– ছক্কা…! চেঁচিয়ে বলে উঠলো শিহাব।
কিন্তু পরক্ষণেই কালো হয়ে গেলো তার মুখ। হাসিটাও উবে গেছে নিমিষেই। কারণ গায়ের শক্তি দিয়ে ব্যাটিং করায় বলটা গিয়ে পড়েছে ঐ মানুষখেকো কুয়ার বেড়ার ভেতরে।
কুয়াটা বেশ পুরনো। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে বহু বছর। দিনের বেলায়ও কেউ ঘেঁষে না এই কুয়ার ধারে কাছে। সপ্তাহ খানিক আগে নাফিজ নামের এক ছেলে কৌতূহল মেটাতে প্রায় আসতো এই কুয়ায়। এবং চারপাশে ঘুরাঘুরি করতো। কিন্তু একদিন সে কুয়ার দিকে তাকাতেই অদৃশ্য কিছু একটা টেনে নেয় তাকে কুয়ার অতল গহ্বরে। আর কখনও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে কুয়ার চারিদিকে বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে দেয়া হয়। কুয়ার কয়েক ফুট সামনে একটি বিলবোর্ডে লিখে দেয়া হয়- ‘বিপজ্জনক স্থান, প্রবেশ নিষেধ।’
আর এই সবকিছুই করেন গ্রামের মেম্বার মিজানুর রহমান মিজান। তিনি শুধু বেড়া দিয়েই ক্ষান্ত হননি সর্বদা একজন পাহারাদারও নিযুক্ত করেন। যাতে কেউ এই কুয়ার ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে না পারে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুরক্ষাই তার প্রধান লক্ষ্য। আজ পাহারাদার নেই ছুটিতে গেছে।
-কিরে শিহাব, তুই এটা কী করলি? এখন বলটা আনবে কে? এতো জোরে কেউ ব্যাটিং করে? ঝাঁজালো কণ্ঠে বললো নীরব।
-আমি কী করবো বল? কিভাবে যে এত জোরে ব্যাট হাঁকালাম আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।
-এত কথা আমি জানি না। তুই আমার বল হারিয়েছিস তুই-ই আমার বল এনে দিবি। বললো রাসেল।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই-ই এনে দিবি। রাসেলের সাথে তাল মিলিয়ে বললো তার বাকি বন্ধুরা।
রাসেল শিহাবের সহপাঠী। একদিন স্কুলে একটি কলম চুরি নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় তাদের। রাসেল তার বন্ধু জাহিদের কলম নিয়ে শিহাবের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। এবং জাহিদের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেয় শিহাবের। সেখান থেকে রাসেলের সাথে মেলামেশা করে না শিহাব। আজকে নীরবের জোরাজুরিতে এসেছে। এসেই ঘটলো এই ঘটনা। আর রাসেল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে।
শিহাব তাকালো নীরবের দিকে। ব্যাচারার মুখটা একেবারে মলিন হয়ে গেছে। তাকিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে আমিই গিয়ে নিয়ে আসছি বলটা।’ বলে কুয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
পেছন থেকে শিহাবের জামা টেনে ধরলো নীরব। বললো, যাসনে শিহাব ঐ কুয়ার কাছে। আমরা না হয় আরেকটা বল কিনে দেবো রাসেলকে।
আচমকাই বলে উঠলো রাসেল, ‘না আমার নতুন বল দরকার নেই। আমার এই বলটাই চাই।’
-রাসেল তুই কি পাগল হয়েছিস? তুই জানিস ঐ কুয়ায় গেলে কি হয়? রাগান্বিত কণ্ঠে বললো নীরব।
-আমি এতো কিছু জানি না। আমার শুধু বল চাই।
-রাসেল দেখ ভালো হচ্ছে না কিন্তু!
-এই থাম! ওর সাথে অযথা ঝামেলা করে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি তুই দাঁড়া বল নিয়েই চলে আসবো।
-চল আমিও যাবো তোর সাথে। বললো নীরব।
-পাগলামি করিস না নীরব। আমি একাই যাই। তুই এখানেই থাক।
-না আমি যাবো তোর সাথে। তোকে আমি একা ঐ কুয়ার কাছে যেতে দেবো না।
-আচ্ছা ঠিক আছে চল।

শিহাব আর নীরব খুব ভালো বন্ধু। একই ক্লাসে পড়ে তারা। স্কুলে যাওয়া আসা থেকে শুরু করে সব কিছুই তারা একসাথেই করে। এমনকি দুপুরের গোসল পর্যন্ত তারা একসাথে একই পুকুরে করে। তাদের আরেক বন্ধু ইমন। খুবই চতুর। আর ভীষণ রহস্যপ্রিয়। রহস্য দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজ তার খেলতে আসার কথা। কিন্তু জরুরি কাজ থাকায় আর এলো না।
কুয়ার কাছে এসে দাঁড়ালো দু’জন। বেড়া দিয়ে ঘেরাও চারপাশ। কুয়ার ধার ঘেঁষেই পড়ে রয়েছে বলটা। নীরবকে দাঁড় করিয়ে বাঁশের তৈরি বেড়া টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো শিহাব। চারদিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে বলটা হাতে নিলো। ফিরে আসবে এমন সময় শিহাবের মনে কৌতূহলের জন্ম নিলো। মন চাচ্ছে একবার তাকিয়ে দেখতে কুয়ার অতল গহ্বরে। কী আছে এই কুয়ায়? যেটা মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। আবার বলছে নাহ, অযথা রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। কিন্তু না, পারলো না শিহাব তার কৌতূহল দমিয়ে রাখতে। ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলো কুয়ার দিকে। শিহাব ঐ দিকে যাস না ফিরে আয়। চেঁচিয়ে বললো, নীরব। নীরবের কথায় কান দিলো না শিহাব। সে আরো এগিয়ে যায়। কুয়ার একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়ায় শিহাব। একটু একটু করে মাথা ঝোঁকায় কুয়ার দিকে। কুয়ার দিকে তাকিয়েই ছানাবড়া হয়ে যায় তার চোখ। কী দেখছে সে এসব? কুয়ার ভেতরটা একদম পরিষ্কার। একটি ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে। তিনজন লোক কতগুলো প্যাকেট নাড়াচাড়া করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে এসব দেখলো শিহাব। হঠাৎই কুয়ায় থাকা একটি লোকের চোখ পড়ে শিহাবের ওপর। সাথে সাথেই হাতের কাছের একটি সুইচ চাপ দিলো লোকটি। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো কুয়া আবার সেই ভয়ানক অন্ধকারের রূপ নিলো। শিহাব কুয়ার মুখ থেকে মাথা তোলার আগেই তার গলা কিছু একটা জড়িয়ে ধরলো এবং টেনে নিয়ে গেলো তাকে কুয়ার ভেতর।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ শিহাবের কর্মকা- দেখছিল নীরব। কুয়ার দিকে তাকিয়ে কি দেখছে শিহাব? আর তাছাড়া কুয়ায় তাকানোর পরও কেন ওকে টেনে নিয়ে গেলো না? বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নীরবের মস্তিষ্কে। ধীরে ধীরে সেও এগোতে শুরু করলো কুয়ার দিকে। কুয়ার কাছাকাছি এসেই থমকে দাঁড়ায় নীরব। আতঙ্কে তার চোখ বড় হয়ে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তার সামনেই কিভাবে শিহাবকে টেনে নিয়ে গেলো কুয়ার ঐ অশরীরীটা। আট পাঁচ না ভেবেই ঘুরে দৌড় দিলো নীরব। বাঁশের বেড়া টপকে এক দৌড়ে এসে পৌঁছল মাঠে। ভীষণ হাঁপাচ্ছে, তর তর করে ঘাম ঝরে পড়ছে তার শরীর থেকে। নীরবকে দৌড়ে আসতে দেখে সবাই এগিয়ে এলো তার কাছে।
-কী হলো নীরব, তুই এরকম ঘামছিস কেন? উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ইমন।
ইমন মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে বাজারে যাচ্ছিলো। যাওয়ার সময় নীরবকে দৌড়ে আসতে দেখে মাঠে চলে আসে সে।
-শিহাবকে…।
-শিহাবকে কী? বল!
-শিহাবকে… শিহাবকে…। কথা শেষ করতে পারলো না নীরব। তার দেহ লুটিয়ে পড়লো মাঠে।
সারাদিন, এমনকি রাতেও জ্ঞান ফেরেনি নীরবের। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে গেছেন। বলেছেন চিন্তার কোন কারণ নেই। প্রচ- ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কাল সকালেই সুস্থ হয়ে যাবে।
ইমন সেদিন নীরবের বাড়িতে থেকে যায়। বাড়িতে ফোন করে মাকে জানায় সবকিছু।

-কী হলো এত রাত হয়ে গেল এখনও বাড়ি ফেরেনি শিহাব। তার কিছু হয়নি তো? চিন্তিত কণ্ঠে বললো শিহাবের মা আমেনা বেগম।
-আরে কী হবে, অযথা চিন্তা করো না। হয়তো নীরবের সাথে পড়ছে। চলে আসবে এক্ষুনি। সান্ত¡না দিয়ে বললো শিহাবের বাবা সিরাজুল ইসলাম।
সান্ত¡না দিলেও তিনিও জানেন না কী হয়েছে তার ছেলের।
শিহাবের বাবা একজন স্কুল টিচার। শিহাব যে স্কুলে পড়ে সেখানেই শিক্ষকতা করেন তিনি।
সন্ধ্যায় তিনি নীরবের বাড়িতে গিয়েছেন। নীরব অজ্ঞান থাকায় ইমন তাকে যা জানে সবকিছু বলেছে। শুনেই বললো, ‘আমার শিহাবের কিছু হয়নি তো?’
-সেটা আঙ্কেল আমিও জানি না। নীরবের জ্ঞান ফিরলে জানা যাবে সবকিছু। ইনশাআল্লাহ আমরা যেভাবেই হোক উদ্ধার করবো তাকে। আপনি শুধু আমাদের সাহায্য করবেন।

পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরে নীরবের। চোখ মেলেই দেখে ইমন বসে আছে তার পাশে।
-এখন কেমন লাগছে নীরব? বললো ইমন।
-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। জবাব দিলো নীরব।
-কাল ঠিক কী ঘটেছিল নীরব? প্রশ্ন করলো ইমন।
ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বসলো নীরব। বলতে শুরু করলো কালকের সমস্ত ঘটনা।
সব শুনে ইমন বললো, ‘আমার মনে হয় এখানে ভুতুড়ে বা অশরীরী কিছু নেই।’
-কী বলছিস তুই?
-হুম, ঠিকই বলছি।
-তোর এমন মনে হওয়ার কারণ?
-অশরীরী কিছু হলে প্রথম দেখাতে সে-ই শিহাবকে নিয়ে যেতো। আমার মনে হয় শিহাব এমন কিছু দেখেছে, যেটা তারা চায় না কেউ জানুক। আর সেই কারণে নাফিজকেও টেনে নিয়ে যায়।
-কাদের কথা বলছিস তুই?
-তাদের কথা, যারা শিহাবকে নিয়ে গেছে।
-কারা হতে পারে?
-সেটা জানার জন্য আজকে আমাদের ঐ কুয়ায় যেতে হবে।
-পাগল হয়েছিস তুই? তুই গেলে যা আমি যাবো না।
-ঠিক আছে, তুই না গেলে নাই। আমি একাই যাবো এবং আজ রাতেই। দেরি করলে ক্ষতি হতে পারে শিহাবের। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ জটিল!

রাত বারোটা। চারদিকে নীরব নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। রাস্তায় একটা মানুষও নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে আছে চারপাশ। এরই মধ্যে নীরবে হেঁটে চলছে দুই কিশোর। তাদের দু’জনের হাতে দুইটা টর্চ। টর্চ দু’টি বন্ধ। পিঠে ঝোলানো ব্যাগ।
-তুই ঠিক কী করতে চাচ্ছিস ইমন? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো নীরব।
-গেলেই বুঝতে পারবি। জবাব দিলো ইমন।
-আচ্ছা, তুই কি কাউকে সন্দেহ করছিস?
-হুম। একজনকে করছি।
-কে লোকটি?
-আমাদের গ্রামের মেম্বার মিজানুর রহমানকে।
-কী বলছিস তুই? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আরে, উনি নিজেই তো টাকা খরচ করে কুয়ার চারিদিকে বেড়া দিয়েছেন। এবং নিজের টাকা দিয়েই পাহারাদার রেখেছেন। শুধুমাত্র আমাদের সুরক্ষার জন্য। আর তুই কিনা তাকেই সন্দেহ করেছিস?
-কুয়া ঘিরে তার এতো নিরাপত্তাই তাকে সন্দেহ করার মূল কারণ।
-আমি তোর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলাম না।
-নিরাপত্তার সঙ্গে তাকে সন্দেহ করার কোনো কারণই আমি দেখছি না।
-সবই জানতে পারবি ঐ কুয়ায় ঢোকার পর। এবার একটু থাম!
আর কোন কথা বললো না নীরব। সে জানে, ইমন কাউকে খামোখা সন্দেহ করে না। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো রহস্য আছে ঐ কুয়ায়। এর আগেও সে এরকম জটিল একটা কেসের সমাধান করেছে।
হাঁটতে হাঁটতে কুয়ার ঘেরাও করা বেড়ার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো দু’জন।

২.
আস্তে আস্তে চোখ খুললো শিহাব। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার একটা রুমে রয়েছে সে।
তার হাত দুটো চেয়ারের হাতলের সাথে বাঁধা। নাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। নাইলনের দড়ি দিয়ে ভীষণ শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। কয়দিন এখানে আছে সে বুঝতে পারছে না। কারণ এখানে রাত দিন সব এক মনে হচ্ছে। শরীরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছে। মনে পড়লো তার ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার কথা। ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছে। মরেই যেতো যদি লোকগুলো তাকে না ধরতো।
হঠাৎ খেয়াল করলো তার পাশেই আরেক চেয়ারে কাউকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ভালো করে খেয়াল করলো কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না।
-এই যে শুনছেন… এই-ই ই ডাক দিল শিহাব।
আচমকা নড়ে উঠলো চেয়ারে বাঁধা দেহটি। কিছু বলতে চাচ্ছিলো ঠিক তখনি খুলে গেলো দরজা। দরজা খুলতেই হালকা আলোকিত হলো রুমটা। লাইট জ্বালাতেই আলোয় ঝলমল করে উঠলো পুরো রুম। রুমে প্রবেশ করলো তিনজন লোক।
দুজন তারা যারা তাকে কুয়া থেকে ধরে এনেছিল। আর অপর জনের দিকে তাকাতেই শক্ খেলো যেন শিহাব। সে ঠিক দেখছে তো? নাকি সব তার মনের ভুল! এ যে স্বয়ং তাদের মেম্বার মিজানুর রহমান মিজান সাহেব।
-কেমন আছো বাবা শিহাব? শয়তানি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো মিজান।
শিহাব কিছু না বলে চুপ করে রইলো। রাগে ফুঁসছে সে।
-দেখো, আমি তোমাকে এতো কষ্ট দিতাম না যদি তুমি এই কুয়ার ধারে না আসতে। পুনরায় বললো মিজান।
কোন কথা বললো না শিহাব।
-আমি চেয়েছিলাম নাফিজকে সরিয়ে তোমাদের এই কুয়া থেকে দূরে রাখতে। কিন্তু তোমরা শোননি। শেষমেশ চলেই এলে। আমি খুব দুঃখিত এখন তোমাদের মারা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। বললো মিজান।
-আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?
-কোন ক্ষতি করনি। শুধু আমার এই পাতালপুরীর খবর জেনে গেছো। আর এটাই তোমার অপরাধ।
-ওর দিকে তাকিয়ে দেখ?
ঘাড় ঘুরিয়ে শিহাব তাকালো চেয়ারে বাঁধা লোকটির দিকে। তাকিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শক্ খেলো সে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, নাফিজ তুই?
-হ্যাঁ, নাফিজ। অনেকবার বারণ করেছি তাকে এই কুয়ার ধারে কাছে না আসতে। তারপরও সে এলো। তাই বাধ্য হয়েই তাকে ধরতে হয়েছে আমার।
-আচ্ছা, অনেক কথা বলে ফেলেছি তোমার সাথে। এবার আসি। চিন্তা করো না আর বেশি কষ্ট করতে হবে না তোমাদের। কালকেই একটা বিহিত করবো। ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেলো মিজান। সাথে সাথেই আবার অন্ধকারে ঢেকে গেলো পুরো রুম।

৩.
-নামবি? জিজ্ঞেস করলো নীরব।
-অবশ্যই নামবো। নামতেই হবে আমাদের। বলে হুকের মাথা ভালো করে কুয়ার সাথে লাগালো ইমন। সাথে নীরবও।
নাইলনের দড়ি বেয়ে তর তর করে নিচে নামতে লাগলো দুজন। বেশ কিছুক্ষণ পর মাটির স্পর্শ পেলো ইমন। সাবধানে নিচে নামলো দুজন। চারদিকে তাকালো ইমন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতের টর্চ জ্বাললো। আলোকিত হয়ে গেলো পুরো কুয়া।
ডানে বামে তাকিয়ে একটি জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেলো নীরবের দৃষ্টি।
-ইমন ঐ দেখ! অবাক হয়ে বললো নীরব।
তাকালো ইমন সেদিকে। দেখলো একটি দরজা।
কিন্তু সে একটুও অবাক হলো না।
ধীরে ধীরে দুজন এগোতে শুরু করলো দরজার দিকে। সিটকিনি টেনে খুলে ফেললো দরজা।
লম্বা একটা করিডোর। চারপাশে অনেকগুলো কার্টন। একটি কার্টন খুলে ফেললো নীরব। দেখলো অনেকগুলো ফেনসিডিলের বোতল। কিছু দূরে গিয়ে আরেকটা খুললো সেখানে অনেকগুলো হেরোইনের প্যাকেট। নীরবের মুখে কোনো কথা বেরোল না। শুধু তাকিয়ে রইলো ইমনের দিকে।
একটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো দু’জন।
দরজায় বাহির থেকে তালা দেওয়া।
-এই ঘরেই আছে শিহাব। বললো ইমন।
-কী করে বুঝলি?
-কারণ এখানে মাত্র দুইটি ঘর। একটা এদের অফিস অপরটা বন্দীখানা। ঐ দেখ সামনের ঘরটায় আলো জ্বলছে। আর ওটাই এদের অফিস। ওরা বোঝার আগেই এ ঘরের তালা ভেঙে উদ্ধার করতে হবে শিহাবকে। ব্যাগ থেকে রডটা বের কর? বললো ইমন।
রড বের করে ইমনের হাতে দিলো নীরব।
ইমন রডটা তালার মাঝ বরাবর বসিয়ে চাপ দিতেই ভেঙে গেলো তালা। কিন্তু ততক্ষণে টের পেয়ে যায় অফিসের লোকগুলো। দৌড়ে আসতে থাকে তাদের ধরতে। ইমন তড়িঘড়ি করে সিটকিনি খুলে ভেতরে প্রবেশ করেই ভেতর থেকে সিটকিনি লাগিয়ে দিল। দ্রুত কণ্ঠে নীরবকে বললো, টর্চ জ্বেলে তাড়াতাড়ি শিহাবকে খুঁজে বের কর।

৪.
-নাফিজ তোকে ওরা কিভাবে ধরলো? প্রশ্ন করলো শিহাব।
-আমি প্রায়ই দেখতাম মেম্বার মিজানুর এখানে রাতের বেলায় আসে আর কুয়ায় নামে। কিছুক্ষণ থেকে আবার বেরিয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন আমি তার এই কীর্তিকর্ম দেখলাম। একদিন তাকে ফলো করে আসতেই সে দেখে ফেলে আমায়। এবং আমাকে এই কুয়ায় আসতে নিষেধ করে। কিন্তু! এতে আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। একদিন রাতে এসে দেখি কুয়ায় তিনজন লোক কী যেন করছে। আমি কিছুক্ষণ দেখে ফিরে আসছিলাম। কুয়া থেকে মুখ তুলতেই একটা দড়ি আমার গলায় পেঁচিয়ে যায়। এবং আমাকে এই কুয়ায় এনে ফেলে। একটানা কথাগুলো বলে একটু দম নিলো নাফিজ।
-এখন কী হবে আমাদের? বললো শিহাব।
-কী হবে আর, হয় মেরে ফেলবে না হয় পাচার করে দিবে। জবাব দিলো নাফিজ।
-আমাদেরকে কি কেউ বাঁচাতে আসবে না?
-হুম। একজন আসতে পারে?
-কে সে?
-ইমন।
-ইমন? সে কিভাবে জানবে আমরা এখানে আছি।
-আমি ধরা খাওয়ার আগে এই কুয়া সম্বন্ধে তাকে যা যা জেনেছি সব বলেছি। এখন সে যদি আজকে আসে তাহলে আমাদের বাঁচার আশা আছে। আর না আসলে…।
কথা শেষ করতে পারলো না নাফিজ। আচমকা ঘরের দরজা খুলে গেল।
নীরব দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো শিহাবকে।
-আল্লাহর হাজার শুকরিয়া, তুই এখনও বেঁচে আছিস। বললো নীরব।
-নীরব, জড়াজড়ি পরে কর আগে শিহাবের বাঁধন খোল। তাড়া দিয়ে বললো ইমন।

বাঁধন খুলে মুক্ত করলো শিহাব ও নাফিজকে।
ইমনের নেতৃত্বে তারা চারজন দুটি ভাগ হয়ে দরজার দুই পাশে দাঁড়াল। চারজনের হাতে চারটি রড।

‘আরো জোরে, আরো জোরে।’ উত্তেজিত হয়ে বললো মিজানুর। দিচ্ছি বস! বলে আরো জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো দরজা। একসময় ভেঙে গেল সিটকিনি। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল তিনজন লোক। লাইট জ্বালতে যাবে ঠিক তখনই মাথার পেছনে ঘাড়ে শক্ত কিছুর আঘাত অনুভব করলো তিনজনই। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো তিনটি দেহ।
ব্যাগ থেকে দড়ি বের করে তিনজনের হাত-পা ভালো করে বাঁধলো ইমন। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল দিল শিহাবের বাবা সিরাজুল ইসলামকে। তিনি ইমনের কথায় বাইরে পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ইমনের কল পেয়েই তিনি চলে আসেন।
কুয়ার দরজা বরাবর লম্বা করিডোরের শেষ মাথায় রয়েছে একটি গোপন দরজা। ওটা ভেঙেই ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ। মেম্বারকে দেখে বেশ অবাক হন ইনস্পেক্টর সজীব হাসান। সেদিনই মেম্বার মিজানুর রহমান মিজানসহ তার সঙ্গীদের গ্রেফতার করে পুলিশ। আর ইমন, নীরব, শিহাব ও নাফিজ সকালে থানায় দেখা করতে বলে চলে যায় সজীব হাসান। শিহাবকে ফিরে পেয়ে তার বাবা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বুকে জড়িয়ে নিলেন ছেলেকে। নাফিজ ভাবছে তার বাবা মা হয়তো এখন তার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে তাকে জীবিত দেখলে তারা যে কী পরিমাণ খুশি হবেন ভাবতে পারলো না নাফিজ।

৫.
পরদিন সকালবেলা। থানায় এসে বসে রয়েছে ইমনরা। কিছুক্ষণ পর ইন্সপেক্টর সজীব হাসান এলেন। বেশ প্রশংসা করলেন তাদের। বললেন, তোমরা বিরাট বড় এক ক্ষতি থেকে শুধু এই গ্রামকে নয় পুরো দেশকে বাঁচালে। সরকারের পক্ষ থেকে এই জন্য তোমাদের পুরস্কৃত করা হবে। মেম্বারের সাথে ঐ দু’জন বিদেশি। বিদেশ থেকে নেশাদ্রব্য এনে মেম্বারের মিজানুর রহমানের ধারা পুরো দেশে ছড়িয়ে দেয়।
ধন্যবাদ স্যার। আমাদের পুরস্কারের প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। ইনশাআল্লাহ সব সময়ই পালন করে যাবো। এখন আসি স্যার বলে বেরিয়ে গেলো তারা।
বাইরে এসেই নীরব জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা ইমন, আজ রাতেই যে শিহাবদের মেরে ফেলবে তুই এটা কী করে বুঝলি?’
ইমন কিঞ্চিৎ হাসলো। বললো, ‘যেদিন শিহাবকে কুয়া টেনে নিয়ে গেলো সেদিন আমি তোর জন্য ডাক্তার আনতে বাজারে যাই। গিয়ে দেখি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে মেম্বার দু’জন লোককে বলছিল, কালকেই ওদের দুজনের একটা বিহিত করতে হবে, তা না হলে আমাদের বিপদ হতে পারে। আমি কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে তাকে সালাম দিয়ে ডাক্তার নিয়ে চলে আসি।
-তার ওপর নাফিজের দেওয়া মেসেজ। সব মিলেয়ে আমি সেই রাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
-ও আচ্ছা, এতক্ষণে বুঝলাম। বলে হেসে দিলো নীরব তার সাথে বাকি সবাই।

Share.

মন্তব্য করুন