পশ্চিম আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ সেনেগাল। দেশটির এক নিভৃত পল্লী থেকে উঠে এসে বিশ^মঞ্চে আলো ছড়াচ্ছেন ফুটবলার সাদিও মানে। গত কয়েক মৌসুম ধরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিভারপুল এফসির হয়ে দারুণ খেলা এই ফরোয়ার্ডকে নিয়ে আমাদের এবারের লেখা।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের সেরা ফুটবল ক্লাবগুলোর একটি ইংল্যান্ডের লিভারপুল এফসি। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ক্লাবটি জিতেছে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ মৌসুমেও তারা খেলেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ক্লাব বিশ^কাপ, উয়েফা সুপার কাপ জিতেছে জার্গেন ক্লপের শিষ্যরা। আর গত মৌসুমে (২০১৯-২০) রেকর্ড ব্যবধানে জিতেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। সেবার লিভারপুলের কতটা দাপট ছিলো সেটি বোঝা যাবে পয়েন্ট টেবিলের অবস্থা দেখে। সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ম্যানচেস্টার সিটির সাথে লিভারপুলের পয়েন্টের ব্যবধান ছিলো ১৮। অর্থাৎ কোন দল লিভারপুলকে চ্যালেঞ্জই জানাতে পারেনি। এর আগের মৌসুমেও লিগে মাত্র ১ পয়েন্টের ব্যবধানে দ্বিতীয় হয়েছে দলটি।
সাম্প্রতিক সময়ে দলটির এই এত যে দাপট তাতে মূল ভূমিকা যে কয়েকজনের তাদের একজন ফরোয়ার্ড সাদিও মানে। মিসরীয় ফরোয়ার্ড মোহাম্মাদ সালাহর সাথে জুটি বেঁধে লিভারপুলের আক্রমণভাগকে করে তুলেছেন দুর্দান্ত। সালাহ-মানে জুটি যে কোন দলের ডিফেন্সের জন্য আতঙ্ক। যে কারণে দলটি পাচ্ছে একের পর এক সাফল্য। গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে সালাহ করেছেন ১৯ গোল আর, আর মানের গোল সংখ্যা ছিল ১৮টি।
শুধু ক্লাব নয়, জাতীয় দলের হয়েও সাদিও মানে দারুণ পারফর্ম করেছেন। ১৬ বছর পর ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ^কাপের মূলপর্বে তুলেছেন সেনেগালকে। ২০১৯ সালের আফ্রিকান ন্যাশনস কাপের ফাইনালে তুলেছেন দেশকে। নিজে হয়েছেন আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলার (২০১৯)।
কিন্তু এই যে বিশ^ ফুটবলে এত আলো ছড়াচ্ছেন, ক্লাবকে একের পর এক সাফল্য এনে দিচ্ছেন- সেই সাদিও মানের জীবনের শুরুর গল্পটা ছিলো খুবই অনুজ্জ্বল। সেনেগালের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকার বাম্বালি নামের এক গ্রামের ছেলে সাদিও মানে। জন্ম ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল। বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তার স্বল্প আয়ে অনেকগুলো সন্তানের ভরণপোষণ দেয়া কষ্টকর ছিল। ছোট বেলা থেকেই মানের ছিল ফুটবলের নেশা। পড়ালেখা বাদ দিয়ে ফুটবল নিয়েই মেতে থাকতো। কাগজের দলা বা কাপড়ের পুঁটলি বানিয়ে খেলতো সারাদিন। বিকেলে সবার আগে মাঠে পাওয়া যেত তাকে। এ ছাড়া দিনের অন্য সময়গুলোতেও চেষ্টা করতো সঙ্গী জুটিয়ে ফুটবল খেলার। কাউকে খেলতে দেখলো তো আর কথাই ছিল না! দরিদ্র পরিবারের কাছে সন্তানদের ফুটবলার হওয়ার আশা বিলাসিতা। তারা চাইতো সন্তান লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করবে; কিন্তু সেসবে মন বসতো না মানের। পরিবারের সাথে কখনো ফসলের ক্ষেতে কাজ করতেও চাইতো না সে।
২০০২ সালের কোরিয়া-জাপান বিশ^কাপে প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পায় সেনেগাল। উদ্বোধনী ম্যাচেই আগের বারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে দেয় তারা। এরপর একের পর এক অবিশ^াস্য খেলা উপহার দিয়ে দেশটি ওঠে কোয়ার্টার ফাইনালে। পুরো সেনেগাল মেতে ওঠে আনন্দে। সে সময় ১০ বছরের কিশোর সাদিও মানে। টিভিতে নিজ দেশের জয় দেখে আর দেশজুড়ে ফুটবল উন্মাদনা দেখে তার মনেও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ডানা মেলতে থাকে।
এরই মধ্যে মানের বয়স যখন ১১ বছর, তখন তার বাবা মারা যায়। পরিবারে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। এতগুলো সন্তান নিয়ে পরিবার কিভাবে চলবে? তখন মানেকে নিয়ে যান তার চাচা। চাচার বাসায় থেকেও তার ফুটবলের নেশা এতটুকু কাটেনি। ফুটবলার হতেই হবে- এই এক জেদ তারা। এর মধ্যে পাড়ায় দারুণ খেলতে দেখে অনেকেই পরামর্শ দিতে থাকেন তাকে কোন ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিতে। এক পর্যায়ে একাই পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রাজধানী ডাকারে; কিন্তু ধরা পড়ার পর পরিবার শর্ত দেয় স্কুলে আরো এক বছর পড়াশোনা শেষ করে যেতে হবে। বাধ্য হয়ে রাজি হয় মানে। এক পর্যায়ে চাচা সিদ্ধান্ত নেন মানেকে ডাকারে পাঠানোর। মানে ও চাচার পরিবারের ফসল বিক্রির টাকা আর স্থানীয় কয়েকজনের সহযোগিতায় তার রাজধানীতে যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়। বয়স তখন ১৫ বছরের কিছু বেশি।

২০০৯ সালে একটি টুর্নামেন্টে খেলা দেখে তাকে ট্রায়ালে ডাকে ডাকারের ‘জেনারেশন ফুট’ নামের এক ফুটবল অ্যাকাডেমি। জেনারেশন ফুটে ট্রায়ালের সময় শুরুতেই এক বুড়ো কর্মকর্তা তার পুরনো বুট, ছেড়া শর্টস নিয়ে খোঁচা দিয়েছিল। জবাবে মানে বলেছিল, আমি মাঠেই দেখাতে চাই। খোঁচা দেয়া সেই বুড়ো ট্রায়ালের পর মানের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, সেদিনই তাকে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেনন। সে সময়ের অ্যাকাডেমির কোচ জুলস বাউচার পরে বলেছেন, তার গতি, ড্রিবলিং আর প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভাঙার দক্ষতা দেখেই বুঝেছিলাম এ একটি রত্ন।

জেনারেশন ফুট অ্যাকাডেমির সাথে চুক্তি ছিল ফ্রান্সের ঘরোয়া লিগের দ্বিতীয় স্তরে খেলা এফসি মেৎজ ক্লাবের। চুক্তি অনুযায়ী অ্যাকাডেমির প্রতিভাবান তরুণদের ডাকা হতো ক্লাবটিতে। তেমনই এক সুযোগ পেয়ে ১৮ বছর বয়সী মানে পা রাখেন ফ্রান্সে। ইউরোপের শীতল আবহাওয়া আর ইনজুরির কারণে সেবার (২০১১-১২ মৌসুম) উল্লেখ করার মতো পারফর্ম করতে পারেননি, ২২ ম্যাচে গোল করেছেন ২টি; কিন্তু ইউরোপের ফুটবল কর্তারা এই অল্পতেই তাকে চিনে ফেলে। তাইতো পরের মৌসুমের শুরুতেই ৪০ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফিতে তাকে কিনে নেয় অস্ট্রিয়ার শীর্ষ লিগের ক্লাব রেড বুল সালজবুর্গ। সেবার দুটি শিরোপা জেতে ক্লাবটি। তিন ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন সাদিও মানে। তবে ক্লাবটির কর্মকর্তাদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় দুই মৌসুমের বেশি খেলা হয়নি অস্ট্রিয়ায়। এটি অবশ্য শাপে বরই হয়ে দেখা দিয়েছে তার ক্যারিয়ারের জন্য। সব মিলে ৬৩ ম্যাচে ৩১ গোল করেছিলেন ক্লাবটির হয়ে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব সাউদাম্পটন এফসি ১ কোটি ১৮ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফিতে তাকে কিনে নেয়। ক্লাবটির সাথে চুক্তি হয় চার বছরের। প্রথম মৌসুমেই ক্লাবটির হয়ে গড়েন প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিকের রেকর্ড। অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে হোম ম্যাচে তিনটি গোল করেন দুই মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের মধ্যে। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এটি দ্রুততম হ্যাটট্রিক। ৩২ ম্যাচে ১০ গোল করে দারুণ এক মৌসুম শেষ করেন। পরের মৌসুমেও এই পারফরম্যান্স ধরে রাখেন। সেবার ১৫ গোল করে ক্লাবের সেরা গোলদাতাও হন।
কিন্তু একটু বড় ক্লাবে খেলতে কার না ইচ্ছে হয়। তাই লিভারপুল এফসির প্রস্তাব পেয়েই রাজি হয়ে যান। ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৩ কোটি ৪০ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফিতে যোগ দেন লিভারপুলে। ক্লাবটির সাথে চুক্তি হয় ৫ বছরের। জুটি বাঁধেন মোহাম্মাদ সালাহরর সাথে। এরপর তার চলার পথকে শুধুই রাঙিয়ে চলেছেন এই ফরোয়ার্ড। ক্লাবকে এনে দিয়েছেন একের পর এক সাফল্য। নিজের মুকুটেও যুক্ত করেছেন নতুন নতুন পালক। প্রথম মৌসুমেই মনোনীত হয়েছেন লিভারপুলের সেরা খেলোয়াড়। গতি, ফিনিশিং দক্ষতা, ড্রিবলিংসহ সব দিকে দক্ষ এই ফরোয়ার্ড।
মানবিক মানে:
বিশ^মঞ্চে আলো ছড়ালেও নিজের শেকড়কে ভুলে যাননি সাদিও মানে। ইমাম বাবার সংসারে যে নৈতিকতা আর মানবিক মূল্যবোধ শৈশবে তার হৃদয়ে জায়গা পেয়েছে সেটিও ধরে রেখেছেন। ধার্মিক মানেকে এখনো প্রায়ই দেখা যায় মাঠেই দু’হাত তুলে মোনাজাত করতে। গোল উদযাপনে করেন সিজদা। নিজের গ্রামের সেই মসজিদটি এখন চমৎকার একটি ভবন পেয়েছে তার অনুদানে। গ্রামের মানুষদের জন্য স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিছুদিন আগে গ্রামের ছেলেদের জন্য পাঠিয়েছে লিভারপুল ক্লাবের তিনশটি জার্সি। বাম্বালি গ্রামের সব কিশোর এখন সাদিও মানে হতে চায়। শুধু গ্রাম নয় পুরো সেনেগাল এখন গর্ব করে সাদিও মানেকে নিয়ে।

ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত ন¤্র আর বিনীয় একজন মানুষ এই ফুটবলার। লিভারপুলের হয়ে প্রতি মাসে তার বেতন ৭ লাখ ২০ হাজার ইউরো। বাংলাদেশী টাকায় যা ৭ কোটিরও বেশি; কিন্তু এত উপার্জন করেও খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করেন। একটি ঘটনা বলে এই লেখা শেষ করবো। ২০১৯ সালের শেষ দিকে মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা গেছে মানের হাতের মোবাইল ফোনটির স্ক্রিন খুব বাজে ভাবে ভাঙা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর আগ্রহী সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে মানে বলেন, ‘২০টি ফেরারি গাড়ি, ২০টি হীরে বসানো ঘড়ি কিংবা দুটি প্লেন চাইলেই কিনতে পারি আমি; কিন্তু এতে আমার কী লাভ হবে, বিশে^রই বা কী উপকার হবে?’

এরপরই তিনি বলেন, আমি আমার উপার্জনের টাকায় স্কুল, স্টেডিয়াম বানাচ্ছি। গরিবদের জন্য খাবার, কাপড় দিচ্ছি। সেনেগালের খুবই দরিদ্র একটি গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৭০ ইউরো করে দিচ্ছি। এগুলো মানুষের উপকারে আসছে। চাইলেই বিলাসী গাড়ি, বিলাসী বাড়ি বানাতে পারতাম; কিন্তু তার বদলে জীবন আমাকে যা দিয়েছে তা থেকে মানুষকে সহযোগিতা করতেই আমার আনন্দ।

Share.

মন্তব্য করুন