কী ভীষণ উত্তেজনার মাঝে পুরো রাত কাটিয়েছি তা বলে বোঝানো যাবে না। ঠিক যেন ঈদুল ফিতরের রাত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নতুন কাপড়-চোপড় পরে কখন স্কুলে যাব, সে উত্তেজনায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। কারণ আজ বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস।
ক্যালেন্ডারের দু’টি পাতা। ১৯৭১। ভীষণ ভয় ও আতঙ্কের মাঝে কাটানো একটি বছর। আর আজ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। আলো ঝলমল রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক আলোকিত আনন্দের দিন। আকাশে পতপত করে ওড়া লাল-সবুজে আঁকা বাংলার স্বাধীনতার প্রথম বিজয় পতাকা।

সেদিন সকালে পাড়ার সব সহপাঠীকে সাথে নিয়ে দল বেঁধে আমরা দুধমুখা হাই স্কুলে গিয়েছিলাম। এটি ফেনী জেলার দাগনভুঁঞা উপজেলার সুপ্রসিদ্ধ একটি বিদ্যাপীঠ। আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (বাংলায়) এম এ পাশ করা এক ধনীর দুলাল জনাব মোস্তাফিজুর রহমান স্যার। তিনি শুধু বাংলার প-িত ছিলেন না; পাশাপাশি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব। স্কুলে ঢুকতেই পুরো মাঠ ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলীতে ভরে উঠেছিল। হেডস্যার সেদিন রাজপুত্রের মত সেজেগুজে স্কুলে এসেছিলেন। সব শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর শরীর নতুন পোশাকে ঝকঝক করছিল। মাইকে বারবার বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, জাতীয় সংগীত ও দেশাত্মবোধক গান বাজছিলো। সকাল ঠিক ৯টায় এসেম্বলি শুরু হলো।

জাতীয় সংগীতের পর প্রধান শিক্ষক মহোদয় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাঁথা আমাদের সামনে সহজ ভাষায় বর্ণনা করলেন। বঙ্গবন্ধুর আপোষহীন লড়াইয়ের কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। আত্মার মাগফেরাত কামনা করলেন লক্ষ লক্ষ বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের। স্মরণ করলেন ইজ্জত হারানো মা-বোনদের। এরপর যথারীতি আমরা প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকম-লীর পেছনে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে স্কুলের মাঠের পশ্চিম পাশে অবস্থিত পূর্বমুখী শহীদ মিনারের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। সবাই নীরবতা পালন করে শহীদদের স্মরণ করলাম।
প্রথম বিজয় দিবসের মূল আকর্ষণ ছিল আমাদের বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিক। সে অতি গোপনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দেয়ার আগে সে প্রায়ই কাঁধে স্ট্যান্ড গান ঝুলিয়ে সাইকেল চেপে দুধমুখা বাজারে আসত। ও আমাদের সহপাঠী হলেও বয়সে ছিল একটু বড়। সম্ভবত ও ব্রেক অব স্ট্যাডি ছিল। ঐ দিন শিক্ষকগণ শফিককে তাদের পাশেপাশে রেখেছিলেন। আমরাও তার সাথে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে আলিঙ্গন করেছি। দুঃখজনক যে, শফিককে ৯ম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকে এ পর্যন্ত আর দেখিনি। জানি না আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুটি কোথায় হারিয়ে গেল।

স্কুলের মাঠপর্ব শেষ করে আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের নেতৃত্বে স্কুল থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে মীরদেরপুল হয়ে দুধমুখা বাজারের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত ‘জয় বাংলা- বাংলার জয়’, ‘স্বাধীনতা- অমর হউক’, ‘শহীদদের রক্ত- বৃথা যেতে দেব না’, ‘স্বাধীনতা এনেছি- স্বাধীনতা রাখবো’, ‘শহীদ স্মৃতি- অমর হউক’, ‘বিজয় দিবস বিজয় দিবস- সফল হউক সফল হউক’ স্লোগানমুখর করে তুলেছিলাম। হাতে রাখা ছোট ছোট পতাকার দুলনি ও এসব প্রাণবন্ত স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল আকাশ-বাতাস। আশপাশের মানুষজন, পথচলা পথচারী, ব্যবসায়ী, আশপাশের বাড়িঘরের মা-বোনেরা বেড়ার আড়ালে থেকে দলে দলে সারি বেঁধে হাততালি দিয়ে আমাদের বিজয় মিছিলকে স্বাগত জানিয়েছিল। মিছিল শেষে আমরা পুনরায় স্কুল মিলনায়তনে সমবেত হয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষকের সভাপতিত্বে একটি আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছাড়াও আমাদের কয়েকজন সহপাঠী দেশের গান গেয়েছিল। তন্মধ্যে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে’ এবং ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না’। এ দু’টি গানের কথা এখনও আমার কানে বাজছে।

আমি এই স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম ’৭২ সালের জানুয়ারিতে। নতুন স্কুল হলেও আমার নানার বাড়ির স্কুল বলে অনেকের সাথেই পূর্ব পরিচয় ছিল। ফলে অতি দ্রুত এই স্কুলকে আমি আপন করে নিয়েছিলাম। আমার বন্ধুদের পাল্লাও ছিল বেশ ভারি। বলতে দ্বিধা নেই, ১৯৭১ সালে আমি আমাদের বাড়ির সামনের স্কুল ‘বাগডুবি হাই স্কুলে’ ৭ম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। এ সময় যুদ্ধের ভয়াবহতায় লেখাপড়া তেমন হয়নি। প্রায় সারা বছরই স্কুল বন্ধ ছিল। এজন্য আমার আব্বা আমাকে অটো প্রমোশনে ৮ম শ্রেণিতে উঠতে দেননি। এ অবস্থায় আমি ৭ম শ্রেণিতে নিচের ক্লাসের ছাত্রদের সাথে পড়তে লজ্জাবোধ করায় বাড়ি থেকে দু’মাইল দূরে দুধমুখা হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম।

বাগডুবি হাই স্কুলের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। আমি প্রায় দিন দুধমুখা স্কুল থেকে বিকেলে বাড়ি ফিরে বাগডুবি হাই স্কুলে চলে যেতাম নাটকের রিহার্সেল দেখার জন্য। একদিন নাটকের পরিচালক আমার পূর্বের শিক্ষক মেজবাহ্ স্যার বললেন, ‘এই নাটকে তোমাকে মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।’ এ কথা শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম। কিন্তু অন্যান্য বন্ধু ও শিক্ষকের উৎসাহে রিহার্সেলে অংশ নিলাম।

চরিত্রটা ছিল এমন, একটি মেয়েকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর মেয়েটি বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্ত-চিৎকার করছে। আমাকে নাটকের সংলাপ বলে দিচ্ছেন পরিচালক। কিন্তু আমি তার মত করে বলতে পারছি না। তিনি আমাকে বারবার বলছেন যে, তুমি কি নাটক বা সিনেমায় দেখনি, গুন্ডারা কোন মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর মেয়েটি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে! তুমি সেভাবে ভয়ার্ত চিৎকার দিয়ে বলো।

আমি কীভাবে বলব? ইতোপূর্বে আমি কখনো নাটক বা সিনেমা দেখিনি। গু-ারা কোন মেয়েকে হাইজ্যাক করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাও শুনিনি। এ অবস্থায় পরিচালকের বারবার চেষ্টাতেও আমার মুখে ‘বাঁ-চা-ও…’ বলাতে পারেনি। আমি বাদ পড়লাম। আমার এক বন্ধু করাচী থেকে যুদ্ধের সময় বাড়ি ফিরেছে। তার নাম নাসির। কয়েক বছর সে আমাদের সাথে লেখাপড়া করেছিল। সে নাটকের রিহার্সেল দেখতে এসেছিল। সে দাঁড়িয়ে বলে, ‘জাফরকে দিয়ে ওসব হবে না। স্যার আমি বহু সিনেমা দেখেছি। আমি-ই মেয়েটির চরিত্রে অভিনয় করব।’

দুধমুখা স্কুলের বিজয় দিবস শেষ করে দুপুরেই বাড়ি ফিরেছি। খাবার আগেই চারদিক থেকে বিজয় মিছিল আর ঢোলের বাদ্য শুনতে পেলাম। আম্মা ভাত খাওয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করলেও আমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে চলে গেলাম বাগডুবি হাই স্কুল মাঠে। দেখলাম উত্তর দিক থেকে অর্থাৎ দাগনভুঁঞা থেকে শত শত মানুষ আর সম্মুখভাগে কয়েক ডজন মুক্তিযোদ্ধা সুন্দর রঙিন পোশাক পরে মিছিল নিয়ে আসছেন। উদ্দেশ্য বাগডুবি বড় হুজুরের মাজার যিয়ারত। এই হুজুর ছিলেন বাগডুবি হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। কবরস্থান মিছিলকারীদের চোখে পড়ার সাথে সাথে তারা ঢোল-বাদ্য ও স্লোগান বন্ধ করে দেয়। সবাই নত মস্তকে এসে বড় হুজুরের কবরের সামনে সারিবদ্ধভাবে দ-ায়মান হয়। আমিও তাদের দলে ঢুকে গেলাম। আমি সেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় অশ্রু বিসর্জন করতে দেখেছি।

সারাদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলো মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাইয়েরা। সবার উদ্দেশ্য স্বাধীনতার প্রথম বিজয় দিবসে আমাদের বাড়ির সামনে অনুষ্ঠিতব্য ‘সোনার বাংলা’ নাটক দেখবে। চারদিকে যেন ঈদের আনন্দ। সত্যিই আমরা নাটক দেখার জন্য মাঠে মঞ্চের সামনে বসে পড়লাম। খোলা মাঠে হাজার হাজার দর্শক। তখন ফেনী শহর ছাড়া কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। সুতরাং হ্যাজাক লাইট জ¦ালিয়ে মঞ্চ আলোকিত করা হল। আর দায়িত্বশীলদের হাতে ছিল টর্চ লাইট। টান টান উত্তেজনার মাঝে অনেক সুন্দর নাটক মঞ্চস্থ হল। নাটকের মূল বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের বিজয় আর হানাদার পাক সেনাদের পরাজয় এই নাটকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে নাটক শেষ হলে আমরা যার যার ঘরে ফিরলাম।

সে সময় টেলিভিশন ঢাকা শহর ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যেত না। এ অবস্থায় রেডিও ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। আমি স্কুলে যাওয়ার আগেই রেডিওতে ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিজয় দিবসের মার্চ ফার্স্ট কুচকাওয়াজ ও বিজয় ভাষণ সেদিন শুনেছিলাম। যদিও এটি ৪৯ বছর আগের ঘটনা। না-না, আমার কাছে এ দিনের কথা একটুও বিস্মৃত হয়নি। যেন প্রতিদিনের নতুন আলোকিত ভোরের মত উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে ফুটে ওঠে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। আমাদের স্বাধীনতার প্রথম বিজয় দিবস।

Share.

মন্তব্য করুন