পূর্ণিমা রাত। চারিদিকে জোছনার ফিনিক ফুটছে। দোতলার ছাদে বসে চাঁদনি রাতকে প্রাণভরে উপভোগ করছে স্বনন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে সুদূরের গ্রহ-নক্ষত্রগুলি। কত দূরের গ্রহেই না গিয়েছে স্বনন। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। কতদিন পর নিজ বাসভূমে (পৃথিবীতে) ফিরছে সে। আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চারপাশের বড় বড় অট্টালিকার দিকে তাকায় ও। কত বদলে গেছে নিজ দেশ! শুধু অট্টালিকায় নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও অনেক এগিয়ে গিয়েছে নিজ দেশ তথা সমগ্র পৃথিবী। ক’দিন পরেই সে বেরিয়ে পড়বে নিজ দেশকে ভালো করে দেখার জন্য। দরকার হলে নাসার কাছে থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নেবে।
স্বনন এমন ভাবতে ভাবতে নিচে রাস্তার দিকে তাকায়। দেখে তার বাসার দিকে কে যেন এগিয়ে আসছে। দুপুর রাত। রাস্তায় আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লোকটি স্বননদের বাসার মোড়ে এসে ডানদিকের রাস্তা ধরে চলতে থাকে। স্বনন উপর থেকে জোছনার আলোয় লোকটির মুখ ভালো করে দেখতে পায় না। স্বনন ভাবছিল লোকটি মোড়ে হয়তো থামবে। কিন্তু সে ধীরে ধীরে চলতে থাকে আবছা সরু গলিতে। ওর কাছে ব্যাপারটা রহস্যজনক মনে হয়। ও রাস্তায় দিনেই লোকজন তেমন একটা চলাচল করে না। পিচ উঠানো ভাঙা রাস্তা; কোনো প্রকারের যানও চলে না। একেবারে দরিদ্র শ্রেণীর লোকজন ঐ রাস্তার ধারে বসবাস করে। আর সেই রাস্তায় এত রাতে লোকটি কোথায় যাচ্ছে? চোর-ডাকাত নয় তো? ও রাস্তায় কোনো পাহারাদার বা পুলিশও নেই। স্বনন তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে পড়ে। বাড়ির গেট খুলে রাস্তায় নেমে পড়ে।
স্বনন সরু গলিতে এসে লোকটিকে খুঁজে পায় না। এত তাড়াতাড়ি লোকটি কোথায় উধাও হয়ে গেল? স্বনন তো দৌড়ে এসেছে এখানে। লোকটির তো দেখা পাবার কথা। মানুষ তো দূরের কথা কোনো কুকুর-বিড়ালকেও দেখা যাচ্ছে না রাস্তায়। তবুও স্বনন আবছা অন্ধকারময় সরু গলির পথ ধরে হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে স্বননের পাশের একটি ওক গাছের দিকে চোখ পড়ে। দেখে টর্চের আলোর মতো দুটি আলো জ্বলছে গাছের নিচে। কাছে আসতেই চমকে ওঠে। আরে! এ তো চিতাবাঘ। কালো রঙের চিতাটির দেহ তেমন দেখা যাচ্ছে না। শুধু জ্বলজ্বলে চোখ দুটো চোখে পড়ছে। স্বনন দাঁড়িয়ে পড়ে। কী করবে, পাশ কাটিয়ে চলে যাবে নাকি পিছিয়ে যাবে? কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এমন সময় ওকে অবাক করে দিয়ে চিতাটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। স্বনন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। নাহ্! আর এগোনোর দরকার নেই। স্বনন বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

দুই.
পরদিন।
স্বনন নাসার অফিসে বসে পেপার পড়ছিল। একটি খবরের শিরোনাম দেখে চমকে ওঠে।
‘লোয়ার রোডের একটি বাড়ি থেকে শিশু উধাও।’
আরে! এটি তো ওদের বাড়ির পাশের সেই সরু গলির নাম! মনোযোগ সহকারে ভিতরের অংশ পড়তে থাকে স্বনন :
‘লোয়ার রোডের একটি বাড়ি থেকে জেমস রবিন নামে একটি ৫-৭ বছরের শিশুকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনাটি ঘটেছে গত রাতে। শিশুটি কিভাবে নিখোঁজ হলো তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেকের ধারণা এটি শিশু পাচারকারী কিডন্যাপারদের কাজ। কিন্তু এর দ্বিমত পোষণও করছে অনেকে। কিডন্যাপাররা রাত্রিতে শিশু ধরবে কেন? আর ধরলেও তো বাড়ির লোকজনের টের পাবার কথা। অনেকের ধারণা কোনো ভূত-প্রেত এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। এর পূর্বে ‘জাঙ্গল রোড’ এর এক নির্জন বাড়ি থেকে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে সরকার একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।’’
খবরটি পড়ে স্বনন অবাক হয়ে যায়। রাত্রিতে বাড়ি থেকে শিশু উধাও হয়ে যায়, কিন্তু কে বা কারা নিয়ে যায় তা কেউ শনাক্ত করতে পারছে না। স্বনন ল্যাবরেটরিতে কয়েকদিন নিরিবিলি কাজ করতে চেয়েছিল। এরপর সে ছুটি নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সংবাদটি পড়ার পর ওর আর গবেষণায় মন বসে না। এর রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। সিদ্ধান্ত নেয়- আজই সে ছুটি নেবে বেড়ানোর কথা বলে। কিন্তু ওর উদ্দেশ্য থাকবে শিশু পাচারের রহস্য উদ্ঘাটন করা। নাসার কাছে গোপন রাখতে হবে সবকিছু। সহকর্মীরা হয়তো ঠাট্টা করে বলবে- বিজ্ঞানী হয়ে আবার গোয়েন্দা হবার শখ চাপলো কবে থেকে?
স্বনন অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির পথে। মনে মনে ভাবে- আমাদের দেশটা এখনো কত পিছিয়ে রয়েছে। এদের মানসিকতার উৎকর্ষসাধন এখনও তেমন ভাবে হয়নি। অনেকে বলছে- ভূতে নাকি শিশুদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে! এই মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে এখনও এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু মানুষ আছে এই গ্রহে। যে যুগে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে মানুষ অবাধে যাতায়াত করছে; অন্যগ্রহের জীবেরা তাদের দৈহিক অবয়ব পাল্টাচ্ছে; সেখানে পৃথিবীবাসীরা এখনও ভূতের বিশ^াস নিয়ে বেঁচে আছে! এ জাতির অগ্রগতি হবে কবে?

তিন.
দুপুর রাত।
আকাশের চাঁদটা পূর্বদিকে হেলে পড়ে জোছনার আলো ছড়াচ্ছে। স্বনন রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ও ‘লোয়ার রোড’-এর রাস্তা ধরে এগুতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ও সেই গাছের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে আজকে আশপাশে কোনো চিতা-টিতা আছে কি না। কিন্তু না, কোথাও কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। স্বনন একটু অবাক হয়- এ শহরের মধ্যে চিতা আসবে কোত্থেকে? বন-জঙ্গল তো অনেক দূরে।
স্বনন আবার হাঁটতে থাকে। উদ্দেশ্যবিহীন পথচলা। যে রাস্তায় কেউ নেই সেই নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে ও। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে ওর। স্বনন এবার দুপাশে গাছপালা ঘেরা একটি নির্জন রাস্তায় ঢুকে পড়ে। আশপাশে তেমন বাড়িঘর চোখে পড়ে না। নতুন গড়ে ওঠা উপশহর এটি। স্বনন আগে কখনো এখানে আসেনি। আসবেই বা কেমন করে? ও তো নিজদেশ পৃথিবী ছেড়ে অনেকদিন অন্যগ্রহে ছিল। স্বনন সামনের দিকে এগুতে এগুতে লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে দু-একটা ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে। ও ভাবে- আরো কিছু দূর গেলে হয়তো আরো কিছু বাড়ির দেখা মিলবে।
স্বননের বেশ ভালোই লাগছে। নির্জন নিরিবিলি রাস্তা। লোকজনের তেমন চলাচল নেই। দু’পাশে প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য। মাঝে মাঝে দু-একটি বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে এ কোনো ছবির দৃশ্য। স্বনন একটি বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে বাড়ির লোকজন জেগে আছে। বাড়িটিতে ঢুকবে নাকি? কিন্তু এতরাতে কারো বাড়ি ঢোকা কি ঠিক হবে? এমন সময় একটি অবাক কা- ঘটে যায়। ওর সামনে দিয়ে একটি কালো চিতাবাঘ দৌড়ে চলে যায়। স্বনন লক্ষ্য করে চিতাটির মুখে পাঁচ-ছয় বছরের একটি শিশু।
আরে! তাহলে ঐ চিতাবাঘই শিশুদের সাবাড় করছে। স্বনন গাছ থেকে একটি ডাল ভেঙে নিয়ে চিতাটির পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ ছুটে চলার পর চিতাটি আঁকা-বাঁকা পথে অদৃশ্য হয়ে যায়। স্বনন মন খারাপ করে আবার ফিরতে থাকে সেই বাড়িটির পথ ধরে- যে বাড়িটির সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। এর রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। স্বনন বন-বনানীঘেরা নির্জন বাড়িটিতে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়ে। ভিতরে ঢুকে দেখে সবাই কান্না-কাটি করছে। ওরা কেউ বুঝতে পারছে না শিশুটি কিভাবে হারিয়ে গেল। শুধু বিলাপ করছে সবাই।
স্বনন ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করে, আপনারা কিছু টের পাননি? কিভাবে কি হলো?
বাড়ির লোকেরা তেমন কিছু বলতে পারে না। এক মহিলা বলে, আমার মেয়ে একটি বিড়ালকে কোলে করে সন্ধ্যের দিকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এরপর কিছুক্ষণ আগে উঠে দেখি ও নেই। বলেই মহিলাটি কান্না শুরু করে দেয়।
বাড়ির মধ্যে উপস্থিত কয়েকজন প্রতিবেশীও ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, আমি কয়েকদিন ধরে একটি বনবিড়ালকে দেখছি ওদের বাড়ির ভিতরে আসা-যাওয়া করতে।
প্রতিবেশীর কথা শুনে বাড়ির এক বৃদ্ধ কিছুটা বিরক্ত হয়। একটু রাগত স্বরে জবাব দেয়, বনবিড়ালের সাথে কি সম্পর্ক আছে আমাদের মেয়ে হারানোর।
কথাটি বলে প্রতিবেশী কেমন যেন বোকা সেজে যায়। প্রতিবেশী লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে। স্বনন পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বলে, থাকুক আর না থাকুক, আপনারা কি কেউ বনবিড়ালটিকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখেছেন?
‘বনবিড়াল নয়, একটি বিড়াল আনাগোনা করছিল কদিন ধরে। আমার মেয়ে বিড়ালটিকে আদর করে খেলার সাথীও বানিয়ে ফেলেছিল। ওর সাথেই তো ঘুমিয়েছিল আমার সোনামণি। বলেই কাঁদতে থাকে মহিলাটি।’
‘দেখুন, এখন খুঁজে পাওয়া যায় কি না বিড়ালটিকে?’
স্বননের কথায় কয়েকজন এ রুম থেকে ও রুমে বিড়ালটিকে খুঁজতে থাকে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে। স্বননের মনে রহস্য আরো ঘনীভূত হয়।
স্বনন যখন ওদের সান্ত¡না দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তখন পুবাকাশ ক্রমশ ফরসা হচ্ছে।

চার.
‘দাদা, তোকে ডাকছে।’
‘কে? স্বনন বিছানা থেকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে।’
‘ড্রয়িং রুমে বসে আছে তোর কলেজ জীবনের বন্ধু।’
‘নাম কী?’
‘জোনাথান লিংকন।’
‘লিংকন!’
ছোটবোন মিমোসার কথায় স্বনন তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সোয়া দশটা বাজে। উহ্! মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুম হয়েছে- এর মধ্যে কি না লিংকন এলো। ছোটবেলার বন্ধু বলে কথা, অন্য কেউ হলে দেখাই করত না। বাড়ি নেই বলে বিদায় করে দিত। স্বনন তাড়াতাড়ি ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ে।
ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে চলে যায়। ওকে দেখেই লিংকন চেয়ার ছেড়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দেয়। হ্যান্ডশেক করার পর স্বনন ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা!
পাশাপাশি সোফায় বসে দুজন নাস্তা খেতে থাকে। কুশলাদি জিজ্ঞেসের পর স্বনন বলে, তুই এখন কি করছিস ফ্রেন্ড? কোথায় আছিস?
‘তোর মতো অতবড় বিজ্ঞানী হতে পারিনি ঠিক তবে ছোটখাটো কিছু একটা হয়েছি। আছি ‘জাঙ্গল রোড’-এর কাছে একটি বাড়িতে।’
‘কি করছিস ওখানে?’
‘ওখানেই আমার সবকিছু। আবার বাড়ি কাম ল্যাবরেটরি।’
‘ল্যাবরেটরিটা কিসের?’
‘জেনেটিক বিজ্ঞানের।’
‘গবেষণার অগ্রগতি কেমন?’
‘ভালোই।’
‘নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পেরেছিস?’
‘হ্যাঁ, পেরেছি কিছুটা।’
‘কি সেটা?’
‘পরে বলব খন। তার আগে বল, তুই কতদিন এখানে আছিস, মানে গ্রহান্তরে কবে নাগাদ যাচ্ছিস?’
‘দু’এক মাস তো দেরি হবেই; বেশিও হতে পারে। অনেক দিন পর নিজগ্রহে এসেছি। অন্যদেশ বা আমার পিতৃভূমি বাংলাদেশেও যেতে হবে।’
স্বননের কথা শুনে লিংকনের মুখটা কেমন কালো হয়ে যায়। স্বনন লিংকনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই যাবি আমার সাথে বাংলাদেশে?’
‘না। আজ তাহলে উঠি।’
‘এত তাড়া কিসের? এখন তো আমার অখ- সময়। আমাকে নিয়ে যাবি না তোর ল্যাবরেটরিতে?’
‘পরে একদিন এসে নিয়ে যাবো। লিংকন দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়।’
স্বনন কিছুটা অবাক হয়। ও এভাবে হঠাৎ করে উঠে চলে গেল কেন? বেশ কথা বলছিল। কি জন্য এসেছিল কিছুই বোঝা গেল না। স্বননের হঠাৎ ইচ্ছে জাগে ওর ল্যাবরেটরিটা দেখার। নতুন কিছু আবিষ্কার করছে নিশ্চয়ই। খুব ভালো ছাত্র ছিল ও। মাইক্রো বায়োলোজি খুব ভালো বুঝতো। স্যাররা বলতো তুই বড় হয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার হবি। স্যারদের কথাটা ফলে গেছে। স্বনন নাস্তার টেবিল থেকে উঠে পড়ে।

পাঁচ.
লিংকনের হঠাৎ করে বাসায় আসা এবং হঠাৎ করে চলে যাওয়া স্বননের মনে একটা রহস্যে জন্ম দেয়। কী কারণে লিংকন এসেছিল? বন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ? হতেই পারে। অনেক দিন পর বন্ধুকে দেখার সাধ জাগতেই পারে মনে। তাহলে তো ওর আন্তরিকতার সঙ্গে ওকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর কথা। হয়তো ব্যস্ততার কারণে ও বেরিয়ে গেল। কিন্তু স্বনন বেশিদিন দেশে থাকার কথা শুনে মুখটা ওর কেমন কালো হয়ে গেল। এর কারণটা কী? এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।
স্বনন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা। অন্যদিন রাত বারোটা-একটার দিকে বাইরে বেরোলেও আজ একটু আগে-ভাগেই বাড়ি থেকে বের হয় স্বনন। বড় একটা পাজেরোতে উঠে পড়ে। আগে লিংকনের বাড়িতে যাবে তারপর দু’বন্ধু মিলে চিতা-রহস্য খুঁজে বের করবে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর স্বননের পাজেরো গাড়িটি থেমে পড়ে লিংকনের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে দেখে বিশাল বাগানবাড়ি। চারিদিকে বন-বনানীতে ঘেরা। বেশ নির্জন; আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। ৪-৫ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট বন রয়েছে। বাগানের ভিতরেই গেট করা ছোট ছিমছাম বাড়ি। গেটে পরিচয় দিয়ে স্বনন ঢুকে পড়ে ড্রয়িং রুমে।
ড্রয়িং রুমে ঢুকেই স্বননকে দেখে চমকে ওঠে লিংকন। ও কল্পনাও করেনি যে স্বনন ওর এখানে চলে আসবে। মনটা খারাপ হয়ে গেলেও মুখে হাসি টেনে লিংকন বলে, ফ্রেন্ড! আমি তো একটু পরেই বেরুব। তুই বলে আসতে পারতিস।
‘তুই তো সেদিন তাড়াহুড়া করে চলে আসলি। তোর নাম্বারটা তো আমার কাছে নেই।’
‘ও তাই তো! লিংকন কি যেন ভাবতে থাকে।’
‘আজ না বেরুলেই নয়? এতদিন পর এলাম, দু’বন্ধু একটু গল্প-গুজব করি।’
লিংকন স্বননের পাশের সোফায় বসে পড়ে।
‘তুই নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিস?’
‘হ্যাঁ। ঘাড় নেড়ে মৃদু স্বরে বলে লিংকন।’
‘কি সেটা? দেখানো যাবে? স্বনন কৌতূহলী হয়ে ওঠে।’
‘না, মা-নে…।’
‘এত ইতস্তত করছিস কেন? এটা তো খুশির খবর।’
‘না, মা-নে; এখনো তো জিনিসটা গোপনীয় রয়েছে। তাই…।’
‘আমি তোর বন্ধু। গোপনই রাখব। তুই গবেষণায় আরো উন্নতি কর এটাই আমার কামনা।’
‘ঠিক আছে চল।’ লিংকন উঠে দাঁড়ায়।

ছয়.
লিংকন স্বননকে সাথে নিয়ে ওর বিশাল গবেষণাগারে ঢুকে পড়ে। বিশাল হল রুম। এ হল রুমের দেয়ালের সাথে রয়েছে ছোট ছোট খোপ। এ খোপে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। হল রুম পেরিয়ে লিংকন স্বননকে একটি নির্জন রুমে নিয়ে যায়। এ রুমে ঝুলানো রয়েছে কয়েকটি বড় আকৃতির খাঁচা। একটি খাঁচায় চোখ পড়তেই স্বনন চমকে ওঠে। দেখে খাঁচাটি রয়েছে একটি দু’মাথাওয়ালা ইঁদুর। যার একটি মাথা ইঁদুরের আরেকটি ছুঁচোর। আরেকটি খাঁচার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে বিড়াল আর কুকুরের সংমিশ্রণে একটি প্রাণী। প্রাণীটির মাথাটা বিড়ালের আর ধড় থেকে বাকি অংশ কুকুরের। পাশেরটিতে রয়েছে বকের মতো মাথাওয়ালা কচ্ছপ। স্বনন অবাক নয়নে এসব অদ্ভুত প্রাণী দেখতে থাকে। ছোটবেলায় সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ নামের ছড়ায় সে এমনটা পড়েছে এবং ছবিও দেখেছে। এর যে বাস্তব রূপ দেখবে তা ওর কল্পনায়ও আসে নি কোনোদিন।
‘কি ভাবছিস ফ্রেন্ড?’
লিংকনের কথায় ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। বলে, ভাবছি এগুলো তুই কি করে করলি?
‘জেনেটিক উপায়ে কাটাছেঁড়া করে।’
‘কোনো সমস্যা হয় নি?’
‘প্রথমে তো একটু সমস্যা হয়েছেই; দু-চারটা মারাও গেছে। কিন্তু এখন আমি তা কাটিয়ে উঠেছি।’
‘মানে এখন পুরোপুরি সাকসেসফুল?
‘হ্যাঁ, বলতে পারিস।’
‘এর পরবর্তী কোনো গবেষণা আছে তোর?’
‘আছেই তো।’
‘যেমন?’
‘থাক না আজ।’
‘বল না, অসুবিধা কিসের?’
‘অসুবিধা তো একটু আছেই।’
‘আমার কাছেও বলা যাবে না?’
‘যাবে, তবে অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার। থাক না আজ।’
‘না শুনে আজ উঠছি না ফ্রেন্ড।’
স্বননের নাছোড় মনোভাব দেখে লিংকন নিচু স্বরে বলতে থাকে, ‘শপথ কর গোপন রাখবি ব্যাপারটা।’
স্বনন মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে। লিংকন বলতে থাকে, এরপরের ধাপে আমি বানরের ধরের সাথে মানুষের মস্তক কিংবা মানুষের ধরের সাথে বানরের মস্তক প্রতিস্থাপন করব।
‘বলিস কি! স্বননের চোখ বড় হয়ে ওঠে।’
‘আর এটা সাকসেসফুল হলেই আমি এক মানুষের ধরের সঙ্গে আরেক মানুষের মস্তক প্রতিস্থাপন করতে পারব।’
‘এটা কিভাবে সম্ভব? আর এটা তো আইনতও নিষিদ্ধ।’
‘নিষিদ্ধ দেখেই তো গোপনে করতে হবে। আমাদের গ্রহে মানবক্লোনও তো নিষিদ্ধ আছে কিন্তু এই মানব বিজ্ঞানীরাই অন্যগ্রহে গিয়ে ঠিকই সাকসেসফুল হয়েছে।’
লিংকনের কথায় স্বনন কি যেন ভাবতে থাকে। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে হঠাৎ পিস্তল বের করে লিংকনের মাথা বরাবর তাক করে বলে, ‘ফ্রেন্ড, পৃথিবী নামক এই সুন্দর গ্রহে তুই অসুন্দর বেআইনি কাজ করতে পারিস না। এতে মানুষ শুধু খুনই হবে কিন্তু তুই কখনো সাকসেসফুল হতে পারবি না।’
স্বননের তাক করা পিস্তলের দিকে তাকিয়ে লিংকন খ্যাক খ্যাক করে বিদ্রƒপের হাসি হাসে। বলে, ‘তুই কিন্তু তোর ওয়াদা ভঙ্গ করছিস। স্বনন তোকে অনেক বড় বৈজ্ঞানিক বলে জানতাম কিন্তু তোর মধ্যে এখনো সংস্কার রয়ে গেছে। বিশ^জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই।’
‘সংস্কার নয় ফ্রেন্ড। এটা কল্যাণ-অকল্যাণের কথা। বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে একটু না হয় পাপই করলাম।’
‘তাহলে তুই পিস্তল সরাবি না আমার সামনে থেকে।’
‘না। বাইরে গাড়িতে পুলিশ রয়েছে। মোবাইলে খবর দিলে ওরা তোর বাড়িটা ঘিরে ফেলবে। আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম যে শিশু নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে তোর একটা যোগসূত্র রয়েছে- এমনটা বুঝতে পেরেই পুলিশ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমি চাচ্ছি তুই আমার বন্ধু, আমার কাছেই সারেন্ডার কর।’
‘হা হা হা! লিংকন হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসি থামিয়ে বলে, তুই নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করিস, না? আরে আমিও বুঝতে পেরেছিলাম তুই আমার পিছে লেগেছিস তাই তুই কবে এদেশ থেকে দূর হবি সেটা জানতে তোর বাড়ি গিয়েছিলাম।’
স্বনন অবাক হয়ে ভাবতে থাকে-ও কিভাবে টের পেলো আমি ওর পিছু নিয়েছি। এর আগে তো ওর সাথে আমার দেখাই হয়নি।
‘কি ভাবছিস? অবাক ব্যাপার তাই না? সেই দিনের সেই চিতাবাঘটিই আমি। আমিই বিড়াল, বনবিড়াল, চিতা বিভিন্ন পশুর রূপ ধরে বাড়িতে ঢুকে শিশুগুলোকে এখানে নিয়ে এসেছি- আমার এক্সপেরিমেন্টের জন্য। তোর পাশে গ্লাসের পর্দাটা টেনে দ্যাখ, এ পর্যন্ত কতগুলো শিশু জোগাড় করেছি।’
স্বনন হতভম্ব হয়ে যায় ওর কথায়; যতখানি ওকে সন্দেহ করেছিল তারচেয়ে শতগুণ বেশি দোষী। তাহলে ও বিভিন্ন রূপও ধরতে পারে কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব?
‘তুই আমাকে গ্রেফতার করবি? হা হা হা!’ আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে লিংকন। হাসি থামিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে একটি ছোট ঔষধের শিশি বের করে। শিশিটির মুখ খুলে এক চুমুকে খেয়ে নেয় তরল ঔষধটুকু।
স্বনন মনে করে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করছে লিংকন। ও চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘না ফ্রেন্ড! তুই মরতে পারিস না।’ কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই লিংকন মেঝেতে ঢলে পড়ে। স্বনন ওর দিকে আগাতে যাবে এমন সময় বিকট এক চিৎকারে ও সরে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে লিংকনের দেহটি প্রচ- জোরে ঝাঁকুনি খেতে থাকে। স্বনন দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে দেহটি ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেটি একটি কালো চিতাবাঘে রূপ নেয়। এরপর ভয়ংকর শব্দে ডেকে উঠে চিতাটি দৌড়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। স্বনন হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে ওর গমন পথের দিকে।
হঠাৎ আরেকটি বিকট শব্দে রুমের ভিতরে তাকায় স্বনন। দেখে- চিতাটি বের হবার পর পরই ছোট্ট ডিম্বাকৃতি একটি বস্তু মেঝেতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ধোঁয়ার বিষক্রিয়ায় স্বনন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

সাত.
স্বননকে একটি রুমের ভিতর আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু ওর হাত-পা খোলা। রুমটি বিশাল আকৃতির। দেয়ালের সাথে লাগোয়া শেলফগুলোতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। স্বনন দেখে বুঝতে পারে এটা কোনো সাধারণ রুম নয়, কোনো ল্যাবরেটরি হবে হয় তো। ল্যাবরেটরির ভিতরে কেন ওকে আটকে রাখা হয়েছে স্বনন কিছুতেই তা বুঝতে পারে না।
স্বনন মেঝের এক কোণে পড়ে ছিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। কিভাবে এখানে এলো কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারে না। ওর শুধু মনে পড়ছে ঘনীভূত এক ধূ¤্রজাল। ধোঁয়াগুলো ওর নাকে-মুখে ঢুকে ক্রমশ ওকে দুর্বল করে ফেলছে। এরপর ওর আর কিছু মনে নেই। স্বনন উঠে দাঁড়াবে এমন সময় লক্ষ্য করে- অদ্ভুত আকৃতির কয়েকটি জীব ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের জীব না বলে দৈত্য বলাই ভালো। রূপকথার গল্পে এ ধরনের বিশালদেহী দৈত্যের ছবি ও দেখেছে। তবে কী ও কোনো দৈত্যপুরীতে চলে এসেছে?
একটি দৈত্যের মতো জীব স্বননের কাছে আসতেই ও লক্ষ্য করল- বিশাল দেহ, ১৪-১৫ ফুটের মতো লম্বা; মুখের আকৃতি অনেকটা চিতা বাঘের মতো। স্বনন কিছু বলার আগেই জীবটি নিচু হয়ে ওকে এক হাত দিয়ে তুলে নিয়ে চলতে শুরু করল। অন্যজীবরা ওকে অনুসরণ করে চলতে লাগল। জীবটি স্বননকে নিয়ে ঢুকল আরেকটি ল্যাবরেটরি রুমে। রোগী দেখার উঁচু টেবিলের মতো একটি বিছানায় ওকে শুইয়ে দেওয়া হলো। স্বনন বুঝতে পারছে না ওকে নিয়ে কী করবে ওরা। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল- রুমটি বেশি বড় নয়, এ রুমের ভিতরেও রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি; তবে তার বেশির ভাগই বায়োলোজিক্যাল। স্বননের মাথায় কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কী দৈত্যরাও গবেষণা করে? ইতোমধ্যে আরেকটি দৈত্য কয়েকটি ছুরি-কাঁচি এনে স্বননের পাশের ছোট টেবিলের পর রাখল। স্বনন এখনো বুঝতে পারছে না ওকে নিয়ে কী করবে ওরা। সাহস করে একজনকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় এসেছি আমি? আপনারা কারা?
ওর পাশে দাঁড়ানো দৈত্যটি জবাব দিলো, এটি ‘আনলাক-১৩’ নামের একটি গ্রহ। আমরা এ গ্রহের বাসিন্দা।
‘এখানে আমি কিভাবে এলাম?’
‘আমরা তোমাকে নিয়ে এসেছি।’
‘কী জন্য?’
‘গবেষণার জন্য।’
উত্তর শুনে স্বনন মনে মনে একটু খুশিই হলো। ভাবল- ওকে বিজ্ঞানী হিসেবে ওদের গবেষণার কাজে লাগাবে। একটু উৎফুল্ল হয়ে বলল, বেশ ভালো, তাহলে সব খুলে বলো কী করতে হবে আমাকে?
স্বননের কথা শুনে ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, আমরা হাসতে জানি না। তাই তোমার কথায় হাসতে পারছি না। তুমি এখনো বুঝতে পারনি তোমাকে নিয়ে আমরা কী করতে যাচ্ছি?
ওর কথায় স্বননের মুখের হাসি হাসি ভাবটা হঠাৎ নিভে গেল। মনমরা হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে তোমরা কী করবে?
‘তুমি আমাদের গবেষণার উপাদান; তোমাকে আমরা কাটাছেঁড়া করব। তোমার ওপর আমরা এক্সপেরিমেন্ট চালাব।’
‘কী বললে!’ ওর কথায় স্বনন কিছুটা ভড়কে গেল। ও বুঝতে পারল- ওকে ওরা ওদের ল্যাবরেটরির ‘গিনিপিগ’ বানিয়েছে। এদের হাত থেকে ও কিভাবে মুক্তি পাবে- স্বনন চিন্তায় পড়ে গেল। এরপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে স্বনন মনমরা হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। একজন বাদে অন্য জীবরা রুম থেকে বের হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর স্বনন ওয়াশ রুমে যাবার ইঙ্গিত করল। পাহারারত জীবটি ওকে ওয়াশ রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর ওয়াশ রুমের ভিতরে একটি লাল অলো জ¦লে ওঠে। দরজা আপনা আপনিই খুলে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়ানো জীবটি বলে, তোমার সময় শেষ। চলো তাড়াতাড়ি।

আট.
লিংকনকে দেখেই স্বনন চমকে ওঠে। ও এখানে! হ্যাঁ, লিংকনই তো; ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। লিংকন স্বননের বিছানার কাছে আসতেই পাহারারত জীবটি চলে যায়। লিংকন কপট হাসি হেসে বলে, কেমন আছিস ফ্রেন্ড?
‘দেখতেই তো পাচ্ছিস। কিন্তু তুই এখানে কিভাবে এলি? স্বননের চোখে বিস্ময়ের ভাব।’
‘আমি! আবার কপট হাসি হাসে লিংকন। হাসি থামিয়ে বলে, এটাও তো আমার বাসস্থান।’
‘মানে?’
‘এখানেও আমার একটি বাড়ি আছে, আর আছে ছোট একটি গবেষণাগার।’
‘তাহলে তুই ওদের সাথে সম্পৃক্ত?’
‘বলতে পারিস।’
‘বুঝতে পারছি অপকর্মের উপযুক্ত স্থান হিসেবে তুই বেছে নিয়েছিস…।’
‘তোকে সব খুলেই বলি। স্বননকে থামিয়ে দিয়ে লিংকন বলতে থাকে, তোর আর আয়ু মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এর মধ্যে তুই মারা যাবি কিংবা অন্য কোনো জীবে রূপান্তরিত হবি। কাজেই তোকে সব খুলে বলা যায়। আর তুই বেঁচে থাকলেই বা কী? এখান থেকে তো কোনোদিন তুই আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবি না।’
লিংকনের কথা শুনে স্বননের মনটা খারাপ হয়ে যায়। মনটা দুর্বল হলেও নিজেকে শক্ত রাখে। বলে, ‘তাহলে তুই বিজ্ঞানকে খারাপ দিকে কাজে লাগিয়ে সফল হতে চাচ্ছিস? পৃথিবীতে সফল হবার সম্ভাবনা নেই দেখে এখানে ঘাঁটি গেড়েছিস?’
‘কিছুটা ঠিক; তবে পুরোপুরি নয়। পৃথিবী থেকে আমি কাঁচামাল সংগ্রহ করে এখানে পাচার করছি। এখানে যেমন নির্বিঘেœ গবেষণা চালাতে পারছি, তা পৃথিবীতে সম্ভব হতো না। তা ছাড়া ওখানে আমার আপনজনেরাই তো বড় শত্রু। শেষের কথাটা স্বননকে কটাক্ষ হেনে বলে লিংকন।’
‘তাহলে তুই কল্যাণের পথে ফিরে আসবি না?’
‘আমি কোনো অকল্যাণ করছি? তোর দৃষ্টিতে যা অকল্যাণ অন্যের দৃষ্টিতে তা কল্যাণকর। মানব-ক্লোন প্রযুক্তি পৃথিবীতে নিষিদ্ধ আছে কিন্তু পৃথিবীর বিজ্ঞানীরাই অন্য গ্রহে গবেষণা করে সফলতা অর্জন করেছে। এখন তো সবাই তাদের বাহবা দিচ্ছে। একদিন আমাকেও সবাই বাহবা দিবে। আমি যে চিতা বা অন্য প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে পারি তা ওদের কল্যাণেই। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখনো এমন ঔষধ আবিষ্কার করতে পারেনি।
‘কিন্তু মানুষ হত্যা করে…।’
‘বড় কোনো সফলতার জন্য ছোটখাটো কিছু ক্ষতি মেনে নিতেই হবে। ঠিক আছে ফ্রেন্ড, বিশ্রাম নাও।’
লিংকন চলে যাচ্ছিল এমন সময় স্বনন কিছুটা করুণ স্বরে বলে, আমার কী হবে ফ্রেন্ড?
স্বননের কথায় লিংকন থেমে ফিরে তাকিয়ে বলে, পৃথিবী থেকে অনেক প্রাণী বা শিশুদের এখানে নিয়ে এসেছি কিন্তু তোমার মতো বুদ্ধিমান কোনো মানুষকে এখানে আনতে পারিনি। আমাদের গবেষণার জন্য একজন বুদ্ধিমান মানুষের খুবই প্রয়োজন ছিল। দুঃখ করো না ফ্রেন্ড, তোমাকে অন্যকোনো প্রাণীর ভিতরে বাঁচিয়ে রাখব-এটুকু কথা দিতে পারি। হাজার হলে ফ্রেন্ড তো! লিংকন একটু কপট হাসি হেসে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

নয়.
স্বনন ওই টেবিলের মতো উঁচু বিছানাতেই নিথর হয়ে শুয়ে আছে। ওর চারপাশে দৈত্যাকৃতির জীবগুলো শলাপরামর্শ করছে :
প্রথম জীব : ওকে কাটাছেঁড়ার পূর্বে রূপান্তরের ঔষধটা খাওয়ানো উচিত ছিল।
দ্বিতীয় জীব : ঔষধ তো খাওয়ানো হয়েছে কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
প্রথম জীব : ক্যানো?
তৃতীয় জীব : মনে হচ্ছে ওই ঔষধে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে; দেহও কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
প্রথম জীব : নিশ্চয়ই তোমরা ওকে ভুল ঔষধ খাইয়েছো?
দ্বিতীয় জীব : এখন কী করব আমরা?
তৃতীয় জীব : এখন কাটাছেঁড়ার এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। একে একে হাত-পা অর্থাৎ প্রতিটি অঙ্গ কেটে অন্য প্রাণীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
দ্বিতীয় জীব : হাত-পা’র চাইতে কিন্তু ওর ব্রেনটা বেশি দামি। আমার মনে হয় হাত-পা না কেটে ওর ব্রেনটা আগে বের করে নিই।
প্রথম জীব : থামো তোমরা। ও এখন দুর্বল। ওকে নিয়ে এখন কিছুই করা যাবে না। দেখছ না কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না এমন ভুল কাজটা করল কে?
তৃতীয় জীব : মি. লিংকন।
প্রথম জীব : তিনি এমন ভুল ঔষধ খাইয়েছেন?
দ্বিতীয় জীব : হ্যাঁ। কিন্তু এখন আমাদের করণীয় কী?
প্রথম জীব : ওকে একটি পাওয়ারফুল ইনজেকশন দাও; যাতে ও আধ ঘণ্টার মধ্যে সুস্থ-সবল হয়ে ওঠে।
প্রথম জীবের কথা মতো দ্বিতীয় জীবটি টেবিলের পর রাখা ট্রে হতে একটি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে স্বননের দিকে এগিয়ে যায়। এমন সময় ‘না!’ শব্দ করে দ্রুতবেগে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে লিংকন। ওর হাতেও আরেকটি সিরিঞ্জ। এ ঔষধটি লিংকনের নতুন আবিষ্কার যা পুশ করলে স্বনন অন্য কোনো প্রাণীতে রূপান্তরিত হবে না হয় চিরতরে মানসিক রোগী হয়ে যাবে।
লিংকন স্বননের ডানহাতে ইনজেকশন পুশ করবে এমন সময় প্রচ- শব্দে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। সে বিস্ফোরণের উজ্জ্বল আলোতে রুমটি ঝলসে যায়। কেউ তাকাতে পারে না। দরজা দিয়ে রুমের ভিতর আরেকটি লম্বা জীব ঢুকতে দেখা যায়। তবে এ জীবটি ওদের মতো এত লম্বা নয়, চেহারাতেও ওদের সাথে কোনো মিল নেই। জীবটি দ্রুতগতিতে স্বননের বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে কাঁধে তুলে নেয়। জীবটি রুম থেকে বেরনোর পর পরই প্রচ- বিস্ফোরণে রুমটি জ¦লে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
ওখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে জীবটি স্বননকে ছোট্ট একটি ইনজেকশন দেয়। কিছুক্ষণ পর স্বনন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। তাকাতেই দেখে- বনবন ওর পাশে বসে আছে; মাথাটা ওর কোলের মধ্যে নোয়ানো। স্বনন ক্ষীণস্বরে বলে, বন্ধু তুমি এসেছো! ওয়াশ রুমে গিয়ে তোমাকে সংবাদ না দিলে আজ কী যে হতো…।
ভয়ে স্বননের কথা আটকে যায়। বনবন বলে, আর কোনো ভয় নেই বন্ধু। ওদের ল্যাবরেটরি আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। ওরা সবাই মারা পড়েছে। এবার চলো, তোমাকে পৃথিবীতে পৌঁছে দেবো।
স্বনন একটু স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলে বলে, হ্যাঁ, চলো।

Share.

মন্তব্য করুন