আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের হাত ধরে একটি দেশের আগামীর ইতিহাস রচিত হয়। ফলে শিশুদের মানবিক গুণাবলি ও মানসিক বিকাশে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেমন ভূমিকা রয়েছে তেমনি সাহিত্যিকদের ভূমিকাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দেশপ্রেম ও দেশের সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জানার সবচেয়ে সহজ ও আনন্দময় উৎস হচ্ছে সাহিত্য। আর সাহিত্যের নাটাই যার হৃদয়ে থাকবে তার আদর্শেই শিশুরা চালিত হবে। আর এ তাড়না থেকেই ফররুখ আহমদ শিশুসাহিত্য সৃষ্টি করেছেন।
শিশুসাহিত্যিক হিসেবে ফররুখ আহমদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম বাংলাসাহিত্যে। তাঁর শিশুসাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য ছিল নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া এবং আনন্দের ছলে পাঠে মনোযোগী করে তোলা। নৈতিকতা শিক্ষাও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। তাঁর নৈতিকতার ভিত্তি হলো, ‘জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস, তাহজিব ও তমদ্দুন।’ তাঁর আদর্শ হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহামানব মোহাম্মদ (সা.)। আল্লাহর দ্বীন ও রাসূল (সা.)-এর অমিয় বাণী হলো তাঁর সাহিত্যের অনুপ্রেরণা এবং স্বদেশের মাটি ও মানুষ হলো উৎসস্থল। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন এক অনন্য দেশপ্রেমিক আদর্শবান ও আপসহীন লড়াকু সাহিত্যিক। তাঁর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন,
জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু তখনি জানি
শহীদি রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানি।
ফররুখ আহমদ শিশুদের জন্য অনেক কবিতা, ছড়া ও নাটিকা রচনা করেন। তিনি মোট একুশটি শিশু-কিশোর কাব্য, ছড়া ও গীতিকাব্য এবং নাটিকা রচনা করেন, যার মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় চারটি শিশু-কিশোর গ্রন্থ প্রকাশ করেন। পাঠ্য হিসাবে চার খ-ে নয়াজামাত প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আরো তিনটি শিশু-কিশোর গ্রন্থ প্রকাশ করলেও বেশ কয়েকটি বই এখনো প্রকাশিত হয়নি। যেগুলোতে শিশু-কিশোরদের অন্তরের অতৃপ্ত বাসনা আরো তীব্রভাবে ধরা পড়ে।
পাখীর বাসা, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর, চিড়িয়াখানা, ফুলের জলসা ও কিস্সা কাহিনী উল্লেখযোগ্য শিশু-কিশোর গ্রন্থ। প্রত্যেকটি গ্রন্থ বাংলাদেশের লোক-ঐতিহ্য ও প্রকৃতির এক নিপুণ সৃষ্টি। উল্লেখ্য, পাখির বাসা গ্রন্থে ‘পাখির বাসা’, ‘ঘুঘুর বাসা’, ‘বকের বাসা’, ‘প্যাঁচার বাসা’, ‘গাঙ শালিকের বাসা’, ‘বাবুই পাখির বাসা’, ‘চড়ই পাখির বাসা’, ‘পাখ-পাখালি’, ‘টুনটুনি’, ‘কাঠ-ঠোকরা কুটুম পাখি’, ‘টিয়ে পাখি’, ‘ফিঙে পাখি’, ‘মাছ রাঙা’ বা তিনি নতুন লেখা কাব্যগ্রন্থে ৬৮টি কবিতা সঙ্কলিত করেন যেখানে ‘মেঘের ছড়া’, ‘বৃষ্টির ছড়া’, ‘ইলশে গুঁড়ি’, ‘ইলিশ’, ‘রুই-কাতলা’, ‘মাছি’, ‘মশা’ ইত্যাদি ছড়া কবিতার মাধ্যমে দেশের প্রকৃতিকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
পাখিবিষয়ক কবিতাগুলোকে শেকসপিয়রের সনেট সিক্যুয়েন্স-এর সাথে তুলনা করা চলে। যেমন, ‘পাখির বাসা’ কবিতায় প্রথমে ঝিমিয়ে পড়া শিশুদের পাখির বাসা খোঁজার ডাক দিয়েছেন। এরপর তিনি কোথায় কোথায় পাখির বাসা পাওয়া যাবে সে নিয়ে একটি বর্ণনা দিয়ে লেখেন,
কোন্ বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন্ বাসাটায়
কোন্ বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে॥

ঝিলের ধারে, ঝোপের মাঝে
কোন্ বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন্ বাসাটায় বাবুই পাখির
মন মাতে॥
আবার ‘প্যাঁচার বাসা’ কবিতায় প্যাঁচা কোথায় পাওয়া যাবে তার বর্ণনা দিয়ে প্যাঁচার শারীরিক বর্ণনার মাধ্যমে প্যাঁচার মধ্যেও যে সৌন্দর্য রয়েছে তা তুলে ধরে বললেন,
চক্ষুটা মিটমিটিয়ে
মনের আগুন ছিটিয়ে
প্যাঁচা বসে যে ডালে
সেই ডালে ভাই ওঠো রে॥
এসব থেকে তাঁর ‘চড়–ই পাখির বাসা’ কবিতাটি অনন্য। পরাধীনতার মধ্যে যে আনন্দ নাই তা উল্লেখ করে বললেন,
চড়–ই পাখি চালাক তবু ভাই,
নিজের বাসার ঠিক ঠিকানা নাই॥
পরের দালান বাড়ি খুঁজে
থাকে সে তার মাথা গুঁজে,
সবাই তাকে খারাপ বলে
বলে যে দূর ছাই॥

পরের দয়ায় বাঁচতে যারা চায়,
দুঃখ তাদের ঘোচানো যে দায়॥

পরের কোটায় চড়–ই পাখি
নিজেরে হায় দিল ফাঁকি,
পরের দয়ায় চড়–ই পাখি
গোলাম হলো তাই॥
এ কবিতার মাধ্যমে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার পথকে সুপ্রশস্ত করেছেন।
অন্যদিকে ‘সবাই রাজা’, ‘বাঘের মাসী’, ‘শাহজাদী’, ‘শাহজাদা’, ‘জঙ্গীপীর’, ‘তিতুমীর’ ইত্যাদি কবিতার মাধ্যমে তিনটি কাজ একসাথে করার চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত ভারতীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ও ধারার ছবি তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয়ত, সাম্যবাদের ইতিহাসকে সুন্দর ক্যানভাসের মাধ্যমে তুলে ধরেন। তৃতীয়ত, দেশে প্রাচীন লোক-ঐতিহ্য তথা ফোকলোর তথা মিথলোজিকে তুলে ধরে আধুনিক সময়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।
মোগল সা¤্রাজ্য ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির এক অন্যতম সোনালি অধ্যায়। সে সময়ে কুতুব মিনার, তাজমহল, কোহিনুর বিশ্ব শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সেই প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোকে তিনি শিশুমনে তুলে ধরেন তাঁর ‘শাহজাদী’ কবিতায়। তাঁর লেখনীতে এসেছে,
চারদিকে ঘন বন রঙটা সবুজ;
মাঝখানে দেখা যায় সাদা গম্ভুজ।
উঁচু সেই গম্বুজ আসমান ছোঁয়
ঝলমল করে ভাই দিনের আলোয়।
বাদশাহী মহলের চারটে মিনার
ছুঁয়ে যেতে চায় যেন আকাশ-কিনার।
কাছে এসে দেখ যদি, তবে আগাগোড়া
দেখবে সে বালাখানা মর্মরে মোড়া।

অথবা তিনি যখন লিখলেন ‘ঝড়ের কাজ’, ‘বৃষ্টির গান’, ‘বর্ষা শেষের গান’, ‘শরতের গান’, ‘শীতের গান’, ‘ফাল্গুনের গান’, ‘চৈত্রের গান’ ইত্যাদি কবিতার মাধ্যমে ষড়ঋতুকে ও বারো মাসের বর্ণনা দিয়েছেন প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য অঙ্কনের জন্য। এর বাইরে এ কবিতার মাধ্যমে জাগরণের পথের আলোকপাত করেছেন। তাঁর ‘ঝড়ের গান’ কবিতায় তিনি বললেন,
ঝড় এল তাই ঝাঁকড়া চুলে
মাথা নাড়িয়ে,
ঝরা পাতা সবগুলোকে
দিল তাড়িয়ে।
এখানে ‘ঝড়’ শব্দটি বেশ রূপক। এটি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে বিদ্রোহের সুরের সমার্থক কেননা, সমাজে থাকা নোংরা বা অন্যায়কে ‘ঝরা পাতার’ সাথে তুলনা করে এসব ঝঞ্জালকে দূর করার কাজটি করেছেন। অথবা একই কবিতায় যখন তিনি বললেন,
থরথরিয়ে উঠলো কেঁপে
তাল গাছটার ছাতা,
মড়মড়িয়ে প’ড়ল ভেঙে
বুড়ো বটের মাথা॥
এখানে ‘তালগাছ’ ও ‘বুড়ো বটগাছ’ রূপক ও নরাত্তোপ হিসেবে ব্যবহার করে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের চলমান সংঘাতকে আঘাত করেছেন এবং বুড়ো বটগাছের মাধ্যমে দেশে ঐতিহ্যের শক্তিকে চিহ্নিত করেছেন। এ শক্তিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে নব্য পুঁজিবাদের আধিপত্যকে ধ্বংস করার রাস্তাকে প্রশস্ত করেছেন। অথবা তাঁর ‘ফাল্গুনের গান’ কবিতায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে তুলে এনে সৃষ্টিকর্তার অপরূপ রহমতের কথা শিশুদের মনে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য,
ফাল্গুনে আজ বনে বনে
জাগলো খুশীর দিন,
সবুজ নিশান যাই উড়িয়ে
খুশীতে রংগিন॥
এখানে ফাল্গুনের শুরুতে নতুন পাতার কারণে চারপাশে সবুজের যে সমারোহ তা মানবচিত্তে খুশির সঞ্চার করে,
সেই খুশীতে ঝলমলালো
আকাশ বাতাস ভোরের আলো,
সেই খুশীতে উঠলো হেসে
শিশির অমলিন॥
চনমনে ভাব বা পরিবেশ তৈরি করে বিপ্লবের পথকে সুগম করেছেন। ফররুখ আহমদের কবিতায় রাতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে। এ ‘রাত’ হারানো ঐতিহ্য ও গৌরকে বুঝিয়েছেন। রাত থেকে বাঁচার জন্য সঙ্কল্পবদ্ধ হয়ে ঘরের বাহিরে এসে নব দিগন্তের সূচনা করার জন্য শিশুদের আহ্বান করে বলেছেন,
রইব না আজ আপন মনে
একলা বসে ঘরের কোণে,
দল বেঁধে ভাই যাব ছুটে
যেথায় খুশীর চিন্॥
লক্ষণীয় এ লাইনগুলো কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতার কথাকে মনে করিয়ে দেয়। এভাবেই কবি ফররুখ আহমদ শিশুদের মনোজগতে প্রবেশ করে তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথকে সুগম করেছেন এবং শিশুরাও ফররুখ আহমদকে তাদের শিক্ষক হিসেবে মেনে নিয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন