ইন্টারভিউয়ের কার্ডটা ডেস্কের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল নিউটন মামা। ডেস্কটা সবসময় তালা লাগানো থাকে। ছোট সাইজের সোনালি রঙের পিতলের তালা। ওই ডেস্কে মামার একটি পারসোনাল ডায়েরি থাকে। বিছানায় যাওয়ার দশ মিনিট আগে মামা ডায়েরিটা নিয়ে বসে। কপালে কলমের পৃষ্ঠাংশ ঠেকিয়ে অতল সমুদ্র চিন্তা করে করে কী যেন লেখে। ভারতের কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদও মামার মতো রাতের বেলায় ডায়েরি নিয়ে বসতেন। কী লিখতেন জাতি জানতে পেরেছিল অনেক বছর পরে, যখন তাঁর অস্তিত্ব আর পৃথিবীতে ছিল না।
নিউটন মামার এমএসসি পাসের বয়সটা বেশি দিন হয়নি। মাত্রই সাত মাসে পড়েছে এই জুলাই মাসে। পেছনের এই ছয় মাস মামা যে একেবারে ঘরের কোণে বসে বসে বেকার সময় কাটিয়েছে তাও না। এক সপ্তাহ ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে দীঘিনালা, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি এলাকায়। উদ্দেশ্য একটাই, মধুর প্রজেক্টে নামবে মামা। কিন্তু কী কারণে যে মামা আবার এই প্রজেক্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, একমাত্র মামা ছাড়া কেউ বলতে পারে না।
নিউটন মামাদের আর্থিক অবস্থা সেকালের জমিদারের মতো। জমিজমার কোনো হিসাব নেই। একটি গ্রামেই মামাদের তিন তিনটে বিরাট বিরাট পুকুর। পুকুরগুলো দেখতে এতো বড় যে, কেউ কেউ পুকুরকে দীঘি বলে ভুল করে। নিউটন মামা যখন এই পুকুরে মাছ ছাড়ার কথা ভাবছে- তখনই এসে গেল ইন্টারভিউ কার্ড।
সকালবেলা নিপা আপা এলো। নিপা আপা নিউটন মামার চেয়ে চার বছর তিন মাসের বড়। নিপা আপার সাথে এলো বিচ্ছু। বিচ্ছুর আসল নাম ইফতেখার মাহমুদ পলক। মামা কখনো তার আসল নাম ধরে ডাকে না। বিচ্ছু বলেই ডাকে। পলক আসলে বিচ্ছুর চেয়ে কম যায় না। দৌড়াদৌড়িও করে বিচ্ছুর চেয়ে তিন ধাপ বেশি। সামনে যা পায় সবকিছু উলটে পালটে দেখে। সুই-সুতো পেলেও ওটা নিয়ে টানাটানি করে।
‘দশটা টাকা দাও।’ পেছন থেকে জাপটে ধরল পলক।
‘দশ টাকা দিয়ে কী করবি?’
‘একটা চিপস কিনবো।’
‘চিপস খাওয়াটা ভালো না।’
‘তুমি কি ডাক্তার? বাবাও তো চিপস খেতে মানা করে না। অথচ বাবা কতো বড় ডাক্তার।’
নিউটন মামা পলকের সাথে আর কথা বাড়ায় না। পকেট থেকে একটা কড়কড়ে দশ টাকার নোট বের করে দেয়। টাকা হাতে নিয়ে পলক মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
ইন্টারভিউয়ের কথাটা মামা কাউকে জানায়নি। মাকে আজ জানাতে হবে। আজ শুক্রবার। কাল শনিবার। রোববার দশটা ত্রিশ মিনিটে মামার ইন্টারভিউ। প্রস্তুতিটা এখন থেকেই নিতে হবে। সময়টা বড়ই কম।
খাবার টেবিলে বসেছে নিপা আপা। মা নিলুফার বেগম এটা ওটা বেড়ে দিচ্ছেন। মায়ের দিকে ভয়ে ভয়ে চোখ ফেলছে নিউটন মামা।
মামা প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলল, ‘কাল ঢাকা যাবো মা।’
‘ঢাকা যাবি মানে?’
‘সেই ছোটকালে তোমাদের সাথে একবার ঢাকা গিয়েছিলাম। চৌদ্দ-পনেরো বছর আগের কথা। এখন নাকি রূপ-গন্ধে ঢাকা অনেক বদলেছে। জৌলুস বেড়েছে ঢাকার। ঘরে বসে বসে আমি আঁটকুড়ো হয়ে যাচ্ছি।’
‘ফিরবি কখন?’
‘দু’দিন থাকব। তারপর তোমার কোলে ফিরে আসব।’
নিলুফার বেগম চেহারা বদলে খাওয়া শুরু করলেন।
‘তোমাকে আসল কথাটা বলা হয় নি মা।’
‘আমি জানি কী বলবি। পাঁচ হাজার দিলে হবে?’
‘ওটা তো গাড়ি ভাড়াই চলে যাবে।’
নিপা আপা বলল, ‘আমি দেব। তবে দুই দিনের বেশি থাকা যাবে না। আমি দুই দিনের বেশি থাকতে পারব না। ঘরে অনেক কাজ।’
নিউটন মামার ফরসা মুখটা আরও ফরসা হয়ে গেল। নিপা আপা কিছু দেওয়ার সময় তার পাঁচ আঙুলই লম্বা হয়ে যায়। দশ হাজারের নিচে কস্মিনেও দেবে না নিপা আপা।
গাড়ি থেকে নেমে সোজা অফিসে ঢুকল মামা। রিসেপশনের সামনে একটা বিরাট করিডোর। সারি সারি চেয়ার পাতা চারপাশে। চেয়ারগুলো নতুন এবং দামি দামি মনে হচ্ছে। প্রত্যেকটি চেয়ার দখল করে আছে একঝাঁক তরুণ। সবার কোলে নানান রঙের নতুন ফাইল। দক্ষিণ পাশে তিন-চারটে চেয়ার খালি আছে। নিউটন মামা একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল।
ভেতর থেকে পিয়ন একজনের নাম ধরে ডাকল। স্মার্ট একজন তরুণ উঠে পড়ল। তরুণের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট হয়ে আছে। বোঝা গেল তরুণের চাকরিটা খুবই জরুরি। এখন বাজে বারোটা দশ। দুই ঘণ্টার ওপরে মামা একই চেয়ারে বসে আছে। ফাইলটা চেয়ারে রেখে মামা কোমরটা সোজা করল। চাকরির প্রার্থীরা এখন ঘন ঘন আসা-যাওয়া করছে। মামার কাছে এটা কর্মকর্তাদের ধৈযচ্যুতির লক্ষণ বলে মনে হলো।

একেবারে শূন্য হয়ে গেছে চেয়ারগুলো। মামা একলা বসে আছে। মামার ডাক আসছে না। বিষয়টা কী? মামা সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করল। নিজেকে অসহায় বোধ করতে লাগল।
পিয়নকে আসতে দেখে মামা সতর্ক হলো। পিয়নের তামাটে মুখে মুচকি হাসি। পিয়নের এরকম হাসি মামার কাছে অসহ্য লাগল।
‘স্যার কি এককাপ চা খাবেন?’ পিয়ন হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল।
মামা বললেন, ‘আমি অসময়ে চা খাই না।’
‘স্যারেরা চা-পানি আপ্যায়নে বসেছেন। পনেরো মিনিট লাগবে। আপনি ছাড়া আর কোনো প্রার্থী নেই।’
‘জানানোর জন্য ধন্যবাদ।’
‘বিদেশি অফিস, সব নিয়মে চলে স্যার। চা-নাশতার সময় চা-নাশতা, লাঞ্চের সময় লাঞ্চ।’
‘এখন কি চা-নাশতার সময়?’
‘দেশের ভেতর বিদেশি নিয়ম, এভাবে চলে আসছে একুশ বছর।’
‘ও আচ্ছা।’
‘স্যারের বাড়ি কোথায়?’
‘চট্টগ্রাম।’
‘চট্টগ্রামের লোকেরা তো চাকরি করে না স্যার। এদের মাথায় ব্যবসার পোকা। এই পোকারা মাথার ভেতর সবসময় কিলবিল করে।’
ক্রিং করে বেল বেজে উঠলে পিয়ন দ্রুত অফিস ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করল।
একটা ত্রিশ মিনিটে মামার ডাক পড়ল। নিজের ভেতর শক্তিহীনতা অনুভব করছে মামা। ছয় ঘণ্টা যাবৎ পেটে একটিও দানা যায় নি। এতক্ষণ কিছু না খেয়ে মামা কখনো থাকতে পারে না।
একটা বিরাট হলরুমে পাশাপাশি তিনজন লোক বসে আছেন। দুজন পুরুষ, একজন মহিলা। মহিলা মাঝখানের চেয়ারে। তিনজনই বাজপাখির চোখ নিয়ে নিউটন মামার দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলা ঠোঁটে টানা বারান্দার হাসি। পুরুষ দু’জনের চেহারা শুষ্ক শুষ্ক। অথচ চা-পানির পর এমন চেহারা সচরাচর চোখে পড়ে না।
মহিলা হাতের ইশারা করলেন বসার জন্য। মামা বসে ফাইলটা টেবিলের ওপরে রাখল।
প্রথম পুরুষ কর্মকর্তা মুখ খুললেন। তিনি বললেন, ‘নামটা প্লিজ…’
‘নিউটন আজাদ।’
‘কী নামে ডাকা হয়, নিউটন না আজাদ?’
‘নিউটন।’
‘নিউটন?’
‘জি, আশপাশের প্রতিবেশীদের দেয়া নাম। উনাদের মতে আমিও একদিন নিউটনের মতো কিছু আবিষ্কার করে ফেলব।’
‘পারবেন?’
‘জানি না।’
‘উনাদের এই ধারণা জন্মাবার কারণ কী?’
‘ইশকুলে পড়ার সময় প্রতি বছর আমি বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে মেলায় ফার্স্ট হতাম। তখন থেকেই পড়শিরা আমাকে নিউটন ডাকতে শুরু করে।’
দ্বিতীয় পুরুষ কর্মকর্তা বললেন, ‘ফ্যানটাস্টিক!’
প্রথম পুরুষ কর্মকর্তা বললেন, ‘একটা ধানের ছড়ায় কতগুলো ধান থাকে বলুন।’
প্রশ্নটা শুনে মামা ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। ধান-গম নিয়ে মামা কখনো গবেষণা করে নি। একটা ধানের ছড়ায় কয়টা ধান থাকে এর উত্তর তো কারোর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব না। কোনো কৃষিবিজ্ঞানীও বলতে পারবেন না এর উত্তরটা। প্রশ্নকর্তা কি জানেন একটা ছড়ায় কয়টা ধান থাকে? জানেন না। কী জবাব দেবে মামা একটুক্ষণ ভাবল এবং বলল, ‘কী ধান স্যার, আমন, বোরো না ইরি?’
‘ইরি।’
‘দুইশ’ বত্রিশটি স্যার।’
‘দুইশ’ বত্রিশ?’
‘জি-স্যার। একটা ছড়া এনে দিলে আমি গুনে দিতে পারব।’
মহিলা কর্মকর্তা কাগজে কী যেন টুকলেন। নম্বর-টম্বর হবে হয়তো। এই বেলায় মামার কপালে কোনো নম্বর এসেছে কিনা মহিলা কর্মকর্তা ছাড়া কেউ বলতে পারে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়’, এটা কোন সমাস?’
‘আসলে যুগ যুগ ধরে আমাদের ভুল-ভাল শিখিয়ে আসছেন আমাদের প-িতেরা। পাগলে তো অনেক কিছুই বলে না। তার বাচ্চাদের পাগলে বকাবকি করে না। মায়ের দিকে চোখ গেলে পাগলে করুণ চোখে তাকায়। আর ছাগলের কথা বলছেন? ছাগলে অনেক কিছু খায় না। কাঁঠাল পাতা খেলেও বটগাছের পাতা খায় না। আপাং গাছের পাতাও ছাগলে খায় না। ছাগলে কি না খায়, এ কথাটিও ঠিক না।’
মহিলা কর্মকর্তা শব্দ করে হেসে উঠলেন। একসময় হাসি থামিয়ে কাগজে কী যেন টুকাতে থাকলেন।
মহিলা কর্মকর্তা হাসি থামিয়ে বললেন, ‘আপনাদের কি জমিজমা আছে?’
‘জি, আছে।’ তবে এর দেখাশোনা বর্গাচাষিরা করে।’
‘এই জমিতে আপনাদের চলে যায়?’
‘আমাদের দুইশ’ পনেরো একর জমি আছে। আছে গোটা সাতেক পুকুর। আমাদের থানায় একমাত্র দীঘিটা আমাদের।
‘তাহলে আপনারা জমিদারই।’
‘অনেকে তা-ই বলে।’
‘জমিদারপুত্র হয়ে আপনি চাকরি করতে এসেছেন কোন খেয়ালে?’
‘জীবনে বড় শখ ছিল একটা ইন্টাভিউ দিই, দিলাম।’
‘আমরা তো আপনাকে নিয়োগপত্র দেব।’
‘একটা কচুক্ষেত প্রজেক্টের কথা ভাবছি।’
‘দুনিয়ায় এতো প্রজেক্ট থাকতে কচুক্ষেতটা মাথায় এলো কেন?’
‘এবার একটি ছেলের গোল্ডেনের কাহিনী পড়েছি। ছেলেটির বাবা রিকশা চালায়। তাদের রোজ রোজ বাজার হয় না। প্রত্যেকদিন সকালবেলা মা মাঠ থেকে কচুশাক তুলে এনে পাকাত। ছেলের মায়ের বক্তব্য হলো কচুশাকই ছেলেকে গোল্ডেন এনে দিয়েছে। আমিও ভেবে দেখলাম ছেলের মায়ের কথাই ঠিক। কচুর আপাদমস্তক অনেক গুণাগুণ আছে। কচু, কচুর ফুল, কচুপাতা, কচুর লতি কিছুই ফ্যালনা যায় না। আয়রনে ভরা এই সবজিকে আমরা কতোই না অবহেলা করি। আমরা কথায় কথায় বলি, তুমি কচু করবে, অথবা বলি, তুমি কচু লিখেছ? দেখুন, কচুর প্রতি এটা অমানবিক আচরণ। আমার অনেক কষ্ট লাগে। তাই…’
মহিলা কর্মকর্তা বললেন, ‘সত্যিই আপনি একজন সোনার মানুষ। আপনাকে পেলে আমাদের প্রতিষ্ঠান বড়ই ধন্য হতো।’
মামা বলল, ‘দোয়া করবেন। যাই…’
মামা দু’পা হেঁটে একটু থামল। প্রথম কর্মকর্তার দিকে মুখ করে বলল, ‘ধানের ছড়ার উত্তরটা আন্দাজে বলেছি, বাড়িতে গিয়ে গুনে দেখব একটা ছড়ায় কয়টা ধান থাকে।’
নিউটন মামা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। চমৎকার দ্রুত হাঁটতে পারে নিউটন মামা।

Share.

মন্তব্য করুন