আস্সালামু আলাইকুম। প্রিয় বন্ধুরা এই মহামারি করোনাকালে কেমন আছো? আশা রাখি আল্লাহর রহমতে ভালো আছো। তোমাদের সাথে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রের পরিচয় করিয়ে দেব, যেখানে মা হারা সন্তান প্রিয় শিক্ষকের নিবিড় সহযোগিতা ও ভালবাসায় স্কুলের সেরা ছাত্রে পরিণত হয়। দেশের প্রথম শিশুতোষ ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’। এটি বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত কিশোরদের জন্য নির্মিত প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র।
দূরবীন ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, জাফর ফিরোজ পরিচালিত একটি শিশু ও কিশোরদের উপযোগী বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে ভারতীয় বাঙালি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রচিত দূরবীন উপন্যাসের আলোকে। চলচ্চিত্রটির প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছে লাবিব, কাজী আখতারুজ্জামান, মাহবুব মুকুল, জাফর ফিরোজ, আফনান প্রমুখ।

২০০৯ সালের ২৯ অক্টোবর চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। স্টার সিনাপ্লেক্সে চলচ্চিত্রটি উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালিন আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, নারী ও শিশু প্রতিমন্ত্রী শারমিন চৌধুরী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি চেয়ারম্যান শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটির উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা, সেভ দ্য চিল্ড্রেন অস্ট্রেলিয়ার দেশ পরিচালক সুলতান মাহমুদ; চলচ্চিত্র তারকা ইলিয়াস কাঞ্চন। সেভ দ্য চিলড্রেনস, ইউনিসেফ সহ অনেক শিশু সংগঠন একটি সফল চলচ্চিত্র হিসাবে দূরবীনের প্রশংসা করেন।
দূরবীন চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য জাফর ফিরোজ মুম্বাই ফ্লিম একাডেমি থেকে আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরিতে সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে পুরস্কার পান।
দূরবীনের পরিচালক জাফর ফিরোজ। বয়সে তরুণ, মনে তার শিশুসুলভ স্বপ্ন। সব সময় চিন্তা করেন তোমাদের নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন তোমাদের জন্য কিছু করার। ওই যে বললাম, মনটা তার একেবারেই শিশুদের মতো! কল্পনা-চিন্তাগুলো সে কারণেই তোমাদেরকে নিয়ে আবর্তিত হয়। আর সেই স্বপ্ন ও কল্পনা থেকেই তোমাদের জন্য বানালেন ‘দূরবীন’। ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। তোমরা যারা ছবিটি দেখেছ তারা সাঈফ স্যারকে মনে রেখেছ। ছাত্রদের কত প্রিয় সেই সাঈফ স্যার! বাস্তবেও ঠিক তাই। সেই সাঈফ স্যারই এই ছবির পরিচালক। শিশু বয়সের ভাবনা, দুরন্তপনা, অজানাকে জানার ইচ্ছা, শ্রেণী-বৈষম্য বিরোধী ভাবনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম। এসব নিয়েই ছবিটি বানিয়েছেন স্বপ্নচারী এই তরুণ পরিচালক।
দূরবীনের প্রযোজনায় রয়েছে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন অনুপম সাংস্কৃতিক সংসদ। পরিবেশনায় বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটি।

আচ্ছা বন্ধুরা, যাকে কেন্দ্র করে ছবিটি তৈরি হয়েছে অর্থাৎ যে শিশুটির জীবনাচার ও স্বপ্ন-কল্পনা এবং বাস্তবতা নিয়ে এর কাহিনী চিত্রিত হয়েছে, তার সাথেও একবার পরিচিত হয়ে নিলে কেমন হয়? ছেলেটির নাম লাবিব। ছবির প্রধান চরিত্র। ছবিটি দেখতে দেখতে তোমরা লাবিবের জন্য চোখের পানি ফেলেছ সেটা আমরা জানি। আবার লাবিবের পুরস্কার ও বৃত্তির খবরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছ তাও জানি। এই জায়গাটিতে নিজেকে কখনোই ধরে রাখা যায় না।
তোমরা আজ প্রথম যারা দূরবীন সম্পর্কে পড়ছো ও জানছো, তারা নিশ্চয়ই এর কাহিনী সম্পর্কে জানতে চাইছো। ঠিক আছে, এবার দূরবীনের কাহিনীটা সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক। তবে যারা ইতোমধ্যেই ওটা দেখে ফেলেছ, তারা কিন্তু আবার মুখ গোমড়া করে ফেলো না। তোমার জানাটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে তো তোমারই ভালো লাগবে।

লাবিবের মা নেই। বাবা বড় ব্যবসায়ী। সবসময় সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলেকে দেয়ার মতো তার তেমন সময় নেই। বাড়ি, গাড়ি, দামি খেলনা কোনো কিছুর অভাব নেই লাবিবের। কিন্তু এসব ওর মনকে এতটুকু খুশি করতে পারে না। ও পাখি হয়ে স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে চায়। ঘাসের বুকে রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ানো ফড়িং বা প্রজাপতি ধরতে চায়। স্কুল থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে স্কুল। নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা এই গোলকধাঁধা ওর একদম ভালো লাগে না। কিসের একটা প্রচ- তৃষ্ণা ওর হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বদা। চাপা একটা চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে ওর মন নামক সুন্দর ভুবনটা ক্রমেই ছোট থেকে ছোটতর হতে থাকে। নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে যায় ও।
এভাবেই কাটছিল দিন। এর মাঝেই একদিন ওর পরিচয় হয় সাঈফ স্যারের সাথে। সাঈফ স্যারের উপস্থিতি ওর জীবনে সূচনা করে এক নতুন দিগন্ত। সাঈফ স্যার হয়ে যায় ওর বন্ধু। যে কল্পনার রঙ মেখে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াত লাবিব, সেই রঙ বাস্তবে ওর জীবনে বয়ে আনে সাঈফ। সুযোগ পায় মুক্ত আকাশে ডানা মেলার।

এই ছবিতে আমরা একজন শিক্ষককে শাসক নয়, বন্ধু হিসেবে দেখতে পাই। শিক্ষক যে ছাত্রদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম তা এখানে দৃশ্যমান। আমরা দেখতে পাই শিশু লাবিবের মানসিক বিকাশ ও জাতীয় শিশু অভিনয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার দৃশ্য, প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তিপ্রাপ্তির মতো আনন্দময় সুখবর। একজন স্নেহবঞ্চিত অমনোযোগী শিশুর পক্ষে এসব কিছুই সম্ভব হয় একজন স্নেহপরায়ন আদর্শ শিক্ষকের কারণে। এই ছবিটিতে আমরা দেখি লাবিব শিশু হলেও তার মাঝে মানবিক কিছু গুণ প্রতীয়মান। খাবার টেবিলে বসে ভাবছে এই বুঝি মা ওর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। অথচ তখন ওর পাশে শূন্য চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। এই জায়গাটিতে এসে কেউ নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। বিড়ালকে খাবার দিয়ে লাবিব বুঝিয়ে দেয় যে, সমাজে সবাই ভালোবাসার মাঝে বেড়ে উঠতে চায়।

শুধু লাবিব নয়, তার অন্য বন্ধুদের দায়িত্ববোধ চোখে পড়ার মতো। বন্ধুরা লাবিবের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায়। ছবিটিতে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান। লাবিব মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে লাবিবের বাবার ভুল ভাঙে। তিনি বুঝতে পারেন তার অমানবিকতা এবং ছেলের প্রতি অবহেলার বিষয়টি। তাই সাঈফ স্যার ও বন্ধুদের মাঝে ফিরিয়ে দেন লাবিবকে। লাবিব ফিরে পায় আপন ঠিকানা। ছবিটিতে তোমরা যে স্কুলটি দেখছ তা ঢাকার বিখ্যাত সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল। আর বাড়িটি বনানীর ১৩ নম্বর রোডের ‘মমতা’।

দূরবীনে দু’টি গান রয়েছে অসাধারণ। মা শিরোনামে গানটি লিখেছেন পরিচালক নিজেই। সুর করেছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আমিরুল মোমেনীন মানিক। শিশু শিরোনামে গানটি লিখেছেন আবু তাহের বেলাল। সুর করেছেন গোলাম মাওলা। মা গানটি শুনে কারো অশ্রু ঝরেনি এমনটি হয়নি। এই গানটি শুনলে মনে হয় মা কতো বড় সম্পদ। অথচ আমরা মাকে কতো জ্বালাতন করি। শিশু গানটি শিশুদের অধিকার নিয়ে। গানটির কথা এ রকম “প্রতিটি শিশুরই সুকোমল মন সুবাসিত ফুলের মতন/পৃথিবীতে তারা আনবে ফাগুন করো যদি সোহাগ যতন।”
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা এবং শিক্ষক-ছাত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছবিটিকে করেছে অমূল্য। ছবিটি বিনোদনের পাশাপাশি মানবিক ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হওয়ার শিক্ষা দেয়।

Share.

মন্তব্য করুন