আমার ছোট মামা। নাম হাবু। কে-না তাকে চেনে। আমি তাকে ছোট মামা না বলে হাবু মামা বলেই ডাকি। নানীর মুখে শুনেছি হাবু মামা নাকি ছোটবেলা হাবাগোবা বেচারা ধরনের ছিল। তাই নানা তার নাম রেখেছিলেন হাবু। পুরো নাম হাবিবুল ইসলাম।
হাবু মামা বেকার। কাজকর্ম নেই। সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ানো আর নানার হোটেলে তিন বেলা খাওয়া। হাবু মামা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে হুট করে চলে আসে। তখন আমার সাথে মাও খুব খুশি হন। হাজার হোক একমার পেটের ভাই। হাবু মামা এলে মা আর তাকে সহজে ছেড়ে দিতে চান না। আর আমাকে নিয়ে কি যে হইচই। মার রান্নাবান্নারও ধুম পড়ে যায়। কী খাওয়ালে হয় তার ছোট ভাইটিকে তাই নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত। মা হাবু মামাকে বলেন; ক’টা দিন এখানে থেকে যা। মামা মার কথায় রাজি হয়ে যায়। হাবু মামা মওকা পেয়ে আর মোটেই নড়তে চায় না।
হাবু মামার দেহের গড়নটা লম্বা আর লিকলিকে। মাথার প্রথম দিকে চুল ফাঁকা হতে শুরু করেছে।

হাবু মামা টেনেটুনে এসএসসিটা উতরে যাওয়ার পর কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু এইচএসসিতে ফেলের হ্যাটট্রিক করে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছে। আর কলেজমুখো হয়নি। তাতে কী হয়েছে। হাবু মামার তাতে কোন মাথা ব্যথা নেই। দিব্যি চলে যাচ্ছে দিন। ঠিক যেন নদীর স্রােতের মতো। হাবু মামার দুটো জিনিসের প্রতি ভীষণ শখ। এক নম্বরে ছিপে মৎস্য শিকার আর দুই নম্বরে ক্রিকেট খেলা। না না মামা নিজে ক্রিকেট খেলে না তবে ক্রিকেট খেলা দেখায় একেবারে পটু। বাংলাদেশ দলের খেলা থাকলে সেদিন আর মামার নাওয়া-খাওয়া থাকে না। টিভি সেটের সামনে বসে বাইরের জগতের কথা ভুলে যায়। চার ছক্কা হাঁকালে বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড় সোফা ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে। একা একা চিৎকার আর হাততালি দিয়ে ঘরটাকে সরগম করে রাখে। নিজের দল যদি হেরে যায়। সেদিন আর মামার মুখের দিকে তাকানো যায় না। মুখটা আষাঢ়ের মেঘের মত থম থম করতে থাকে।
হাবু মামার ছিপে মাছ মারার শখ সেই ছোটবেলা থেকে। বাড়ির পুকুরে, নদীতে কিংবা বিল বাঁওড়ের জলাশয়ে যেখানে মাছ সেখানে আমার হাবু মামা। কোন দিন মাছ পায় কোন দিন না। তবে মামা ধৈর্য হারা হয় না। ছিপ ফেলে পাতনার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমনকি দিনের পর দিনও। বড়শিতে মাছ ঠোকর দিলে মামার চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

গত বছরের আশি^ন মাস। বেলা তখন ডুবু ডুবু একটু পরেই আঁধার ঘিরে ধরবে। এমন সময় খুলনার টুটপাড়া থেকে হাবু মামা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। পিঠে বড় ব্যাগ। হাতে কাস্টিং ছিপ। এসেই হেড়ে গলায় আমাকে ডাক দিলো; কইরে গাবলু। গেলি কোথায়? এদিকে আয়। আমি তখন সবে বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরছি। মামার হাঁক শুনে বাইরে এলাম সাথে মাও। মামার হাতে ছিপ দেখে বললাম কি গো মামা, তুমি এখানে মাছ ধরবে নাকি? মামা বলল; তুই জানিস না। তোদের সাতক্ষীরার পৌরসভার দীঘিতে আগামীকাল থেকে তিন দিনের জন্য মাছ ধরার টিকিট দিয়েছে? আমি বললাম, নাতো মামা জানি না। মামা বললো, দুলাভাইকে টিকিট কিনতে বলেছিলাম। দুলাভাই টিকিট কেটে রেখেছেন। কাল ভোর থেকে তুই আমার সঙ্গে থাকবি। হাবু মামার প্রস্তাবে আমিও খুশি হলাম। মামার মাছ মারার দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখতে পাবো এই ভেবে।

তখন ভোরের পাখিদের ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু হাবু মামার ঘুম ভেঙে যায়। আমাকেও ঘুম থেকে ডেকে তোলে। আমার চোখে তখনও ঘুম জড়িয়ে। চোখ দুটো দু’হাতে কচলাতে কচলাতে উঠে পড়ি। ততক্ষণে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের নামাজের আযান শুরু হয়ে গেছে। পাখিরাও গাইতে শুরু করেছে। হাবু মামা মাছ মারার জন্য খাবারের চার তৈরি করতে লেগে যায়। রাতেই কটা মশলা মা’র কাছ থেকে মামা বেটে রেখে দিয়েছে। সেগুলোর সাথে ব্যাগ থেকে মামা এক এক করে বের করতে থাকে বড় মেথি, একাঙ্গি, বুচকিদানা, তাম্বুল, রসুন, ঘোড়াবাজ, কাঙলাসহ আরো কত কী? ওগুলোর সাথে আবার আতপ চালের ভাত চটকাতে থাকে। তার সঙ্গে আরো খৈল ভাজা, গাওয়া ঘি। মশলা মাখা প্রায় কেজি খানেক হবে। মামা এগুলো একটি পাত্রে রাখে। আর একটি পাত্র বের করে তাতে রাখে পাউরুটি আর লাল পিঁপড়ের ডিম। আর একটি পাত্রে বেশ কিছু ভিজেমাটি। আমি এতসব মাছ মারা মশলা দেখে অবাক হই। আমি মামাকে প্রশ্ন করি। মামা এ যে এলাহি কা-। মামা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল; চুপ কর এখন কোন কথা না আমার সঙ্গে এবার চল।

এতক্ষণে ভোরের আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। পুব আকাশে সূর্য লাল আবির ছড়িয়ে ডগমগ করে উঠতে শুরু করেছে। মামা ছিপ আর মশলা পাতি সঙ্গে মাছ তোলার জালতি নিয়ে দীঘির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আমি তার পিছনে পিছনে। আমার হাতে মামার ধরিয়ে দেয়া মাছ রাখার জন্য চটের একটা বস্তা। আমাদের বাড়ি থেকে দীঘিটা বেশি দূরের পথ না। মিনিট দশ বারো হেঁটে আসতে সময় লাগে। আমরা পৌঁছে গেলাম যথাসময়ে। মামা তার নির্দিষ্ট মাচায় যেয়ে উঠে গেল। আমিও উঠলাম। মামা ব্যাগ থেকে বের করে চারের মশলাপাতি। সেই সাথে অন্যপাত্রে আনা মাটির দলায় মশলা মিশিয়ে মামা দীঘির পানিতে সামনের ছিপ বরাবর ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা। ততক্ষণে বেলা অনেকটা উপরে উঠে গেছে। অন্য মাছ শিকারিও সব এসে গেছে যার যার মাচায়। উৎসব মুখর পরিবেশ। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার পাশেই দীঘি। রাস্তায় লোক চলাচল শুরু হয়ে গেছে সেই ভোর থেকে।

হাবু মামার ছিপে দুটো বড়শি। দুটো বড়শিতেই পাউরুটি ও পিঁপড়ের ডিমের চার গেঁথে নেয়। তারপর বড়শির চারটি ছুঁড়ে দেয় আগে যেখানে মশলাপাতির চার তৈরি করে ছিটিয়ে দিয়েছিল। সাদা ময়ূরের পাতনা ভাসছে পানির ওপর। মামা ছিপ নিয়ে মাচাটায় বসে থাকে। চোখ শকুনের মত পাতনার দিকে। বেলা বাড়তে থাকে। বড়শিতে মাছের ঠোকর দেয়ার কোন লক্ষণ নেই। আমার তো মাচায় বসে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যথা ধরে যায়। মামা কিন্তু অবিচল। শুধু পাতনার দিকে নজর। কোন নড়ন চড়ন নেই। একেবারে যেন কাঠের পুতুল। আমার হাফ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল সেটটা বের করে দেখে নিই ক’টা বাজে। তখন দশটা পার হয়েছে সবে।
মা সকালের নাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন। দু’জন মাচায় বসে খাবো। আমি মামাকে তাড়া দিলাম। বললাম, মামা এখনও তো মাছ লাগেনি বড়শিতে। এই ফাঁকে এসো আমরা নাস্তা সেরে নিই। মামা শুধু বলল, পরে চুপ করে বসে থাক। আমি চুপ হয়ে যাই।

কিছুক্ষণ বাদেই হাবু মামা আমাকে বলল, দেখতো গাবলু পাতনাটা একটু নড়ছে না? আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি বাতাসের ঢেউয়ে পাতনাটা দুলছে। আমি মামাকে বললাম, তাই তো মামা বড়শিতে মনে হয় মাছে ঠোকর দিচ্ছে। মামার চোখে মুখে তখন যে কি উত্তেজনা। মামা বলল, মাছ এসে গেছে গাবলু। এক্ষুনি দেখ কেমন করে মাছ গাঁথি বড়শিতে। শুধু হু বলে পাতনার দিকে চোখ বড় বড় করে আমিও তাকিয়ে থাকি। মামা ছিপ ধরে হঠাৎ টান দেয়। উঠে আসে একটি বড়সড় কাঁকড়া। আমার হাসি আসে। মামাতো রেগে আগুন, আমাকে জোরে ধমক দেয়। মামা কাঁকড়াটিকে বড়শি থেকে ছাড়িয়ে মাচায় সজোরে আঘাত করল। কাঁকড়াটার ঘিলু ছিটকে আমার ও মামার জামা প্যান্টে এসে লাগলো। ক’জন পথচারী রাস্তা থেকে মাছ মারার দৃশ্য দেখছিল। তারাও হাসাহাসি করে যার যার গন্তব্যে পা বাড়ালো।

হাবু মামা আবার বড়শিতে চার গেঁথে ফেললো। এবার আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই পাতনা ডুবিয়ে নিলো। আর তখনই ছিপের সুতো ছাড়া হুইলের সুতো ডান হাতের আঙুলে চেপে জোরে টান। মাছ বড়শিতে গেঁথে গেছে। মামা সুতো ছাড়ছে না। মাছটি প্রাণপণে ছুটে যেতে চাইছে। মামাও নাছোড়বান্দা। মামা বলল, গাবলু নিশ্চয়ই দশ বারো কেজির রুই হবে। আমি বললাম, হ্যাঁ মামা তাই হয়তো হবে। মামা কোন কিছুতেই হাতের সুতো ঢিল করছে না। মামা আর মাছে টানাটানি। ইতোমধ্যে মামার মাচার পিছনে প্রচুর লোকের ভিড় জমে গেছে মাছ দেখার জন্য। মাছের টানে মামা একবার মাচার সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে যাচ্ছে, আবার পরক্ষণে পিছনে চলে আসছে। মামা আমাকে আবার বলল, মাছ তোলা জালতিটা রেডি রাখ। আমি জালতি হাতে নিয়ে অস্থির হয়ে পায়চারি করছি। এই বুঝি মাছ উঠে এলো। মামার কপাল ঘেমে গেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম জবজব করছে সারা গা আর কপালে। মামা আবারও বললো হাঁপাতে হাঁপাতে গাবলু মাছটা মনে হয় আরো বড় হবে। আগে ওকে টেনে তুলি মাচায় তারপর তুই দেখিস। মাছে মামার টানাটানিতে সুতোয় আঙুল কেটে রক্ত বেরুচ্ছে। মামার সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই।

হঠাৎ করে মামা দেখি মাচার পিছনে দীঘির পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। বড়শি ভেঙে মাছ চলে গেছে। মামার হাতে তখনও খালি ছিপ। তবে একটি বড়শিতে বিঁধে আছে মাছটার কানকো। আমি লাফিয়ে পড়লাম পানিতে মামাকে তোলার জন্য। সেই সাথে উৎসুক দর্শকের কয়েকজন মামাকে চ্যাংদোলা করে পানি থেকে তুলল। কিন্তু একি! মামার যে জ্ঞান নেই। তাড়াতাড়ি ভ্যান করে সদর হাসপাতালে নেয়া হলো। ডাক্তার নার্স ছুটে এসে মামার চিকিৎসা শুরু করল। আমি হতভম্ব। কী করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। সংবাদ পেয়ে মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন হাসপাতালে। খুলনা থেকে নানা নানীও রওনা হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। মামার তবু জ্ঞান ফেরে না। সবাই ভীষণ চিন্তিত। আমিও সবার অজান্তে চোখ মুছে নিলাম। ভাবলাম হাবু মামাকে কি হারিয়ে ফেলবো? মা বারবার আঁচলে চোখ মুছছেন। হঠাৎ মামা চোখ খুলে বলল, গাবলু আমার মাছ? মা কান্নাকণ্ঠে বলে উঠলেন বাহাদুর ভাই আমার কি বাহাদুরি দেখালে!

Share.

মন্তব্য করুন