কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ
যগজনে করে শীত নিবারণ বাস।
কালকেতু উপাখ্যানে পাওয়া কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের কবিতার দু’টি লাইন। এ দু’টি লাইনেই কিন্তু হেমন্তের পরিচয়টি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। কার্তিক মাসে যখন হালকা ঠা-া ঠা-া লাগে, ভোরে হালকা কুয়াশা দেখা দেয়। গভীর রাতে শীত শীত অনুভূত হয় তখনই হেমন্ত। ‘যগজনে করে শীতনিবারণ বাস।’ জগতের মানুষ শীত অনুভব করে। এটাই হেমন্ত।
বাংলা মাসের কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হচ্ছে হেমন্তকাল বা ষড়ঋতুর বাংলাদেশের চতুর্থ ঋতু। একে ঋতুর রানীও বলা হয় আবার ঋতুকন্যাও বলা হয়ে থাকে।
বাংলার গ্রামাঞ্চলে হেমন্তের আগমনটা অনেকটাই বেশ ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। কারণ এ সময় নতুন ধান ওঠে। ঘরে ঘরে দেখা দেয় সুখ সুখ মুখগুলো। কিশোর-কিশোরীর হাসিমুখ দেখে প্রাণ জুড়ায় বাবা মা। কবি বলেন-
অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।
সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে।

হেমন্ত প্রকৃতির সুখের ছবি আঁকে সর্বত্র। ফসলকাটা শেষে ধানের ক্ষেতগুলো থাকে জনশূন্য, নির্বাক নিস্তব্ধ। সোনার ফসল কৃষকের বাড়িতে এনে দেয় সোনালি সুখের সময়। ক্ষেতগুলোকে তখন শোকাতুর মনে হলেও নবান্নের আহ্বানে তাদেরও সাড়া জাগে। ভোরের স্নিগ্ধ কুয়াশায় ঘাসের ডগাগুলো ফিরে পায় সজীবতা।
শুধু ধানক্ষেত বা ফসলের ক্ষেত নয় হেমন্তে অন্যান্য গছের পাতাও ঝরে নিঃস্ব হয়ে যায়। ধানক্ষেতের নাড়ার মতো ন্যাড়া হয়ে যায় ঘরের পাশের গাছপালাও। প্রতিদিন উঠোন ঝাড়– দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যায় বধূরা, মায়েরা, কিশোরী কন্যারা। আর শিশুরা নেচে ওঠে মনের আনন্দে। হালকা বাতাসে বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে শুকনো পাতা। হৈ হৈ করে শিশুরা উঠোনে নেমে আসে। কিছুদিন ন্যাড়ামাথার যন্ত্রণা ভোগ করে এই হেমন্তেই আবার জেগে ওঠে নতুন পাতা। গাছগুলো সজ্জিত হয় নতুন পত্রপল্লবে। কী এক কচি আর মায়াভরা থাকে সে পাতায়। আর তাতেই শীতের আগমনী শিশির কুয়াশা জমে। কখনও মনে হয় এই বুঝি শীত। আসলে এটা শীতের পূর্বাভাসমাত্র।
ধানকাটা সারা হলে বাড়ির পুরুষরা তখন একটু বিরতি পায়। আর গিন্নিরা তখন বায়না ধরে বেড়াতে যাবার। বাবারা মেয়েকে চিঠি লেখে- মা রে কবে আসবি জামাইকে নিয়ে? নাতিদের নিয়ে? আগে তো কেউ কেউ চিঠির বদলে পালকিই পাঠিয়ে দিত। আর এই বেড়াতে যাওয়ার নাম ছিল নাইওর। আর যারা বেড়াতে যায় তারা নাইওরি। এই নাইওরি নিয়ে গ্রামীণ লোকশিল্পীদের অনেক গান আছে। পালা আছে। একটি বিখ্যাত বাউল গান আছে- ‘নাইওরি নাইওর হলো শেষ/এইবার চলো নিজের দেশ।’ এটা কিন্তু নাইওরি অর্থাৎ যে মেয়ে হেমন্তে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে তাকে উদ্দেশ করে গাওয়া হলেও বাউল গানের আধ্যাত্মিক অর্থ কিন্তু ভিন্ন। এই নাইওরি মানে শুধু বাপের বাড়ি কিছুদিনের জন্য বেড়াতে আসা মেয়ে-জামাই-নাতি নয়। বরং এই নাইওরি মানে দু’দিনের পৃথিবীতে মানুষের বেড়াতে আসার কথাই মনে করিয়ে দেয় বাউল গানের মাধ্যমে। সেই গানের মাঝেই বয়াতি আবার এর অর্থ করে দেয় ঠিক নাইওরির মতো কয়েক দিনের অতিথি আমরা দুনিয়াতে, যেদিনে আল্লাহপাক ডাক দিবেন- ‘নাইওরি নাইওর হলো শেষ/এইবার চলো নিজের দেশ।’ তখন কিন্তু আমাদের সকলকে আসল দেশে পাড়ি দিতে হবে। এভাবেই আধ্যাত্মিক আনন্দ বেদনার রসে ভরে ওঠে গ্রামের হেমন্তরাত।

হেমন্তে ফসল যেমন তার আসল লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, আপন ঘরে পৌঁছে যায়, তার মালিকের কাছে পৌঁছে যায় তেমনি মানুষও একদিন তার ক্ষেত ছেড়ে আপন ঘরে পৌঁছে যায়।
হেমন্তের শূন্য ক্ষেত দেখে কবিগুরু লিখেছিলেন-
আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।

কাজী নজরুল ইসলামও কিন্তু হেমন্তের দ্বিতীয় মাস অগ্রহায়ণের ঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত হননি। তিনি লিখলেন,
ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি- ধরণীর সওগাত?
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি, অঘ্রাণ হ’ল মাৎ।
বিন্নি-পাগল চালের ফিরনি-
তশতরী ভরে নবীনা গিন্নি-
হাসিতে, হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত-
শিরনী রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ী- গন্ধে তেলেসমাত!
মিঞা ও বিবিতে- বড় ভাব আজি, খামারে ধরে না ধান-
বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে, চাপা সুরে গাহে গান!
ধান ভানে বৌ, দুলে দুলে ওঠে- রূপ-তরঙ্গে বান!
বধূর পায়ের পরশে পেয়েছে, কাঠের ঢেঁকিও প্রাণ।
হেমন্ত-গায়, হেলান দিয়ে গো- রৌদ্র পোহায় শীত-
কিরণ-ধারায় ঝরিয়া পড়িছে, সূর্য-আলো-সরিৎ!
‘মুজদা’ এনেছে অগ্রহায়ণ-
আসে নৌরোজ খোল গো তোরণ,
গোলা ভরে রাখ, সারা বছরের- হাসি-ভরা সঞ্চয়-
বাসি বিছানায় জাগিতেছে শিশু- সুন্দর নির্ভয়।।

কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে হেমন্ত ছিল বিষণœতার ঋতু। তার কবিতা পড়লে মনে হবে হেমন্তের রূপময়তায় তিনি মৃত্যুর আহ্বান খুঁজে পেতেন। হেমন্তের পাতাঝরার দৃশ্য যেন তার কাছে ছিল জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া। লিখলেন-
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে।

আবার লিখলেন-
যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে- ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়,
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,
শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-
তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,
তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,
যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-
কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান-
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান-

পল্লীকবি জসীম উদ্দীনও হেমন্তকে এড়িয়ে যাননি। তিনি লিখলেন-
আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।
হেমন্তে বেশকিছু ফুল ফুটতে দেখি আমরা। কিন্তু বিশেষ ফুলটির কথা আমরা মোটেও ভুলতে পারি না। শিউলি ফুলের কথা। কী যে সুন্দর আর সুবাসে ভরা এই ফুল। কিন্তু এর জীবনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত। হেমন্তের এই ফুলটাও যেন মনে করিয়ে দেয় দেয় জীবনের স্বল্প পরিধিকে। শিউলি ছাড়াও ফোটে কামিনী, জবা, গোলাপ, মল্লিকা ফুল। কিন্তু ফলের কথা বলতে গেলে কামরাঙা আর চালতার কথাই মনে পড়ে। চালতা তো খুব একটা আদরণীয় ফল নয়। খুব টক। তবে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ চালতার আচার করে, ডালে দিয়ে খায়। আদর কম বলে দামও কম।

আগেকার দিনে বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন ধানের গাছ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক মাসে ধান পরিপক্ব হয়। কৃষকেরা এই সময় খুশিমনে পাকাধান কেটে ঘরে তোলে। নতুন ধানের পিঠা-পুলি আর খেজুরের রসে রসিয়ে রসিয়ে প্রয়োজন মতো আয়োজন করে নবান্ন উৎসব।
আর যখন হঠাৎ গান ভানতে ভানতে পালকি নিয়ে হাজির হতো বেয়াড়া তখন কী আনন্দটাই হতো সবার। বিশেষ করে ছোটদের। নানা বাড়িতে বেড়াতে যাবার আনন্দ, পালকিতে চড়ার আনন্দ। পিঠা পুলির আনন্দ। আনন্দ আর আনন্দ। আগের দিনে মানুষ কতোই না আনন্দে সময় কাটাতো! তাই বুঝি এই গানটি গাওয়া হতো- ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/গ্রামের নওজোয়ান-হিন্দু মুসলমান,/মিলিয়া বাউলা গান আর মুরশিদী গাইতাম…।/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম… আমরা…।’
আসলে হেমন্ত হোক, শীত হোক, বসন্ত হোক, প্রকৃতির যে সাজসজ্জাই হোক না কেন তা যেন মহান সৃষ্টিকর্তারই কোনও না কোনও নিদর্শন। প্রকৃতির পরতে পরতে যেমন নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তেমনি নিদর্শনের মাঝে লুকিয়ে আছে দর্শন। দর্শন হলো তাই যা সবাই দেখে না। কেউ কেউ দেখে। যাদের সেই বিশেষ দেখার ক্ষমতা আছে তারাই দার্শনিক। কবিরা সেই দার্শনিকদেরই প্রতিনিধি। তাই বাউলের গানে, কবিদের কবিতায় সৃষ্টি রহস্যের, প্রকৃতি ও ঋতুরহস্যের অনেক দর্শন ফুটে ওঠে। তাই কখনও ‘নাইওরি নাইওর হলো শেষ,/এবার চলো নিজের দেশ’ -গানের মাঝে কেউ ভাবে নাইওরি বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর কেউ ভাবে এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে হবে।… তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাওয়ার প্রস্তুতি কিন্তু নিতে হবে। তা সে প্রভুর কাছেই হোক আর নাইওরির বাপের বাড়ি ছেড়েই হোক। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

Share.

মন্তব্য করুন