ক্রিকেটে তিন অঙ্ককে বলা হয় ম্যাজিক ফিগার। একজন ব্যাটসম্যানের জন্য এক শ’ রান বা সেঞ্চুরি তাই একটি বড় অর্জন। এবার তোমাদের জানাবো ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম দুই সেঞ্চুরিয়ানের কথা। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচটি খেলে ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে। সেই ম্যাচে ইমরান খানের শক্তিশালী ও তারকাসমৃদ্ধ পাকিস্তান দলের কাছে ৯৫ রানে অলআউট হয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটের নবীন দলটি। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৩৭ রান করেছিলেন শহীদুর রহমান। চার বছর পর বাংলাদেশ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। ১৯৯০ সালের এপ্রিলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৪ রান করলেন আজহার হোসেন। তখন অবশ্য বাংলাদেশ বছরে ম্যাচই খেলতে পারতো হাতে গোনা দু’একটি।
পরের কয়েক বছরে আরো কয়েকটি হাফ সেঞ্চুরি এসেছে। বাড়তে থাকে ব্যক্তিগত রানের সংখ্যাও। ১৯৯০ সালে আতহার আলী খান কলকাতার ইডেনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৮ রানের ইনিংস খেলেন। সাত বছর পর ১৯৯৭ সালে কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আরেকটি ইনিংস খেলেন ৮২ রানের তিনি। আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে ক্রিকেটারদের, আর তার সাথে প্রত্যাশা বাড়তে থাকে সমর্থকদের। সেই প্রত্যাশা সেঞ্চুরির। কবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করবে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান?
দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ঢাকায় মেরিল ত্রিদেশীয় সিরিজের এক ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে স্বপ্নের খুব কাছে গিয়ে ফিরে আসতে হয় ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎকে। আক্ষেপে পোড়েন দর্শক-সমর্থকরা। ব্যক্তিগত ৯৫ রানে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে আসেন বিদ্যুৎ। তাই হতে হতেও হলো না বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি। তবে অপেক্ষার পালা শেষ হয় সেই সিরিজেই। পাঁচ দিন পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচে স্বপ্ন পূরণ হয় মেহরাব হোসেন অপির ব্যাটে। সেই সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটে সমীহ জাগানিয়া দল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপি খেলেন ১১৬ বলে ১০১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। অপি-বিদ্যুৎ সেদিন উদ্বোধনী জুটিতে তুলেছিলেন ১৭০ রান। ব্যক্তিগত ৬৮ রানে বিদ্যুৎ আউট হয়ে গেলেও অপি পৌঁছে যান তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে। হয়ে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। ৯টি চার ও দুটি ছক্কার মার ছিলো তার ইনিংসে। সে ম্যাচে আগে ব্যাট করে ৫০ ওভারে বাংলাদেশ তুলেছিল ৫ উইকেটে ২৫৭ রান। তবু এন্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, এলিস্টার ক্যাম্ববেলদের কাছে টাইগাররা ম্যাচ হেরেছিল ৩ উইকেটে।
এই ঘটনার পর আজ পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা মোট সেঞ্চুরি করেছে ৫৭টি। সবচেয়ে বেশি তামিম ইকবালের ১৩টি। এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে। এক সময় সেঞ্চুরির সংখ্যা শতক, হাজার ছাড়িয়ে যাবে; কিন্তু মেহরাব হোসেন অপির নামটি প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে রেকর্ড বইয়ে।

সাদা পোশাকে আমিনুল ইসলাম
১৯৯৯ বিশ্বকাপে দুটি জয় পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ দ্রুত টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে। অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হয় দেশের ক্রিকেটার-কর্মকর্তা-দর্শক সবার। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত আঙ্গিনায় পা রাখে বাংলাদেশ দল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক। সেই ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেন নাইমুর রহমান দুর্জয়। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান তোলে বাংলাদেশ। টেস্ট পরিবারের নতুন এক সদস্য দলের জন্য যা ছিল অনেক বড় পাওয়া। আর সেই বড় স্কোরের রূপকার ছিলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ৪৪ রানের মধ্যে দুই ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি ও শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ফিরে যাওয়ার পর দিনের প্রথম সেশনেই ক্রিজে আসেন বুলবুল। একের পর এক ব্যাটসম্যানের সাথে জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন, সেই সাথে বাড়তে থাকে তার ব্যক্তিগত রান। শুরু থেকেই দারুণ দক্ষতা আর পুরোপুরি টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করতে থাকেন। হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ১৭৯ বল খেলে। এরপর প্রথম দিন পুরোটা ব্যাটিং করে দিন শেষে অপরাজিত থাকেন ৭০ রানে। প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৬ উইকেটে ২৩৯ রান।
দ্বিতীয় দিন সকালে ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম সেশনেই পৌঁছে যান কাক্সিক্ষত ম্যাজিক ফিগারে। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি যেমন করেন, তেমনি অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারদের তালিকায়ও নিজেকে নিয়ে যান বুলবুল। ২৮২ বলে আসে তার সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত অজিত আগারকারের বলে জাভাগাল শ্রীনাথের ক্যাচে প্যাভিলিয়নে ফেরেন ১৪৫ রানে। পুরো স্টেডিয়াম তো বটেই ভারতীয় ফিল্ডারও এসে অভিনন্দন জানান বুলবুলকে। দারুণ ধৈর্যশীল ইনিংস খেলে প্রশংসা কুড়ান ক্রিকেট সমালোচকদেরও। তার ৩৮০ বলের ইনিংসটিতে ছিলো ১৭টি চার। ক্রিকেট ইতিহাসে এটি ছিলো কোন দেশের অভিষেক টেস্টে ব্যক্তিগত ইনিংসের হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার খুব বেশি অভিজ্ঞতা না থাকলেও ব্যাটিং করেছিলেন প্রায় ৯ ঘণ্টা। যার কল্যাণে বাংলাদেশ পায় ৪০০ রানের বিশাল সংগ্রহ।
যদিও টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি বাংলাদেশ। মাত্র ৯১ রানে অলআউট হয়ে ম্যাচ হারে চার দিনেই। সেটি অবশ্য অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণেই। বুলবুল দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ৬ রান। তবে প্রথম ইনিংসে যে কীর্তি তিনি গড়েছেন তা চিরদিন অমর হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসে।
এখন পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা সেঞ্চুরি করেছেন ৫৯টি। সবচেয়ে বেশি ৯টি করে মুমিনুল হক ও তামিম ইকবালের। এ প্রসঙ্গে তোমাদের জানিয়ে রাখি, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেছেন ওপেনার তামিম ইকবাল। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ভারতের ধর্মশালায়, প্রতিপক্ষ ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান। ৬৩ বলে অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তামিম। টেস্ট ও ওয়ানডের অনেক পরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রচলন হয়। আবার সেই সেঞ্চুরিটি যখন এসেছে ততদিনে বাংলাদেশ বিশ্বক্রিকেটে সমীহ জাগানিয়া দল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টেস্ট ও ওয়ানডেতে অনেকগুলো সেঞ্চুরি করে ফেলেছে। তাই হয়তো আগের দুটির মতো টি-টোয়েন্টির প্রথম সেঞ্চুরি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। তবে ফরম্যাটের হিসেবে কিন্তু রেকর্ড বইয়ে মেহরাব হোসেন অপি, আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পাশেই তামিম ইকবালের নাম লেখা থাকবে।

Share.

মন্তব্য করুন