হেমন্ত প্রায় বিদায় নিচ্ছে প্রকৃতি থেকে। গুটি গুটি পায়ে শীত আসছে প্রকৃতিতে। তাই প্রকৃতি এখন সাজছে নতুন সাজে। শীতের আগমনে গ্রাম-বাংলার আবহাওয়ায় ধীরে ধীরে আসে পরিবর্তন। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে ও বসন্তের আগে। শীতকাল পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস হলেও এর শুরু কিছুটা আগে এবং শেষ হয় কিছুটা পরে। পৌষ-মাঘ এই দুই মাস নিয়েই শীতকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে শীতের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হিমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। উল্লেখ্য, বাংলার শীতকে উপযোগী জেনে প্রতি বছরই অপেক্ষাকৃত বেশি শীতের অঞ্চলগুলো থেকে আসে লাখো লাখো অতিথি পাখি। এই অতিথিরা বাংলার প্রকৃতিতে ঠাঁই নেয়, প্রিয় অতিথি হয়ে থাকে গোটা শীতের মৌসুম। তাদের কলতানে মুখরিত হয় দেশের বিভিন্ন জলাভূমি।

এসব পাখির পাখা ছড়িয়ে দেয়া উড়ে চলার সৌন্দর্য বাংলার আকাশকে করে তোলে আরও সুন্দর। তাই প্রতি বছর শীতকাল এলেই আমাদের আশপাশের বিভিন্ন জলাশয়, খাল-বিল, হাওর, পুকুর ভরে যায় নানা রঙবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। এসব পাখিকেই বলা হয় অতিথি পাখি। তাই পৌষ মাঘ মাসে সচরাচর যেসব পাখি দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লেঞ্জা, কুন্তি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, নীলশির, গ্যাডওয়াল, লালশির, পাতারি হাঁস, বামনীয়া, ভুটি হাঁস, কালো হাঁস, চখা-চখি, বালি হাঁস, বড় সরালী, ছোট সরালী, রাজ হাঁস, কানি বক, ধূসর বক, গো বক, সাদা বক, ছোট বক, মাঝলা বক, কালেম বা কায়েন, জল ময়ূর, ডুবুরি, খোঁপা ডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি, বড় পানকৌড়ি, শামুক ভাঙা বা শামুক খোলা, কালো কুট, কাদা খোঁচা বা চ্যাগা, জলের কাদাখোঁচা পাখি, ছোট রিয়া, বাটান, চা পাখি, সবুজ পা, লাল পা পিও, লাল লতিফা বা হটটিটি, গঙ্গা কবুতর, কাল মাখা গঙ্গা কবুতর, রাজসরালি, পিন্টেল, পাতিসরালি, বালিহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, সাদাবক, দলপিপি, পানমুরগি, কাস্তেচড়া, বেগুনিকালেম, পানকৌউড়ি, ঈগল প্রভৃতি। এসব পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়। সেইসব দেশ বরফে ঢেকে যাওয়ায় এতই ঠা-া আবহাওয়া থাকে যে আমাদের দেশের শীতকাল সেই পাখিদের জন্য অনেক আরামদায়ক। ফলে এসব পাখি আমাদের দেশে প্রতি বছর বেড়াতে আসে। তাই প্রতি বছর শীতকাল এলেই জলাশয়, বিল, হাওর, পুকুর ভরে যায় নানা রঙবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। আদর করে আমরা সেগুলোকে বলি অতিথি পাখি। নাম অতিথি হলেও এই পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় নিজেদের জীবন বাঁচাতে। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির পাখি আছে। এসব পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়। শুধু ইউরোপ আর এশিয়ায় আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। কিছু কিছু পাখি তাই প্রতি বছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে যায় দূরদেশে। উত্তর মেরু অঞ্চলের এক জাতীয় সামুদ্রিক শঙ্খচিল প্রতি বছর এই দূরত্ব অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে চলে আসে। আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও তারাও অনেক দূর থেকেই আসে। বরফ শুভ্র হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশির ভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এসব পাখিরা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে।

এ ছাড়া ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকেও এসব পাখি আসে। এরা কিছু সময় পর আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। অতিথি পাখি কেন আসে কেন যায় এর উত্তর খুব সহজেই দেওয়া যায়। কারণ শীত এলে এরা সহ্য করতে না পেরে অন্য দেশে যেখানে শীত অপেক্ষাকৃত কম সেখানে চলে যায়। তা ছাড়া এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেও দেখা যায় প্রচ- অভাব। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সাথে রয়েছে তুষারপাত। তাই কোনো গাছপালা জন্মাতেও পারে না। তাই শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠা-া অঞ্চলের দিকে। বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। ঘুম ভাঙতে শুরু করে পুরো শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা অনেক প্রাণীদের। ঠিক এ রকম এক সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ। আবার এখানে বেশ মজার একটা ব্যাপার আছে। তারা ফিরে গিয়ে ঠিক তাদের বাড়ি চিনে নেয়। অদ্ভুত এক ব্যাপার তাই না? গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে এই পাখিদের দেহে সেরকম কিছু একটা জন্মগতভাবেই আছে।

যা তাদের পথ চলার সময় দিক চিনতে সাহায্য করে। তা ছাড়া তারা সূর্য ও তারার অবস্থানের ওপরই নির্ভর করে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাতে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পাখিরা নির্বিঘেœ পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলে নক্ষত্র ঢাকা পড়ে। এ সময় এসব পাখিরা আকাশ থেকে নিচে কোনো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলা পাখিরা এ ক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়। তাই এ সময় অনেক দূরের কোনো লাইটহাউজের শক্তিশালী আলোর দিকে তারা পথ ভুল করে চলে আসে দলে দলে। মেঘলা কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে লাইটহাউজের গ্লাসে আঘাত পেয়ে হাজার হাজার পাখি মারা পড়ে। অতিথি পাখিরা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই প্রতি বছর ভ্রমণ করছে। প্রতি বছরই তারা শীতপ্রধান অঞ্চলের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে উড়ে যায় হাজার হাজার মাইল দূরের অপেক্ষাকৃত কোনো উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, নীলফামারী জেলার নীলসাগর দীঘিতে, দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিতে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বাইক্কা বিলে প্রভৃতি স্থানে শীতের হাজারো অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠে। এ সময় অতিথি পাখি দেখতে ছুটে আসেন বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য পাখিপ্রেমী মানুষ। এসব স্থানে বসে দর্শনার্থীদের মিলনমেলা। শীতের অতিথি পাখিরা কিচিরমিচির ডাক আর পাখা নাচিয়ে উড়াল দিয়ে পানিতে ভেসে বেড়ানোর খেলায় মেতে উঠে।

এ সময় দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিতেও আসা শুরু করে শীতের অতিথি পাখি। ৭টি অভয়াশ্রমসহ গোটা হাওরই যেন এসব অতিথি পাখির মুক্ত বিচরণভূমি। ক্রমে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে গ্রাম বাংলার ছোট-বড় ২৩৫টি বিলের সমন্বয়ে গড়া হাওরাঞ্চল। দেশের যে স্থানগুলোতে অতিথি পাখির সমাগম ঘটে হাকালুকি হাওর তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের হাওরগুলোর ওপর জরিপ চালিয়ে পাখি বিশেষজ্ঞরা জানান, আমাদের দেশে বেশি অতিথি পাখি সমাগমের পাশাপাশি বেশি প্রজাতির এবং বিলুপ্ত প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। ফলে সুযোগসন্ধানী পাখি শিকারিরা এইসব অতিথি পাখি শিকার করার জন্য লোভাতুর হয়ে থাকে। তাই সেইসব লোভী পাখি শিকারি যাতে শীতের এই অতিথি পাখি শিকার করতে না পারে এ লক্ষ্যে আমাদের গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। অতিথি পাখির জন্য সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায় তা আজও পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি।

১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা মতে পাখি শিকার ও হত্যা দ-নীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। যা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা জাতীয় সংসদের সামনেও দিনের বেলা অতিথি পাখি অবাধে বিক্রি হতে দেখা যায়। পত্র-পত্রিকায় এর ছবিও ছাপা হয়। কিন্তু এতে কারও টনক নড়ে না। বারবার একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটে। পাখির দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ বাংলাদেশ। অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এদেশ পেয়েছে অতিথি পাখি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ফ্রেন্ডশিপ ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে নামক অতিথি পাখি সংরক্ষণ ও গবেষক সংস্থা বাংলাদেশকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে, যা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। অতিথি পাখি আমাদের বন্ধু। অতিথি পাখি আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নানাভাবে রক্ষা করে থাকে, যা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারি না। তাই একটু আশ্রয়ের আশায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যে পাখিরা এসে আশ্রয় নেয় বাংলা মায়ের বুকে তারা যেন কোনো ধরনের বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির কবলে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা আমাদের সবার কর্তব্য।

Share.

মন্তব্য করুন