সূর্য ডুবে গেছে অনেকটা আগেই। কুয়াশার মতো ঝাপসা অন্ধকার নেমেছে খেলার মাঠজুড়ে অল্প আর হালকা। তুলি বলল, ‘দীপু, চল সবে বাড়ি যাই।’
মামামি অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, ‘যাবো তো, চল না আরেকটু খেলা করি। কি রে দীপু, খেলবি আরও?’ দীপু ভয়ে তুলির কথায় সায় দিলেও মামামিকে না করতে পারেনি! তুলিও চালাকচতুর বুঝে ফেলল অনায়াসেই। কিন্তু দলের বাকিরা খেলবে না কেউ; ওরা বাড়ির পথে হাঁটছে…। দীপু, তুলি মামামি সবার পিছনে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঝখানে বাকিরা সবার সামনে। হাঁটতে হাঁটতে তুলি বলল, ‘দীপু, মামামি, দেখ, দেখ ওটা কে? মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে, রাস্তায় দূরত্ব রেখে! ভীষণ ভয়ে দীপু বলল, ‘ভূত! ভূত!! ভূত ওটা…।’ দীপুকে ধমক দিয়ে মামামি বলল, ‘থাম, থাম তো, ওটা ভূত নয়, মানুষই।’ তাকিয়ে দেখ, ঝাপসা অন্ধকার, কেউ-ই তাই দেখতে পায়নি। কড়া গলায় মামামি বলল, ‘ওকে পথ চলো, কাল না হয় দোকানি দাদুর থেকে জানা যাবে লোকটা কে ছিল? মাঠের পাশেই তো দোকানটা, দোকানি দাদু দেখবেন নিশ্চয়ই।’

দীপুরা প্রতিদিনই জড়ো হয় ছোট্ট এই মাঠটায়, খেলার জন্য। এটা সুন্দরপুর গ্রামের একমাত্র খেলার মাঠ। পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাঠের উত্তরে তিতিয়া জঙ্গল, তার উত্তরে ছোট দীঘি তারপরেই জমিদার বাড়ি, অনেক বছরের পুরনো আর ভাঙাচোরা।
জমিদার বাড়ির পরেই মতিয়া নদীটা। উত্তর থেকে পূর্ব এবং দক্ষিণে বয়ে গেছে নিরবধি, কলকলিয়ে আপন মনে…পশ্চিমে ছবির মতো সুন্দর ‘সুন্দরপুর’ গ্রামটা। সুন্দরপুরের পর মতিপুর তারপরে নীলদীঘি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। স্কুলের পরেই পাকা ব্রিজ। ব্রিজটা মতিয়া নদীর উপরে নির্মিত; ছোটখাটো আর সুন্দর! ব্রিজের ওপাশেই শহর।
দীপুরা নীলদীঘি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরেই দল বেঁধে মাঠে আসে খেলতে। পরদিনও ওরা মাঠে খেলছিল গোল্লাছুট, কাবাডি, ডাংগুলিসহ হরেক কিসিমের খেলা…খেলার ফাঁকে মামামি সেই লোকটার মুখোমুখি হলো। দেখতে ইয়া লম্বা, মাথায় টুপি, সাদা পায়জামার সাথে পাঞ্জাবি পরা। দেখতে কিছুটা জাদুকর জাদুকর লাগে! ঠিক গতকাল সন্ধ্যায় দেখা লোকটার মতোই। হাতে ছোট ব্যাগ, নানান রঙের বেলুন! দেখতেই বুঝা যায় উনি জাদুকর না, ফেরিওয়ালা। বেলুনের সাথে ছোট ছোট পুতুলও আছে। বেলুন আর পুতুল দেখে সবাই ছুটে এলো, নতুন ভিনদেশী লোকটার দিকে। মামামি, তুলি ও দীপুকে ইশারায় পিছনে ডাকল। সন্দেহের স্বরে মামামি বলল, ‘তোরা কেউ বুঝলি কিছু? লোকটা সুবিধের নয়! সুন্দরপুর কিংবা মতিপুরেরও নয়। মামামির কথায় অবাক হয়ে তুলি বলল, ‘তুই কী করে বুঝলি লোকটা ভিনদেশী?’

মৃদু হেসে মামামি বলল, ‘লোকটার কথাই আমাদের থেকে আলাদা। উনি যে এই পাড়া বা মতিপুরের নয় এটা আমি নিশ্চিত।’ মাথা নেড়ে ওরাও সায় দিলো মামামির কথায়। ঠিক তখনই দোকানি দাদুর আগমন; ভাঙা গলায় হেসে হেসে বললেন, ‘কি রে আজ আর খেলবি না?’ উত্তরে মামামি বলল, ‘দাদু গতকাল কাউকে এদিকটায় দেখেছেন, আমরা যাবার পর পর-ই?’
‘হ্যাঁ রে দেখেছি তো, একটি ভিনদেশী ফেরিওয়ালা ছিল, হাতে বেলুন আর হরেক কিসিমের খেলনা।’ দোকানি দাদু পানের পিক ফেলে ইশারা করে বললেন, ‘ওই তো লোকটা, ওই লোকটাই তো ছিল কাল।’ মামামি লোকটার কাছে গেলো আর বলল, ‘ওই নীল পতুলটা দেখি।’

আশ্চর্য হয়ে লোকটি বলল, ‘না না, ওটা দেখানো যাবে না। এই নাও, এইটা নাও, এটাও নীল পুতুল। ঠিক তোমার পছন্দের পুতুলটার মতোই সুন্দর আর চকচকে গাঢ় নীল।’ লোকটা তখনি মামামির পছন্দের পতুলটা নিজের পুঁটলিটায় রেখে দিলো। মাথা ঘুরিয়ে মামামি তুলি ও দীপুর দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় বুঝালো সন্দেহের আঁচ আছে। রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। কিন্তু কী রহস্য আছে এই পুতুলটায়? দীপুর প্রশ্নে মাথা চুলকানি শুরু হলো তুলি আর মামামির। ওদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সূর্যটা ডুবতে চলছে, খেলনা গাড়ির মতো ধীরে ধীরে… বাড়ি ফিরছে সবাই। মামামি হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়; সেই সাথে দীপু আর তুলি। ওরা দেখছে যে, ফেরিওয়ালা লোকটা তিতিয়া জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে! দৃশ্য দেখে দীপুর গলা শুকিয়ে কাঠ; দীপু ঢোক গিলে বলল, ‘জঙ্গলের পরে দিঘী তারপর জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির পরেই মতিয়া নদীটা। বিশাল নদী, চারদিকে পানি আর পানি…।’

দীপুর কথায় তুলি যোগ করল, ‘ওদিকটায় তো সন্ধ্যায় জেলেরা ছাড়া কেউ-ই যায় না! আর ওদিকে কোনো গ্রামও নেই। গ্রাম তো পশ্চিমে, তাও কেবল দু’টো গ্রাম, সুন্দরপুর আর মতিপুর। তারপরে শহর।’ গোয়েন্দা ভঙ্গিতে মামামি বলল, ‘আজ এতো ভাবার সময় নেই, কাল শুক্রবার। সারাদিন লোকটাকে চোখে চোখে রাখবি সবাই।’ লোকটার বাজে মতলব আছে। সেটা আমাদেরই তল্লাশি করে দেখতে হবে।’
‘আমাদের!’ অবাক হয়ে বলল, দীপু ও তুলি। অদ্ভুত হাসি হেসে মামামিও বলল, ‘হ্যাঁ আমাদেরকেই এই রহস্য উন্মোচন করতে হবে।’
‘সকালেই মাঠে আসবি সবাই। ঠিক সকাল সাতটায়। মনে থাকবে?’
‘হুম, মনে থাকবে।’ মাথা নেড়ে সায় দিলো দীপু আর তুলি।

কাকডাকা ভোর। মামামি, মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে। দৃশ্যটা চোখে পড়লো দোকানি দাদুর। জানতে চাইলেন, ‘এতো সকালে একা কেনো মাঠে এসেছ, দাদুভাই?’
‘আরে, মামামি তুই! আমাদের আগেই চলে আসলি যে? বাড়িতে তোকে এজন্যই ডেকেও সাড়া পাইনি। দোকানি দাদুর সাথে দীপু আর তুলি যোগ করল কথাটি। উত্তরে মামামি বলল, ‘খেলতে এসেছি। চল মাঠে চল, কথা আছে।’
‘কী কথা?’ দীপুর প্রশ্ন।

‘বোকা তুই, ওই অচেনা লোকটার কথাই তো আমরা আলোচনা করবো। কি রে মামামি তুই একটু বুঝা দীপুকে।’ কথাটি বলেই হেসে উঠলো তুলি। মামামি বলল, ‘থাম তো, মজা করার সময় নেই। আয় আমার সাথে…।’
‘কোথায় যাবি?’ দীপু ও তুলির প্রশ্ন।
‘জঙ্গলে’
‘জঙ্গলে! জঙ্গলে কেনো?’
‘আহা! আয় না তোরা। কাল তো ফেরিওয়ালা লোকটা জঙ্গলের ওদিকটায় গিয়েছিল। দেখিসনি?’
হ্যাঁ-সূচক শব্দে মাথা নাড়িয়ে মামামির পিছু চলল, দীপু আর তুলি।
কিছুটা পথ চলতেই থমকে দাঁড়ায় মামামি। আরে ওটা কী? নীল রঙের?
মামামির কথায় ভয়ঙ্কর শব্দে ‘ভূত-ভূত’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে দীপু। ধমক দিয়ে থামাতে পারেনি তুলি। দীপুটা এতোই ভীতু যে গাছের পাতা নড়লেও ভয় পায়!
সবুজ ঘাসে ছোট্ট নীল পুতুল দেখেও তাই ঘটল। তুলি এগিয়ে পুতুলটা হাতে নেয়। রহস্যময় সুরে বলে, ‘মামামি, এটা তো পুতুল।’
‘পতুল!’ কই দেখি, আমার হাতে দে।
পুতুলটা নাড়িয়ে বিস্ময়করভাবে মামামি বলল, ‘তুলি, এটা তো ওই ফেরিওয়ালা লোকটার পুতুলটার মতো।’ দীপু তখন ভয়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘ওইটা সত্যি সত্যি সেই পুতুলটাই নয় তো, যে পুতুলটা মামামির হাতে ফেরিওয়ালা লোকটা দিতে চায়নি!’
‘হবে হয়তো।’ তুলির উত্তর।
মামামি পুতুলটা গভীরভাবে দেখছে। এপিঠ-ওপিঠ, উলটেপালটে। পুতুলটার দু’টো অংশ। প্রথম ভাগে মাথা আর বাকিটা নিচের অংশ। মধ্যখানে পুতুলটা জোড়ানো। হাত দিয়ে ঘুরিয়ে খোলা যাবে। মামামি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুতুলটা খুলে ফেলল, দু’টো ভাগে আলাদা করতেই মাটিতে পড়ল টুকরো একটি কাগজ। গোল করে মোড়ানো আর ফিতে দিয়ে বাঁধা। তুলি ঢোক গিলে বলল, ‘ছোট্ট মাঝারি পুতুলটায় এই কাগজটা কিসের?’
দীপু তখনো ভয়ে কাঁপছে। ওদিকে দু’জন জেলে আসছিল জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে। মামামি কাগজটা পুতুলে রেখে মাঠের দিকে ফিরে আসলো।

দীপুর ভয়টা হালকা হলো। খুশির হাসি হেসে বলল, ‘জঙ্গলে যেতে হবে না, হুররে…।’
তুলি উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘মামামি, জেলে দু’জন তো চলে গেছে। ওই দেখ, জঙ্গলের পথে ফেরিওয়ালা লোকটা আসছে!’
‘তাই তো! আয় আমার সাথে। লোকটাকে কাছ থেকে দেখবো একবার। পুতুলটা থাকুক গাছের নিচে, ঘাস দিয়ে ঢেকে রাখ।’
পুতুলটা রেখে ভদ্রতার সুরে মামামি সালাম দিয়ে বলল, ‘কাকু এতো সকালে জঙ্গলেও পুতুল বিক্রি করেন নাকি?’ তুলি বলল, ‘জঙ্গলে তো ভূতেরা থাকে।’ দীপু বলল, ‘কাকু, ভূতের বাচ্চারা বেলুন কিনেছে?’
লোকটা নানানভাবে কথা কাটিয়ে চলে যেতে চাইল। মামামি হাত ধরে থামালো; কিন্তু কি জানি ভেবে হাতের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। লোকটার টুপি দেখিয়ে বলল, ‘কাকু আপনার টুপিতে বাবরকাটা। এই যে, মাথার টুপি খুলে লোকটার হাতে দিল, মামামি।’ এবার মামামি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল লোকটার কপালের দিকে। বিষয়টা তুলি লক্ষ করেছে, দীপু না। লোকটা নানান টালবাহানা করে কথা কাটিয়ে চলে গেলো। তুলি জানতে চাইল, ‘মামামি, লোকটার দিকে চোখের গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার রহস্য কী?’

শোনো তুলি, তাকানোর রহস্যের আগে আমাদের এটা জানা উচিত, মতিপুরের টাক্কু মাস্তান শহরের জেলে আছে, নাকি পালিয়েছে? গম্ভীর কণ্ঠে দীপু বলল, ‘পুতুলটার সাথে টাক্কু মাস্তানের কী সম্পর্ক?’ আর লোকটার সাথেই বা কিসের সূত্র আছে? দীপুর কথায় তুলি যোগ করে বলল, ‘হ্যাঁ ঠিকই তো, এখানে টাক্কু মাস্তানের সাথে কী সম্পর্ক আছে?’
ওদের প্রশ্ন শুনে মামামি বলল, ‘ওসব পরে বুঝিয়ে বলবো, কাল স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে শহরে যাবো। টাক্কু মাস্তান শহরের জেলে আছে কি না জেনে আসব।’ তারপরেই বুঝা যাবে আমার সন্দেহ ঠিক কী, না। নাকি আমি অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছি!’
দীপু তুলিও উচ্চস্বরে একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘ওকে ঠিক আছে, তো তাই হবে। কিন্তু এই কাগজটা কিসের? ওটা খুলে দেখবি না?’
‘হুম, দেখবো। আজ না, কালকে। ওটা জঙ্গলের বটগাছের বড় গর্তটায় থাকুক। আমাদের গোপন ব্যাংকে।’
‘হ্যাঁ, তাই ভালো, চল রেখে আসি।’ কথাটি তুলি বললেও দীপুর সাহস হয়নি। কাজটি যদিও তিনজনেই সম্পন্ন করেছে। পুতুলটা রেখে ওরা মাঠে ফিরল, এসে দেখল গ্রামের ছেলেমেয়েরা মাঠে উপস্থিত। কিছুটা সময় খেলাধুলা করে ধূলোমেখে বাড়ি ফিরলো সবাই। পরদিন শনিবার, টিফিন পিরিয়ডে ওরা খোঁজ নিতে যায় জেলা কারাগারে। ওখানে টাক্কু মাস্তানের সঠিক সন্ধান মেলেনি। কিন্তু ওদের তথ্যটা জানতে হবেই হবে; তাই ওরা কারাগার থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় থানায়। কারাগারের পশ্চিমেই সুন্দরপুর থানা। থানার নামকরণ হয়েছে মামামিদের গ্রামের জমিদার নবাব সুন্দর আলী খাঁর নামানুসারে। থানায় ওরা যে তথ্যটি পেয়েছে সেটা ঠিক এমন, টাক্কু মাস্তান জেল থেকে পালিয়েছে আজ সাতদিন। বিষয়টা ভীষণ অবাক করলো ওদের। থানায় ওদের দেখা হয় মতিপুরের সর্দার জীবন বাবুর সাথে। উনিও বিশেষ কাজে থানায় এসেছেন। মামামি উনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বিশেষ কাজটা কী দাদু?’
‘আর বলো না ভাই, দুঃখের কথা কী বলবো? আমার নাতিকে গতকাল সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না! তাই জিডি করতে এসেছি।’
কথাটি তুলির মনে দাগ কাটলো। মায়াময় শোকের কণ্ঠে ও বলল, ‘আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে খোঁজ নিন। হয়তো কারোর বাড়িতে থাকবে।’
‘নিয়েছি, কারোর বাড়িতেই নেই!’ জীবন বাবুর উত্তরে দীপুর মনটায়ও দুঃখ এসে জমলো। মামামি তখন বড়দের মতো করে বলল, ‘ওর বয়স কত? আর ঠিক কোথায় ওকে শেষ দেখেছেন কেউ?’
অতো সব জানি না ভাই, আসি এখন। পরে তোমাদের সাথে কথা বলছি।’

জীবন বাবু দৃঢ় পায়ে চলে গেলেন। ওদেরও টিফিন পিরিয়ড শেষের দিকে। স্কুলের পথে হাঁটছে ওরা। হাঁটতে হাঁটতে মাথা চুলকিয়ে চুলকিয়ে মামামি বলল, ‘বুঝেছি এবার, ওই লোকটাই টাক্কু মাস্তান!’
‘কোন লোকটা?’ দীপু ও তুলির প্রশ্নে মামামি যেন আকাশ থেকে পড়লো। হাত দুইটা ঘষতে ঘষতে মামামি উত্তর দিলো, ‘টাক্কু মাস্তানের বুড়ো আঙুল নেই, বাম হাতের। কপালের নিচে কালো দাগ; গর্তের মতো ছোট্ট, তিল পরিমাণ! জানিস তোরা?’
‘হ্যাঁ, জানি তো, তুলি ও দীপুর পরিষ্কার উত্তর।’
মামামি তুলিকে সম্মোধন করে ফের বলল, ‘কাল তুই বলেছিলি আমি কেন ফেরিওয়ালা লোকটাকে চোখের তীক্ষè নজরে গভীরভাবে দেখছিলাম।’
‘হ্যাঁ, বলেছিলাম তো।’
আসলে ওই লোকটারও বুড়ো আঙুল নেই। আর কপালে কালো দাগটা দেখার জন্যই বাবরকাটার অজুহাতে টুপিটা খুলেছিলাম। যদিওবা সত্যি সত্যিই কাঁটাটা ছিল।’
‘দাগটা কি ছিল রে?’ ভয় মেশান গলায় দীপু জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ, কালো দাগটাও ছিল। আর আমি শতভাগ নিশ্চিত, ওই লোকটাই টাক্কু মাস্তান।’
সাহসী কণ্ঠে তুলি বলল, ‘তাহলে লোকটাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া উচিত।’
দীপু বলল, ‘ঠিক বলেছিস। এটাই ভালো। আর কাজটা আজই করা জরুরি।’

‘না, না আজ না। টাক্কু মাস্তান কেনো ছদ্মবেশে গ্রামে এলো? ওর উদ্দেশ্য কী? ওর সাথে কে কে আছে? ওসব জানবার আগে কিছুই করা ঠিক হবে না। এতে বিপদ দ্বিগুণ হবে, বাড়বে ছাড়া কমবে না। মামামির কথায় যুক্তি ছিল; দীপু আর তুলিও তাই রাজি না হয়ে পারলো না। ওসব বলাবলি করতে করতে ওরা স্কুলে পৌঁছেছে। একে একে বাকি ক্লাসের শেষে বিকেল চারটায় ছুটির ঘণ্টা বাজালো মিঠুন দা। ঘণ্টার শব্দে শুরু হলো ছাত্র-ছাত্রীর ছোটাছুটি। কে কার আগে বেরোয়, তার প্রতিযোগিতা। ফাঁকা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছিল দীপু, মামামি আর তুলি। হঠাৎ ওরা শুনতে পায় রাস্তায় লোকজন বলাবলি করছে, গতকাল থেকে নাকি সুন্দরপুরের রাহুল মাস্টারের ছেলেটা নিখোঁজ। মতিপুরের সর্দার জীবন বাবুর নাতিও। পরিচিত কারোর বাড়িতে খোঁজও মেলেনি কারোর। তুলির গলা শুকিয়ে কাঠ, ভাঙা গলায় বলল, ‘ওসব কী ঘটছে? দু’দুটো ছেলে নিখোঁজ! তাও আবার একই দিনে।’ তুলির কথায় দীপু কিছু না বললেও মামামি বলল, ‘এই ঘটনাগুলোর পিছনে টাক্কু মাস্তানের হাত নেই তো?’
‘থাকতে পারে, টাক্কু মাস্তানই ফেরিওয়ালা সেজে বাচ্চাদের কিডন্যাপ করে। শুদ্ধ বাংলায় ‘অপহরণ’। কথাটি ভীতু দীপুর।
‘তাই যদি হয়, লোকটাকে আজ নজরে রাখবো। বিকেলে ওর পিছুপিছু যাবো। লোকটা নিশ্চয় জঙ্গলের দিকে আজও যাবে। মামামির কথায় তুলি বলল, ‘কী করে বুঝলি, লোকটা আজও জঙ্গলের দিকেই যাবে?’
‘উহু, বুঝিস না কেনো, লোকটা প্রথম দিনও জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। পরদিনও। গতকালও। আমরা জঙ্গলের দিকটা থেকে ফিরতে দেখেছি।’

‘হ্যাঁ তাই তো! তুই ঠিক বলেছিস।’ মাথা নেড়ে কথাটি বলল তুলি। ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করতে করতে ওরা চলে এলো বাড়িতে, খাওয়া-দাওয়া করে চলল মাঠের দিকে। মাঠে ছোটরা খেলছিল গোল্লাছুট, কেউ কেউ ডাংগুলি। দীপু, তুলি, মামামি আর তার সমবয়সীরা খেলছিল লুকোচুরি। ওটা দারুণ মজার খেলা! যেখানে একজন দূরে চোখ ঢেকে এক থেকে একশো গুনবে আর বাকিরা লুকিয়ে পড়বে, যে যার মতো, যেখানে খুশি। তারপরে গোনা শেষে লুকিয়ে থাকা সবাইকে বের করাই হলো কাজ। দীপু, তুলি আর মামামি লুকিয়ে ছিল বটগাছটার বড় গর্তে। যেখানে ওরা পুতুলটা রেখেছিল, ঠিক সেখানেই। দীপু বলল, ‘পুতুলটায় রাখা কাগজটা কিসের? দেখবি না?’ উত্তরে তুলি বলল, ‘মামামি চল না, কাগজটা কিসের খুলে দেখি!’
‘ঠিক আছে আয় খুলে দেখি, কাগজটা কিসের।’
পুতুলের মাথা ঘুড়িয়ে ঘুরিয়ে দু’ভাগে ভাগ করে কাগজটা হাতে নিলো মামামি। কাগজটা খুলে অবাক হলো তিন জোড়া চক্ষুগোলক! তুলি বলল, ‘ওটা তো মানচিত্র!’
দীপু কাগজটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘ঠিকই তো, কিন্তু এটা কিসের মানচিত্র?’ মামামি বড়দের মতো করে বলল, ‘দেখি, দেখি, আমাকে দেখতে দে।’
এই নে, দীপু, মামামির হাতে কাগজটা দিয়ে দিলো।
মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মামামি বলল, ‘ওটা আমাদের সুন্দরপুরের মানচিত্র!’
আশ্চর্য হয়ে তুলি বলল, ‘কী করে বুঝলি?’
‘আহা! আমাকে পুরোটা বলতে দে, বলছি তো। এই দেখ কাগজটার উপরের অংশটা উত্তর। তার মানে নিচের অংশ দক্ষিণ। ডানদিকটা পূর্ব আর বাঁ’দিকটা পশ্চিম।’
‘ঠিক বলেছিস। বইয়ের পাতায় আমিও পড়েছি; পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানচিত্রেই কিছু নির্দিষ্ট সংকেত, রঙ, প্রতীক, চিহ্ন একই অর্থের জন্য ব্যবহার করা হয়। তাকে প্রচলিত বা প্রথাগত প্রতীক চিহ্ন বলে। এরকম কয়েকটি হল- পাহাড় পর্বতের জন্য খয়েরি বা বাদামি, জলের জন্য নীল, সমভূমি বা বনভূমির জন্য সবুজ, কৃষিজমির জন্য হলুদ রঙ।’ দীপুর কথায় তুলিও সায় দিলো। মামামি এবার গোয়েন্দা ভঙ্গিতে বলল, ‘এই যে এই উত্তরের জায়গাটা ওটা তিতিয়া জঙ্গল। পরের এই জলচিহ্ন, ওটা জমিদার বাড়ির দিঘী। তারপরে ওটা জমিদার বাড়ি। দেখ লাল দাগ টেনে বৃত্তের ভেতর রেখেছে। তারপরে নদী রেখার চিহ্ন। তার মানে ওইটা মতিয়া নদী।’ মামামির কথায় দীপু যোগ করে বলল, ‘মামামি ঠিকই বলছে, এই দেখ তুলি, পশ্চিমে দু’টো গ্রামের নকশা করা, একটি সুন্দরপুর অন্যটি মতিপুর।’

ঠিক তখনি তুলি দেখল, ফেরিওয়ালা লোকটা জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। ওরা চুপিচুপি পিছু ছুটলো। ফেরিওয়ালা লোকটা ওদের অনেকটা সামনে। পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের রাস্তা শেষে, জমিদার বাড়ির দিঘী। ছোট না, মাঝারি আকারের দিঘী। লোকটা জঙ্গলের পথে হেঁটে দিঘীর পাড়ে পাড়ে জমিদার বাড়িতে পৌঁছায়। দীপু, তুলি আর মামামিও লোকটার পিছুপিছু পৌঁছে যায়। ওখানে লোকটার সাথে আরও তিন তিন জন লোক ছিল। ওরা যে মতিয়া নদী হয়ে স্পিডবোটে করে এসেছে ওটা বুঝতে বাকি রইল না কারোর। তবে লোক তিনজনই মুখোশ পরা। ওরা জমিদার বাড়ির সুড়ঙ্গ পথের পাথর সরিয়ে সোজা চলে গেলো গোপন কক্ষে। বড় এই পাথরের পিছনে গোপন ঘর ছিল ওটা না জানতো দীপু, না মামামি কিংবা তুলি! লোকগুলোর এমন আশ্চর্য আবিষ্কারে দারুণ অবাক হলো এই খুদে গোয়েন্দারা! এভাবে তিন মিনিট পর ওরা দেখলো একটি বিরাট ঘর। চারপাশে বিদেশি অস্ত্র, নানান ঔষধপত্র, গান পাউডার এবং দু’টো জাল টাকা তৈরির মেশিনে। এক কোণে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ওখানে জীবন বাবুর নাতি আর রাহুল মাস্টারের ছেলেও থাকবে হয়তো। এমন সময় দীপু দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়লো! ভয়ে ভয়ে বলল, ‘চল ফিরে যাই, ওসব আমাদের কাজ না। পুলিশকে বলবো। পুলিশই ওদের শায়েস্তা করবে।’ ঠিক এমন সময় ফেরিওয়ালা লোকটাকে মুখোশ পরা একজন বলল, ‘ওটা কিসের শব্দ? ওখানে কে?’
ফেরিওয়ালা লোকটা অভয়ের সুরে বলল, ‘কেউ না বস, এখানে সচরাচর কেউ আসে না। এখানে আসা তো দূরের কথা, ওই তিতিয়া জঙ্গলেই কেউ আসে না!’
মামামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভাগ্য ভালো লোকগুলো আমাদের দেখেনি। দেখলে যে কী কেলেঙ্কারি হতো!’

‘আচ্ছা, টাক্কু মাস্তান, এখন কাজের কথায় আসো।’ মুখোশ পরা লোকটা ফেরিওয়ালা লোকটাকে টাক্কু মাস্তান বলে ডাকলো! তুলি বলল, ‘মামামি তার মানে তোর সন্দেহটাই ঠিক। ফেরিওয়ালা লোকটাই টাক্কু মাস্তান।’
ঠিক বলেছিস, ‘লোকটা মতিপুর আঞ্চলিক ভাষায় কথাও বলছে।’
ভয়ে তখনো কাঁপছিল দীপু। তুলির কথায় কোনো উত্তরও দেয়নি।
মামামি বলল, ‘এই কথা থাক এখন, শোন ওরা কী বলে।’
মুখোশ পরা লোকগুলো তখন বলছিল, ‘আগামীকাল এই সবক’টা ছেলেমেয়ের চোখ, কিডনি খুলে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বিকেলে নদীতে ছোট লঞ্চ থাকবে। মুখোশ পরা লম্বা লোকটা বলল, ‘টাক্কু মাস্তান, তুই লঞ্চে ওদের উঠিয়ে দিবি।’

‘জ্বি বস, তাই হবে। আপনি চিন্তা করবেন না।’ মুখোশ পরা বাকি লোক দু’টোর একটিকে লালু নামে এবং অন্যজনকে ডাব্বু বলে ডাকল, লম্বা লোকটা। ওরাও ওই লোকটাকে ‘বস’ বলে ডাকলো। তার মানে এই লোকটাই এই তিনজনের বস। তোরা এখানে থাকবি। আমি সকালে চলে যাবো। কাল বিকেলে লঞ্চে করে এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে তুই সমুদ্রবন্দর যাবি। যেখান থেকে ওদের বিদেশে পাঠানোর কাজটা আমিই করবে।
সকাল সকাল তাই বেরিয়ে পড়বো।
এখন যা খাবারের ব্যবস্থা কর। টাক্কু মাস্তান, লালু আর ডাব্বু চলে গেলো। লোকটাও পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লো। মুখোশটা খোলেনি এখনো। তুলি ভয়-টয় ভুলে রাগী কণ্ঠে বলল, ‘মামামি, এখন ঘরটা ফাঁকা। ওই লোকগুলোও নেই। পিছন থেকে লোকটার মাথায় আঘাত করে ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে পালাই, চল!’
‘না তুলি, এতে করে লোকগুলো ধরা পড়বে না। ওদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে।’
দীপু ভয়ে ভয়ে ‘ঠিক বলেছিস’ বলতেই তুলি বলল, ‘কাজটা কী করে করবি? আগামীকাল বিকেলেই ওদের পাচার করবে। শুনিস নি?’

‘না, এটা কখনো সম্ভব না! তার আগেই লোকগুলো পুলিশের হাতে বন্দী হবে। দেখে নিস!’
কিন্তু এখানে থেকে আমরা কিছুই করতে পারবো না। মামামির কথায় তুলি ও দীপু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘তাহলে কী করবো আমরা?’
‘এখন আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে। কোনো একজনকে যেতে হবে গ্রামে, পুলিশকে খবরটাও দিতে হবে রাতের মধ্যেই।’
‘কিন্তু যাবে কে? তুলি তুই যাবি?’
‘না, না, আমি না, দীপুকে যেতে বল। এখানে ও থাকলে ভয়ে কী হতে কী করবে আর আমরা ধরা পড়বো।’
‘ঠিক বলেছিস।’ বললো মামামি। উত্তরে চাপা কণ্ঠে দীপু বলল, ‘একা এই জঙ্গল পেরিয়ে যেতে ভয় করবে। তোরা আমায় এগিয়ে দে।’
ঠিক আছে, চল। আমরা দু’জন তোকে মাঠ অবধি পৌঁছে দেবো। বাকিটা পথ তুই একা যাবি। মামামির কথায় তুলি বলল, ‘তাই ভালো। এখানে থাকা আমাদের জন্যেও এখন নিরাপদ নয়। লোকগুলো কখন জানি চলে আসে।’ সুড়ঙ্গ পথ শেষে জমিদার বাড়ি ফেলে, দিঘীর পাড়ের কিছুটা পথ পরেই জঙ্গল। প্রতিদিনকার মতো সেদিনও হলুদ আভা ছড়িয়ে সূর্যটা ডুবে গেছে সেই কবে। চারদিকে জ্যোৎস্নার হালকা আলো। মৃদু হাওয়া। জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে মামামি দীপুকে বলল, ‘তুই তুলির ছোট চাচ্চু রাজু আঙ্কেলকে চিনিস?’
‘হ্যাঁ চিনি তো। পুরো নাম মোস্তফা রাজু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর সাংবাদিকও। পাশাপাশি তিনি লেখকও বটে। পত্রিকায় উনার কত গল্প, ছড়া-কবিতা পড়েছি। এ বছর মেলায় উনার গোয়েন্দা গল্পের নতুন বইটিও কিনেছি। কী দারুণ লিখেছেন!’ দীপুর কথায় তুলি বলল, ‘হয়েছে হয়েছে, আঙ্কেলের হয়ে অতো ঢোল পিটাতে হবে না।’
‘ঢোল পিটালাম কই? আমি তো শুধু উনার প্রতিভার প্রশংসা করছি।’ দীপুকে ভেংচি কেটে তুলি বলল, ‘আহারে প্রশংসা, আহারে প্রতিভা…।’

দীপু আর তুলিকে ধমক দিয়ে মামামি বলল, ‘এখন ঝগড়া বা মজা করার সময় না। শোনো দীপু, প্রথমেই যাবি রাজু আঙ্কেলের কাছে। পুরো ঘটনার বর্ণনা করবি, সংক্ষেপে। রাজু আঙ্কেলকে বলবি থানায় যেতে। পথ চিনিয়ে পুলিশকে নিয়ে যেন জমিদার বাড়িতে আসেন। জলপথে। থানার পাশে মতিপুরের ব্রিজে পুলিশের স্পিডবোট থাকে।’ তুলিও মামামির কথায় কথা যোগ করে বলল, ‘স্পিডবোটে করে জমিদার বাড়ি আসতে সময় লাগবে ৩০-৪০ মিনিট। পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ হয়ে; পূর্ব দিকের বিশাল ধান ক্ষেতের পর মতিয়া নদী, তার কিছুটা পরে জমিদার বাড়ি। তুই রাজু আঙ্কেলকে খবর দিয়ে গ্রামের সবাইকে নিয়ে দ্রুত চলে আসবি জমিদার বাড়িতে। পারবি তো?’
‘খুব পারবো। আমাকে পারতেই হবে।’
তিনজন ওদের পরিকল্পনা মতো কথা বলতে বলতে মাঠে আসল, দীপুকে মাঠে ছেড়ে ওরা পুনরায় হাঁটছিল জঙ্গলের পথে; উদ্দেশ্য জমিদার বাড়ি। আকাশে তখন তারার ঝিকিমিকি। মৃদু মিষ্টি হাওয়া। জ্যোৎস্নার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত রাতের প্রকৃতি। শুকনো পাতার মরমর শব্দে ভেঙে যায় রাতের নীরবতা! জঙ্গল পিছনে ফেলে ওরা দিঘীর মাঝ পাড় বরাবর পৌঁছেছে। ডানদিকে কিছুটা হেঁটে পাড় ঘেঁষে ওরা সোজা চলে যাবে জমিদার বাড়ি। তুলি আচমকা ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠলো!
‘তুলি, কী হয়েছে?’
‘পানিতে কেউ দৌড়ে আসছে। আমাদের দিকে!’
‘কই?’ মামামি জানতে চাইলো।
কিন্তু না কেউ-ই নেই! তুলি হতবাক! কিন্তু কেউ তো ছিল। এই না দেখেছি। এটা সত্যি সত্যি ভূত নয় তো!
একটু যাবার পর তুলির চিৎকার। ওই তো পানিতে কেউ দৌড়ে আসছে!…
মামামিও দেখলো, সত্যি সত্যি কেউ পানিতে দৌড়ে আসছিল! কিন্তু সেটা ভূত না! মানুষও না!
‘ভূতও না, মানুষও না!’ কে তবে? তুলি জিজ্ঞেস করলো।
‘আলো। বাতির আলো!’
‘মানে? বলিস কী?’
‘বুঝিয়ে বলছি। মন দিয়ে শোন। ওই দেখ জমিদার বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। হলুদ আলো। দিঘীর পাড়ে কলাগাছ, প্রকৃতিতে মৃদু হাওয়া। হাওয়ায় কলাগাছের পাতা নড়ছে। প্রথমে আলো পড়ে কলাপাতায় আর বাতাসে পাতাটা নড়ে, ঠিক তখন আলো পড়ে দিঘীর পানিতে। বাতাসে পাতাটি আবারো নড়ে আলোও একটু সামনে আসে। এভাবে পাতাটি যখন পুরো নুয়ে পড়ে তখন আলো গতিতে ছুটে আসছিল জলে। আর আমাদের মনে হলো ওটা ভূত না’হয় মানুষ! এটাকে বলে আলোর প্রতিসরণ। অষ্টম শ্রেণিতে পড়িস নি? মনে আছে?
‘হ্যাঁ, মনে আছে। আলোক রশ্মি এক স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অন্য স্বচ্ছ মাধ্যমে তির্যকভাবে যাওয়ার সময় দিক পরিবর্তন করে, দিক পরিবর্তনের ঘটনাই আলোর প্রতিসরণ।’
‘হুম, ঠিক বলেছিস। এখন চল। হাতে অনেক কাজ। সময় কম। যা করার রাতেই করতে হবে।’

কিছুক্ষণ পর ওরা জমিদার বাড়িতে পৌঁছায়। সুড়ঙ্গ পথে হেঁটে গোপন ঘরটায় যেতে ওদের পাঁচ মিনিট লাগলো, লোকগুলোও সেখানে খাবার নিয়ে বসে আছে। মুখোশ পরা লোকগুলো মুখোশ খুলেছে। লালু আর ডাব্বু এবং টাক্কু মাস্তান ছাড়াও ওদের বসের পাশে নতুন লোক বসা। দেয়ালের পাশে লুকিয়ে দেখছিলো তুলি আর মামামি। লোকটা হয়তো আমাদের যাবার পরই এসেছে, কী বলিস তুলি?’
‘হ্যাঁ, হবে হয়তো, লোকটাকে চেনাচেনা মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি? ঠিক মনে পড়ছে না!’
তুলি আর মামামি পুরো কথা শেষ করার আগেই ওদের পিছন থেকে কেউ বলল, ‘একদম নড়াচড়া করবি না; ঘাড় ঘুরিয়েছিস তো, ঘাড়টা মটকে দেবো! গোয়েন্দাগিরি করো। এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল! মামামি লোকটাকে আঘাত করতে যাবে এমনি লোকটা সামনে আসে, আরে দীপু! কখন আসলি? এইমাত্র। তুলি রেগে টগবগে হয়ে বলল, ‘এতো সাহস কোথা থেকে এলো শুনি?’
‘আসবে না? রাজু আঙ্কেল, পুলিশসহ গ্রামের লোকজন যে চলে এসেছেন।’
‘সত্যি।’ তুলি আর মামামি এক সুরে বলে উঠলো।
‘হ্যাঁ সত্যি।’ দীপু উত্তর।
তুলি দীপু তোরা বাইরে যা। রাজু আঙ্কেল আর পুলিশ বাহিনী নিয়ে ভেতরে আয়। আমি এখানটায় আছি। গ্রামের লোকজনকে বলবি সুড়ঙ্গের পথে দাঁড়িয়ে থাকতে। পরিকল্পনা মতো পুলিশ বাহিনী গোপন ঘরটায় চলে আসে। লোকগুলোর অস্ত্রও হাতে ছিলো না, খাবারের টেবিলের ওই পাশটায় স্তূপ করে রাখা। দারোগা বাবু বললেন, ‘হ্যান্ডস আপ! কোনো চালাকি কিংবা পালানোর চেষ্টা করো না। তা’হলে গুলি করতে বাধ্য হবো।’ এমন সময় নতুন লোকটা নিজের মুখম-ল ঢাকার চেষ্টা করলো! রাজু আঙ্কেল আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘দারোগা বাবু এতো মাফিয়া ডন মিমিং সাং! আন্ডারওয়ার্ল্ডের কুখ্যাত নাম, চীনা নাগরিক। কত শতবার খবরের কাগজে ছবিটা দেখেছি।’

দারোগা বাবু চশমা কপালে তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই তো! লোকটাকে দেশ-বিদেশের কতশত গোয়েন্দা খুঁজতেছে। আর লোকটা কি-না এখানে!’
হাবিলদার সবাইকে পিছমোড়া বেঁধে বাইরে নিয়ে চল। অস্ত্র এবং যাবতীয় মালামাল থানায় নেওয়ার ব্যবস্থা করো। ছেলেমেয়েদের বাঁধন খুলে নিয়ে এসো। খোঁজ নাও, কার বাড়ি কোথায়।
খুদে গোয়েন্দারা তোমরাও এসো। তোমাদের জনই ওদের ধরা সম্ভব হলো। মিমিং সাং কত বড় মাফিয়া ডন তা অনুমান করাটা বেশ কঠিন আর জটিল! চীনা এই নাগরিক ‘মিমিং সাং’ পৃথিবীর অন্যতম একজন আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ গোয়েন্দা বিভাগে খরব এসেছিল, মিমিং সাং আমাদের দেশে আত্মগোপন করে লুকিয়ে আছে। রাজু আঙ্কেল মিমিং সাং কে প্রশ্ন করে এটা জানলেন যে, আজই সে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে মিয়ানমার চলে যেতো। চট্টগ্রাম বন্দরে এই কথাটি পুলিশ জেনে যায়। তাই এখানে রাতটা কাটিয়ে সকালে যাবেন ভেবেছিলেন মিমিং সান। কিন্তু তা আর হলো কই! অবশেষে সুড়ঙ্গ পথ শেষে বাহিরে এলেন দারোগা বাবু, রাজু আঙ্কেল, দীপু, তুলি, মামামিসহ সব্বাই। দারোগা বাবু আর রাজু আঙ্কেল গ্রামের সবাইকে বললেন এই খুদে গোয়েন্দাদের ভয়ঙ্কর অভিযানের জন্য দেশ-বিদেশের মানুষের কতটা উপকার হয়েছে। গর্বে সবার বুকটা ফুলে উঠলো, জোয়ার ভাটার মতো। দারোগা বাবু, তিনজনের নাম জানতে চাইলেন। দীপু আর তুলির নাম শুনে দারোগা বাবু অবাক হননি, ‘মামামি’ নামটা শুনে যতোটা আশ্চর্য হয়েছিলেন! দীপু অট্টহাসি হেসে বলল, ‘মামামি ওর সংক্ষিপ্ত নাম। পুরো নাম, মামুন মাশরাফি মিশু। সংক্ষেপে ‘মামামি!’

দীপুর কথায় হেসে কুটিকুটি দারোগা বাবু, মামামির পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘যেমন অদ্ভুত সংক্ষিপ্ত নাম, তেমনি অদ্ভুত তোমার বুদ্ধি। বেঁচে থাকো বাবা। বড় হও। তোমরাও ভালো থেকো। আবারো দেখা হবে। পরদিনই জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হলো ‘খুদে গোয়েন্দাদের ভয়ঙ্কর অভিযান : আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন মিমিং সাং আটক।’ সংবাদটি রাজু আঙ্কেলই লিখেছেন। ঠিক তার দু’দিন পর মামামি, তুলি আর দীপুরা পেয়েছিল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পুরস্কার আর সম্মাননা ক্রেস্ট।…

Share.

মন্তব্য করুন