আমার আর দূর্জয়ের দুজনেরই খুব বিদেশ ভ্রমণের শখ ছিল। তাই একসাথেই বেড়িয়েছি অনেক জায়গা। সেসব জায়গায় গিয়ে যে সবসময় শান্তিতে থেকেছি তাও ঠিক নয়। আসলে দূর্জয়ের খ্যাতি ছিল অনেক জায়গাতেই। তাই অনেক সময় বেড়াতে গিয়েও বসে পড়তে হয়েছে রহস্য নিয়ে। নতুন নতুন কেস এসেছে আমাদের হাতে। এমনই এক ঘটনার কথা বলছি আজ।
দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েছিলাম দুই বন্ধু। সেখানে গিয়ে উঠেছিলাম আমাদের আরেক বন্ধু প্রিতমের বাসায়। একদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়েছিল। ফিরে চাকরের মুখে শুনি, এক ধনী লোক আর তার স্ত্রী নাকি এসেছিল দূর্জয়ের খোঁজে। অপেক্ষা করে করে যখন ফিরলাম না আমরা, তখন নাকি চলে গিয়েছে। এ কথা শুনেই রেগে গেল দূর্জয়।
‘একটা ফোন করতে পারো নি বাপু? নাম্বার তো আছেই। আমার না থাকলেও তোমার সাহেবের তো আছে, নাকি?’
‘মাফ করবেন বাবু। ফোন করলে যদি বিরক্ত হন, তাই ভয়ে আর ফোন করিনি।’
‘বিরক্ত? বিরক্ত হচ্ছি এখন। কখনো শুনেছো চাওয়ালা চা বেঁচতে বিরক্ত হয়? হয় না তো। তেমনি গোয়েন্দা কখনো কেস শুনে বিরক্ত হয়?’
‘মাফ করে দেন বাবু।’
পরিস্থিতি সামাল দিল প্রিতম, ‘আচ্ছা আচ্ছা। যা হওয়ার হয়েছে। এখন এইসব বলে তো আর লাভ নেই।’
‘সেটাই। লাভ তো নেই। তো বলি, সে লোক কি কোনো নাম্বার-টাম্বার বা ঠিকানা দিয়ে গেছে তোমায়?’
‘না তো বাবু, কিছুই দেয়নি।’
‘ভালো।’
মুখ দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল প্রচুর বিরক্ত হয়েছে সে। বসে পড়ল পাশের চেয়ারে। আমরাও বসলাম। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম সোফার উপর একটি জিনিস। ‘আরে আরে, এটা কী?’
‘কই দেখি?’
জিনিসটা আমার হাত থেকে নিলো দূর্জয়।
‘ও মাই গুডনেস! এ কী দেখালে গো সুরীদ!’
‘কী আবার দেখালাম? এ তো সামান্য এক ঘড়ি।’
‘সামান্য নয়, সামান্য নয়! ভালো করে দেখো, এ তো সোনার তৈরি। এমন ঘড়ি তো প্রিতমের নেই। এ নিশ্চয় সেই দম্পতির। শুনলে না, চাকর বলল যারা এসেছিল তারা নাকি ধনী। এ তাদেরই। নিশ্চয় তারা আসবে এ ঘড়ির খোঁজে।
দূর্জয় ভুল ধারণা করেনি। কিছুক্ষণ পরই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। প্রিতমের চাকর গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। দূর্জয় সোফাতেই বসে ছিল। সে পরিচয় না জিজ্ঞেস করেই বলে উঠলো, ‘আপনাদের ঘড়িটা যে ফেলে গিয়েছিলেন, সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি।’
‘উফফ, তাও ভালো। আমি তো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের বিয়ের সময়কার স্মৃতি এই ঘড়িটা। হারিয়ে গেলে খুবই খারাপ হতো,’ মনে হলো কিছুটা শান্তি পেলেন ভদ্রলোক। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল তাঁর।
‘এই ঘড়ির জন্যই আমাদের আবার দেখা হয়ে গেল। দেখলেন, বিধাতার কী খেল! নিন, বসুন। আর এভার একটু খোলাসা করে বলুন তো, কী দরকারে এই অভাগার কাছে আসা হয়েছিল।’
‘বড়ো বিপদে পড়ে গিয়েছি দূর্জয় বাবু,’ ভদ্রলোক বলা শুরু করলেন। ‘প্রথমে আমাদের পরিচয় দেই। আমি মি. তাশরিফ। আর ইনি হলেন আমার মিসেস। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ধনসম্পদ কম পাইনি। এসব নিয়ে বেশ সুখেই ছিলাম। হঠাৎ করে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমার স্ত্রীর একটি খুবই পছন্দের এবং দামি সীতাহার আছে। আসলে এটি আমাদের পারিবারিক সীতাহার। আমার মা বিয়ের পর এটি আমার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। তো এই সীতাহারটি আমার স্ত্রী সবসময় নিজের কাছেই রাখতেন। ঘটনাটি এই সীতাহারকে নিয়েই। ও কিছুদিন আগে মায়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। সীতাহারটি ছিল বাড়িতেই। একটি আলমারিতে। গত সোমবার হঠাৎ এক ঘটনা ঘটে গেল। বাসায় ছিলাম আমি, কলেজে পড়া আমার শ্যালিকা আর দুই চাকর। সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী। শ্যালিকা আমার স্ত্রীর সাথে তাদের মায়ের বাড়ি যেতে পারেনি ওর কলেজের পরীক্ষার কারণে। দুপুরের দিকে আমি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ করে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আগুন, আগুন’ বলে। আর কোত্থেকে যেন ধোঁয়া আসতে লাগলো। চারদিকে হই-হুল্লোড় লেগে গেল। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর দেখি সেই ধোঁয়া আর নেই। সব স্বাভাবিক। কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। ভেবেছিলাম কেউ হয়তো বাজে মশকরা করেছে। তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। স্ত্রী বাড়ি ফেরার পর বাড়ি মাথায় তুললো। সেই সীতাহার নাকি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর পেলাম না সেই সীতাহারটি। আমার তো মনে হয়, সেইদিন ওই আগুনের মজার মধ্যেই চোরে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে সীতাহারটি। এত দামি আর পারিবারিক ইতিহাস সমৃদ্ধ হার হারিয়ে যাবে, তা তো হতে দেয়া যায় না, তাইনা? তাই আপনার কাছে ছুটে আসা। আপনার নামডাক অনেক শুনেছি, শুনলাম আপনি নাকি এখানে এসেছেন। তাই চলে আসলাম বিরক্ত করতে। এখন আপনিই কিছু করুন, দূর্জয় বাবু।’
পুরো কাহিনীটা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। কিন্তু কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না। এত দামি সীতাহার, এর চোরের তো অভাব নেই। এখন কীভাবে খুঁজে বের করব চোর কে? অবশ্য দূর্জয়ের কাছে এটি এত কঠিন নাও হতে পারে। দেশসেরা গোয়েন্দা বলে কথা।
‘আচ্ছা, সব আমাকে বলেছেন তো? নাকি কিছু বাদ দিয়েছেন?’
‘না তো। কিছুই বাদ দেইনি।’
‘এই ঘড়িটি কার? যেটি ফেলে গিয়েছিলেন?’
‘এটি আমার স্ত্রীর।’
‘আচ্ছা। তো মিসেস তাশরিফ, এবার আপনার সাথে কিছু আলাপ হয়ে যাক। আপনি এই সীতাহারটি যে আলমারিতে রেখে গিয়েছিলেন, এ ঘটনার কথা আপনারা দুজন ছাড়া আর কে কে জানতো?’
‘তেমন কেউ তো জানতো না আমরা দু’জন ছাড়া। শুধু আমার বোন আর আমাদের বাড়িতে যে মহিলা কাজ করে, রিনি, সে। ব্যাস।’
‘কাজের লোক! কাজের লোক জানতো আপনার সীতাহারের ব্যাপারে?’
‘হ্যাঁ…।’
‘আসলে ওর সাথে রিনির খুব ভালো সম্পর্ক। দুজন একই গ্রাম থেকে তো, তাই আরকি। ওর প্রায় সব কথাই রিনি জানে,’ মিসেস তাশরিফকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মি. তাশরিফ।
‘আচ্ছা। তো মিসেস তাশরিফ, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? কে করতে পারে এমন কাজ?’
‘না তো। আমাদের তো সেরকম কোনো শত্রু নেই। সন্দেহ তো হয় না কাউকেই।’
‘আর মি. তাশরিফ, আপনার?’
‘নাহ দূর্জয় বাবু, আমারও তো সেরকম কাউকে সন্দেহ হচ্ছে না।’
‘আচ্ছা, ব্যাপার না। আপনি আপনাদের বাড়ির এড্রেস এখানে লিখে দিয়ে যান। আমি সময়মতো পৌঁছে যাব সেখানে। ধন্যবাদ।’
‘আচ্ছা দূর্জয় বাবু।’
উঠে চলে যাচ্ছিলেন দম্পতি, দূর্জয় থামিয়ে দিল তাদের। ‘আরে আরে, আবার যে ঘড়িটা রেখে যাচ্ছেন। নিয়ে যান, ধরুন।’
‘ইশ! কত্তবার তোমাকে বলেছি নিজের জিনিসপত্র সাবধানে রাখো। শোনোই না আমার কথা। নেও, নিয়ে ব্যাগে রাখো ঘড়িটা,’ স্ত্রীকে অনেকটা ধমকের সুরেই বললেন মি. তাশরিফ।
ওনারা চলে যাওয়ার পর দূর্জয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বন্ধু? কী বুঝলে?’
‘কিছুই বুঝলাম না বন্ধু। এরকম কাজ তো অনেকেই করতে পারে, এখন আমরা এটা খুঁজে বের করবো কীভাবে?’
‘অনেকেই যে করতে পারে, তা মনে হয় না। কারণ বেশি কেউ তো জানতোই না সীতাহারটা কোথায় রাখা ছিল। যাই হোক, স্পটে না গেলে বুঝতে পারবো না। তবে একটা বিষয় ঠিকই বুঝে গেছি এতক্ষণে, যে ভদ্রমহিলাটি খুবই ভুলোমনা। দেখলে না, নিজের পছন্দের জিনিস কীভাবে দুবার ফেলে চলে যাচ্ছিলো?’
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো কিন্তু।’

পরদিন সকালে আমরা গেলাম মি. তাশরিফের বাড়িতে। প্রিতম আমাদের নামিয়ে দিয়ে ওর অফিসে চলে গেল। সেখানে গিয়ে আমরা মি. ও মিসেস তাশরিফের উষ্ম অভ্যর্থনা পেলাম। দূর্জয় আর আমি প্রথমেই পরিচিত হলাম বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে। মিসেস তাশরিফের ছোট বোন জান্নাত। উচ্চতা বেশি নয়, পাঁচ-সাড়ে পাঁচ হবে। চেহারা ফরসা। মেয়েটাকে দেখে মনে হলো বেশ লাজুক। এছাড়া বাড়িতে থাকে দুই কাজের লোক। রিনি আর মিলন। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই বেশ লম্বা-চওড়া। চেহারা শ্যামবর্ণের। সবাইকে ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করলো দূর্জয়। ওদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথাও বললো।
‘আচ্ছা রিনি, যখন নকল অগ্নিকা-ের ঘটনাটা ঘটে, তুমি কোথায় ছিলে তখন?’
‘সাহেব, আমি তো রান্নাঘরে ছিলাম। রান্না করতিছিলেম সাহেব।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। আর মিলন, তুমি কী কাজে ব্যস্ত ছিলে?’
‘সাহেব, আমি তো তখন বাড়িতে ছিলামই না। একটু বাজারে গেছিলাম।’
‘ও আচ্ছা আচ্ছা।’
তারপর হঠাৎ কেন জানি একটু হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে রইলো মিলনের দিকে। তারপর আমরা গেলাম সেই ঘরে যেখানে ছিল সেই সীতাহারটি। ঘরটি বেশ বড়। ঘরে রয়েছে একটি খাট, একটি শোকেস, আলমারি আরো কিছু আসবাবপত্র। ঘরটির উত্তরদিকে জানালা রয়েছে। দূর্জয় হঠাৎ বলে উঠলো, ‘আচ্ছা তাশরিফ বাবু, জানালার ওপাশে কী?’
‘ওখানে তো আমাদের বাগান। কেন বলুন তো?’
‘আমি কি ওদিকে একটু যেতে পারবো?’
‘অবশ্যই অবশ্যই। এই মিলন, সাহেবকে নিয়ে যাও তো বাগানে।’
‘না না, মিলনের যাওয়ার কোনো দরকার নেই। কারোরই যাওয়ার দরকার নেই। শুধু আমি আর সুরীদ যাব।’
‘ঠিক আছে, যান তাহলে।’

বাগানে আসলাম আমরা দুজনে। দেখে মনে হলো গাছপালা লাগানোর ভালোই শখ আছে তাশরিফ সাহেবের। অনেক প্রজাতির গাছ আছে বাগানে। কী সুন্দর দেখতে গাছগুলো! আমি মন্ত্রমুগদ্ধের মতো দেখতে লাগলাম গাছগুলো। অন্য সব দিক থেকে মন উঠে গিয়েছিল।
হুশ ফিরলো দূর্জয়ের ডাকে।
‘কী হে? এভাবে দুনিয়া থেকে দূরে সরে গিয়ে কী দেখছো?’
‘আরে না, সেরকম না। দেখো, কী চমৎকার গাছগুলো! যাই হোক, বলো কী বলবে।’
‘এই দেখো, গুপ্তধন পেয়েছি।’
‘মানে?’
‘আরে ভালো করে দেখো না কেন, আগুনের উৎস পেয়ে গেছি! এখান থেকেই আগুনের উৎপত্তি!’
‘আরে, তাই তো!’

তাকিয়ে দেখি জানালার ঠিক বাইরে ছাইয়ের গাদি! মানে কেউ জানালার পাশে কিছু জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে সেই ধোঁয়া ঘরে পাঠিয়েছে! আর সবাই ভেবেছে বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে! দূর্জয়ই সব বুঝিয়ে বলল।
‘কিন্তু এরকম কাজ কে করতে পারে বন্ধু?’
‘নিজেদের কেউ। এমন কেউ, যে বাড়ির যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় যেতে পারে, কেউ কিছু বলবে না বা সন্দেহ করবে না।’
‘কার কথা বলছো?’
‘কারো কথাই না। আচ্ছা বাদ দেও, চলো। ভেতরে সবাই অপেক্ষা করছে। তবে হ্যাঁ, কাউকে কিছু বলো না যেন এ বিষয়ে।’
‘আচ্ছা বলবো না।’
বাড়িতে ঢুকবো, এমন সময় দূর্জয় দরজার সামনে গিয়ে থেমে গেল। কী কারণে এমন করলো, তা ঠিল বুঝলাম না।
‘তুমি এগোও, আমি আসছি সুরীদ।’
‘কেন? কী হলো আবার?’
‘না, কিছু না। তুমি এগোও।’
আমি ঘরে ঢুকে মি. তাশরিফের সাথে কথা বলতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দূর্জয় ঘরে ঢুকলো।
‘চোরদের পেতে একধাপ এগিয়ে গেছি মি. তাশরিফ।’
‘বলেন কী! চোরদের মানে? একের বেশি চোর?’
‘আজ্ঞে।’
‘আপনি কীভাবে বুঝলেন? চোরকে পেয়ে গেছেন নাকি?’
‘ওই যে বললাম। একধাপ এগিয়ে গেছি। অবশ্য এখনো পুরোটা জানতে পারিনি। তবে জানতে যে বেশি সময় লাগবে না, এটি হলফ করে বলতে পারি।’
‘বলেন কী! এ তো খুব ভালো কথা,’ মিসেস তাশরিফ অনেকক্ষণ পরে মুখ খুললেন।
আমরা রওনা দিলাম প্রিতমের বাড়িকে উদ্দেশ্য করে। তবে আমাদের সম্পূর্ণ যেতে হলো না। দূর্জয় গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললো।
‘কী হলো দূর্জয়? গাড়ি ঘোরাতে বললে কেন?’
‘পেয়ে গেছি বন্ধু! কেসের সমাধান পেয়ে গেছি! সব জট এতক্ষণ ধরে ভেবে ভেবে সলভ করলাম। এখন সব পরিষ্কার!’
‘আরেব্বাহ! রাস্তায়ও কেস নিয়েই ভাবো তুমি? পারোও বটে!’
‘আমার কাজই তো ভাবা। না ভাবলে, ভাত পাব কীভাবে বলো তো? আচ্ছা, যাই হোক। এইযে ভাই, চলেন, যেখান থেকে আসছিলাম সেখানেই ফিরে চলেন।’

যাওয়ার পথে আর কোনো কথা বললো না বন্ধু। কেন যে এত রহস্যের মধ্যে আমাকে রাখে সে, আমি জানি না! গেটের সামনে গাড়ি না দাঁড়াতেই এক লাফে নেমে পড়লো দূর্জয়। নেমেই দৌড় দিলো বাড়ির দিকে। শুনতে পেলাম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই সে আমাকে গাড়িতে বসে থাকতে বলল। থাকলাম ওর কথা মতো। বেশিক্ষণ বসে থাকতে হলো না। দুই মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসলো সে।
‘কেস শেষ! চোরের নাম মি. তাশরিফকে বলে দিয়ে এসেছি। কাল ফোন করে সব বুঝিয়ে বলব আর পেমেন্টটাও নিয়ে নিব।’
গাড়িতে উঠতে উঠতে গাড়োয়ানকে বললো, ‘ভাই! চলো। কাজ শেষ। তোমায় একটু কষ্ট দিলাম বটে, তবে চিন্তা করো না, দামও দিয়ে দেব।’
‘আচ্ছা, বাবু,’ খুশি হয়ে উঠলো গাড়োয়ান।
রাস্তায় যেতে যেতে এবার অবশ্য আর দূর্জয় চুপ করে থাকলো না বন্ধু। আমার প্রশ্নের জবাব দিল ঠিকই।
‘আচ্ছা এখন তো বলো আসল চোর কে?’
‘কে আবার, ওই রিনি-মিলন।’
‘কীহ! বলো কী! ওরা বলে মিসেস তাশরিফের পরিচিত লোক!’
‘হু। পরিচিত তো বটেই। তবে পরিচিত হলেই যে সাধু হবে তার তো কোনো মানে নেই। দামী সীতাহার দেখেছে, লোভ সামলাতে পারেনি।’
‘কিন্তু, কীভাবে করলো এসব?’

‘বলছি, শোনো। মিসেস তাশরিফ ওই সীতাহারের সব কথা রিনিকে আগেই বলেছেন। তাই সে জানতো সীতাহার কোথায় রাখা থাকবে। অনেকদিন থেকেই স্বামী-স্ত্রীর নজর ছিল ওই হারটির দিকে। শুধু সুযোগ খুঁজছিল সীতাহার চুরি করার। সেই সুযোগও পেয়ে গেল। মিসেস তাশরিফ অত্যন্ত ভুলোমনা মানুষ। তাই মায়ের বাড়ি যাওয়ার সময় তিনি ভুলে সীতাহারওয়ালা আলমারিতে চাবি দিতে ভুলে যান। এই সুযোগই লুফে নিয়েছে রিনি আর মিলন। দারুণ প্ল্যান বানায় ওরা। মিলন আলমারিওয়ালা ঘরের জানালার পাশে কিছু কাগজ পুড়িয়ে আগুনের আর ধোঁয়ার সৃষ্টি করে। সেই ধোঁয়া ঘরে ঢুকতেই মিলন ‘আগুন, আগুন’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। মি. তাশরিফ ধোঁয়ার কারণে কিছু দেখতে পাননি আর বুঝেও উঠতে পারেননি। এদিকে রিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে সীতাহারটি আলমারি থেকে বের করে নেয়। হয়তোবা ওর চোখে কিছু পরা ছিল, যা দিয়ে ধোঁয়া প্রতিহত করেছে। এই হলো পুরো কাহিনী।’
ঘটনা শুনে পুরো অবাক হয়ে গেলাম। একটি সীতাহার চুরির জন্য এত বড় প্ল্যান!
‘এবার বলো দেখি, তুমি এত কিছুর সমাধান করলে কীভাবে?’

‘আরে, এতো সোজা। বেচারা রিনি কাঁচা চোর। আমি জেরা করতেই সব গুলিয়ে ফেলেছে। ওকে যখন আমি জিজ্ঞেস করি, চুরির সময় ও কোথায় ছিল, তখন ও উত্তর দেয় যে ও রান্না করছিল। কিন্তু মি. তাশরিফ আমাদের আগেই বলেছিলেন, ঘটনাটি ঘটেছে দুপুরের খাবার খাওয়ার ঠিক পরে। তাই তখন রান্না করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এ কথা বুঝতে আমার সময় লেগেছে অবশ্য। আজ চলে আসার সময় মাথায় আসে এ ব্যাপার, তাই গাড়ি ঘুরিয়ে নেই।’
‘আর আগুনের ঘটনা যে মিলন ঘটিয়েছে, সেটা বুঝলে কীভাবে?’
‘ওটা সহজ ছিল। আমার আগে থেকেই মিলনের উপর সন্দেহ ছিল। বাগান থেকে যখন ঘরে ফিরি, তখন দরজার সামনে মিলনের স্যান্ডেল চোখে পড়ে। মাথায় আসে, যদি ও পোড়ানোর কাজটা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই ওর স্যান্ডেলে ছাইয়ের বা পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন থাকবে। পেয়েও গেলাম ওর স্যান্ডেল চেক করে। ছাইয়ের টুকরো লেগে ছিল সেখানে। ব্যাস, বুঝে ফেললাম সব।’
‘আরে বাহ! তুমি পারোও! এত বুদ্ধি রাখো কোথায় বলো তো?’
মুচকি হাসলো বন্ধু।
‘তবে যখন চোর ধরিয়ে দিতে যাও, আমাকে গাড়িতে বসে থাকতে বললে কেন?’
‘আরে, অকারণে সময় নষ্ট করব কেন? আমি দ্রুত গিয়ে শুধু মি. তাশরিফকে নাম বলে আবার ফিরে আসলাম। দুজনে একসাথে গেলে হয়তোবা সময় লাগতো বেশি। তাই সময় বাঁচাতেই এই কাজ। তুমি রাগ করোনি তো?’
‘আরে নাহ। রাগ করব কেন? কী যে বলো না!’
হো হো করে হেসে উঠলাম দুজনে।

Share.

মন্তব্য করুন