সকাল সকাল চন্দনের মা ঠাকুর বাড়ির উঠোনে এসে তার মাইকের মত গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘নীলমতি দিদি, ও নীলমতি দিদি, বলি ঘরে আছো? শুনে যাও, তোমার আদরের ছেলের কা-খানা একবার শুনে যাও।’
এই বলে চন্দনের মা বাড়ির উঠোনে একটা লঙ্কাকা- শুরু করে দিলো। চন্দনের মা যার নাম ধরে ডাকছে সে এই বাড়ির বড় বউ। তার শরীরটা আজ খুব খারাপ। তাই ঘর হতে বের হয়নি আজ। চন্দনের মার গলা শুনে তার বুকটা কেঁপে উঠলো। নিশ্চয় অভাগা আবার কোনো কা- ঘটিয়েছে। অভাগা নীলমতির একমাত্র আদরের সন্তান বলা চলে। দীর্ঘ বারো বছর পর এই অভাগার মুখে নীলমতি মা ডাক শুনেছে। অভাগা তার নিজের পেটের সন্তান না হলেও, নিজের সন্তানের মতো করেই বড় করেছে। তাকে বুঝতে দেয়নি যে, সে তার নিজের পেটের সন্তান না। এই একটি মাত্র মানুষ যে অভাগাকে নিজের করে নিয়েছে। কারণ, দীর্ঘ বারো বছর সন্তানের সুখ পাবার জন্য কতই না চেষ্টা করেছে নীলমতি। কতই না কবিরাজ, বদ্দি, পীর, ফকির দেখিয়েছে। কিন্তু কোনো ভাবেই সে মা হতে পারেনি। এদিকে স্বামী দেবচন্দ্র উঠতে বসতে নীলমতিকে কথা শোনাতো। জীবনটা তার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো পরিবারের মানুষের মুখে কটু কথা শুনতে, আর সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে না পাওয়ার জন্য। দিন-রাত একটি সন্তানের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো। হাজার ডাকেও ঈশ্বর নীলমতিকে মা ডাক শোনালো না।

এমন সময় মাঘ মাসের এক সকাল বেলা গ্রামে এক ঘটনা ঘটে গেলো। কে বা কারা গ্রামের দক্ষিণের বড় বট গাছটির নিচে একটি বাচ্চাকে ফেলে রেখে গেছে। বাচ্চাটি কার, সেটার কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো বাচ্চাটির দায়িত্ব নেয়া থেকে বাঁচার জন্য, কিংবা নিজের পাপ মানুষের কাছে লুকানোর জন্যই এই নিষ্পাপ শিশুটিকে ফেলে রেখে গেছে কেউ। এইদিকে বাচ্চাটি প্রচ- শীতে আর অনাহারে কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে দিয়েছে। মাঘ মাসের কনকনে শীতে বাচ্চাটিকে কেউ কোলে তুলে নেয়নি। যেমনটি গাছের নিচে পড়ে ছিল তেমনটিই পড়ে আছে। আজ যে চন্দনের মা অভাগার নালিশ নিয়ে এসেছে, সেই চন্দনের মা নীলমতিকে এসে বাচ্চাটির খবর দিয়েছিলো সেইদিন। চন্দনের মার মুখে বাচ্চাটির কথা শুনে নীলমতির খুব মায়া হয়েছিলো। সে শুনে আর চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারেনি। চন্দনের মাকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলো সেখানে এবং পরম যতেœ কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো বাচ্চাটিকে। তার কাছ হতেই মা হওয়ার সাধ পেয়েছে নীলমতি। বারো বছর ধরে সন্তানের যে আকাক্সক্ষা ছিল, বাচ্চাটিকে পেয়ে তার সব আশা-আকাক্সক্ষা পূর্ণ হল। তবে রাস্তা থেকে একটা বাচ্চা তুলে আনা নীলমতির বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারেনি। এমনকি তার স্বামী দেবচন্দ্রও না। উঠতে বসতে স্বামীসহ পরিবারের সকলের কাছে লজ্জিত হয়েছে হাজার। তবুও, বাচ্চাটিকে কোল থেকে ফেলে দেয়নি নীলমতি। কারণ একজন নিঃসন্তান মা’ই বোঝে সন্তান না থাকার ব্যথা। তাই সে বাচ্চাটিকে মানুষ করে তার সন্তানের অভাব পূর্ণ করতে চেয়েছে। বর্তমানে সেই বাচ্চাটি দশ পেরিয়ে এগারো বছরে পা দিয়েছে। সবাই তাকে অভাগা বলেই ডাকে। যেমনি খুব সাহসী, তেমনি খুব দুষ্টু আর জেদিও বটে। সারা গ্রাম ঘুরে কোথায় কার নারিকেল গাছ আছে তা থেকে নারিকেল চুরি করা, পেয়ারা বাগান হতে পেয়ারা চুরি করা, গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে দল বেধে খেজুুর রস চুরি করে খাওয়া তার দৈনন্দিন কর্মকা-। এমন কোনো দুষ্টামি নেই যা অভাগা করে না। এক কথায় সারা গ্রাম মাথায় করে রাখে সে। প্রতিদিন নীলমতির কাছে কেউ না কেউ তো আসেই অভাগার বিপক্ষে নালিশ নিয়ে। আজ হয়তো চন্দনের মা কোনো নালিশ নিয়ে এসেছে। এই ভেবে নীলমতি ঘর হতে বের হয়ে উঠোনে আসতে আসতে বলল, ‘কি হয়েছে, এতো সকাল সকাল চেঁচামেচি করছিস কেনো?’
নীলমতির এই কথাটি বলার সাথে-সাথেই চন্দনের মা নীলমতির দিকে চেয়ে বলল, ‘কি আর হবে গো দিদি! তোমার আদরের ছেলে অভাগা, কা-খানা কি করেছে তা কি জানো? আজ সক্কাল সক্কাল পাড়ার বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে আমার পেয়ারা গাছটি হতে সব পেয়ারা চুরি করে পেড়ে নিয়ে গেছে। কত শখ করে উঠোনের এক কোণে গাছটি লাগিয়েছিলাম। এবারেই প্রথম গাছটিতে কয়েকটা ফল ধরেছিলো। আর ওই অভাগা সবক’টা পেড়ে নিয়ে গেছে একটিও রাখেনি। এই অভাগার জ¦ালায় আর পারছিনে। আজ এর একটা বিহিত করতে হবে তোমাকে।’
নীলমতি চন্দনের মার কথার আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। চন্দনের মার কথা চুপটি করে শুনে থাকলো আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, অভাগা আসুক তার একটা বিহিত সে আজ করবে। রোজ রোজ কারো না কারো নালিশ শুনতে তার আর ভালো লাগে না। আর এদিকে চন্দনের মা অভাগার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ করে ঠাকুর বাড়ি মাথায় করে রেখেছে। বাড়ির উঠোনে এমন চেঁচামেচি শুনে বাড়ির মেজো বউ, সেজো বউ এবং নীলমতির শাশুড়ি এসে হাজির। মেজো বউ তো এসেই নীলমতিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো, ‘এ আর নতুন কি কা-! এতো প্রতিদিনের কথা। কেউ না কেউ তো এসেই চলেছে নালিশ নিয়ে।’
মেজো বউ এর কথা শেষ না হতেই ছোটো বউ বলে উঠলো, ‘বাড়িতে জাতপাতহীন, বংশ পরিচয়হীন কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে থাকলে তো প্রতিদিন এমন নালিশ আসতেই থাকবে গো মেজো দিদি। বাড়িতে তো আরো ছেলে-পুলে রয়েছে, তাদের নিয়ে তো এমন নালিশ আসে না। সব নালিশ ওই অভাগার উপর। কে জানে, কোন না কোন ধর্মের ছেলে! বাড়িতে তুলে এনে বাড়ির মান-ইজ্জত সব মাটিতে মিশিয়ে দিলো।’
কথাগুলো বলে ছোটো বউ নীলমতির উপর তার কিছুটা ঝাল মিটালো। বাড়ির সবাই সুযোগ পেলেই নীলমতির বিরুদ্ধে লেগে পড়ে। কারণ ওই একটাই, জাতপাতহীন অভাগাকে ঘরে তুলে আনা। অভাগাকে নিয়ে কোনো বিষয় পেলে তার আর ছাড় নেই। অভাগার বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বলে নীলমতির মাথাটা গরম করবেই। বিশেষ করে মেজো বউ এবং ছোটো বউয়ের কাছে অভাগা যেন, চক্ষুশূল। নীলমতি মেজো ও সেজো বউ এর জ্বালাময়ী কথায় ভেতর হতে জ্বলে-পুড়ে গেলো। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, আজ বড় শাস্তি দেবে অভাগাকে। এই ভাবতে ভাবতে নীলমতি ঘরে চলে গেলো। কারণ, আজ তার শরীরটা ভীষণ খারাপ। দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে করছে না তার।
এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো, তবুও অভাগার বাড়ি ফেরার কোনো খবর নেই।

নীলমতি সেই সকাল হতে তার অপেক্ষা করছে, কিন্তু সে এখনো বাড়ি ফিরেনি। নীলমতি ছাড়া তার বাড়ি ফেরা না ফেরা নিয়ে চিন্তা করার মতো কেউ নেই এই বাড়িতে। এই একটি মাত্র মানুষ যে অভাগার কথা ভাবে। হয়তো এই বিশাল পৃথিবীতেই কেউ নেই অভাগাকে নিয়ে ভাবার। এমন সময় অভাগা এসে হাজির। এসেই মা নীলমতিকে জড়িয়ে ধরে হাতে দু’টো পেয়ারা দিয়ে বলল, ‘মা, আমি তোমার জন্য পেয়ারা এনেছি। তুমি খাবে? পাকা পেয়ারা, তুমি খেলে তোমার ভালো লাগবে।’
এই কথা শুনে নীলমতির সকালের কথা মনে পড়ে গেলো। অভাগার উপর প্রচ- রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, পেয়ারা কোথায় পেয়েছিস বল? চুরি করেছিস?’
অভাগা মায়ের কাছে কখনো মিথ্যে বলে না। সে ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘হ্যাঁ মা, আমি চুরি করেছি। চন্দনদের গাছ থেকে লুকিয়ে পেড়েছি। চাইলে দিতো? তুমিই বলো। দিতো না, তাই চুরি করে পেড়েছি।’
নীলমতি ছেলের কথা শুনে আরো খেপে গিয়ে বলল, ‘চুরি করেছিস! আমার জন্য পেয়ারা চুরি করে এনেছিস তাই না! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। এই বলে নীলমতি অভাগার গালে কয়েকটা চড় দিতে দিতে টেনে নিয়ে গেলো উঠোনের আমড়া গাছটির নিচে। সেখানে নিয়ে তাকে একটি রশি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে ফেললো, আর মনের মধ্যে চাপা কষ্ট নিয়ে বলতে লাগলো, ‘চুরি করেছিস তাই না, আমার জন্য পেয়ারা চুরি করে এনেছিস!’
এই কথা বলতে বলতে নীলমতি অভাগার এনে দেয়া পেয়ার দুটো উঠোনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লো। সে আর কথা বলতে পারছে না। তার সমস্ত শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। নীলমতি আজ অনেক কষ্ট পেয়েছে। এদিকে অভাগা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে,
মা, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও মা, আর কখনো চুরি করবো না।
ঘর থেকে নীলমতি অভাগার আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে। অভাগার এমন আর্তনাদে নীলমতির বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, তবুও আজ সে অভাগাকে কঠিন শাস্তি দেবে। আজ আর তাকে খাবার তো দূরের কথা এক ফোটা জলও দেবে না। এটাই তার শাস্তি। এমন শাস্তি অভাগাকে নীলমতি কখনো দেয়নি।
এদিকে অভাগা কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তাই কান্নার সুরও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এক সময় কান্না থেমে গেলো, তবুও নীলমতি অভাগার বাঁধন না খুলে অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে রইলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে নেমে এলো, কিন্তু কেউ এলোনা অভাগার বাঁধন খুলে দিতে। সারাদিন অনাহারে আমড়া গাছের নিচেই বাঁধা রইলো। বাড়ির একটা মানুষের মনেও অভাগার জন্য মায়া হলো না। এদিকে কেঁদে কেঁদে অভাগা গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলমতিও অভাগাকে না খাইয়ে কখনো খায়নি, তাই আজো না খেয়ে নিরবে বসে চোখের জল ঝরাচ্ছে। এক ফোটা জলও মুখে দেয়নি নীলমতি। কি করে দেবে! এক মাত্র আদরের সন্তান, অভাগাকে না খাইয়ে মা কখনো খেতে পারে! অভাগাই তো তার একমাত্র আপনজন এই পৃথিবীতে। যে-যাই বলুকনা কেনো, নীলমতির কাছে অভাগা পেটের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ছেলের কথা চিন্তা করে নীলমতির শরীরটা আজ আরো বেশি খারাপ লাগছে। নীলমতি নিজেও জানে না, এই মরণ ব্যাধি ক্যান্সার নিয়ে কতদিন আর এই পৃথিবীতে থাকবে। হয়তো আর বেশিদিনের যাত্রী নয় সে। তবে তার আজ চিন্তা হচ্ছে অভাগাকে নিয়ে। চিন্তা তার একটাই, সে চলে গেলে অভাগার পাশে কে থাকবে? তার যে আপন বলতে কেউ নেই এই স্বার্থপর জগতে। এসব ভাবলে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে নীলমতির। বড় অভিমান করেই আজ অভাগাকে এমন শাস্তি দিয়েছে। অবশেষে,সন্ধ্যা বেলা চোখ মুছতে মুছতে নীলমতি বিছানা থেকে নেমে, ধীরে ধীরে গিয়ে পাশের টেবিলে কাজের মেয়ে অঞ্জনার রেখে যাওয়া ভাতের থালাটা নিয়ে অনেক কষ্টে ঘর হতে বের হলো, ছেলেকে খাওয়াবে বলে। ঘর থেকে বেরিয়েই আঙিনার আমড়া গাছের দিকে তাকিয়ে নীলমতি দেখলো, অভাগা সেখানে নেই। তাকে যে রশিটা দিয়ে বেঁধেছিলো, শুধু সেই রশিটা পড়ে আছে। অভাগাকে না দেখতে পেয়ে নীলমতির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই সন্ধ্যা বেলায় সে কোথায় গেলো! আর, তার বাঁধন বা কে খুলে দিলো?
এসব ভাবতে ভাবতে নীলমতি কাজের মেয়ে অঞ্জনাকে ডাক দিলো। নীলমতির ডাক শুনে অঞ্জনা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে বলল,
-কি হয়েছে দিদি?
নীলমতি এক হাতে অভাগার জন্য আনা ভাত আর, এক হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
-অভাগাকে দেখেছিস? ও এখানেই তো আমড়া গাছের সাথে বাঁধা ছিলো।
অঞ্জনা জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। অঞ্জনার মুখ দেখে নীলমতি কিছু আঁচ করতে পেরে অঞ্জনার খুব কাছে গিয়ে বলল,
-কি হয়েছে অভাগার? চুপ করে আছিস কেনো?
অঞ্জনা মাথা নিচু করেই ভয়ে ভয়ে বলল,
-কিছুক্ষণ আগে আপনি যখন ঘরে শুয়ে ছিলেন,তখন দাদা ভাই অভাগাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আর বলেছে, ও এই বাড়ির কেউ না। আপনিও ওর মা না, তাই ও যেন এই বাড়িতে আর ফিরে না আসে।
অঞ্জনার কথা শুনে নীলমতির মাথায় যেনো বাজ পড়লো। তার হাতে ভাতের যে থালাটি ছিলো, সেটা সে আর ধরে রাখতে পারলো না। থালাটি হাত থেকে পড়ে গড়িয়ে আঙিনার মধ্যে গিয়ে থামলো।
কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার নেমে এলো। চারদিকে ঝিঝি পোকার ডাক, আর জোনাকির আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। অভাগা নদীর পাড়ে জড় বেরিয়ে থাকা একটি বট গাছের গোড়ায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। অন্ধকারে একা থাকতে সে খুব ভয় পাই। কিন্তু,আজ তার মনে কোনো ভয় নেই। কষ্টে আর দুঃখে ভয় হারিয়ে গেছে মন থেকে। এই একাকি শুনশান অন্ধকারে বসে শুধু তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। কারণ, মা ছাড়া কে আছে তার এই দুনিয়াতে! তার খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু, তাকেতো বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আরো বলেছে, ও ওই বাড়ির কেউ না। এসব ভাবতে ভাবতে অভাগা বটগাছের জড়ের উপর বসেই ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকাল বেলা খুব ভোরে পরিচিত একজনের ডাকে ঘুম ভাঙলো অভাগার। ঘুম থেকে জেগে দেখে, নিমাই কাকু তার সামনে দাঁড়িয়। নিমাই ঠাকুর বাড়ির একজন কাজের লোক। অভাগা তাকে নিমাই কাকু বলেই ডাকে। নিমাইকে দেখে অভাগা খুব খুশি হয়ে বলল,
-নিমাই কাকু, তুমি আমাকে নিতে এসেছো তাইনা? মা নিশ্চয় তোমাকে পাঠিয়েছে, আমাকে নিয়ে যাবার জন্য! আমি জানতাম, মা কাওকে না কাওকে পাঠাবেই আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। মা আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। জানো,আমি সারারাত এই গাছ তলায় কাটিয়েছি। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছিলো আমার। চলো আমি মায়ের কাছে যাবো, মা আমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।
এই বলে অভাগা মায়ের কাছে যাবার জন্য নিমাই কাকুর হাত ধরে টানতে শুরু করলো। কিন্তু, নিমাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন সে পাথর হয়ে গেছে। নিমাই কাকুর এই নিরবতা দেখে অভাগা বলল,
-কাকু, তুমি চুপ করে আছো কেনো, বাড়ি যাবে না? বুঝেছি, মা আমাকে নিতে পাঠায়নি। মা আমার উপর এখনো খুব রাগ করে আছে তাই না?
নিমাই আর চুপ থাকতে না পেরে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
-হ্যা ‘রে অভাগা, তোর মা তোর উপর ভীষণ রাগ করে আছে। আর কোনো দিন তোর মা তোকে অভাগা বলে ডাকবে না, তার নিজ হাতে তোকে আর খাইয়ে দেবে না। অভাগাদের কপালে সুখ সয়নারে। অভাগারা চিরকাল অভাগাই থাকে। নীলমতি দিদি একদিন তোকে গাছ তলা থেকে তুলে এনে বুকে ঠাই দিয়েছিলো। মাতৃ স্নেহ দিয়ে তোর মায়ের অভাব পূর্ণ করেছিলো,সাথে তার সন্তানের অভাবটাও ভুলে গেছিলো। আজ আবার তোকে গাছতলাতেই রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে তোর মা। মায়ের সুখ তোর কপালে নেইরে অভাগা। কাল তোকে কতই না খুজলাম, কিন্তু কোথাও পেলাম না। শুধু একটিবার তোকে দেখার জন্য,বুকে জড়িয়ে আদর করার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো, তা আর হলো না। ঐযে দেখ, দূরে দেখা যাচ্ছে তোর মায়ের জ্বলন্ত চিতা। অভাগা ছলছল চোখে ঐ দূরে যেখানে তার মায়ের চিতা জ্বলছে, সেই দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

Share.

মন্তব্য করুন