প্রাচীন রাজ্য মণিপুর। মণিপুর রাজ্যের অন্যতম আকর্ষণ একটি হ্রদ। হ্রদটি রাজধানী ইম্ফাল শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে টিডিম রোডে প্রাচীন মৌরাং রাজ্যে অবস্থিত। প্রায় ২৮৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদ। রাজ্যের বিভিন্ন নদীর পানি যুক্ত হয়েছে এই হ্রদের পানিতে। তবে এই প্রাকৃতিক হ্রদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ওপর ভেসে বেড়ানো জৈব পদার্থ আর ঘাস জাতীয় বিভিন্ন গাছপালা। এই সকল গাছপালা একত্র হয়ে এখানে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন আকারের ছোট বড় দ্বীপভূমি। এসব দ্বীপভূমির কোনো কোনোটিতে রয়েছে মানুষের বাস। এসব ভাসমান দ্বীপ বা দ্বীপের বিভিন্ন অংশগুলোকে বলা হয় ফুমদি। এই ফুমদিগুলোর কিছু কিছু গোলাকার, আবার কিছু আয়তাকার।

ফুমদিতে ছোট ছোট চালাঘর তৈরি করে মানুষ বসবাস করে। অনেককাল আগে থেকেই মানুষ এই সকল দ্বীপভূমিতে বসবাস করে আসছে। মৈরং হয়ে লোকতাকের মধ্যে একটি সরু ভূখ- প্রবেশ করেছে, যাতে গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম, নাম ‘থাঙ্গা’।
গ্রামের বাড়িঘরগুলোর মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আকার আকৃতি একইরকম। টিনের চালে ঘেরা রয়েছে বাঁধানো উঠোন। আর অধিকাংশ বাড়ির উঠোনের সাথে টিনের ঘরে রয়েছে এক বা একাধিক তাঁত।

লোকতাকের দৃশ্যপট দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বিচিত্রতায় লোকতাকের শোভা পরিবর্তিত হতে থাকে। বৃষ্টির সময় লোকতাক যেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। বৃষ্টিস্নাত লোকতাকে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তবে বর্ষাকালে জীবনযাত্রা অনেক বেশি দুর্বিষহ।
মিষ্টি পানির হ্রদ হওয়াতে লোকতাকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। লোকতাকের অধিবাসীদের জীবনযাপন অনেকাংশই নির্ভর করে মৎস্য-প্রাচুর্যের ওপর। তাই অনেক বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন পরিবারের লোকতাকে বসবাস।

এটা অন্যরকম এক জীবনব্যবস্থা যেখানে স্থায়ী বসবাস বলে কিছু নেই। লোকতাকের জনজীবনও এমন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তাদের ঘরবাড়িও সেভাবেই তৈরি করা। তবে এখানকার মজার বিষয় হলো, হ্রদের সীমানা নির্দিষ্ট হলেও লোকতাকের মধ্যে অবস্থিত ফুমদিগুলোর ওপর থাকা চালার ঘরবাড়িগুলোর অবস্থান মোটেও স্থায়ী নয়। পানির সাথে ভেসে ভেসে বাড়িগুলো বিভিন্ন জায়গায় দিক পরিবর্তন করতে থাকে প্রতিনিয়ত। এখানে বিভিন্ন স্থানে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সাথে একটি করে ডিঙি নৌকা বাঁধানো থাকে। নৌকা ছাড়া এখানে জনজীবন প্রায় কল্পনাতীত।

লোকতাকের বেশ কাছেই অবস্থিত কৈবুল লামজো ন্যাশনাল পার্ক। এটি বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জলাভূমি তথা জাতীয় উদ্যান, যেখানে মণিপুরের জাতীয় পশু সাঙ্গাই হরিণ। দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত সবুজ আর হলুদ লম্বা লম্বা ঘাসে ঘুরে বেড়ায় এ ধরনের হরিণ। এখানে রয়েছে পর্যটক বাংলো এবং ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত উজ্জ্বল সবুজ ভাসমান ঘাসজমি।

শীতের সময় এখানে বিদেশি পাখিদের মেলা বসে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকতাকে ভিড় করে নানান জাতের অতিথি পাখি। পাখির কিচিরমিচির এবং হ্রদের ওপর উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকের দৃশ্য মনোরম এক অনুভূতি জাগায়। এসব পাখি নিধন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং প্রাকৃতিক এই ভারসাম্য রক্ষা করতে স্থানীয়রাও খুব সচেতন। লোকতাককে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০টিরও বেশি গ্রাম আর ৩০টির মতো বাজার। মণিপুর রাজ্যের অর্থনীতিতেও এই লোকতাকের আছে অসামান্য অবদান। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে পর্যটকের সংখ্যাও।
তবে লোকতাকে নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে জীববৈচিত্র এবং পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই বিঘিœত হয়েছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে আশার সঞ্চার করলেও অপার সৌন্দর্যম-িত এই লোকতাককে করেছে হুমকির সম্মুখীন।
বিমান, ট্রেন বা সড়ক পথে ইম্ফাল হয়ে লোকতাকে পৌঁছানো যায়। থাকার জন্যে এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রিসোর্ট বা হোম স্টে। নৌকাভ্রমণ লোকতাকের প্রধান ও মূল আকর্ষণ। এখানে ঘোরার শ্রেষ্ঠ সময় শীতকাল।

Share.

মন্তব্য করুন