গল্পের ডানা আকাশছোঁয়া
‘তুমি এ-ত্ত কিছু মনে রাখ কেমন করে নাদের চাচা? অনেক কিছু জান তুমি। অনেক কিছু। মাথায় রাখ কেমন করে বলত?
তানজিমের পুঁতির দানার মতো ঝলমলে চোখের তারায় আলো ঠিকরায়। নাদের আলী পান-খাওয়া রাঙা ঠোঁটে ঝলমলে হাসি টেনে বলে, ‘জানি আর কিরে ভাইয়া? আমি কি আর আইএ, বিএ পাস দিছি। গাঁয়ের ছেলে, সরকারি ইস্কুলে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ছিলাম। ঐ টুকুনই। বাপজানটা কুটুস কইরা দুনিয়া ছাইড়া চইল্যা না গেলে মনে হয় আরো একটু বিদ্যা মগজে ঢুকাইতে পারতাম। তবে এ কথাডা ঠিক বালক-বয়সে খুব ছুটে বেড়াইছি এপাড়া ওপাড়া, এ মহল্লা সে মহল্লা, মুলুক মুলুক। ঘাস ফুল গাছগাছালি, পাখপাখালি, সাপখোপ, বেজি-বাদুর, ইঁদুর-বান্দর, হনুমান আকাশ-বাতাস স্বজন-কুটুম আশ-পড়শি সবার জন্য আমার মন আনচান করত। সব্বাইরে মেলা ভালবাসতে ইচ্ছা লাগত। নোনতা বুড়ি, ফুলি পাগলি, মংলু মেথর, শুটকা ফকিন্নী থেইক্যা মীর বাড়ির শাহজাদা, বাউল হাফিজউল্লা, মৌলবৗ কেরামত মওলা সবার সঙ্গে আমার অন্যরকম দোস্তি ছিল। সবার সাথে আমার পরান বন্ধুর মতো খাস সম্পর্ক ছিল। ওরা আমারে ভালবাসত। আমার গাঁও গ্রামের প্রত্যেক কানচি কোনা আমার মুখস্থ। কোন জলায় শীতের পাখি বেশি আসে, কোন বিলে শাপলা ফোটে, লটকন, গাব, মাখনা, জামরুলের খবর আমার চেয়ে বেশি কেউ জানত না বোধহয়।

‘ই-স্-স কি মজাই না করেছ ছোটবেলায়। তানজিম ওরফে অমিয়ের চোখজোড়া উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। নাদের আলী হুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘নারে ভাইয়া-কুট্টি ভাইয়া। জীবনটা সোজা সুন্দর যেমন, বাঁকাতেরাও তেমন। বাজান ছিল গাঁয়ের নামকরা কবিয়াল হঠাৎ ‘বুক ব্যথা বুক ব্যথা। বইল্যা চইল্যা গেল সংসার ফেল্যাইয়া। একটা পয়সাও জমা রাখে নাই। মা আমার কোনোরকমে হাঁস-মুরগি গর”র-ছাগল পাইল্যা পুইষ্যা ঠেলা-ধাক্কা খাইয়া সংসারের চাক্কা বছর দুই চালাইছিল। কিন্তু একবেলা খাইয়া পাঁচজন সন্তান পালা খুব কষ্টের। তার শরীরটাও খারাপ হলো। আমি সোবহান সারের পরামর্শে তখন খুব মনোযোগ দিয়া ড্রাইভারিটা শিখ্যা ফেলাই। কয়েক বছর এদিক ওদিক ড্রাইভারি করলাম। তারপর তোমাদের বাড়িতে যে ঢুকলাম ঢুকলামই। দশ বছর হইয়া গেল। দেখ কুট্টি ভাইয়া, সময় এমন বেঈমানি করে যে কোন ফাঁকে চুলে পাক ধরল বুঝতেই পারলাম না।

অমিয় সিক্সে উঠেছে এবার। ওরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে পড়ার বইয়ের বাইরে। আর আলী চাচা অর্থাৎ আলী হলো গিয়ে সেই অফুরন্ত রসের ভা-ার। মজার মজার গল্পের এক গভীর গুদামঘর। চাবি খুললেই হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসে বিচিত্র সব গল্পের রোমাঞ্চ। একবেলা নাদের আলীকে না দেখলে অমিয়ের পৃথিবীটায় সূর্যগ্রহণ লাগে। পূর্ণগ্রাস। বাবা নামজাদা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: রাফি খান, মা বিশিষ্ট সমাজসেবিকা অধ্যাপিকা শেফা খান। সত্যি দু’জনেই মহাব্যস্ত। বিশেষত বাবা। বাড়িতে হীরামন বুয়া আর তার একমাত্র ছেলে পুটু আছে। কিন্তু পুটুটা ভীষণ আলসে ভাবলেশহীন। একটুও মজা করতে জানে না ছেলেটা তা ছাড়া ওর কিছু কাজকর্মও থাকে। গাছে পানি দেওয়া, ফার্নিচার মোছা, ঘর ঝাড়পোছ করা। কয়েকদিন পুটুকে নিয়ে ক্রিকেট খেলতে চেষ্টা করেছিল অমিয়। একেবারে অচল। একটু ব্যাট ধরেই বলে হাতব্যথা করে। পারে শুধু দিনভর মুড়িগুড় চিবাতে। আর টিভির সামনে পাথরের মতো বসে থাকতে। তখন ওর মুখটা হাঁ হয়ে যায়, চোখের পলকও পড়ে না।

সকাল সাতটার মধ্যে নাদের ড্রাইভার কথাকলি বাড়িটার উঁচু পিতরঙের গেটের কলিংবেলে আলতো চাপ দেয়। মাঝে মধ্যে দারোয়ান কলিম সর্দার হাই তুলতে তুলতে রক্তজবা চোখ মেলে গজ গজ করে। ‘আলী ভাই, আল্লাহর ওয়াস্তে কি একটা দিনও একটু দেরি কইরা আসবার পারো না? রোজ এই কাঁচা ঘুমডা তুমি আনটাইমে ভাঙাও। এর বিচার আল্লায় করব। সায়েবরা বারায় বেলা সাড়ে আটটায়। তুমার কি পায়ের তলা ফজরের ওক্তেই সুরসুরায়, হাঁটা ধর ধানমন্ডি!
চোখজোড়া আধবোজা করেই ঘাড়ে একটা জোর ঝাঁকুনি দেয়। ট্যাকে বাঁধা চাবি দিয়ে পিতলরঙা ইয়া বড় তালা খুলেই গুটিশুটি মেরে আবার শুয়ে পড়ে। আলী ড্রাইভার থাকে জিগাতলার ভেতর দিকে। ভোর ছয়টার মধ্যে রওনা দেয় আর সাতটার মধ্যে পৌঁছে যায়। এক মিনিট এদিক ওদিক হবার জো নেই। অসম্ভব পাংচুয়াল। শীতের দিনে রীতিমতো কুয়াশা দুই হাতে সরিয়ে সরিয়ে ‘কথাকলি’র পিতরঙা গেটে পৌঁছে যায়। গেটের দুই পাশের দেবদারু গাছগুলি ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে যেন আলীকে সুপ্রভাত জানায়।

সোয়া আটটায় নেমে এল তানজিম। ইয়া তোষা স্কুলব্যাগ পিঠে। ছোট্ট ছিপছিপে শরীরটা প্রায় কুঁজো হয়ে গেছে বইয়ের ভারে। হাতের ওয়াটারবটল বারবার কাত হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে আসে আলী ড্রাইভার। গাড়িতে শেষবারের মতো ঝাড়নটা বুলিয়ে।
‘কুটি ভাইয়া দাও ব্যাগটা আমার হাতে। তোমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে।’ এক্ষুনি ড. রাফি খান এবং শেফা খান এসে পড়বেন ব্যস্ত আর কিছুটা গুরুগম্ভীর তাদের মুখচ্ছবি। অভ্যেসমতো টানা একটা সালাম দেবে নাদের আলী। সাত সকালেই সে খুশবুদার জর্দার পুরভরা ডবলপান চিবুচ্ছে।
অমিয় সিটে বসে প্রভাতি আলাপের সূচনা করে ‘আচ্ছা আলীচা তুমি এত পান চিবাও কেমন করে? হাসে সশব্দে আলী চাচা।
হরে কুট্টি ভাইয়া, তাম্মুলরস বিহনে প্রাণ বাঁচে না। একবেলা বাত না দিলাম, তাও সই। কিন্তু তাম্বুল? হায় খোদা সেদিন যেন না আসে।

এসে পড়েছে অমিয়র বাবা-মা।
গাড়ি ছুটতে শুরু করেছে রাস্তায় এখন আল্লাহর অসীম দয়ায় জ্যাম লেগে ওঠেনি।
শেফা খান হঠাৎ মনে পড়ার মতো বলে ওঠেন অসহিষ্ণু গলায়, ‘আচ্ছা অমি তোর আজ ম্যাথ এর ক্লাস টেস্ট না? তবে যে ম্যাথ নিয়ে বসলি না। এই ছেলেকে নিয়ে আর তো পারছি না।’

ড. রাফি ঝাঁঝালো গলায় বলেন-
‘ম্যাথ কি তোমার খুব অপছন্দ? একদমই মন বসাতে পার না? প্রবলেমটা কোথায়?’
অমিয় এবার ঠা-া গলায় বলে,
মামণি আমি সব অঙ্ক করে ফেলেছি। খুব ইজি ছিল। ‘সত্যি বলছিস অমি!’ মায়ের কণ্ঠস্বরে সন্দেহ দুলছে।
‘সত্যি-সত্যি আর সত্যি। আমি কি মিথ্যে বলি বলো?’
আজ খুব সুন্দর দিন। ক্লাসে খুব আনন্দে কেটেছে। অঙ্কগুলো সব কারেক্ট। ম্যাডাম ভেরি গুড লিখেছেন। রাগিবের সঙ্গে বহুদিনের আড়ি আজ ভাব হয়েছে। অমিয় বুঝতে পারছে রাগিব আসলে অনেকের চেয়ে ভাল। তবে এতসব আনন্দে সব গুবলেট হয়ে গেছে। টিফিন খাওয়া হয়নি। ডিম সেদ্ধটা অর্ধেক খেয়েছে, কিন্তু পরোটা একটুও ছেড়েনি। মা-মণি যদি টিফিন ব্যাগ চেক করেন, তবে বেকায়দায় পড়ে যাবে অমিয়। সুতরাং বাড়িতে ঢুকেই ফরজ কাজটি হলো পুটুকে পরোটা বিতরণ। ও ঠিকই গপাগপ খেয়ে নেবে। আলীচা খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে। স্কুল ছুটি হয়েছে ভিড়-ভাট্টা চারপাশে, হইচই তুঙ্গে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল, রাস্তার ধারে টুনটুনি বাজানো আইসক্রিমওয়ালার বিশাল বাক্সের পেটের ভেতর থেকে আইসক্রিম তুলে নিচ্ছে পলাশ, রিপন, বিভু। কী আনন্দ করে খাচ্ছে ওরা। জিভ পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। লোভ হচ্ছে বটে। তাড়াতাড়ি চোখ ফেরাতেই। হলো। মা-বাবার মার্শাল ল আছে এই আইসক্রিমের ব্যাপারে।

বন-বাদাড়ের গল্প
সকালবেলা অ্যালার্ম ঘড়িটা তানজিমের ঘুম ভাঙায়। মায়ের নরম গলা শোনা যায়। আজ মনে হয় মায়ের মনটা নীল আকাশের মতো। পিঠে আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন। আলতো গলায় ডাকলেন, ‘অমি বাবুমণি ওঠো তো!’ ‘প্রত্যেকদিন ভোরবেলা কেবল ইস্কুল। ভাল লাগে না মা-মণি।’
অভিমানে ঠোঁট ফোলায়।
‘সে কি অমিয়! এ কথা বললে কি চলবে বাবু। ওঠ ওঠ, কুইক। গা ঝাড়া দিয়ে একবার উঠে বসলেই হলো চাঁদমানিক।’
নাশতার টেবিলে পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে মা বলেন, ‘বহুদিন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি না আমরা। এক্কেবারে বস্তাপচা থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়।’
ড. রাফি একটু চাপা গলায় বলেন, ‘আহা অত হাহাকারের কি হলো। এই সপ্তাহেই তিন দিন ছুটি আছে। আমরা একটা দিন জুড়ে চলো ঘুরে আসি সুন্দরবন।

‘ওখানে তো বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে! অনেক অনেক হরিণ। চিত্রা হরিণ। রুবিনা ম্যাডাম বলেছেন কত রঙবেরঙের পাখপাখালি। কুমির, সাপ। ওরে বাবাহ!’
খুশির রেণু রোমাঞ্চের ঢেউ অমিয়কে পাগল করে তোলে। সত্যি সত্যি ওরা সুন্দরবন যাচ্ছে। গোছগাছ চলছে। ট্র্যাভেল ব্যাগ গুছিয়ে মা ক্লান্ত। কত কি যে সঙ্গে নিচ্ছেন। ওষুধ, ওরস্যালাইন, থার্মোমিটার এমনকি ব্লাডপ্রেসার মাপার যন্ত্র! নাদের আলী বার দুই সুন্দরবন ঘুরে এসেছে। তাকেও নেয়া হচ্ছে। সে কারণে অমির খুশি যেন ছড়িয়ে গেছে আকাশময়।
খুলনা পৌঁছাবার পর অমি’র আব্বার বন্ধু মবিন সাহেব অনেক সহযোগিতা করলেন। সারা হলো ফরেস্ট অফিসের অনুমতি ও অন্যান্য ফর্মালিটিজ। মংলা বন্দর থেকে লঞ্চে করে যাত্রা শুরু হবে। আলীচা অমিয়কে বাগেরহাটের গল্প শোনাল। জিন্দাপীর, পাগল পীর, ঠা-ার পীর, খঞ্জলী দীঘি; যে দীঘিতে কালাপাহাড় ধলাপাহাড়ের বংশধর কুমির আছে। কত গল্প যে আলীচার মগজে! খানজাহান আলী (র.) এর বিস্ময়কর কীর্তি, ষাট গম্বুজ মসজিদ, অযোধ্যা মঠ ফুরায় না।
লঞ্চে উঠে বসেছে ওরা সবাই। পশুর নদী ও মংলা নদী মিলেমিশে বইছে ঢেউ। সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগবে। তবে অমিয়ের চিন্তা নেই। আলীচা আছে- গল্প শুনে শুনে মহানন্দে কাটবে এই নৌযাত্রা। বাবুর্চি রান্না চড়িয়েছে, মাসকলাইয়ের ডালের খিচুড়ি। মুরগির মাংসের ভুনা। কি সুবাস ছড়াচ্ছে।

ইস যদি রাগিবকে সঙ্গে আনা যেত তাহলে কী মজাই না হতো। মামণি কিছুক্ষণ পরপর ছেলেকে স্যান্ডউইচ, কলা, কাজু বাদাম সাধছেন। অমিয়ের বাবা বাইনোকুলারটা চোখ থেকে নামাচ্ছেন না।
রূপসা ফেরিঘাটে সবাই সাংঘাতিক নাজেহাল হয়েছে। যেমন কড়ারোদ তেমন ভিড়ভাট্টা আর হল্লা। সময়ও নিয়েছে প্রচুর। ব্রিজ হয়ে যাবে শোনা যায়, আলীচা শোনাল অমিকে। শেফা খান উদাস গলায় বললেন, ‘ছোটবেলায় আমরা সিরাজগঞ্জ যেতে প্রায় ছয় সাতটা ফেরি পার হয়েছি। আরিচা, নগরবাড়ি, বাঘাবাড়ি। এত কষ্ট হয় নাই মনে হয়।’ কিছুক্ষণ লঞ্চ চলার পর মনটা ময়ূরের মতো পেখম মেলে দিল বুঝি।
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। দুইপাড়ে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, বাইন, কেওড়া, কাঁকড়া, পশুর, ধুন্দল, ঝনা, হেঁতাল, গোলপাতার বিশাল মিছিল। মা কয়েকটি গাছ দূর থেকে বাইনোকুলারে পরখ করে চেনার চেষ্টা করছিলেন। মাঝে মধ্যে আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন।
‘অমি, তানজিবাবু ঐ দেখ জলকবুতর-সিগাল। এইসব গাছে রয়েছে অসংখ্য মৌচাক। মৌয়ালরা খুব রিস্ক নিয়ে মধু বের করে নেয়। বাওয়ালিরা গোলপাতা কাটে। আর কাঠচোরেরা অন্যায়ভাবে কাঠ চুরি করে ব্যবসা করে। হরিণ শিকার করে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারও শিকার করে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার কতগুলো মতলববাজ মানুষের ফন্দিবাজিতে হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে সুন্দর এ বনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অমি মনে রেখ।’
অমিয় কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, ‘ঐ মন্দলোকগুলোকে কেন পানিশমেন্ট দেয় না বনের অফিসার, পাহরাদাররা মামণি।
শেফা খান প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে ফেলেন, ‘বাতাসে রান্নার খুশবু ছড়াচ্ছে। আর ঐ ঐ যে-এক ঝাঁক হরিণ পানি খাচ্ছে- অ-মি-ই। সত্যি। বাইনোকুলারে চোখ রাখে অমি।
‘কি সুন্দর খয়েরির মধ্যে সাদা সাদা ফোঁটা। এগুলোই তো চিত্রা হরিণ, না মা?’
চারদিকে পানির ঢেউ। দু’পাশে সবুজ গাছের সারি। আকাশে জলকবুতর। কী সুন্দর, কী সুন্দর! অমিয়ের মুগ্ধতা আকাশ ছুঁয়েছে।

অমিয়রা যাবে নীলকমল বা হিরণপয়েন্টের ফরেস্ট রেস্ট হাউজে। রিজার্ভ করা আছে। তারপর কচিখালী বা টাইগার পয়েন্ট। কটকা অভয়ারণ্য, যেখানে হরিণেরা আসে স্বপ্নের পথ ধরে ঝাঁকে ঝাঁকে, কেওড়াগাছের কচি ফল পাতা খায় মনের সুখে। কিন্তু এবার কটকা যাওয়া হবে না।
আলীচা চায়ে চুমুক দিতে দিতে স্মৃতির জাবর কাটে, ‘কুট্টিভাইয়া আমি গেছিলাম দুবলার চর। গভীর বনের মধ্যে শেখের সাথে আর একবার এক সাহেবের সাথে কটকায়ও গিয়েছিলাম। হায় আল্লাহ দুনিয়া এত সুন্দর, চোখে না দেখলে কেউ জানবেই না। বই পইড়্যা ঠিক মতো জানা যায় না। বাচ্চা হরিণগুলো ওর মাকে দলপ্রধান ধরে নেয়। জঙ্গলে চলাফেলার সময় মাকেই খুব খুব মান্য করে। যেমন বিপদ বুঝলে মায়ে ল্যাজের সাদা অংশ নাড়িয়ে বুঝায়া দেয় বিপদ আসতাছে। ব্যস, টিত টিত শব্দ করতে করতে স্বপ্নহরিণরা বনের মইদ্যে লুকায়া যায়। আসলে জানো তো ভাইয়া, বদলোকের অভাব নাই। ওরা তাই মানুষ ভালবাসে না, বিশ্বাস করে না। ওদের কত আত্মীয় বন্ধুর বুক রক্তে ভেসে গেছে বন্দুকের গুলিতে। মাংসের লোভে চামড়ার লোভে।’
‘বাব্বাহ আলীচা, তুমি এত কিছু জান।’
আলী পান খাওয়া রঙিন ঠোঁটে ঝলমলিয়ে হাসে।
‘জোরে জোরে শ্বাস নেও, বুকের খাঁচায় পিউর বাতাস ভরো।’
রেস্টহাউজে পৌঁছে ওরা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাশতা করল। মায়ের গাছ-গাছালি আর পাখ-পাখালির এত নেশা। যেন অন্যরকম মানুষ। বাবাও কেমন নরম উদার হয়ে গেছেন। মায়ের পরনে সবুজ রঙের একটা বুটিদার সবুজ শাড়ি। কী ভাল লাগছে অমির। সকালবেলা মাকে দেখে অবাক অমি- যেন ছেলেমানুষিতে ভরপুর এক কচি মেয়ে। ব্রেকফাস্ট তৈরি। পরোটা, আলুপটোলের ভাজি, মুরগি। বাইরেটা কী চমৎকার।
ড. রাফি খান আয়েশি ভঙ্গিতে বললেন, ‘দেখেছ আকাশ ভরাট নীল আর গাছলতাগুলো কী চকচকে সবুজ। মনের সব মাধুরী মিশিয়ে নিখুঁত বুরুশ টেনে টেনে কে আঁকেন এ ছবি- জলরঙ ছবি!

অমি বিস্ময়ে আনন্দে মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলে। আলীচা পান বিতরণ করছে বাবুর্চি ভাইকে। সালাম বাবুর্চি নাকি তার কোন জন্মের আত্মীয়। আলী এক অবাক-মানুষ, বিশ্বজোড়া ওর আত্মীয় বন্ধু। বিত্ত নাই। তবু বিত্তবান। সর্বদাই হাসিখুশি। গাছ-লতাপাতায় ও কত আনন্দ যে খুঁজে পায়। একটি মাত্র মেয়ে, বিয়ে দিয়েছে। ঘরজামাই বসিয়ে দিয়েছে ওর ভিটেতে। ত্রিভুবনে আর কেউ নেই। তবুও জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে। কী গভীর আনন্দে। কোনো নালিশ নেই, হা-হুতাশ নেই।
শেফা খান মাঝরাত অবধি রেস্টহাউজের বারান্দায় কান পেতে রইলেন, যদি হরিণের ডাক কি বাঘের গর্জন শুনতে পান। বাদুড়, রাতচড়া পাখিদের ডানা ঝাপটানি, ডাক শুনতে পেলেন। রাতের রূপ অন্যরকম এ অপূর্ব অরণ্যে। পূর্ণিমা রাত। রুপোগলা আলো গাছের পাতায় পাতায়।
মা চাপা গলায় বলতে লাগলেন। অমিয়ের কেমন গা শিরশির করছে, ‘অমিয় জানিস নাকি, ছোট বড় পঞ্চাশ-ষাটটি দ্বীপ নিয়ে এ সুন্দরবন। জঙ্গলজুড়ে অসংখ্র নদী-নালা-খাল। জোয়ারের সময় এই জঙ্গলের প্রায় চল্লিশ ভাগই ডুবে যায়। তাই সুন্দরবনকে বাদাবন বা জলা-জঙ্গল বলে ডাকা হয়। পাশেই বঙ্গোপসাগর। কুমির আছে ইয়া ইয়া। সাপ আছে বিষধর, বিষহীনও। মোট আয়তন যতটুকু মনে পড়ে ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছে এই বাদাবন। জীবজন্তু আর বৃক্ষলতার বিচিত্র মিতালী এই বনে।
তাদের নিয়ে ফন্দিফিকির করে বাণিজ্য করে। ভেরি স্যাড। মানুষের মধ্যে। আপন অন্তর থেকে সততার প্রতি আস্থা আসতে হবে, নইলে কোনো উন্নতি নেই, আশা নেই ভালো থাকার।

অমিয় অবাক চোখ মেলে বাবাকে নতুন আনন্দে পাঠ করে যেন। বাবাকে সবসময় গুরুগম্ভীর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়া আর কিছুই যেন ভাবতে পারত না অমিয়। বাবাও সবার সঙ্গে কেমন দিলখোলা নির্ভার অন্যরকম হয়ে গেছে। মাঝরাত অবধি ওরা রাতচরা পাখি বাদুড় আরও কত না দেখা জীবজন্তুর আলাপবিলাপ শুনতে পেল। জোছনায় চারপাশ থৈ থৈ করছে। রহস্যময় সুন্দরবন একেই বলে। আর নাদের আলী? সে কী এমন অসাধারণ রাত বেরসিকের মতো ঘুমিয়ে কাটাতে পারে। তাই কি হয়, না। হতে দেয়া যায়। আলীচাচা বাবুর্চি চাচার সঙ্গে খোশগল্পে বিভোর রইল প্রায় রাতভর। শেষরাতে মা-ছেলে-বাবা সুন্দরবনের মায়াবী রহস্য চাদরের মতো শরীরে জড়িয়ে ঘুমুতে গেল।
সকালে উঠে পরোটা, আলু পটোলের ভাজি চা দিয়ে নাশতা সারা হলো। একফাঁকে অমিয় তরতর করে নেমে গেছে আলীচার কাছে।
আলীচা তুমি না কটকা গেছ, দুবলার চরের গল্পটা বলো না। সেই যে লঞ্চে বলতে বলতে থেমে গেলে বাবাকে দেখে।
‘ও সেই গল্প কুট্টি ভাইয়া খুব মজার। আমার বয়স তখন অল্প এই যে মাথাজোড়া এমুন চর পরে নাই। ত হইছে কি আমরা দুবলার চরে নৌকা বিড়াইছি। আমার এক বন্ধু বাওয়ালি আর এক বুড়া পাতান্যা চাচা মৌয়াল। বাওয়ালি বন্ধু যখন গোলপাতা কাটে, তখন পড়ছি বনদস্যুর পাল্লায় আর মৌয়াল চাচা যখন মধু নেয়া শুরু করছে তখন আসছে একদল জলদস্যু। কী দানবের মতো চেহারা ভাইয়া। হাতে ভোজালি, কিরিচ, বন্দুক। আমি ত এক লাফে একটা গাছের ডালে চইড়া বসছি। সারা রাত্র ঐখানেই ছিলাম। কী হৈ হৈ রৈ রৈ কা-! ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কুলু কুলু ঘামতে ঘামতে নিঃসাড়। খালি আল্লারে ডাকি। কুলহু আল্লাহু ভুইল্যা যাই। হন্না লিলাহে ভুইল্যা যাই… খালি কাঁপি কলাপাতার মতো।
আলীচা অতীতের সেই দিনটি যেন চোখের সামনেই দেখতে পারছে।

হঠাৎ উপরতলা থেকে তলব এল। মা ডাকছেন। ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে দৌড়াতে হলো। মাতৃআজ্ঞা। অমি তোমার সেভেন সিজের ক্যাপসুলটা গত তিন দিন ধরে খাচ্ছ না, মনে আছে কিছু। এক্ষুনি লক্ষ্মীর মতো হাঁ করো। গ্লাসে পানি নিয়ে বসে আছি।
অমিয় ক্যাপসুল খেয়ে নিচে নামার জন্যে পা বাড়াতেই মা বললেন ‘বোসো নো সোনা। গল্প করি। শোন একটু নোট নিস কিন্তু, ঘরে যেয়ে লিখতে হবে ভ্রমণ কথা। এই সুন্দরবনে কত প্রজাতির পাখি আছে জানিস, তিনশ আঠার জাতের পাখ-পাখালির মেলা এই সুন্দরবনে। আর এটা ত অনেকবার শুনেছিস বাংলাদেশের বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে যার জন্য, সেই মহাশয়টির আনন্দবাস এই সুন্দরবনে। হেঁতাল ঝোপ তার খুব পছন্দের। আস্তানা। মহাশয়ের নামটি কি বলে দিতে হবে? তিনি ত বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সেই বিখ্যাত জীবটিও মন্দ মানুষের কূটবুদ্ধির কারণে আর আনন্দে থাকতে পারছে না। খেজুর গাছের মতো দেখতে হেঁতাল ঝোপগুলোর কাছে বেশি ঘোরাফেরা করো না।
ওরে বাবা রেস্ট হাউজে বসেও ভয় করছে। পায়ে পড়ি বাঘ মামা… তুমি যে এখানে কে তা জানত।… ভুলে গেছি… দূর ছাই।
হেঁড়ে গলায় আচমকা অমিয় গেয়ে ওঠে। গুপী গায়েন বাঘা বাইন থেকে। কটকার একটু দূরে টাইগার পয়েন্ট ওখানে এবার যাওয়া হচ্ছে।

বাঘমামার সঙ্গে তাই কুশল বিনিময়ও হচ্ছে না। হিরণ পয়েন্টের রেস্ট হাউজ থেকে একটু দূরে একটু উঁচু কাঠের ওয়াচ টাওয়ার, সেখানে উঠে পুরো বনটা দেখা হলো। সঙ্গে বন বিভাগের সশস্ত্র গার্ড। অমিয়ের ইচ্ছে করছিল একছুটে বনের ভেতর ঢুকে যেতে কিন্তু তা সম্ভব হলো না।
শেফা খান নরম আনন্দময় গলায় গল্প শোনাতে লাগলেন-এখানকার গাছ-গাছালিগুলোর একটা কমন ধর্ম হলো এরা লবণ-পানি সহ্য করতে পারে আর অদ্ভুতভাবে নরম কাদার উপর জন্মায়। আত্মরক্ষায় এরা ভীষণ পটু। প্রবল বাতাস প্রচ- স্রোতেও অসংখ্য পোক্ত শিকড়ের জোরে এরা দিব্যি গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন কিস্যু হয়নি। এদের আছে অদ্ভুত দর্শন শ্বাসমূল, শূলের মতো সুচালো প্রায় আধা হাত লম্বা মাথা জাগিয়ে রাখে। বাইন, কেওড়া, সুন্দরী আর পশুর গাছের শ্বাসমূল পরিষ্কার দেখা যায়। এগুলোর জ্বালায় বনের মধ্যে পা ফেলে আয়াশে হাঁটার উপায় নেই আবার আরেক মজা খেয়াল করিস অমিয়। গর্জন, গেঁওয়া ও গরান গাছের। রণপার মতো অসংখ্য ঠেশমূল দেখা যায় মায়ের গল্পগাছা আপাতত শেষ অমিয়ের অভিজ্ঞতার ঝোলা বেশ পুষ্ট হয়ে উঠেছে। চোখমুখ মহানন্দে তারাবাতির মতোই জ্বলছে। একটু উঁচু জমিতে হেঁতালের ঝোপ। আর গোলপাতা মোটেই গোল নয়। কত মজা আছে এ বাদাবনে। আলীচার কাছে শুনেছে আরো অনেক রূপকথার গল্পের মতো শিহরণ জাগানো গল্প।

আলীচা বলে, গেওয়া গাছের গুড়ি দিয়ে নাকি ঢোল তবলা বানানো হয়। গরান গাছে ঘরের খুঁটি বেড়া হয়। আর তৈরি হয় নৌকার দাঁড়া। গোলপাতায় ঘর ছাওয়া থেকে শুর” করে অনেক কাজ হয়। এই বাদাবনে প্রচুর গাব গাছ আছে। পাকা গাব মানুষ খায় না কিন্তু গরুর জন্যে খুব ভাল। অন্যান্য পাখ-পাখালিও বোধ হয় খায়। গাবের কষ দিয়ে জাল পোক্ত করা হয়। আর অনেক গেরস্থালি কাজেও লাগে। দুপুরে ভরপেট খাওয়া হয়ে গেল। বনে-বাদাড়ে ঘুরে সবার ক্ষিধেও ছিল তুঙ্গে। চিনিগুঁড়া চালের হালকা পোলাও আর টকবেগুন ও বড় বড় রুই মাছের ফালির দোপেঁয়াজা।
বিকেলে বাবা-মা ধড়মড় করে উঠে ওজু করলেন আসরের নামাজ প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে। আলীচা জর্দাপানে মুখভরে রসুইঘরের সিঁড়িতে বসে চিবুচ্ছিল। কী আনন্দময় আর রঙিন টইটম্বুর তার মুখখানা। অমিয়ের খুব ভালো লাগে। সুবর্ণ সুযোগ, অমিয়র আবদার কী ফেলতে পারে তার আলীচা! কেমন করে মৌচাকে আগুন দিয়ে মধুর চাক থেকে টসটসে ভিটামিন ভরপুর মধু ভাঁড়ে ভরেন? তার গল্প একটার চেয়ে একটা রোমাঞ্চকর।

বাদাবনে থেকে বিদায়ের ঘণ্টা বাজল। এবার ফেরার পালা। এ বনে দিনে রাতে চারবার জোয়ার ভাটার খেলা চলে। লঞ্চে উঠে বসতেই মনটা সুন্দরবনের জন্য কেমন হু হু করে উঠল যেন। ফেরার পথে পাক্কা চৌদ্দ ঘণ্টা লেগে গেল। সকালে উঠে রাত আটটা। অবশ্য ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে ভয়ও যেমন লাগছিল তেমনি মজাও লাগছিল। মাঝে মাঝে নোঙর করা জাহাজে আলো জ্বলছে। থৈ থৈ পানি।

Share.

মন্তব্য করুন