বইয়ের মতো বন্ধু জগতে নেই আর। নেই এমন আনন্দের সঙ্গী। নীরবে-নিভৃতে একান্ত সাথী হয়ে বই ছাড়া কে আর জেগে থাকে সারারাত অথবা সারাটি দিন। এ কারণে টলস্টয় বোধ করি বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই আর বই।’ বই জগতের সমস্ত রহস্যের দুয়ার খুলে দেয়। দেখিয়ে দেয় প্রকৃতির যত আনন্দের দিক আছে। বই অতীতকে নিয়ে আসে বর্তমানের কাছে। বর্তমানকে নিয়ে যায় ভবিষ্যতের দরজায়। এভাবে কাল থেকে কালান্তরে বই একটি অখ- প্রবহমানতা নির্মাণ করে। টমাস কার্লাইল যদিও শুধু অতীতাশ্রয়ের কথা বলেছেন। বলেছেন- ‘বইয়ের মধ্যে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ অতীতের প্রতিচিত্র।’ হ্যাঁ, অতীত তো থাকেই। থাকবেই। কিন্তু বর্তমান? সেও কি থাকে না? নিশ্চয়ই থাকে। ট্রুপার সেই কথাই তো বলেছেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে- ‘একটি ভালো বই বর্তমান ও চিরদিনের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বন্ধু।’ এ বন্ধুকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার ভাগ্য জগতের সবার জোটে না।
বই যার বন্ধু হয় তার জীবনে হতাশা, দুর্দশা কিংবা নিঃসঙ্গতা প্রবেশ করে না কোনো দিন। আবরাহাম কাওলের কথা বলা যায়। তিনি বলেছেন- ‘আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু আমার বইগুলো। বই আমার কাছেই থাকে এবং আমাকে আলোর রাজ্যে নিয়ে যায়।’ সত্যিই তো বই মানুষকে আলোর রাজ্যে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় শান্তি ও সৌম্যের রাজ্যে। নিয়ে যায় সুখ ও প্রশান্তির দেশে। বই পাঠ করে কেউ অসুখী হয়নি। হয় না। এবং হবেও না। বরং বই পড়ে সুখী হওয়ার হাজার নয়, লাখো প্রমাণ রয়েছে। বই বেদনা ভুলিয়ে দেয়। আনন্দ জাগিয়ে দেয়। দূর করে হতাশার সমস্ত উৎসমুখ। বই মানুষকে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে শেখায়। মানুষকে মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার মন্ত্রণা দেয়। মানুষ বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠে সুন্দরের প্রতিনিধি হয়ে। উন্নত বোধ ও রুচির অগ্রপথিক হয়ে। বোধ ও রুচির বিষয়টি একজন মানুষের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে উন্নত করার মাধ্যম তো বই-ই।
বইয়ের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে ইতিহাস। ঘুমিয়ে থাকে সভ্যতার সমস্ত উদ্যান। ঘুমিয়ে থাকে প্রেম ও বিরহের সমস্ত কাহিনী। যারা বই পাঠ করেন তারা মূলত ইতিহাস জাগিয়ে তোলেন। সভ্যতা জাগিয়ে তোলেন। জাগিয়ে তোলেন প্রেম ও বিরহের আশ্চর্য সব ঘটনা। এ কারণে বই প্রেমিককে সুখের সৌধ দান করে, শক্তি জোগায় দুঃখের ভার বহন করার। হতাশার সমুদ্রে ডুবন্ত মানুষকে উপহার দেয় কূলের তরী। এ তরীর যাত্রীরা চিরকাল সুন্দরের সঙ্গী হয়ে যায়। হয়ে যায় কালের সাথী।
মনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর মাধ্যম তো বই-ই। বই বিনে কে এনে দেবে জীবনের গভীরতম সুখের সন্ধান। সুতরাং বই পাঠ করার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বই পড়তেই হবে। পড়ার বিকল্প তো পৃথিবীতে নেই। জানার জন্য যেমন পড়তে হবে, শেখার জন্যও পড়তে হবে। পড়তে হবে লেখার জন্যও। পাঠ জীবনেরই অনুষঙ্গ। পাঠহীন জীবন মৃত বৃক্ষের মতো। যার কা- রয়েছে; অথচ তা পল্লবহীন, শুষ্ক। পাঠ নেই তো জীবন নেই। পাঠহীন জীবন সঙ্কীর্ণতায় ছেয়ে যায়। উদারতা বসত করে না তার বুকের দেশে। স্বার্থপরতা বাসা বাঁধে সেখানে। পাঠবিমুখ মানুষের নিজেকেও আবিষ্কার করার সুযোগ ঘটে না। অন্যকে তো নয়ই। সমাজ, দেশের এবং বিশ্বের কাছে তার কোনো পরিচিতি দাঁড়ায় না। মহৎ হওয়ার কোনো বাসনাও জাগে না তার মনের কোণে। পিয়ারসন স্মিথ এ কথাই যেন বললেন এভাবে- ‘যে বই পড়ে না তার মধ্যে মর্যাদাবোধ জন্মে না।’ যার মর্যাদাবোধ নেই তার সম্মানবোধও থাকে না। সম্মান নেই যার সে কি সত্যিকারের মানুষ?
হয়তো কেউ বলতেই পারেন- হ্যাঁ, সেও মানুষ। তারও হাত-পা রয়েছে। মস্তক রয়েছে, চোখ-কান সবই তো মানুষের। তবে সে মানুষ নয় কেন? এ প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়ার নয়। সে তো আকৃতিতে নিশ্চয়ই মানুষ। কিন্তু শুধু শারীরিক মানুষ তো সত্যিকার মানুষ নয়। বিবেকবুদ্ধি, বোধবিশ্বাস, মনন ও মর্যাদা মিলেই তো একজন মানুষ। আর এসব তো রয়েছে বইয়ের বুকে। যিনি বই পড়লেন না তার কাছে এসবের আশা করার যৌক্তিকতা কোথায়। তাহলে বলতেই হবে আকৃতির কাঠামো দিয়ে কখনো মনুষ্য বিবেচনা করা চলে না।
মানুষ হতে হলে তাকে মানবিক গুণাবলী অর্জন করতেই হবে। থাকতে হবে মানুষের মৌলিক কিছু সৌন্দর্য। মানবিক গুণাবলী এবং সৌন্দর্য অর্জনের মাধ্যম বই ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। হ্যাঁ বইয়ের বাইরেও বিদ্যা অর্জন করে মানুষ। কিন্তু তার পূর্ণতার জন্য বইয়ের বিকল্প নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কী পাঠ করা যাবে! কী ধরনের বই পাঠ করা উচিত। কী পাঠ করা উচিত নয়। পৃথিবীতে এত বই প্রকাশিত, যার কথা ভাবলেও বিস্ময়ে নুয়ে থাকে ভাবনার শির। একজন মানুষের পক্ষে অসংখ্য বই পাঠ করা সম্ভব নয়। কেননা জীবন তো সীমিত আনন্দের দরজায় জেগে থাকে। সুতরাং বেছে নিতে হবে পাঠযোগ্য বই। বেছে বেছেই পাঠের কৌশল নির্মাণ করা চাই। প্রয়োজনীয় বই এবং কতটা প্রয়োজন- এ বিবেচনা নিয়েই পাঠ রচনার জগৎ আবিষ্কার অথবা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সর্ববিষয়ে পা-িত্য অর্জন কোনো দিনই সম্ভব নয়। তাই পরিকল্পনার সৌন্দর্য জানতে হবে। জানতে হবে কিভাবে অধিককে অল্পের আয়োজনে অধীনস্থ করা যায়। এ ক্ষেত্রে রুচি অনেক বড় কাজ করে। রুচির সান্নিধ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রুচিহীন মানুষেরা জীবনকে যুদ্ধই ভাবে। হয়তো এক অর্থে সত্য জীবন মানে এক ধরনের যুদ্ধ। তার মানে কি এই- জীবন কোনো আনন্দবোধই স্বীকার করবে না! জীবন মানেই দুঃখের সমুদ্র। জীবন মানেই কষ্টের কাহিনী। জীবনে সুখ-দুঃখ, কষ্ট-সাধনা সবই থাকবে। থাকতেই হবে। এসব নিয়েই জীবন মহৎ হবে।
বই মানেই পাঠযোগ্য- এ কথা কেনো বলব। বরং বই পাঠযোগ্য হলেই কেবল পাঠ করা চলে। অন্যথায় একে আনা যায় না পাঠের আওতায়। এত সময় সংগ্রহ করা সম্ভব কি? জীবন তো খুবই ছোট। সংক্ষিপ্ত। সংক্ষিপ্ত জীবনে গুরুত্বের দাবিদার কাজগুলোই জোগান দিতে হয়। সুতরাং বাছাই পদ্ধতি ছাড়া যথাযথ পাঠ সম্ভব নয়। পরিকল্পনার অধীনেই কাক্সিক্ষত সুন্দরের সাধনা করা উচিত।
মানসম্মত বই কোনটি? এ জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে হবে। কোনো বইয়ের গায়ে তো উৎকীর্ণ থাকে না এটি মানসম্মত বই। তবে? তবে পাঠক তার বোধ ও মনন দিয়েই চিহ্নিত করবেন ভালো বইটি। মানসম্মত বইটি। এ ক্ষেত্রে পাঠকের রুচি কাজ করে। রুচিহীন পাঠক কখনো সঠিক বইটি নির্বাচন করে উঠতে পারেন না। বই মানে আনন্দের একটি অন্য দরজা। সে দরজা চিনতে হয়। চিনে নিতে হয়। তবেই এই পাঠের মজা পাওয়া যেতে পারে। পাঠে মজা না পেলে পাঠ জমে না। পাঠ যদি না-ই জমলো সেই পাঠে চিহ্নিত করার মতো কিছু হবে না। সুতরাং কাজ যেমন আনন্দের সাথে করা চাই। পাঠও আনন্দের সাথে হতে হবে। তবেই বই হবে প্রকৃত বন্ধু।
পাঠের ধারাবাহিকতাও থাকতে হবে। প্রতিদিন কিছু হলেও পাঠ করা জরুরি। মাঝে মাঝে পাঠ করা যায়। সে পাঠে অনেক পাওয়ার আশা করা যায় না। তবে না পড়ার গুমোট পরিস্থিতির চেয়ে ভালো তো বটে। কেউ কেউ আছেন যারা বই পাঠ করার মানসিকতাই রাখেন না। বই পাঠ অপরিহার্য এ কথা ভাবতেই নারাজ। তার ভাবনায় থাকে অর্থ। থাকে সম্পদ। থাকে বিত্তের চাকচিক্য। বই এদের বন্ধু হবে এ কথা বললে এরা অবাক হয়ে যায়।
আবার এক প্রকার মানুষ যারা টেলিভিশন ছাড়া আর কিছু দেখতে পড়তে নারাজ। টেলিভিশনের জগৎই তাদের কাছে বড় জগৎ। বইয়ের জগতে তাদের প্রবেশাধিকার তারাই নিষিদ্ধ করার মতো অবস্থা তৈরি করে। নাটক সিনেমা সিরিয়াল এসব দেখেই সময় খরচ করেন তারা। যেটুকু সময় কাজ আর ঘুম। বাকি সময় সিরিয়াল ছবি। এভাবেই কেটে যায় তাদের জীবন। যে কারণে এদের অন্তর মরে যায়। আবেগ থিতিয়ে যায়। ধীরে ধীরে এক এক ধরনের হতাশা দুরাশা বাসা বাঁধে মনে। অনেক না পাওয়ার আগুনে পুড়তে থাকে। অথচ বই মানুষকে এসব থেকে অতি সহজে মুক্তি দিতে পারে। এ কারণেই বলা যায় বইয়ের মতো বন্ধু এ জগতে নেই।

Share.

মন্তব্য করুন