গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরের আবহাওয়া বেশ গরম হয়। বিশেষ করে শহরে কেন্দ্রে বেশি গরম অনুভূত হয়। কিন্তু শহরের চারপাশের গ্রামাঞ্চলে তুলনামূলক কম গরম পড়ে। যেমন- গ্রীষ্মকালে শহরাঞ্চলের জলবায়ু অনেক উষ্ণ থাকে এবং এই উষ্ণতা স্থির ও অনেক বেশি সময় ধরে অনুভূত হয়।
সাধারণত মনে করা হয় যে শহরে কলকারখানা এবং যন্ত্রপাতি বেশি, গাড়ি বেশি চলাচল করে এবং এগুলো থেকে ধোঁয়া ও কার্বন বের হওয়ার কারণে এবং গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে গ্রামের তুলনায় বেশি গরম অনুভূত হয়।
কোন কোন বিষয়ের কারণে গরম বাতাস বেশি উৎপন্ন হয়, গরমের কারণে কী কী ক্ষতি হয়, গ্রিনহাউজ ইফেক্ট, কালো ধোঁয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। কিন্তু আরও এমন অনেক বিষয় আছে যেটা সম্পর্কে আমরা কম জানি।

উঁচু উঁচু কংক্রিটের দালান কোঠাগুলো বাতাসের প্রবাহকে বাধা দেয়। শুধু বাধাই দেয় না, এই দালানগুলোর অবস্থানের কারণে বাতাস প্রবাহের একটি চ্যানেল তৈরি হয়ে যায়। এসব কারণে কোনো একটি এলাকার পুরোটুকু ঠা-া না হয়ে বিশেষ কয়েকটি স্থান একটু একটু ঠা-া বাতাস পেয়ে থাকে।
গরমের কারণে বাষ্পীভবনের মাত্রা বেড়ে যায়, কিন্তু তাপশক্তির ক্ষয় কম হয়। কারণ উন্নত কারিগরি প্রকৌশলের কারণে বৃষ্টির পানি কিংবা গলিত তুষার থেকে প্রাপ্ত পানি ড্রেন দিয়ে বের হয়ে যায়।
আবার শীতপ্রধান দেশে লবণ ছিটিয়ে দেয়ার কারণে রাস্তায় বরফও বেশিক্ষণ ধরে স্থায়ী হতে পারে না। এই পিচঢালা রাস্তা এবং দালান কোঠা তৈরির উপাদানগুলো খুব সহজেই তাপ শোষণ করে ফেলতে পারে। কিন্তু কাঠের বাড়ি কিংবা ঘাস জাতীয় রাস্তা কিংবা মাটি এসবের তুলনায় কম তাপ শোষণ করে।

যদি আমরা ধরে নেই যে দালানগুলোর উচ্চতা প্রায় একই রকম এবং শুধুমাত্র রাতেই এরা নিজেদের শোষিত তাপগুলো ছাদ দিয়ে বাইরে বের করে দেয় তাহলে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই অবস্থাটি হচ্ছে একই সারির দালানের ওপর একটি ঠা-া বাতাসের স্তর তৈরি হয়ে যায়।
ভূমি থেকে উঠে আসা গরম বাতাসকে এই স্তর বাধা দেয় এবং গরম বাতাসের একটি ফাঁদ তৈরি করে। যদি পুরো শহরে বায়ু দূষণের পরিমাণ বেশি হয় এবং বাতাসে যদি দূষিত পদার্থের উপস্থিতি বেশি থাকে, তাহলে এরকম তাপীয় ফাঁদের ফলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠতে পারে। এই গরম রাতের বেলা যদিও বাইরে চলে যেতে পারে তবুও গ্রামাঞ্চলের মতো ঠা-া পরিবেশ শহরে পাওয়া যাবে না।

কংক্রিট, বিটুমিন কিংবা এস্ফালট ইত্যাদি দিয়ে যে রাস্তা তৈরি করা হয় এগুলোর তাপ ধারণক্ষমতা অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সূর্যের আলোর কারণে প্রচ- গরম পড়ে। সেখানকার পৃষ্ঠভাগ যে পরিমাণ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে সেটা খুবই ভয়ঙ্কর। যেমন- সেখানকার এস্ফালট দিয়ে তৈরি রাস্তার পৃষ্ঠভাগ প্রচ- গরমে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গরম হয়ে পড়তে পারে। যেখানে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতে মানুষের শরীরের চামড়া পুড়ে যায় সেখানে এখানকার তাপমাত্রা আরও ২৬ ডিগ্রি বেশি। তার মানে যদি সেই রাস্তায় কেউ গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়, তাহলে দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতি হবার সাথে সাথে গরমের থেকেও তার শরীরের ক্ষতি হবে। এমনকি পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকলেও পা থেকে পুরো শরীর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

প্রচ- গরমের ফলে পরিবেশে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যেখানে গাছপালাও পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঊহারৎড়হসবহঃধষ ঝপরবহপব ধহফ ঞবপযহড়ষড়মু নামক জার্নালে একটি গবেষণাপত্র বের হয়, যেখানে দাবি করা হয়, শহরের উদ্ভিদ, বিশেষ করে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদগুলো পরিবেশে দূষিত পদার্থ তৈরিতে অনেক সময় সাহায্য করে। সেই গবেষণায় আরও দেখানো হয়, যখন কোনো শহরের তাপমাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং শহরের ভিতর দিয়ে গরম বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে, তখন এই জাতীয় উদ্ভিদগুলো বিশেষ রাসায়নিক উপাদান বের করে পরিবেশে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এর সাথে সাথে আশপাশের পরিবেশের তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। এখানে বৃক্ষ নিজ থেকে পরিবেশের ক্ষতি করছে না, বরং আশপাশের গরম পরিবেশ তাদেরকে বাধ্য করছে এমনটি করতে।

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, শুধুমাত্র গাড়ির ধোঁয়া বা কারখানার চিমনি থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ শহরাঞ্চলে গরমের জন্য দায়ী নয়। কোনো কিছু তৈরিতে আমরা যে উপাদান ব্যবহার করে থাকি, সেই উপাদানগুলোর কারণেও গরম বৃদ্ধি পেতে পারে। এবং এই সবকিছু মিলে একটি জায়গায় যে উষ্ণতার সৃষ্টি হয় সেই উষ্ণতাপ্রবণ এলাকাকেই বলা হয় হিট আইল্যান্ড।
বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে আমাদের প্রয়োজন সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া এবং একটি পরিকল্পনা তৈরি করা। তাহলে একটি সুন্দর সমাজ এবং সুন্দর পরিবেশ তৈরি হবে। পরিকল্পনা এবং পরিবেশ আইন প্রণয়ন করলে ইতোমধ্যে হওয়া ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

Share.

মন্তব্য করুন