একটি শিশু প্রথম শব্দটি শেখে মায়ের মুখ থেকে। শিশুর মা-ই তার ভাষার প্রথম শিক্ষক। মা-ই আদর সোহাগে নানা শব্দ ব্যবহার করে শিশুটির জিব নাড়াতে সাহায্য করেন। ঠোঁট নাড়ানোর চেষ্টা করেন। এভাবে করতে করতে এক সময় শিশুটি জিব ও ঠোঁট নাড়াতে শুরু করে। শুরু করে শব্দ বলার চেষ্টা। এভাবে হঠাৎ একদিন শিশুটি ভাঙা উচ্চারণে মা অথবা আম্মা বলে ফেলে। শুনে খুশিতে চিৎকার করে ওঠেন মা। বলেন, তোমরা কে কোথায়? শুনে যাও। আমার নয়নমণির আজ মুখ ফুটেছে। কথা বলেছে। মা ডেকেছে আমাকে। আহা আজ কী আনন্দের দিন। আজ আমার কলিজার টুকরো আমার মন ভরে দিয়েছে। কী যে খুশি আমার। কী যে আনন্দ আমার। আমার উড়তে ইচ্ছে করছে। ছুটতে চাইছে মন।

পরিবারের সদস্যরা হৈ হৈ রবে ছুটে আসেন। এসে শোনেন মায়ের মুখে শিশুর বিরাট প্রশংসা। শোনেন কিভাবে মা ডেকে ফেললো শিশুটি। কিভাবে ভরে দিলো মায়ের মন। সবাই শিশুটির দিকে চোখ তোলে। দেখে শিশুর ভঙ্গি। দেখে শিশুর চোখের চাহনি। সবার নজর তখন শিশুর মুখের দিকে। জিব ও ঠোঁটের দিকে। উৎসাহ জোগাতে থাকে শিশুকে- বলো সোনা বলো। আবার বলো- মা। সবার খুশি শিশুকেও ছুঁয়ে যায়। শিশু জিব গোল করে। আবার ছাড়ে। লম্বা করে। আবার গুটায়। ঠোঁট কাঁপায়। দোলায়। সবার উৎসাহে শিশুটি আবার বলে ফেললো- ওম্ মা। অমনি খুশিতে ডগমগ সকলে। রৈ রৈ করে ওঠে সবাই। সবার মুখে তখন শিশুটির প্রশংসা। এভাবে শিশুর ভাষার যাত্রা। এভাবে শুরু ভাষা শেখার অভিযান।

এক সময় মায়ের মুখেই ছড়া শোনে শিশু। শোনে ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠা বাণী। ছড়া-কবিতা শুনে সুললিত হয় শিশুর ভাষা। সুতরাং ভাষা শেখার প্রথম পাঠশালা হলো মা। দ্বিতীয় পাঠশালা শিশুর বাবা। বাবার মুখের শব্দও শিখতে থাকে শিশুটি। মা ডাকের পর বাবা ডাকটি উঠে আসে শিশুর মুখে। বা-বা বা-বা বলতে থাকে শিশু। শুনে বাবার মন ভরে যায়। মায়ের মনও পুরে যায় আনন্দে। তারপর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ভাষা শেখে। ভাই বোন ও অন্য সদস্যদের মুখের শব্দগুলো শিখতে থাকে শিশুটি। এরপর আসে স্কুল এবং শিক্ষক। স্কুলে শিক্ষক থেকে শেখে নানান শব্দ বাক্য। এবং কিভাবে বাক্য বলতে হয় তাও।

তারপর আসে বন্ধুদের ভূমিকা। স্কুলে একই শ্রেণির কিছু মুখ একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে যায়। একজন আরেকজনের সঙ্গে বসে। কথা বলে। হাসি মশকরা করে। টিফিন ভাগাভাগি করে খায়। এক সাথে খেলাধুলা করে। এসব করতে গিয়ে নানারকম নতুন নতুন শব্দের সাথে পরিচয় ঘটে। নতুন বাক্য শেখে। সেই সাথে আনন্দে মেতে ওঠে বেশ।
এভাবে বেড়ে উঠতে উঠতে এক সময় গল্প উপন্যাস পাঠ করে। পাঠ করে প্রবন্ধ-নিবন্ধ। পরিবেশ বিষয়ে বই পাঠ, বিজ্ঞানের বই এবং ভূগোলের বই, এসব থেকে ভাষার নতুন নতুন বাক্য শব্দ শেখে।
মানুষ ভাষা শেখে তার ভাবনা প্রকাশের প্রয়োজনে। মানুষ যা ভাবে তার ভাবনা প্রকাশ করার চেষ্টা করে। কল্পনার কথাও প্রকাশ করতে চায়। স্বপ্নের কথা তো বলবেই। বিচিত্র ভাবনা থাকে মানুষের। ভাবনার বৈচিত্র্য যেমন থাকে। তেমনি তা প্রকাশের ভাষাও বৈচিত্র্যময়।

কল্পনার আকাশ যেমন বিশাল। তেমনি তা বলার ভাষা বিশালকে ধারণ করার উপযোগী হতে হয়। মানুষ তারই উপযুক্ত ভাষা শিখে নেয়।
স্বপ্নের বিষয়টি তো আরও অন্যরকম। স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে মানুষ। স্বপ্ন দেখেই এগিয়ে চলে সবাই। স্বপ্ন না থাকলে বাঁচে না মানুষ। বেঁচে থাকে না মানুষের আগ্রহ, উচ্ছ্বাস। স্বপ্ন বুকে ধরে ছুটতে থাকে মানুষেরা। স্বপ্নকে ভাষা দিতে ভাষা শেখে মানুষ।

চাকরি বাকরির প্রয়োজনেও ভাষা শিখতে হয়। শেখে সবাই। যিনি সাংবাদিক তাকে সংবাদপত্রের ভাষা শিখতে হয়। যিনি ব্যাংকার তাকে ব্যাংকের পরিভাষা শিখতে হয়। ব্যবসায়ীকে ব্যবসার ভাষা। ক্রীড়াবিদকে ক্রীড়ার ভাষা রপ্ত করে নিতে হয়। এভাবে একজন বিচারপতিকে বিচারালয়ের পরিভাষা জানতে হয়। আইনের পরিভাষা জানতে হয় আইনজীবীকে। বিজ্ঞানের ভাষা জানেন বিজ্ঞানী। মহাকাশ বিদ্যার ভাষা জানতে হয় জ্যোতির্বিদকে। একজন ডুবুরি জানেন সমুদ্রের ভাষা। পরিবেশবিদ পরিবেশের ভাষা আয়ত্ত করেন।

একজন মানুষ সারা জীবন ধরে ভাষা শিখতে থাকেন। শিখতে শিখতে চলতে হয়। চলতে চলতে শিখতে হয়। নতুন বিষয়, নতুন জায়গা। নতুন জিনিস ও নতুন আয়োজনের শব্দ- বাক্য জানতে হয়।
একজন কবিকে জানতে হয় ভাষার আনন্দ। জানতে হয় ভাষার সৌন্দর্য। জানতে হয় ভাষার গাম্ভীর্য। একটি ভাষা কিভাবে নান্দনিক হয়। কিভাবে শৈল্পিক হয় এবং কিভাবে হয় মাধুর্যময় অবশ্যই জানতে হয় কবিকে। নতুন শব্দ সৃষ্টি করেন কবি। নতুন বাক্য তৈরি করেন তিনি। পুরনো কথাকে নতুন ভাষায় প্রকাশ করেন। তাই কবিতা পাঠকও ভাষা শেখেন কবিতা পড়ে।

গল্প পাঠক শেখেন নতুন ভাষা। উপন্যাস পাঠকও। প্রবন্ধের পাঠকও পরিচিত হন নতুন ভাষার সাথে।
দেখা যায় সারাটি জীবন মানুষ ভাষা শিখে এগিয়ে যায়। জীবনের প্রয়োজনে, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করেন যেমন। তেমনি শেখেনও।
ভাষা শেখার একটি বড় জায়গা প্রকৃতি। প্রকৃতির বিশাল ভা-ার থেকে হাজার রকম শব্দ শেখা যায়। প্রকৃতির ভাষা শেখার অন্যরকম আনন্দ আছে। আছে অন্যরকম উল্লাস! প্রকৃতির এ বিশালতায় ডুব দিলে বোঝা যায় কি বিস্ময় কাজ করছে প্রকৃতির সর্বত্র।

সত্য হলো কোনো কিছুরই যেমন শেখার শেষ নেই। তেমনি ভাষা শেখারও শেষ থাকে না। শিখতে হবে আজীবন। আমৃত্যু। যেমন শব্দ শেখা জরুরি। তেমনি বাক্য শেখাও জরুরি। তেমনি জরুরি শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ। উচ্চারিত বাক্যটির শুদ্ধ উচ্চারণ না হলে শুনতে ভালো লাগে কি? লাগে না, এটিই জবাব। তবে? তবে একটাই কথা, শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে হবে। ভাষা শেখার এটিও অন্যতম। এসব কিছু মিলেই ভাষা। সবকিছু নিয়েই ভাষা। এভাবেই ভাষা শেখে মানুষ।

Share.

মন্তব্য করুন