দু’শ চৌত্রিশ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মেসবাড়িতে থাকা শিবরাম বাবুকে যদি তুমি না চিনে থাকো, তাহলে ভারি মুশকিল। তাঁকে চেনা জরুরী, কারণ তিনি হচ্ছেন হাসির রাজা। কথায় আছে, মানুষকে কাঁদানোর চেয়ে হাসানো বেশ কঠিন। কীভাবে সেই কঠিন কাজটিকে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে জলবৎ তলরং করেছিলেন, তা জানতে হলে পড়তে হবে তাঁর বইগুলো। তাঁর বই মানেই হাসির পটরা। যা খুললেই কেবল হাসি আর হাসি। নানা রকম হাসির ফোয়ারা বইয়ে মরু গাঙে জোয়ার আসার মতো দুঃখে ভরা প্রাণে হাসির পরশ ছড়িয়ে দেয়। তাঁর গল্পও রম্য রচনা, যার প্রতিটা শব্দে শব্দে ছড়িয়ে আছে কেবলই হাসি আর হাসি। পড়তে গেলে মনে হবে প্রতিটা শব্দ যেন রসগোল্লা-চুইয়ে চুইয়ে যেন রস পড়ছে। পড়তে পড়তে তুমি ভুলে যাবে কী গল্প বলা হচ্ছে- গোগ্রাসে গিলবে এই ভাষা-রস। তাঁর লেখায় আছে প্রচুর পান (ঢ়ঁহ)। পান হলো, শব্দ নিয়ে মজা করার টার্ম। প্রতিটা শব্দ নিয়ে তিনি এত মজা করেছেন, ভেঙেচুরে অর্থ করেছেন নিজের মতো। কথার পিঠে কথা চাপিয়ে সরস রচনার ধারা বাংলা সাহিত্যে প্রচলন করেছেন তিনি। তাঁর প্রচলিত রীতি ‘শিবরামি স্টাইল’ নামেও পরিচিত।

১৯০৩ সালের ১৩ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেছিলেন হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তী। তাঁর শৈশব কেটেছে পাহাড়পুর ও চাঁচলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভবঘুরে। কৈশোরেই বাড়ি ছেড়েছিলেন একদম ফাঁকা পকেটে। বাইরের জগৎটাই অবশ্য তাঁকে ‘অকৃত্রিম’ শিবরাম বানিয়েছে। তাই নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁর লেখালেখির মূল রসদ। সারাজীবন তিনি ছিলেন বাউ-ুলে, ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশি দূর যাননি। ঘরে বসেই পড়ে ফেলেছেন বিশ্বের বড় বড় লেখকের নামকরা সব বই। বিচিত্র জীবন ছিল তাঁর। রাজনীতি করে জেল খেটেছেন, জীবিকার তাগিদে সংবাদপত্রের হকারি করেছেন, আবার করেছেন সাংবাদিকতাও। যেটা করেননি সেটা হচ্ছে বিয়ে। এ নিয়ে তাঁর একটা বক্তব্য রয়েছে। সারাটা জীবনতো কারো জন্য কিছু করতে পারেননি, তাই একটা মেয়েকে ‘হেল্প’ করতে চেয়েছেন বিয়ে না করে! কবিতা দিয়ে তিনি তাঁর লেখালেখি শুরু করে লিখেছেন প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস।

শিবরামকে বাংলা সাহিত্য কীভাবে পেল তার একটা স্বল্প ইতিহাস আছে। একবার শিবরাম মাসিক দুই টাকা সুদে এক কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা কর্জ নেন। প্রথম মাসের কিস্তিটা নিয়ে কোন বিড়াম্বনা হয়নি। কারণ দুই টাকা সুদ কেটে রেখেই কাবুলিওয়ালা তাকে আটচল্লিশ টাকা দেয়। কিন্তু গোল বাঁধে পরের মাসে এসে। মাস শেষ হতে চললেও শিবরাম কোনভাবেই সুদের দুই টাকা জোগাড় করতে পারেন না। কিন্তু কাবুলিওয়ালার সময়-জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর। নির্ধারিত দিনে তাগদায় গেছে কাবুলিওয়ালা। সেই কাবুলিওয়ালার তাগদা থেকে রেহাই পেতে মেস ছাড়া হলেন শিবরাম। কিভাবে ঋণের টাকা শোধ করবেন তা ভেবে ভেবে শরীর শুকিয়ে আমচুর। ঠিক এমনি যখন অবস্থা তখন দৈনিক বাসমুতির সম্পাদক হেমন্ত প্রসাদ ঘোষ বললেন, ‘শিবরাম তোমাকে একটা কথা বলি-’
‘কী কথা?’

‘কথা হচ্ছে- তুমি লেখালেখি শুরু করো।’
শিবরাম বললেন, ‘আপনি আর রসিকতা খুঁজে পেলেন না-লেখালেখি করব এই আমি? অসম্ভব-!’
‘না ভাই, অসম্ভব হবে কেন? তুমি লেখ আমি তোমাকে বলছি, এ লাইনে তোমার যশ অর্থ দুই প্রাপ্তি ঘটবে।’
এর চেয়ে কম অনুরোধে মানুষ গলে যায়, মানে যাকে বলা হয় অনুরোধে ঢেঁকি গেলা, সেখানে একজন সম্পাদকের অনুরোধ তাকে সহসাই কাবু করে ফেলল। তিনি একটি লেখা নিয়ে পরদিন সম্পাদকের দপ্তরে হাজির। লেখাটি নিয়ে সম্পাদক তাকে পাঁচটি টাকা নগদে হাতে দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাকে আরো উৎসাহিত করা। টাকাটা পেয়ে শিবরামের আনন্দ আর ধরে না। তিন টাকা খরচের জন্য রেখে বাকি দুই টাকা কাবুলিওয়ালাকে খুঁজে সুদের টাকা বুঝিয়ে দিলেন। এরূপ অতি দ্রুত লেখালেখি করে সেই অর্থে কাবুলিওয়ার দেনাশোধ করলেন। এরপর তিনি নিয়মিত লেখালিখি করেছেন। কারণ লিখেই তাকে খেতে হয়। সাহিত্য সাধনা শুরু করে তিনি বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন তোলেন।

জীবনের বেশির ভাগ সময় (প্রায় চল্লিশ বছর) কাটিয়েছেন কলকাতার দু’শ চৌত্রিশ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মেসবাড়ির ঘরে। মজার ব্যাপার হলো, তিনি জমিদারঘরের সন্তান। মেসবাড়িতে থেকেও রসিক মানুষটি সুখের ঢেকুর তুলে বলতেন, ‘মুক্তারামের তক্তোরামে শুক্তোরাম খেয়ে ভালোই আছি।’
নিজে আরামে থাকতেন, তাই বুঝি আরামে আর আনন্দে রাখার জন্য দারুন সব লেখাও লিখে গেছেন সারাটা জীবন। শিবরামের লেখা পড়া মানেই তো সারাক্ষণ মুখের মানচিত্রে হাসি লেগে থাকা। নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা ও সত্যজিতের ফেলুদার মতো পাঠকনন্দিত চরিত্র তাঁর লেখা ‘হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন’। তাঁর লেখা ‘হর্ষবর্ধন’ আর ‘গোবর্ধনের’ কা-কীর্তি এতটাই সরস যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়! তাই তো পাঠক-সমালোচকদের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘হাসিসম্রাট’ উপাধী।

অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা করা যতটা সহজ নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করা ততটাই কঠিন। কারণ, নিজেকে নিয়ে মজা করলে আর কারও রসিকতার সুযোগ থাকে না! এটা ভালো করেই জানতেন শিবরাম। একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে নিজেকে নিয়ে মজা করার সুযোগ অন্যের হাতে তুলে দিবেন এটা হতেই পারে না। তাই দায়িত্বটা আজীবন নিজের কাছে রেখেছিলেন তিনি। খুব অবলীলায় নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে ‘শিবরাম চকরবরতি’ বা ‘শিব্রাম চক্কোত্তি’ নামে যে লেখাগুলো লিখেছেন, তা-ও বাংলা সাহিত্যে বিরল।

শিবরাম চক্রবর্তীর বেশ কয়েকটি উপন্যাস রয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন। তবে তিনি সাধারনের কাছে জনপ্রিয় তাঁর গল্পের জন্য। শিবরামের গল্পের ধরন নিয়ে এক কথায় বলতে গেলে, গল্পের আনন্দ তাঁর ভাষায়, বাক্যের গাঁথুনিতে। বাংলা ভাষা যে এত রসিক, তা কে জানত? আর তাঁর গল্পের এক একটা ঘটনা, কথোপকথন এমন যে, বিশ্বাস করাই কষ্ট হয় একজন মানুষ কীভাবে এত আজগুবি চিন্তা করতে পারে! খুব নির্মম ঘটনাও তিনি এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে যাবে। আবার খুব হাসির ঘটনা পড়েও খারাপ হয়ে যাবে মনটা।
শিবরামের লেখা গল্পের কথা বলে কি শেষ করা যাবে? হাতির সঙ্গে হাতাহাতি, নরখাদকের কবলে, হাতাহাতির পর, অঙ্ক সাহিত্যের যোগফল, মন্টুর মাস্টার…থাক, এই তালিকা শেষ করতে হলে কয়েক পৃষ্ঠা লাগবে। এর চেয়ে বরং তাঁর সব লেখাগুলো পড়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। গল্পগুলো তোমাদের কাছে দারুন লাগবে এ কথা হলফ করেই বলতে পারি।

বইয়ের লেখনীর মতো শিবরাম চক্রবর্তী যে ভীষণ রসিক ছিলেন, তা কে না জানে। তাঁর রসিকতাও খুব উচু মানের, যতই আস্বাদন করো না কেন, স্বাদ বেড়েই চলে। একবার হয়েছে কি, বন্ধুরা এসেছে শিবরামের মেসবাড়িতে। সবাই জুতা খুলে তার কক্ষে ঢুকেছেন। জুতা বাইরে। তাই দেখে শিবরাম হাসতে হাসতে বললেন, বুঝেছি বুঝেছি, আমার ঘরের ময়লা তোমাদের দামী জুতায় লাগবে বলেই তোমরা বাইরে রেখে সে ময়লার হাত থেকে কৌশলে জুতাকে বাঁচালে।
সবাইকে একদিন চলে যেতে হয় তেমনি ১৯৮০ সালে শিবরাম চক্রবর্তী মুক্তারামের তক্তারাম চিরকালের জন্য ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমান।

Share.

মন্তব্য করুন