, কথা বলার অধিকার, সংস্কৃতি চর্চার অধিকার, চাকরির অধিকার, অর্থব্যবস্থার অধিকার; ইত্যাদি অধিকার থেকে মানুষ যখন বঞ্চিত হলো এবং বঞ্চনার প্রতিবাদ করতে যেয়ে নির্যাতনের শিকার হতে থাকল। তখন পূর্বপাকিস্তানের মানুষ আবার স্বাধীন হবার স্বপ্ন দেখতে লাগলো।

এবার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করল শেরই বাংলা ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ। রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা মানুষকে পূর্বপাকিস্তান স্বাধীনের স্বপ্ন দেখাতে আরম্ভ করলেন। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে অংশ নিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ আবুল কাসেম, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, শাহেদ আলী, আবুল হাশিম, নুরুল হক ভুঁইয়াসহ অনেকেই। রাজনৈতিক আন্দোলন এগিয়ে চলল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন হলো ১৯৫৪ সালে। ১৯৬৬ সালে পেশ করা হলো স্বাধিকারের ৬ দফা। ছয় দফা বাস্তবায়িত হলো না। ৬ দফা গণদাবিতে রূপ নিলো ১৯৬৯ সালে। গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হলেন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ ও ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। পাকিস্তান সরকার আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে নির্বাচন দিয়ে পরীক্ষা করতে চাইল। শুরু হলো ১৯৭০ সালে নির্বাচন। এ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক আসন লাভ করল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দেয়া হলো না। চক্রান্ত করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়। এর প্রতিবাদে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিলেন। সংগ্রাম প্রতিহত করতে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শুরু হয় স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম। ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হলো। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে ১১টি সেক্টর করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল চাষি মুটে মাঝি মজুর; জেলে তাঁতি কামার, ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। অর্জিত হয় বাঙালির স্বপ্নের স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার ৫০ বছর সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন হতে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের মনে স্বাধীন থাকার যে আনন্দ, সেই আনন্দ নেই। স্বাধীনতার বাস্তবায়ন নেই। স্বাধীন দেশে মানুষ ভোটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের নেতা বানাতে পারে না। মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়ে গেল। অর্থনৈতিক মুক্তি কেউ পেল, কারুর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো। কেউ রাজনীতি করতে পারে কেউ পারে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা হত্যা, গুম, নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হতে থাকল। স্বাধীনভাবে কথা বলতে গেলে বিনা বিচারে জেল খাটতে হয়। অফিস আদালতে সাধারণ মানুষ অবজ্ঞা অবহেলা তাচ্ছিল্যের শিকার হতে থাকে। কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না। মেয়েরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে না। অফিসে, বাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তাঘাটে নারীদের শ্লীলতাহানি করা হয়। রিলিফের জিনিসপত্র মেম্বার, চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা গায়েব করে দেয়। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, গায়করা তাদের মেধা চর্চা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হতে থাকেন। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে খবর দিতে ভয় পায়। দুর্বল মানুষ ভয়ে তটস্থ হয়ে নিভৃতে কাঁদে। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা প্রদর্শনে আরো দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। এমন অপ্রীতিকর বীভৎস স্বাধীনতার স্বপ্ন এদেশের মানুষ দেখেনি। স্বাধীনতা ধীরে ধীরে হয়ে উঠল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ার। দেশের মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বানানো হলো। যারা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করলো তাদেরকেও স্বাধীনতার বিপক্ষে ফেলে দেয়া হলো। স্বাধীনতার স্বপ্ন কেন জানি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে থাকল। ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ আমল কোনো আমলেই মানুষ স্বাধীনতার আসল স্বাদ উপভোগ করতে পারল না। কার পাপে এমন হলো তা কেউ বলতে পারে না।

Share.

মন্তব্য করুন