নর্দার্ন ব্যাল্ড আইবিস এক ধরনের বিলুপ্তপ্রায় পরিযায়ী পাখি। কোথাও কোথাও এদের ওয়ালড্রাপ নামেও ডাকা হয়। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৭০০ শতকের দিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডে এদের ঝাঁকে ঝাঁকে দেখতে পাওয়া যেত। পরবর্তীতে এদের স্থান ছিল শুধু চিড়িয়াখানায়। এরপর একদিন আচমকাই দেখা গেল অন্যরকম দৃশ্য। পাখিগুলো নিজের পথ চিনে নিতে পারছে না। ইউরোপ ছাড়াও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ও পশ্চিম এশিয়ায় পাওয়া যেত এদের। কিন্তু সেখান থেকে ইউরোপে যেতে পারছে না তারা।
অন্যান্য পাখির মতো এই পাখি গাছে বাস করতে পছন্দ করে না। পাখিটি জঙ্গলে, মরুভূমির কিছু কিছু শুষ্ক অঞ্চলে, পাথরে এবং কোনো পুরনো কেল্লার খোঁপে বাসা বাঁধে।
নর্দার্ন ব্যাল্ড আইবিস আকারে বেশ বড়, ওজনেও ভারী। এর সারা দেহ কুচকুচে কালো, আবার গায়ের কোথাও কোথাও লাল ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। মুখম-ল লাল আর মাথার দিকে কালো ঝুঁটি রয়েছে। এর পাগুলো ছোট এবং হালকা লাল রঙের। প্রাপ্তবয়স্ক আইবিস পাখির লম্বা বাঁকানো ঠোঁট, পালকে নীল-বেগুনি ভাব থাকে। এরা ৭০-৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়, পাথরে খাঁজে বা কোনো পরিত্যক্ত দুর্গের কোটরে বছরে ২-৩টি ডিম পাড়ে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, টিকটিকি জাতীয় ছোট ছোট প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য।
জানা যায়, সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডের মতো ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অঞ্চলে এই পাখি দেখতে পাওয়া যেতো। ১৫৫৭ সালে সুইস প্রকৃতিবিদ কনরাড জেসনার তার পাঁচ খ-ে রচিত ‘হিস্ট্রি অব অ্যানিমেলস’ বইয়ে উল্লেখ করেন যে, প্রচুর সংখ্যায় জেরোনটিকাস এরেমিতা বা আইবিস পাখিকে আল্পস পর্বতের চূড়ায় উড়তে দেখা গেছে।
পাখিটি বর্তমানে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে দক্ষিণ মরক্কোতে এই প্রজাতির ৫০০টির মতো পাখি রয়েছে। ২০০২ সালে সিরিয়াতে ১০টির মতো নর্দার্ন ব্ল্যাডের ছোট্ট একটি প্রজনন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে লেবাননের দ্য সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অফ ন্যাচার কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আইএস-এর আক্রমণের পর থেকে এই পাখিদের কোনো প্রজাতি সিরিয়ার কোনো অঞ্চলেই আর দেখা যায়নি।
এবার পাখিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন একদল বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বহু বছর ধরে ওই পাখিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আসলে শিকার ও মারাত্মক শীতল আবহাওয়ার কারণে এরা ইউরোপ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। আইবিসকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন পাখিবিশারদ করিন্না ইস্টেরার। তার সঙ্গে আছেন আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী। এবার আইবিস পাখিকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা ওয়ালড্রাপ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পের আওতায় পাখিদের বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে তাদেরকে কিভাবে পুনরায় ইউরোপে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। বর্তমানে ইউরোপের একটি চিড়িয়াখানায় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই পাখির সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৮৪টির মতো আইবিস পাখি রয়েছে।
ওয়ালড্রাপ প্রকল্পের আওতায় পাখিদের পথ চিনিয়ে ইউরোপে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ২০০১ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন জীববিজ্ঞানী জোহানেস ফ্রিৎজ। তার নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবক পাখিগুলোর পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব নিয়েছেন। চিড়িয়াখানায় জন্মানো পাখিগুলোকে ইউরোপের বন্য জীবনধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ ও তার দলের একমাত্র লক্ষ্য।
প্রথমবার ২০০১ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনরাড লোরেনজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে আইবিস পাখির একটি দলকে ইউরোপের দক্ষিণে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ফ্রিৎজ লক্ষ করলেন পাখিদের যাত্রাপথটি ভুল দিকনির্দেশ করছে।
পাখিদের পরিযায়ী পথ তৈরি করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। কারণ পাখিরা তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য কোন পথটি ব্যবহার করবে, তা প্রমাণিত নয়। তখনও আইবিস পাখির পরিযায়ী পথ কোনটি, তাও নির্দিষ্ট করতে পারছিলেন না ফ্রিৎজ ও ওয়ালড্রাপ প্রকল্পের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।
২০০৪ সালে এসে তারা সফল হন। এই সময় ফ্রিৎজ ও তার দল আইবিস পাখির একটি পালকে পথ চিনিয়ে ইউরোপে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। শেষ পর্যন্ত সেই পরিযায়ী পথটি আইবিস পাখিদের পরিযায়ী পথ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
পাখিদের এই পথ চিনিয়ে দেয়ার কাজে আধুনিক প্রযুক্তির মাইক্রোলাইট বিমান ব্যবহার করা হয়। এই বিমানগুলো পাখিদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে। এই পথ ব্যবহার করে পাখিগুলো যেন পাড়ি দিতে পারে ইতালি, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য শহরগুলোয় তার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কোনও পাখি পথ হারিয়ে অন্যত্র যাতে চলে না যায়, তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে জিপিএস ট্র্যাকার। কিন্তু জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেক বিজ্ঞানী।
কিছু পাখি মাইক্রোলাইট বিমানের পথ অনুসরণ করে তার গন্তব্যে ফিরে যেতে পেরেছে, আবার কিছু পাখি পুনরায় তার পূর্বের জায়গায় ফিরে এসেছে। বিজ্ঞানীরা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এভাবে বেশ কিছু পাখিকে ইউরোপে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
২০১১ সালে একটি আইবিস পাখি তাসকেনিয়ার পথে উড়ে যেতে সক্ষম হয় এবং সে আবার সেখান থেকে দক্ষিণ জার্মানির বার্গোসেনে ফিরেও আসে। ২০১২ সালে এক শিকারি পাখিটিকে মেরে ফেলে। কিন্তু পাখির এই পরিযায়ী পথটি সঠিক ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
২০১০ সালে ২৯টি পাখিকে পৃথকভাবে মাইক্রো ফ্লাইটের সাহায্যে তার গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এভাবে ফ্রিৎজ ৮৪টি পাখিকে পথ চিনিয়ে অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
প্রকল্পটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছিল। ফ্রিৎজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে প্রকল্পটি আবার নতুনভাবে চালু করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেন, যাতে করে ৫০০ আইবিস পাখিকে ২০৫৭ সালের মধ্যে ইউরোপে স্থানান্তর করা যায়।
অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠবে নর্দার্ন আইবিস ব্ল্যাডের আবাসস্থল। আবারও আল্পস পাহাড়ের চূড়ায় আইবিস পাখির ঝাঁককে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী সবাই।

Share.

মন্তব্য করুন