সাধারণ মানুষের সাথে একজন কবির পার্থক্য বেশ। এটি সবাই জানেন। সবাই বোঝেন। বলেনও সবাই। কিন্তু কী পার্থক্য সে কথা তো বলেন না কেউ। হ্যাঁ তাই তো! কী পার্থক্য একজন কবি আর সাধারণ মানুষের?
পার্থক্যটি খুব দূরের কিছু নয়। আবার একদম কাছেরও নয়।
কবির থাকে অন্তর্দৃষ্টি। থাকে দু’টি চোখের বাইরে আরও একটি চোখ। একে বলে তৃতীয় নয়ন। ভেতর দৃষ্টিও বলে একে। সাধারণ মানুষ যা দেখেন কবি দেখেন তারও বেশি। তারও দূরের। তারও অধিক কিছু। দেখেন আড়ালের অদেখা বিষয়। দেখেন অপ্রকাশ্য দিক। যা গোপন থাকে তা ই প্রকাশ পায় কবির তৃতীয় চোখে। যে কবির ভেতরের চোখ যত ধারালো সে কবির লেখা ততই গভীর। সুন্দর। আনন্দময়।
আল মাহমুদ তেমনই গভীর দৃষ্টির একজন কবি। তেমনই সুন্দর কবিতার কবি।

তিনি বেড়ে উঠেছেন গ্রামে। গ্রামের মাটি বৃক্ষ ও লতাপাতার গন্ধ জেগে আছে তার কবিতায়। তার লেখা নাড়া দিলে বের হবে ফুলের সুবাস। ঝরবে পাতার রঙ। ভেসে উঠবে মাটির ঘ্রাণ। এবং বয়ে যাবে নদীর স্রােত। তার কবিতায় কখনো চাঁদের মুখ। কখনো জোছনা। কখনো অন্ধকার। কখনো ধানের দুলুনি। তার কবিতায় জাগ্রত গ্রামীণ নিসর্গ। আল মাহমুদ তেমনই একজন কবি। যিনি একেবারে গ্রাম ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা। যিনি গ্রামের আবহমান সৌন্দর্যের রূপকথার কবি।
তার একটি কবিতা পাঠ করা যাক-
একটু ছিলো বয়স যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
আমার কাছে খেলাই ছিলো কাজের চেয়ে দামী।
উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
তারার দেশে উড়তো আমার পরান আত্নহারা।
জোছনারাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ
আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ।

আহা কি আনন্দের কবিতা! কি স্বপ্নময় কবিতা। কি মজার কবিতা।
এই যে উঠোন ভরা ফোটা ফুল, আকাশ ভরা তারার মেলা আর জোছনা রাতের কথা আমরা সবাই জানি। সবাই দেখেছি। দেখি আজও। কিন্তু একজন কবি দেখেছেন আনন্দের সাথে। অন্যরকম করে। অন্য চেতনায়।
এ কবিতায় আরও লিখেছেন-
তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দুটি পা
নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না।
খেলার সাথী ছিলো তখন প্রজাতির ঝাঁক
বনবাদালির গন্ধে কত কুটকুটাতো নাক।
কি অদ্ভুত মজার কবিতা। তারায় তারায় কবি হেঁটে বেড়ান। এবং নীল চাঁদোয়ায় শেষ হতো না রাত। খেলার সাথী প্রজাপতির ঝাঁক বললেই আমরা দেখি গ্রামের ঝিঙে ফুলে দলে দলে উড়ে যাওয়া নানা রঙের প্রজাতি।

কাঁঠাল চাঁপা ফুলের কথা আমরা জানি! জানি তার মুগ্ধ গন্ধের কথা। কী মনকাড়া রঙ তার! কী চমৎকার তার পাপড়ি! কী মনজুড়ানো ঘ্রাণ! আহা! দেখতে যেমন। শুঁকতেও তেমন। তেমনি তার সৌরভ। বাংলাদেশের বন বাদাড়ে এখানে ওখানে এ ফুলের দেখা মেলে। দেখি আমরা। চিনিও সকলেই প্রায়। চিনলে কি হবে! তার কথা বলতেও তো হয়! কিন্তু শুধু বললেই কি হয়? না। যেনতেন করে বললেই হয় না। তবে? তবে আর কি অন্যরকম করে বলার মজাটি তো অন্যরকম হবেই। আর সেটি যদি কোনো কবি বলেন?
এবং সে কবি যদি হন আল মাহমুদ! তবে তো আরও অন্যরকম! তেমন অন্যরকম করেই বলেছেন কবি আল মাহমুদ। কী যে মজা করে বলেছেন তিনি! যেমন তার ভাষা। তেমনই তার শব্দ। তেমনই তার ছন্দ। তেমন করেই দুলে ওঠে মন। কবিতাটি পাঠ করে আসি তবে-
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।

আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।

সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়
দুধ ভরা ওই চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায়!

তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো।

তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হবার জন্য
আমি না হয় পাখি হবো
পাখির মতো বন্য।
অসাধারণ একটি কবিতা। একেবারে গ্রাম জড়ানো কবিতা। স্বপ্ন জড়ানো কবিতা।
অদ্ভুত উপমা টেনেছেন তিনি। চাঁদকে বলেছেন দুধ ভরা বাটি। এবং সে বাটি ফেরেশতারা উল্টায়। গোটা বাংলা কবিতায় এমন উপমা ছিলো না। নেই। এখানে আল মাহমুদ একদম আলাদা। একেবারে পৃথক একজন।

তার আরেকটি কিশোর কবিতার কথা বলা যাক-
নারকোলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠা-া ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর
ঝিম ধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিল থরথর।
দরগাতলা পার হয়ে যে মোড় ফিরেছি বাঁয়
কোত্থেকে এক উড়কো পাহাড় ডাক দিলো আয় আয়।
পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দীঘিটার পার
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।

আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল
বললো এসো আমরা সবাই না ঘুমানোর দল!
আনন্দের কবিতা। কি যে কল্পনার বিশালতা। রাতজাগা বিস্ময় সব ঘটনা।
তিনি বলেছেন চাঁদটি ডাবের মতো গোলগাল এবং ঠা-া। এ যে ডাবের মতো চাঁদটি ঝুলে থাকে আকাশে। একেও অদ্ভুত উপমা বলা যায়।
তার আরেকটি কবিতার নাম ‘রসায়নের রান্না’। কবিতাটি একেবারে অন্যরকম উপমার। নান্দনিক শব্দ ছন্দ ও অন্তমিলে- পড়ে দেখা যাক কবিতাটি-
গ্লোবের পেটে কান লাগিয়ে খোকন শোনে কান্না
বিশ্ব গোলক ফুঁপিয়ে ওঠে আর পারি না আর না।
মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা আমায় নিয়ে খেলছে
আমার সাগর পাহাড় নদীরোলার দিয়ে বেলছে ।
ক্লোরোফিলের ছিলো আমার সবুজ ভরা গাত্র
সাগর ভরা ছিলো আমার লবন জলের পাত্র।

সব বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষ ধুয়ায় আকাশ অন্ধ
কলের বিষে তলিয়ে গেছে গোলাপ ফুলের গন্ধ।
শস্য ছিলো পুষ্প ছিলো ছিলো সুখের পার্বন
শান্তিটাকে পুড়িয়ে মানুষ করলো কালো কার্বন।
এমনই অসাধারণ অনেক কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ। লিখেছেন মন ঢেলে। হৃদয় উজাড় করে। কি অবাক করা উপমা দিয়েছেন তিনি। বলছেন আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে, বিস্ময়কর! বিস্ময়কর!

আল মাহমুদের একটি কবিতার নাম ‘নোলক’। এ কবিতাটির কথা তো সবারই জানা। কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হন সবাই। আড্ডায়-আসরে আলোচনা হয় নোলক কবিতা। পড়ে আসি একবার-
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম আছে তোমার কাছে?
হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।

বললো কেঁদে তিতাশ নদী হরিণ বেড়ের বাঁকে
সাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল হারিয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করেরে ঝিকমিক।

বনের কাছে এই মিনতি ফিরিয়ে দেবে ভাই
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।

সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি না তো
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও হাত পাতো হাত পাতো।
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।

এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।

আহা কি চমৎকার কবিতা। কি অসাধারণ সুন্দর তার চিত্রকল্প। কি যে পরিস্কার তার বাণী। ‘হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে’ এ কথা খুব ছোট কথা নয়। এ বাণী কোনো সাধারণ বাণী নয়। এটি বাংলাদেশের ভেতরের চিত্র। বাংলাদেশের বুকের ভেতর লুকায়িত দৃশ্যের খবর। দেশপ্রেমের একটি উজ্জ্বল উপমা এ কবিতা।
আল মাহমুদ জন্ম নিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানায়। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ছিলো তারিখটি। লেখালেখি শুরু হয় কিশোরকাল থেকেই। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের তুমুল সময়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকাতেই তার সবকিছু। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলামসহ সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন তিনি। সব বিষয়ে প্রকাশিত বই সংখ্যা একশ’র বেশি।

তিনি আমাদের প্রিয় কবি। তার কবিতা আমাদের বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা বলে। তার সাহিত্য বিশ্বাসের কথা বলে। ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
আল মাহমুদকে জানতে হবে আমাদের। জানতে হলে পড়তে হবে তার রচনা। তার কবিতা পাঠ করতে হবে। করতে হবে গভীর ভাবে। তিনি যা লিখেছেন তার ভেতর তাকে আবিস্কার করা যাবে। একজন লেখক তার লেখায় বেঁচে থাকেন। একজন কবি বেঁচে থাকেন তার কবিতায়। কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের মানুষের কাছে পৌঁছে যান।
একজন কবি বেঁচে থাকেন তার রচনার ভেতর। তার সৃষ্টির ভেতর। তার লেখার ভেতর। আল মাহমুদও তার কবিতায় তার সৃষ্টির ভেতর থেকে যাবেন। থেকে যাবেন পাঠকের হৃদয়ে হৃদয়ে। থেকে যাবেন কবিতার ছন্দের দোলায়।
আল মাহমুদের রচনা পাঠ করতে হবে আমাদের। পড়তে হবে তার রচিত সাহিত্য ভা-ার। তবেই আমরা জানতে পারবো কত বড় ছিলেন আল মাহমুদ! কত কিছু লিখেছেন তিনি। আমরা জানবো তিনি আল মাহমুদ তিনি কবি।

Share.

মন্তব্য করুন