পড়ায় এতোটাই মনোযোগী ছিলো দীপু যে তার খেয়ালই আসেনি লণ্ঠনের তেল যে একেবারেই তলানিতে। আলো কমে যেতেই সলতেটা একটু বাড়িয়ে দিতে গিয়েই বুঝলো তেলশূন্য লণ্ঠন এখন আর আলো দিবে না। বিরক্তিটা নিজের ওপরেও কম কিছু নয়। আগেই খেয়াল করা দরকার ছিলো। টেবিলে রাখা ঘড়িতে চোখ দিতেই দেখে রাত বারোটার কাছাকাছি সময়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর মা এখন ঘুমিয়ে। ডেকে তোলার প্রশ্নই আসে না। অঙ্কের সিলেবাস পুরোটা এখনও শেষ হয়নি। সকালের অপেক্ষায় না থেকে একটু ভোর থাকতেই উঠতে হবে। অবশ্য দীপুর তেমন অসুবিধে হবে না। অঙ্কে ও সবসময় ভালো।

বিছানায় যেতেই ঘুম যেন উধাও। স্বপ্নগুলো যেন জড়ো হয়ে ভাসতে থাকে। আর তার ভিতরেই থাকে একটা জিদ। যেভাবেই হোক, যেমন করেই হোক পড়ালেখায় তাকে এগিয়ে যেতেই হবে। বসির তার বাবাকে বলে কিনা ঠেলা গাড়িওলা। অমনি বাবার মুখটা ভেসে আসে সামনে। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাবা তার প্রতি মাসেই একবার বাড়ি আসে। শহর থেকে কিনে আনা জিনিস মা গুছিয়ে রাখে। বাবার কষ্টে জমানো টাকায় প্রতিবারই দীপুর জন্য মিমি চকোলেট থাকবেই। পড়তে বসে ঘুম আসলেই খানিকটা ভেঙে মুখে দেয়। বেশ লাগে। দীপু একটু রয়ে-সয়েই খায়। ফুরোলেই তো আবার এক মাসের অপেক্ষা। আর তার সেই বাবাকেই উদ্দেশ করে বসির বলে কিনা।

‘দীপু এতো পড়ালেখায় মন দিয়ে কী করবি? হবি তো সেই ঠেলা গাড়িওয়ালা। তোর বাবার মতো।’
থামকে যায় দীপু। অবাক চোখ রাখে বসিরের চোখে।
‘বাবা ঠেলাগাড়ি চালায়। পরিশ্রমে উপার্জন করে। তাতে দোষ কোথায়?’
দোষের কথা বলছি না তো। ঠেলাগাড়ি ঠেলতে তো আর বিদ্বান হতে হয় না। মূর্খ হলেও চলে। তাই তোকে বলছি অতো খেটে পড়তে যাবি কেন?
সেদিন আর খেলা জমেনি মাঠে। কথাটার হুল ফুটে থাকে মনে। বসিরের বাবা কী এমন বিদ্বান। না হয় ফসলের জমি আছে বেশকিছু। গোয়াল ঘরে গরু। নিজেদের পুকুরে মাছও কম নয়। অভাব কোনদিন বসিরকে তাড়া করে না। বসিরের বাবার অক্ষর জ্ঞানও তো নেই। আছে দাপট আর অহঙ্কার। সে-ই যে খেলার মাঠ ছেড়ে এসেছিলো আর ওদিকে পা বাড়ায়নি।
বাবার ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যই দীপুর এই সাধনা। এক কথা বাবার, ‘দীপু, পড়া হলো জীবনের আদর্শ। শহরের স্কুলে ভর্তি করে তোকে আমি স্কুল হোস্টেলে রাখবো।’
খুব ভাবে দীপু। ভালোয় ভালোয় পরীক্ষা শেষ হলেই হলো। স্বপ্নমাখা চোখ কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।

শহর দেখা দীপুর এই প্রথম। আগে থেকেই সব ঠিকঠাক থাকাতে হোস্টেলে সিট পেতে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। দু-একদিন বাবার সাথেই ছিলো। এরপর নতুন স্কুল। হোস্টেল। অচেনা, অজানা এতো এতো ছেলেদের ভিরে নিজেকে কেমন যেন একা একা মনে হতো। পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখতো টিফিন পিরিয়ডে ওদের খেলা হৈহুল্লোড়। এর ভিতরেই কি করে যে জুটে গেলো বন্ধু। হ্যাঁ বন্ধুই তো। একসাথে একই রুমে থেকে এক ক্লাসে পড়লে অচেনা ছাত্রটিও একটু একটু করে মনে জায়গা করে নেয়। বেশ লাগে রাতুলকে দীপুর। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হতো মায়ের জন্যে। একা মা কী করে সবদিক সামলাবে। আসার সময় কান্না ভিজা চোখে মা বলেছিলো।
দীপু একা থাকবে। তোমার সব কাজে খেয়াল রাখার কেউ থাকবে না। তাই বিছানায় যাওয়ার আগে বিছানা ঝেড়ে নিবে। ভিজা কাপড়, গামছা জমা করে রাখবে না। মেলে দিবে রোদে।

মায়ের চোখে দীপু যেন সেই ছোটটিই আছে। দীপুর বড় হওয়াটা মায়ের চোখেই পড়ে না। এইসব ভাবনাতেও দীপুর মন কেমন করে ওঠে। মা ভালো আছে তো। আর তার পোষা বিড়ালটা?
চলে যাওয়া দিনের ভিতরেই দীপু যেন প্রিয় মুখ হয়ে ওঠে তার রুমে। খুব একটা অঙ্কে কাচা না হলেও ভালো বলা যায় না রাতুলকে। সেই রাতুলকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে দিতে জুটে গেলো আরও কয়েকজন। যেন ওদের মাস্টার মশাই দীপু। বেশ লাগে। হঠাৎ একদিন দীপুকে অবাক করে দিয়ে তন্ময়ের বাবা একটা খাম তুলে দেয় দীপুর হাতে। সাথে বলে, ‘কিছু মনে করো না বাবা। তন্ময় বারাবরই অঙ্কে ভালো নয়। উৎসাহটা তুমি জুগিয়েছো বলেই ভালো রেজাল্ট করেছে। তাই এটা তোমার প্রাপ্য। আর প্রতি মাসে এটা থাকবে।

রুমে এসে খাম খুলে দীপু অবাক। একশো টাকার মোট দশটি নোট। এক হাজার টাকা! অবিশ্বাস্য চোখে দীপু ভাবে এটাই তার প্রথম ইনকাম। এমনি করে রিজু আর ফাহিমদের বাবাদের কাছ থেকেও থাকে একটি করে খাম। প্রতি মাসে। দীপুর ভাবনায় থাকে- যাক বাবাকে তো কিছু হলেও সাহায্য করা হলো।

পিকনিকের আয়োজনটা স্কুল থেকেই সিদ্ধান্ত হয়। এবার দূরে কোথাও ছাত্রদের নিয়ে ঘুরে আসা। স্কুলের স্যার ও থাকবেন সাথে। আগামী সকালেই ট্রেন। এরপরও কি রাতে ঘুম আসার কথা? ওদের চারজনের হৈহুল্লোড়ে রাতের আধা ভাগই চলে যায়।

ট্রেনের জানালার ভাগটাই দীপু দখলে নেয়। কতো রকম শব্দ করে ট্রেন এঁকেবেঁকে চলে। পিছনে ফেলে যায় গাছগাছালি, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি। কেউ কেউ গান ধরছে-
‘আজ আমাদের ছুটি ছুটি।
দীপুও মনে মনে আওড়ায়-
‘ধায় গাড়ি ধুম ছাড়ি, ধায় শত পায়
ঝড় গতি চলে ছুটে, দুনিয়া কাঁপায়।
আনন্দে ও যে কতো রকম ভাবে আনন্দ দেয়। দীপু শৈশব ভুলে আগামীর ভাবনায় বিভোর হয়। আর একটু বড় হলেই বাবাকে আর কষ্ট করতে দিবে না দীপু। ঠেলাগাড়ি যারা ঠেলে দীপু দেখেছে কিভাবে ঘাম ঝরে তাদের শরীর থেকে। গাড়ি বোঝাই মাল যেন এক একটা ছোট টিলা। শরীরের সব শক্তি দিয়ে পা ফেলে ফেলে টানা কি যে অসহনীয় কষ্ট। ঘাম নয় যেন রক্ত ঝরে শরীর থেকে। দীপু এই রক্তের দাম মিটাতে পারবে তো! একটা ঘর, বাবা, মা আর দীপু।

ট্রেনটা হঠাৎ থেমে যেতেই আবার হৈহুল্লোড়। এবার নামার পালা। দীপুর এতোসব ভাবনার মাঝে কখন যে ট্রেনটা থেমে গেল নিজের জায়গায়!

Share.

মন্তব্য করুন