বিখ্যাত ক্রীড়াবিদদের শৈশব কেমন ছিলো সেটি নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই অনেকেরই। তাই এবার তোমাদের সামনে হাজির করছি কিংবদন্তি তিন ক্রীড়াবিদের ছেলেবেলার গল্প।

মোহাম্মদ আলী
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট লুইস ভিল শহরে জন্ম মোহাম্মদ আলীর। ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি। বাবা ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে ছিলেন রঙশিল্পী। দেয়ালে বিলবোর্ডে ছবি আঁকতেন। বাবার নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখা হয় ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র। সংক্ষেপে ক্যাসিয়াস ক্লে। তবে ক্লে যখন কয়েক মাস বয়সের, তখন মুখ দিয়ে সারাক্ষণ ‘জি.. জি..’ শব্দ করতেন। সেই থেকে সবাই ‘জিজি’ নামে ডাকতে শুরু করে তাকে।
সময়টা ছিলো আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য খুবই কঠিন। কালোরা ভালো স্কুলে পড়তে পারতো না, গাড়িতে তাদের পাশে কেউ বসতে চাইতো না। এটি ক্লের মনে দারুণ জেদ তৈরি করে। নিজের যোগ্যতা দিয়েই এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পণ করেন শৈশবে। এই জেদটিই পরবর্তীতে তাকে সফল হতে সাহায্য করেছে।
ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী, আর ছিলো মেধা। সমবয়সী যেকোনো কিশোরের তুলনায় তার শক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষিপ্রতা ছিল বেশি। ১২ বছর বয়সের সময় বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে গিয়ে ক্লের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। দৌড়ে এক পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়ে বললেন, আমার সাইকেল চুরি হয়েছে। চোরটাকে ধরে দিন। আমি নিজেই ওকে পেটাবো।
জন্মদিনে উপহার পাওয়া প্রিয় সাইকেলটা হারিয়ে মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়েছিল তার। ঘটনাক্রমে জো মার্টিন নামের ওই পুলিশ অফিসার আবার ছিলেন শখের বক্সিং কোচ। চাকরির অবসরে কিশোরদের বক্সিং শেখাতেন। তিনি মজা করে ক্লেকে বললেন, মার দেয়ার জন্য তোমার দেয়ার কৌশল শিখতে হবে। তুমি বক্সিং শেখো, তাহলে যে কাউকে শায়েস্তা করতে পারবে।
প্রস্তাবটি ভীষণ পছন্দ হলো তার। ভাবলেন বক্সিং শিখলে তো আর চোরকে শায়েস্তা করা কোন ব্যাপার না! আর দেরি না করে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন বক্সিংয়ে। সে বছরই অপেশাদার টুর্নামেন্টে অভিষেক ১২ বছর বয়সী ক্লের। দ্রুত সবার নজর কেড়ে নিলেন। এরপর একের পর এক ফাইট জিতে তাক লাগিয়ে দিলেন। সমবয়সীরা তো পাত্তাই পেত না তার কাছে, বয়সে বড়রাও হতো ধরাশায়ী।
সেই শুরু কিংবদন্তি এক বক্সারের পথচলা। জিততে থাকলেন একের পর এক শিরোপা। খুব দ্রুত নাম ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই তার ঘরে এলো ৬টি কেন্টাকি গোল্ডেন গ্লোব (আঞ্চলিক শিরোপা), দুটি ন্যাশনাল গোল্ডেন গ্লোব (জাতীয় শিরোপা) ও দুটি অ্যাথলেটিক ইউনিয়ন শিরোপা। এই বয়সে যা কেউ কল্পনাও করতে সাহস পেত না এতদিন। তারপর পেশাদার বক্সিংয়ে নেমেও গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড। প্রতিপক্ষকে দুমড়ে, মুচড়ে জিতে নিয়েছেন একের পর এক শিরোপা। পেশাদার ক্যারিয়ারে ৬১টি ফাইটের মধ্যে মাত্র পাঁচবার হেরছেন তিনি।
ক্যাসিয়াস ক্লে নামের সেই ছেলেটিই পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার নতুন নাম হয় মোহাম্মদ আলী।

পেলে
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেন পেলে। পুরো নাম এডসন অ্যারান্তেস দো নাসিমেন্তো। নামটি রাখা হয়েছিল আমেরিকান বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের সাথে মিলিয়ে। পরিবারে অবশ্য ডাকনাম ছিলো ডিকো।
দরিদ্রতার মধ্যে জন্ম হলেও ফুটবল ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। সংসারের অভাবের কারণে ছোটবেলায়ই তাকে কাজে নামতে হয়। কখনো চায়ের দোকানের কর্মচারী, কখনো রেলস্টেশনে ঝাড়– দেয়া কিংবা এরকম ছোটখাটো আরো অনেক কাজ করতে হয় তাকে। তবে এত কিছুর পরেও তার ছিলো ফুটবলের নেশা। ফুটবল কেনার টাকা ছিলো না, তাই কোন কিছুর মধ্যে কাগজ ঢুকিয়ে বল বানিয়ে খেলতেন বস্তির ছেলেদের সাথে।
ফুটবল-পাগল ছেলেটির প্রিয় ফুটবলার ছিলেন ভাস্কো ডাগামা ক্লাবের গোলরক্ষক বিলে; কিন্তু বিলের নামটি তিনি কখনোই ভালোভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না, বলতেন পেলে। এরপর বন্ধুরা তাকে ‘পেলে’ বলে খ্যাপাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেটিই তার ডাকনাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
গলিতে ফুটবল খেলতে খেলতেই পেলের প্রতিভা একদিন চোখে পড়ে বিখ্যাত ক্লাব স্যান্তোসের ওয়ালডে মারডি ব্রিটোর। তখন বয়স মাত্র ১৫ বছর। ব্রিটোর মাধ্যমে পেলে যোগ দেন সান্তোস ক্লাবে। জায়গা হয় ক্লাবের বি টিমে। এক বছরের মাথায় ক্লাবের মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান। ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লিগে সান্তোসের হয়ে সেবার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু কিংবদন্তি এক ফুটবলারের বিশ^মঞ্চে যাত্রা।
এরপর আন্তর্জাতিক ফুটবলেও ঝড় তুলেছেন এই কিংবদন্তি। ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন তিনটি বিশ^কাপসহ অনেক শিরোপা। ব্যক্তিগতভাবে জিতেছেন অনেক সম্মাননা।

ডিয়াগো ম্যারাডোনা
পেলের মতো আরেক কিংবদন্তি ডিয়াগো ম্যারাডোনার শৈশবও কেটেছে দরিদ্রতার মাঝে। আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম ম্যারাডোনার। দিনটি ছিলো ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর। চার কন্যাসন্তানের পর মায়ের কোলজুড়ে আসেন তিনি। জন্ম লানুসে হলেও ম্যারাডোনা বেড়ে উঠেছেন ভিয়াফিয়োরিতো নামের আরেকটি ছোট শহরে।
ম্যারাডোনা নিজেই তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘বাবা যখন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন, আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আট সন্তানের জন্য তিনি বেশি কিছু আয় করতে পারতেন না। আমাদের কোনো কোন দিন খাবার থাকত না। আমার বোন কম খেত, যেন আমি রাতের বেলায় বেশি খেতে পারি। মা পেট ব্যথার ভান করে খেতেন না। সেই খাবার আমাদের দিতেন।’
তবে এত কষ্টের মাঝেও ফুটবল ছিলো তার ভালোবাসা। ম্যারাডোনা বলেন, ‘ফুটবল ছিল তখন আর্জেন্টিনার গরিব আর বস্তিতে থাকা ছেলেদের মুক্তির একটা উপায়। দারিদ্র্যের দুঃখ ভুলতে আমরা ফুটবল খেলতাম। খুব ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকতাম। ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকতো। আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার এক কাজিন আমাকে একটা চামড়ার বল উপহার দেয়। সেটাই ছিল আমার প্রথম বল। আমি সেই বলটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম।’
বাড়ির পেছনে একটা মাঠ ছিলো সেখানে খেলতেন ফুটবল ছোট্ট ম্যারাডোনা। সন্ধ্যায় অন্য ছেলেরা বাড়ি ফিরে গেলেও ম্যারাডোনা অন্ধকার নামার পরও খেলতেন একা একা। মাত্র ৮ বছর বয়সের সময় বাড়ির কাছের এক ক্লাবের মাঠে খেলতে গিয়ে একটি প্রতিভা অনুসন্ধানী দলের নজরে আসেন ম্যারাডোনা। জায়গা হয় রাজধানী শহর বুয়েনেস আইরেসের ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়রস-এ। অল্প দিনেই ক্লাবটির জুনিয়র দলের প্রাণভোমরা হয়ে ওঠেন তিনি।
সে সময় আর্জেন্টাইন প্রথম বিভাগ লিগের একটি ম্যাচের মধ্য বিরতির সময় মাঠে বল নিয়ে কারিকরি দেখান ১২ বছরের ম্যারাডোনা। সে সময়ই মূলত আর্জেন্টিনার মূল ধারার ফুটবল অঙ্গনের নজর পড়ে তার ওপর। ১৯৭৬ সালে ১৬তম জন্মদিনের ১০ দিন আগে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক তার। এরপর বিশ^ফুটবলে কি না করেছেন এই বাম পায়ের জাদুকর! আর্জেন্টিনাকে বিশ^কাপ জিতিয়েছেন, নিজে জিতেছেন অসংখ্য সম্মাননা। আর সবচেয়ে বেশি জিতেছেন সম্ভবত মানুষের হৃদয়।

Share.

মন্তব্য করুন