জ্বলছে লাল বাতি। শাহবাগে সারি সারি ছোট বড় অনেক গাড়ি দাঁড়ানো। ও পাশের একটি রাস্তা একদম ফাঁকা। কে নাকি যাবেন। প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি কেউ হবেন হয়তো।
ট্রাফিক পুলিশ তাই অনেক সময় ধরে গাড়ি আটকে রেখেছে।
মিসেস তুলিকার প্রাইভেট কারও সব গাড়ির মতোই দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কখন ছাড়া পাবে কে জানে?
ঢাকা শহরের এটা বলা যায় প্রতিদিনের চিত্র। দেখে দেখে মানুষের এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।
খরখরে দুপুর। গনগনে আগুনের মতো রোদ। এই রোদে যেন রাস্তার পিচ গলে গিয়ে গাড়ির চাকা লেপ্টে গেছে। স্টার্ট হয়ে গাড়ি তাকে নিয়ে ছুটতে পারে কি না আল্লাহ মালুম।

রোদের সাথে গরমও পাল্লা দিয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটার মতো বেড়ে চলেছে। গাড়ির এসি বাড়িয়েও ঘেমে যাওয়া থেকে মুক্তি মিলছে না।
পাশে থাকা রুমালটা ভিজে গেছে এরই মধ্যে। পানির পট থেকে ঢকঢক করে পানি খেলেন মিসেস তুলিকা।
চোখের সামনে রঙবেরঙের গাড়ি। দূরে চোখ সরে না। বেশিক্ষণ চোখ মেলে থাকাও যায় না। ঝলসে যেতে চাইছে চোখজোড়া।
ভাবলেন, কী আর করবেন? আজকের পত্রিকাটায় একটু চোখ বুলানো যাক। পাশ থেকে টেনে নিলেন পত্রিকা। মেলে ধরলেন চোখের সামনে।
একটু বাদেই আবার তা ছুড়ে ফেললেন। চরম বিরক্তি চোখে মুখে।
অন্য কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না তিনি।

এ সময় গাড়ির গ্লাসে কয়েকটা টোকা পড়ল। তাতেই তার ধ্যান ভাঙল।
– আম্মা দুইডা টেকা দ্যান। বিয়ান বেলাথন কিছু খাই নাই। দ্যান না গো দুইডা টেকা। আম্মা, আম্মা গো…।
একটা সাত আট বছর বয়সী মেয়ে গ্লাসের সামনে দাঁড়ানো।
একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে সে।
মিসেস তুলিকা চিৎকার করে উঠলেন। সামনে বসা গাড়ির ড্রাইভার ম্যাডামের হঠাৎ এমন চিৎকারে রীতিমতো চমকে উঠল।
কী হলো ম্যাডামের? তিনি তো এমন করেন না কখনো। ঢাকা শহরে সিগন্যাল পড়লেই কেউ না কেউ এ রকম করে গ্লাসে টোকা দেয়। ভিক্ষা চায়। ম্যাডাম ইচ্ছে হলে দেন, না হলে কিছুই বলেন না। এ রকমই সে দেখে এসেছে এতদিন।

কিন্তু এমন করে মেজাজহারা হয়ে ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করতে দেখেনি কখনো।
মিসেস তুলিকা চিৎকার করে গাড়ির গ্লাসটা একটু ফাঁক হতেই বললেন, যা, ভাগ এখান থেকে। দুইডা টেকা দ্যান। যেন আমার কাছে উনি টাকার বান্ডিল দিয়ে রেখেছেন। চাইলেই উনাকে দিয়ে দিতে হবে! যত্তসব!!
ছোট মেয়েটি আকস্মিক এ রকম আচরণে থতমত খেয়ে গেল। ভয়ও পেল মনে হয়।
সুন্দর কচি মুখটা তীব্র রোদে এমনিতেই লাল টকটক করছিল। মিসেস তুলিকার ধমক খেয়ে তার মুখে একেবারে রক্তবর্ণ ধারণ করল।
বোধ হয় এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি সে কখনো হয়নি। কত জনই তো কিছুই দেয় না। চুপচাপ থাকে। সিগন্যাল ছাড়লে চলে যায়। কিন্তু…
আজকের অপমানটায় খুব লাগল বোধ হয় মেয়েটির মনে। সেখান থেকে যেন ওর পা আর উঠছিল না। সেখানে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই ফেলল সে।
মিসেস তুলিকা ধমক দিয়ে গ্লাস বন্ধ করে নিজে ভেতরে ভেতরে গজগজ করছিলেন।
কী মনে করে আবার গোস্বা চোখেই মেয়েটির দিকে তাকালেন।
-আবার কান্না করা হচ্ছে!

উচ্চারণ করতে করতে তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। আরে! এ কী দেখছেন তিনি? না না, এ হতে পারে না। চোখ রগড়ে নিলেন ভালো করে। চশমা পরলেন দ্রুত।
এবার তিনি যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন।
এ কী করে সম্ভব? তিনি কী দেখছেন এ! এই মেয়েটির মুখ তারই মেয়ে আফরিনার মতো! তার একমাত্র মেয়ে আফরিনার মুখটা কে যেন অবিকল এই মেয়েটির মুখে খোদাই করে বসিয়ে দিয়েছে!
তিনি আর কিছু ভাবতে পারছেন না। সবকিছু কেমন করে যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। শরীরে ঘামের মাত্রা আরো বেড়ে গেল।

এখন কী করবেন, কী বলবেন, কী করা উচিত এ সবের কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।
মেয়েটির দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছেন আশ্চর্য চোখে।
মেয়েটিও চরম শক পেয়ে তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। দু’চোখের কোণ বেয়ে হড়হড় করে অশ্রুপাত হচ্ছে।
মিসেস তুলিকার মনের ভেতর কী হলো কে জানে? হঠাৎ এক ঝটকায় গাড়ির দরজা খুলে দ্রুতপায়ে নেমে মেয়েটিকে অকস্মাৎ বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। আর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

মেয়েটিকে আদর করতে করতে ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন, তুই আমায় মাফ করে দে মা। আমি তোর কাছে খুব অন্যায় করে ফেলেছি। যা তা বলে গালি দিয়েছি। বল তুই আমায় মাফ করেছিস?
ড্রাইভার প্রবল বিস্ময় নিয়ে এই দৃশ্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একজন সাধারণ দর্শকের মতো দেখে যেতে লাগল। যেন একটা নাটকের কোনো দৃশ্য দেখছে সে।
ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটি যেন বোবা হয়ে গেছে। ও ঠিক মেলাতে পারছে না। ম্যাডামের এই রকম বদলে যাওয়া রূপ ও কল্পনাই করতে পারছে না।
মেয়েটিরও কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে গেল। ম্যাডামের সুগন্ধি শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে ও আরো শব্দ করে কাঁদতে লাগল।
মিসেস তুলিকা কিছুক্ষণ পর মেয়েটিকে আপন বুক থেকে সরিয়ে নিচু হয়ে তার চোখের সামনে আনলেন।
মিসেস তুলিকা আবারো চমকে উঠলেন। কোথায় তার আফরিনার মুখ। এ তো প্রথম দেখা সেই মুখ! ছিপছিপে মায়াময়। একহারা গড়নের। তবে ধুলোমলিন।
এতক্ষণ তিনি তাহলে কিভাবে আফরিনাকে দেখতে পেলেন এই মেয়ের মুখে। দারুণ এক ধাঁধায় পড়ে গেলেন তিনি। এও সম্ভব? মাথায় তার চক্কর খেতে শুরু করেছে।
মাত্র দুই মিনিট। এটুকুর মধ্যেই মিসেস তুলিকার মনের বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল। তিনি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন হঠাৎ।

কী ভেবে মেয়েটির মুখ নিজের হাতের তালুতে নিলেন। সুন্দর মায়াকাড়া একটা মেয়ে। ময়লা জামাকাপড় আর মাথার উষ্কখুষ্ক চুলের কারণে ওর চমৎকার চেহারাটাই হারিয়ে গেছে। তিনি তাকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন, আর কেঁদো না মা। আমি তোমার মায়ের মতোই। আমাকে আপন ভাবতে পারো। আচ্ছা বলো তো মা, তোমার ঘরে কে কে আছেন?
মেয়েটি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তার আন্তরিক কথায়।
সে মিসেস তুলিকার প্রশ্নের জবাবে বলল, মোগো ঘর নাই। মোর বাবা-মাও নাইকা। দাদুর লগে থাহি ফারমগেডের উবারব্রিজি।
তুলিকা বিস্মিত হলেন। ঘর নাই? বললেন, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে আমাদের বাসায়। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আমার আর একটা মেয়ের মতোই মানুষ করব। লেখাপড়া শেখাব। থাকবে আমার কাছে? জানো, তোমার মতোই আমার আরো একটা মেয়ে আছে। আফরিনা। খুব ভালো মেয়ে। তোমার খুব পছন্দ হবে।
মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মিসেস তুলিকার মুখের দিকে। কী জবাব দেবে ঠিক বুঝতে পারছে না।
এরই মধ্যে একজন দু’জন করে সেখানে বেশকিছু লোক জমে গেছে। মিসেস তুলিকার শেষের কথাগুলো অনেকেই শুনেছে। একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, স্যরি, আমি কি আপনাদের এ বিষয়ে কিছু কথা বলতে পারি?

উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বললেন, দেখুন, আপনাদের অপরাপর ঘটনাগুলো শুনে কিছু অনুমান করতে পারছি। প্রথমে ওকে আপনি খুব বকাঝকা করলেন। এতে করে কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা। পরে হঠাৎ আপনার কোনো স্মৃতি জেগে ওঠায় ওকে আদর দিয়ে বাসায় নিয়ে মেয়ের মতো মানুষ করতে চাইছেন। ব্যাপারটা ভালোই বলতে হবে। জানতে চাইছেন ও যাবে কি না আপনার সঙ্গে। কথা হচ্ছে ও তো ছোট মানুষ। এরকম সিদ্ধান্ত ও কিভাবে দেয় বলুন? যেহেতু ও বলছে ওর দাদু আছেন, আপনি বরং ওকে নিয়ে ওর দাদুর কাছেই যান। তিনি যদি ওকে আপনার হাতে তুলে দেন, বোধ করি সেটাই ভালো হবে।

কথা শেষ করে সমর্থন পাবার আশায় ভদ্রলোক উপস্থিত অন্যদের দিকে তাকালেন। সবাই ভদ্রলোকের কথায় সায় দিলো।
মিসেস তুলিকা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ধন্যবাদ আপনাদের। আপনারা ভালো একটা উপায় বলে দিয়েছেন। আমি বরং সেটাই করি। ওকে সঙ্গে করে ফার্মগেটেই যাই, যেখানে ওর দাদু আছেন।
এই বলে তিনি মেয়েটির চোখ মুছিয়ে দিলেন নিজের আঁচল দিয়ে। তারপর সবার দিকে হাত নেড়ে মুচকি হেসে গাড়ির দরজা খুলে মেয়েটিকে তাড়া দিলেন, কই চলো, গাড়িতে ওঠো। তোমার দাদুর কাছে যেতে হবে না? প্রায় কোলে করেই মেয়েটিকে গাড়িতে তার পাশে বসালেন মিসেস তুলিকা। খুব শক্ত করে নিজের বুকের মধ্যে টেনে রেখেছেন মেয়েটিকে।
এরই ফাঁকে তিনি মেয়েটির নাম জেনে নিলেন। ‘ছোটু’ ওর নাম। ওর নামটাও তিনি বদলে দেবেন বলে ভাবলেন।
এই সময়ের মধ্যে শাহবাগ মোড় আবার ব্যস্ত হতে শুরু করেছে। মানে এই ঘটনার ভেতরেই ভিআইপি পাস হয়ে গেছে। সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। চারিদিকে নানা কিসিমের গাড়ির হর্নের শব্দ।
ড্রাইভার তো থ। ম্যাডামের এই আর্ত হৃদয় দেখে তার মনটাও ভালো হয়ে গেল।

আর মেয়েটি মিসেস তুলিকার নিবিড় আলিঙ্গনে এক মমতাময়ী মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। অনেক ছোটবেলায় তার মা ওই আকাশে চলে গেছে। তারপর দাদুর কাছে তাকে রেখে বাবা কোথায় জানি হারিয়ে গেল। আর ফেরেনি। মা-বাবার আদরবঞ্চিত মেয়েটি সেই থেকে দাদুর কাছেই থাকে।

কতদিন পর খোদা তায়ালার কৃপায় মায়ের সেই আন্তরিক পরশ পেতে শুরু করেছে সে। নিজের ময়লা জামাকাপড় ভদ্র মহিলার দামি শাড়িতে লেগে যাচ্ছে। এতে ওর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু তিনি তাকে নিজের বুকের সাথে জাপটে ধরে রেখেছেন। একটুও আলগা হতে দিচ্ছেন না। নিজের মা না থাকলেও এ রকম একজন মানুষ তাকে মায়ের স্নেহ দিচ্ছেন, এর চেয়ে বড় পাওয়া তার কাছে আর কিইবা হতে পারে? তার উপর তাকে ‘মা’ বলে ডাকতে পারবে এই আনন্দে আরো একবার কেঁদে ফেলে মেয়েটি।

Share.

মন্তব্য করুন