তুলার প্রাসাদ নামটা শুনলেই বেশ অবাক লাগে। তুলো দিয়ে প্রাসাদ তৈরির ঘটনা নিশ্চয় সবার কাছে নতুন। প্রকৃতির এমনই এক আশ্চর্য নিদর্শন রয়েছে তুরস্কের পামুক্কালে। তুর্কি ভাষায় যার অর্থ কটন ক্যাসল বা তুলোর প্রাসাদ।
দুধ-সাদা প্রাচীরের নীল পানিতে টলটলে উষ্ণ পানির দেখা মেলে পামুক্কালে। বিস্তীর্ণ এলাকায় তুষারের আবরণ ও তুলোর প্রাসাদের মতো গড়নের কারণেই এমন নামকরণ।
তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দেনিজলি প্রদেশের মেন্দারিস নদীর উপত্যকায় অবস্থিত পাললিক শিলা দ্বারা নির্মিত পামুক্কালের সৌন্দর্য একেবারে নজরকাড়ার মতো।

বিশ্বে যতগুলো মুসলিম দেশ আছে তাদের মধ্যে অন্যতম তুরস্ক। এক সময় তুরস্ক পুরো পৃথিবীকে শাসন করত। এই দেশের সব ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল। সবচেয়ে ঝকঝকে আকাশ দেখা যায় তুরস্কে।
আয়া সোফিয়া, আঙ্কারা, মারডিন কিংবা সুলতান সুলেমান মসজিদের মতো দর্শনীয় স্থাপনাগুলো তুরস্কেই অবস্থিত। এ ছাড়াও নানা কারণে তুরস্ক সারা বিশ্বে বেশ পরিচিত। বর্তমানে তুরস্কের আর একটি বিস্ময়কর জায়গা এই তুলার প্রাসাদ।
এখানে গেলে কেউ ভাবতে পারে বরফরাজ্য। কিন্তু পামুক্কালের সঙ্গে তুলা কিংবা বরফ কোনোটিরই সম্পর্ক নেই। পামুক্কালের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এই উপত্যকার সবুজ প্রান্তরের মাঝেই আচমকা দাঁড়িয়ে আছে এই তুষার-শুভ্র পামুক্কালে।
পামুক্কালের পাহাড়ি উপত্যকাটি খনিজলবণে সমৃদ্ধ। এই লবণগুলোই জমাট বেঁধে চুনাপাথরের এই তুলার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে।

তুলোর প্রাসাদকে অনেকে চেনেন গরম পানির ঝর্ণা হিসেবে। পৃথিবীর একমাত্র স্থান এটি যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই ঝর্ণার পানি গরম।
দু’হাজার সাতশো মিটার লম্বা, ছয়শ মিটার চওড়া ও একশো ষাট মিটার উঁচু প্রাসাদজুড়ে আছে গরম পানির অসংখ্য ঝর্ণা। যা দিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট পুকুর। খনিজলবণের কারণে এগুলো কেবল নান্দনিকই নয়, এখানকার পানিও বেশ উষ্ণ ও সুস্বাদু।
হাজার বছর আগে এ এলাকায় একের পর এক ভূমিকম্প হয়ে মাটিতে অনেক ফাটল সৃষ্টি করেছিল। ভূ-তাত্ত্বিকরা মনে করেন শক্তিশালী ভূমিকম্পে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট সমৃদ্ধ উষ্ণ ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হয়ে জমতে শুরু করে ভূপৃষ্ঠে। কালের বিবর্তনে ছাদের মতো পরত পড়ে পড়ে জন্ম হয়েছে এ তুলোর প্রাসাদের।
অবশ্য কেবল এই তুষার-শুভ্র সৌন্দর্যই পর্যটকদের আকর্ষণ করার একমাত্র কারণ নয়। বরং যে কারণে চার পাশে সবুজের মাঝেও জায়গাটি সারা বছর এমন ধবধবে সাদা হয়ে থাকে, সেটিই পর্যটকদের আকর্ষণ করার কারণ তা হলো খনিজলবণ।

এখানকার খনিজলবণে ভরপুর পুকুরগুলোতে গোসল করা যায়। প্রচুর খনিজলবণের কারণে জায়গাটি কেবল সুন্দর আর দর্শনীয়ই নয়, বেশ স্বাস্থ্যকরও।
গুহার মতো ক্যালসিয়ামের স্তর জমায় ‘পামুক্কালে’কে ঘিরে ‘হিয়েরাপলিস’ বা ‘পবিত্র শহর’ নামে আস্ত এক প্রাচীন শহরই গড়ে তুলেছিলো গ্রিক-রোমানরা। তুরস্কের সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুটির অবস্থান দেনিজলি প্রদেশের হিয়েরাপলিসে। অসাধারণ নৈসর্গীয় এমন রূপ হাজার বছর আগের সৃষ্টি।
এমন অপার সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর ছুটে আসেন ২০ লাখের বেশি পর্যটক। এর স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে নামার লোভ সামলাতে পারেন না অনেকে। গোসলের পাশাপাশি শ্বেত লবণ মেখে নেন ত্বকের যতেœ।
১৯৮৮ সালে এটি স্থান পেয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে। তুর্কি সরকারের যতেœ দিনে দিনে এর সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে পর্যটকের ভিড়।
জায়গাটি সংরক্ষণ করার জন্য তুরস্ক সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখান থেকে সব ধরনের হোটেল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি পামুক্কালের পুকুরগুলোতে জুতা পরে নামা যায় না আর। এসব কারণে দিন দিন পামুক্কালের সৌন্দর্য যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে পর্যটকদের ভিড়ও।

Share.

মন্তব্য করুন