বিশ্বমাঝে গর্ব করার মত বাংলাদেশের যে কয়টি স্থান আছে, নিঃসন্দেহে সুন্দরবন তার অন্যতম। বিশ্বের একক বৃহত্তম ‘ম্যানগ্রোভ বন’ এটি। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এক আকর্ষণীয় স্থান। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বহু পশু-পাখির প্রিয় আবাসভূমি এটি। ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা, ফনী ও বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবেলা করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। নিপুণ হাতের সবুজ আলপনায় সাজানো রূপসী রাজকন্যার মতো সুন্দরবন নিজেই যেন প্রকৃতির এক মহাকাব্য, রহস্যময় ছবি। সৌন্দর্য পিয়াসী কবি-শিল্পী, সাহিত্যিকদের এক চিরন্তন দুর্বার আকর্ষণ এই সুন্দরবন। তারা সুন্দরবনকে নিত্য নতুন শিল্প সুষমা দান করেছেন তাঁদের বর্ণিল শিল্পকর্মে। লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, এঁকেছেন ছবি। বাংলা সাহিত্যে এমন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার খুঁজে পাওয়া কঠিন যিনি কোনো না কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্দরবনকে তাঁর সৃষ্টিকর্মের বিষয়বস্তু করেননি। এমনকি ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজেস এশীয় কবিতা উৎসবে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসে সুন্দরবনে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাঁর নীল চোখে সুন্দরবন যে মায়াজাল পরিয়ে দিয়েছিল তারও প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর কয়েকটি কবিতায়। সুন্দরবনের যেন এক সম্মোহনী শক্তি আছে। আছে এক দুর্বার আকর্ষণ। এ কারণেই কবি বলেছেন-
‘যে খেয়েছে কেওড়ার ঝোল
সে ভুলেছে মায়ের কোল।’
বাংলা সাহিত্যের নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি কবিতায় সুন্দরবনাঞ্চলের সমুদ্রগামী নদীর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
‘নদী চলিছে ডাহিনে বামে
কভু কোথাও সে নাহি থামে।
হোতায় গহন গভীর বন
তীরে নাহি লোক নাহি জন।
শুধু কুমীর নদীর ধারে
সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে।
বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝাপে
ঘাড়ে পড়ি আসে এক লাফে।
কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ
তাহার গায়ের চাকা চাকা দাগ,
রাতে চুপি চুপি আসে ঘাটে
জল চকো চকো করি চাটে।’
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সুন্দরবন পরিদর্শন করতে গিয়ে জঙ্গলের নির্জন স্থানসমূহ ও বিস্ময়কর পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন-
‘গহন সুন্দরবনের
অজানা বিহগ কণ্ঠে
কে গাহিছে গান-
আর কে শুনিছে বসি
দেবতাবিহীন এই নির্জন মন্দিরে
পাতায় পাতায় কারা কহিতেছে
ফিসফিস কথা
কার কথা, কোন সে বিস্মৃত রূপকথা
আধ জানা আধ নাহি জানা
ভুলে যাওয়া ছায়াপথ ধরি
কোন সে অতীত হতে
আনিয়াছে বটুক আহারি।
কি করুণ সুরে পাখিটি ডাকিতেছে
বাঁশি বাজিছে রয়ে রয়ে
মন বলে এই খানে রয়ে যাই
মন্দিরের শিলাখ- হয়ে’।
জীবনানন্দ দাশ অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৃতিপ্রেমিক কবি। প্রকৃতির নানা উপকরণ তাঁর কবিতায় মর্যাদার সাথে স্থান করে নিয়েছে। বাংলার নিসর্গের রূপ তিনি চিত্রায়িত করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। নিসর্গের অন্যতম রূপকার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সুন্দরবন উঠে এসেছে এভাবে-
‘অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো নীল হয়ে যাচ্ছে আবার
যেন মেহগিনির গহন ঘন ছায়ায়
হয়ে যাচ্ছে মেহগিনি কাঠের হরিণ
নীল দারুময়ী বাঘিনী
অন্ধকার রাত্রি ঘিরে
নিরাকূল সমুদ্রের মতো
পাহাড়ের গুহায় গুহায় আবেগে স্ফীত হয়ে উঠছে
রুপালি চাঁদের আলোর ফোয়ারায়
হাওয়ার ফোয়ারায়
রাশি রাশি কাঞ্চন ফুলের মতো ফুটে উঠছে এদের দেহ আরেকবার’
(সুন্দরবনের গল্প- জীবনানন্দ দাশ)
আবুল হোসেন আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন সুর সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কাব্যে বাংলার নিসর্গ এসেছে উৎকৃষ্ট শিল্পকলার সহযোগী হিসেবে। চিত্রময়তা ও কুশলী শব্দবিন্যাস তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তিনি লিখেছেন-
‘দাদা যাবে বাঘ শিকারে
সঙ্গে নেবে কারে কারে?
খোকন সেজে বসে আছে
সকাল থেকে দোরের কাছে।
দাদা শুনে প্রমাদ গনে
খোকন যাবে বাদাবনে!
খোকন বলে, কেন, কেন?
গাছে বসে বাঘ মারাটা
দারুণ একটা ব্যাপার যেন,
খাই না আমি রোজ পরটা?
দেখছে আমার হাতের পেশি?
বাঘ বাবাজি করলে বেশি
বাড়াবাড়ি কানটা ধরে
শুইয়ে দেব না এক চড়ে?
(বাঘ শিকার- আবুল হোসেন)
আধুনিক বাংলা কাব্যের শক্তিমান কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় সুন্দরবন উঠে এসেছে নানাভাবে নানা অনুষঙ্গে। তিনি লিখেছেন-
‘সুন্দরবনের শোভা দেখেছি নিকট আর দূর
থেকে, জানা আছে ওর নিজস্ব বাসিন্দা পশুদের
পরিচয়-হিংস্র ওরা অবশ্যই, সকলেই নয়, অনাহারে
কাতর হলে শুধু হরিণ অথবা অন্য প্রাণীকে আহার করে
মাঝে মাঝে। আজকাল আমাদের রাজধানী আর
কতিপয় শহর ও পাড়াগাঁর নরপশুদের কথা শুনে
মাথা হেঁট করে আরও গভীর জঙ্গলে চলে গেলে
ওদের মাথায় চাঁদ আর নক্ষত্রেরা ফুল, চন্দন ছড়ায়।’
(সুন্দরবনের খুব কাছে- শামসুর রাহমান)
বাংলা কাব্য সাহিত্যে আল মাহমুদের হাতে যেভাবে সুন্দরবন উঠে এসেছে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন:
‘অরণ্যে স্বাধীন সবই, জোঁক, ব্যাঙ, তরুণ হরিণ
বাঘের দারুণ চোখ, ঝোরার সচল জল সাপ
আর এই আগাছার বন্য ফুল তাও যে রঙিন।
বনমুরগির ডানা, প্রস্রবণে তরল আলাপ
বাতাসে পাশব গতি, পাষাণের উদ্যত চিবুক
সবার স্বতন্ত্র সত্তা, প্রত্যেকের সহজ সাহস
একাকী আমিই শুধু, আমি যেন কেমন অলস
বনে কারো দুঃখ নেই আমি ছাড়া, আমারই অসুখ-’
(অরণ্যে অসুখী- আল মাহমুদ)
খ্যাতিমান কবি ফজল শাহাবুদ্দীন সুন্দরবন নিয়ে লিখেছেন-
‘এই পাহাড় অরণ্য এই সুন্দরবনকে তুমি ধ্বংস হতে দিয়ো না কোনোদিন
দক্ষিণ লোকে আমাদের বেঁচে থাকার এক বিশাল খোলা জানালা এই সুন্দরবন
যেখানে তোমার সুন্দরবন আর তার খোলা সমুদ্র
সেখানেই আজো আমরা বেঁচে আছি এখনো বেঁচে থাকি
আমরা বেঁচে থাকতে চাই চিরকাল এই বঙলোকে
এই সুন্দরবনের বৃষ্টিভেজা জানালায় বাতাসের সামনে দাঁড়িয়ে
তোমার সবুজ পাতা আর বহুবর্ণ ছড়ানো পুষ্পভরা
পুরোনো হাওয়ায় আন্দোলিত দরোজাকে
তুমি বিপন্ন হতে দেবে না কখনো
আমার স্বদেশ তুমি তোমার কাছে আমার ক্রমাগত প্রার্থনা।’
(আমার আম্মা এবং সুন্দরবন- ফজল শাহাবুদ্দীন)
সুন্দরবন নিয়ে একটি মিষ্টি আমেজের কবিতা লিখেছেন শামসুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন-
‘আদিকাল থেকে তোমার সুনাম।
সুন্দরী গাছের ফাঁকে নরখাদক
ওঁৎ পেতে থাকে শিকার আশায়।
আমি ভয় পেয়েছিলাম হে
আমার যাওয়া হলো না।
কেওড়ার মধু অবশ্য আমি পেয়েছিলাম
আলী আকবর ভূঁইয়ার কৃপায়।
কিন্তু তোমার অঞ্চলে পা দিতে
ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম আমি।
আমার আর কোনদিন যাওয়া হলো না
তোমার নিলয়ে হে সুন্দরী সুন্দরবন।
(সুন্দরবন- শামসুল ইসলাম)
মহাদেব সাহা মূলত প্রেম ও প্রকৃতির কবি। প্রকৃতির মধ্যে তিনি যে সৌন্দর্য অনুভব করেছেন, হাতে সুন্দরবনের গোলপাতা চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে। সুন্দরবনের গোলপাতা নিয়ে তিনি লিখেছেন হৃদয় কাড়া এক কবিতা-
‘জল পড়ে গোলপাতা –ঘরে
পড়ে জল বাহিরে অন্তরে,
বৃষ্টি জল কাঁপে গোলপাতা
আকাশ কি জলের উদগাতা?
সেই কথা জানে না কিছুই
বৃষ্টি ভেজে ভবনের বাবুই,
দূরে কার শোনা যায় বাঁশি,
কাকে খুঁজি, কাকে ভালবাসি;
(গোলপাতা- মহাদেব সাহা)
সুন্দরবন দেখতে মানুষ কতটা আবেগপ্রবণ হয়, যুগে যুগে কবিদের সৃষ্টিতে তার পরিচয় পাওয়া যায়। শক্তিমান কবি মুশাররাফ করিমের কবিতায়ও সে দৃষ্টান্ত আছে। তিনি লিখেছেন-
‘তোমাকে এক পলক দেখতে, আমি
গায়ে মাখবো না কোনো প্রতিবন্ধক;
যত দূরেই থাকো তত দূরেই যাবো
সুন্দরবন তুমি কি জানো না, আমি যে
তোমার এক কাঙাল প্রেমিক।’
(সুন্দরবন প্রিয়বরেষু- মুশাররাফ করিম)
কারো কারো কবিতায় সুন্দরবন বিশেষভাবে রূপায়িত হয়েছে। এমনই একজন কবি শাহাদাত বুলবুল। ‘একা, বড্ড একা সুন্দরবনে’ কবিতায় সে দৃষ্টান্ত মেলে।
‘বড় আশা ভরসা করে
এসেছি সুন্দরবনে। ভালবাসবে
প্রজাপতি, বাঘ, হরিণ
ভালোবাসবে?
ভালোবাসবে মহাকাল?
এ বুকে আশা ও বিশ্বাস
নিয়ে এসেছি বনে। আমাকে নাও
বনজ হাওয়া, ময়ূর,
নাও আমাকে।
আমাকে নাও নীলাকাশ।’
(একা, বড্ড একা সুন্দরবনে- শাহাদাত বুলবুল)
ফারুক নওয়াজ একাধারে কবি, ছড়াকার ও শিশুতোষ গাল্পিক। নানা বিষয় নিয়ে তিনি চমৎকার কিশোর কবিতা রচনা করেছেন। সুন্দরবন তার কবিতায় উপেক্ষিত নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে ফারুক নওয়াজের ‘সুন্দরবন’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হলো
‘সবুজের ঠিকানায়
যত দূরে চোখ যায়
অনাবিল বিস্ময়ে ভরে যায় মন।
নদী যেন মালা হয়ে
চারিদিকে যায় বয়ে
পাড়ঘেঁষে জেলেদের জীবন যাপন।
ভেঙে সব নীরবতা
হরিণের চপলতা
গোলবনে বাঘেদের শুনি গর্জন।
বাওয়ালির ছেলে গুলো
চুলগুলো উলো ঝুলো
চোখে মুখে সাহসেরা বাজে ঝন ঝন।
কেওড়ার শাখা ধরে
শাখা মৃগ খেলা করে
পাখিদের মাতামাতি চলে সারাক্ষণ।
এতো রূপ এতো শোভা
অনাবিল মনোলোভা
এই হলো আমাদের সুন্দরবন।’
(সুন্দরবন- ফারুক নওয়াজ)
আসলাম সানী ছড়া এবং কিশোর কবিতার দক্ষ কারিগর। তার ছড়া কবিতায় সমাজ ও পরিবেশের বাস্তব রূপ ও মানবিক বেদনাবোধ অতি উজ্জ্বল ‘সুন্দরবনের আহবান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘এই দেশে আছে কত অমূল্য ধন
পশুপাখি মানুষের হৃদয় স্বজন।
সুন্দর এই দেশ বিশ্বের সেরা
সুন্দরবন ভাই স্বপ্নেই ঘেরা।
এই ভবনে হরিণীরা কত খেলা করে
ডোরা কাটা বাঘগুলো ছায়াপথে ঘিরে।
যদি দেখিবার চোখ আর মন
দেখে এসো একবার সুন্দরবন।’
(সুন্দরবনের আহবান- আসলাম সানী)
এভাবে জীব ও বৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনের স্থান হয়েছে একালের আরো অনেক বিখ্যাত কবিদের বহু কবিতায়। কখনো সরাসরি, কখনো বা অন্য কোনো প্রসঙ্গের অনুষঙ্গ হিসেবে। যেমন- আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমার সকল কথা’ শহীদ কাদরীর ‘বিচ্ছিন্ন দৃশ্যাবলি’ বেলাল চৌধুরীর ‘সুন্দরীতমা সুন্দরবন’, রফিক আজাদের ‘তোমাকে কাছে পেয়ে’, সিকান্দার আমিনুল হকের ‘অন্য কিছু নয়, নিসঙ্গ’, নির্মলেন্দু গুণের ‘সেই গাছ’, আল মুজাহিদীর ‘অরণ্যা’ বুলবুল খান মাহবুবের ‘আধুনিক বনবাসি’ সাযযাদ কাদিরের ‘সমুদ্রবন’ হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘বাঘ ও লালন’ শিহাব সরকারের ‘সবাই চলে গেছে’, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘গাছ গাছালির গল্প’, আতাহার খানের ‘সবুজ আমাকে ডাকে’ তাপস মজুমদারের ‘সুন্দরবনের বাঘ’, নাসির আহমেদের ‘সুন্দরবন’ আবু করিমের ‘সুন্দরবনের কেওড়া’, দুখু বাঙালের ‘বনবাসি’ জাহাঙ্গীর ফিরোজের ‘সুন্দরবনের ছায়াটি’, জাহিদ হায়দারের ‘ক্ষমা করো বনভূমি’ আবদুল হাই শিকদারের ‘সুন্দরবন গাঁথা’ ফাহিম ফিরোজের ‘সুন্দরবনের বাঘ’ সুজাউদ্দীন কায়সারের ‘সুন্দরবনের হরিণ চোখ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে রচিত এসব কবিতা বাংলা কাব্য সাহিত্যে হীরকখ-ের দ্যুতি নিয়ে বেঁচে থাকবে হাজার বছর; প্রিয় পাঠক, এ প্রত্যাশা আপনার মতো আমারও।

Share.

মন্তব্য করুন