অফিস শেষে বাসায় ফিরে লাগেজ নিয়ে চলে এলাম ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে। রাত ৮টা বেজে ৩০ মিনিট। ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো। ঝক ঝক ঝক শব্দ করে পুণ্যভূমি সিলেটের উদ্দেশে ছুটে চলল উপবন এক্সপ্রেস।
তোমরা জানো বোধহয় ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনটি মার্কিন স্থপতি রবার্ট বাউগির নকশায় স্থাপিত। প্রতিষ্ঠিত ১৯৬০ সালে, চালু হয় ১৯৬৯ সালে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেল যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা হোক সিট নম্বর জানা না থাকায় ভ্রমণ টিমের আহ্বায়ক জাকি ভাইকে ফোন দিলাম। সবকিছু অনলাইনে নির্দেশনা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে আমার অনলাইন অফ ছিলো। ফোনের নির্দেশনা অনুযায়ী এক বগি থেকে আরেক বগি ঘুরে ঘুরে ভিড় ঠেলে কাক্সিক্ষত সিট পেলাম। ও হ্যাঁ পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও এটিই আমার প্রথম ভ্রমণ। মৃদু শীতের মধ্যেও ঘর্মাক্ত শরীরে বসে পড়লাম আমি, আইমান আর আইমানের আম্মু। বলাই হয়নি, মুসনাঈন আইমান আমার একমাত্র পুত্র। বয়স ২২ মাস। সারা রাত ও আমার কোলেই ছিল। পাশেই তাওহীদ ভাইয়ের পরিবার। ভাই-ভাবী তিন সন্তান তাফহীম (১২), তানিশা (১০) আর কোলের বাবু তানজিম (১৮ মাস)। আরও দুই বগিতে আছে শুদ্ধ কবি-শিল্পীদের ২০টি পরিবারের ৬৫ জন সদস্য। শিশু বৃদ্ধ তরুণ যুবক নারী পুরুষ মিলে ট্রেনের তিন বগি ভর্তি শিল্প ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
ঢাকা এয়ারপোর্ট এবং টঙ্গী পার হওয়ার পর পরই চলে এলো স্বেচ্ছাসেবকরা নাস্তা দেয়ার জন্য। সিট প্ল্যান অনুযায়ী নাস্তা বিতরণ করা হলো পরটা সবজি আর মিনারেল ওয়াটার।
নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুলাউড়া হয়ে ছুটে চলছে উপবন এক্সপ্রেস। দুই পাশে সবুজ গাছপালা পত্রপল্লব, মাঝেমধ্যে ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, দোকানপাট। রাত ২টায় পৌঁছে বাংলাদেশের চা রাজ্য শ্রীমঙ্গলে। ঠা-া বাতাস ছেড়েছে। নগর জীবনের কোলাহলমুক্ত বনাঞ্চলের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত চা বাগানের স্বর্গের সুবাসে হারিয়ে যায় মন। শ্রীমঙ্গলের পূর্বপাশে কিছু অংশ হাওর ছাড়া পুরুটা চা বাগান দ্বারা আবৃত। এটি মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত।
শ্রীমঙ্গলে ট্রেনের লম্বা যাত্রা বিরতির পর আবার শুরু হয় পথ চলা। সিলেট অঞ্চলে প্রচ- ঠা-া অনুভূত হয়। কনকনে শীতের মধ্যে ২৩৫ কিলোমিটার ট্রেনের জার্নি শেষে ভোর ৫টায় আমরা পৌঁছে যাই সিলেট রেলস্টেশনে। সিলেট রেলস্টেশন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহৎ রেলস্টেশন। ১৯১২-১৫ সালে এই অঞ্চলে রেল যোগাযোগ চালু হয়। সুরমা নদীর দক্ষিণ পাশে সিলেট রেলস্টেশনের অবস্থান। কিন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি এবং জিতু মিয়ার বাড়ি সিলেট শহরের ঐতিহ্য।
খায়ের ভাইয়ের ৪ বছর বয়সী ছেলে আয়াতের চটপটে কথায় সকলের শীত পালিয়ে যায়। নিরাপদ ভ্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পূর্বনির্ধারিত বাংলাদেশ ব্যাংকের দু’টি স্টাফ বাস আমাদেরকে নিয়ে যায় সিলেট শহরের উত্তর জেল রোডে অবস্থিত অভিজাত হোটেল পানশি ইনে। এখানে আছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা ওয়াল টিভি, ফ্রিজ, সুবিশাল খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফোন, ঠা-া এবং গরম পানির সুব্যাবস্থা, পেস্ট ব্রাশ নতুন টাওয়েল ইত্যাদি সব আয়োজন। ফজরের সালাত আদায় করে হালকা রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নাস্তার ব্যবস্থা চিকেন ভুনা খিচুড়ি, ডিম আর গরম চা খেয়ে দিনের যাত্রা শুরু।
প্রথমেই নির্ধারিত গাড়ি ছুটে চলল তামাবিল স্থলবন্দরের দিকে। সিলেট থেকে তামাবিলের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। পথ চলতে চলতে গাড়িতে সকলকে মাতিয়ে রেখেছেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী আবু শাকের মোহাম্মদ ইউনুচ ভাই। বাংলাদেশে ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে ১৩টি চালু আছে। এর মধ্যে তামাবিল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর। এটি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা। তামাবিল বাংলাদেশ এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত। এ বন্দর দিয়েই ভারত থেকে কয়লা এবং পাথর আমদানি করা হয়। তামাবিলের অপর প্রান্তে ভারতের ডাউকি বাজার। তামাবিল থেকে মেঘালয় রাজ্যের শিলং পাহাড়, পর্বত, ঝর্ণার জলপ্রপাত দেখা যায়। পাশেই বয়ে চলেছে সিলেটের নীলনদ লালাখাল। সব মিলিয়ে উপভোগ করা যায় অপূর্ব দৃশ্য সবুজ বৃক্ষ শাখা, আকাশচুম্বী পাহাড় প্রকৃতির শোভা ¯িœগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের মন।
তামাবিল জিরো পয়েন্ট হলো ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ গেইট। এরপর আমরা চলে যাই পার্শ্ববর্তী স্থান জাফলং। এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং। এ প্রান্ত থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতু দেখা যায়।
এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন। মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় রয়েছে পাহাড়ি উত্তরবঙ্গ। দূর থেকে উঁচু উঁচু পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। আর পাহাড়ের গায়ে নরম তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও বেশ মনোরম। স্বচ্ছ পানির মধ্যে পাথর দেখে আমাদের মন জুড়িয়ে যায়। যা আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ মহিমা। গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছা করে, ‘কী বিপুল সৃষ্টি তোমার দেখে নয়ন মুগ্ধ হলো…।’ জাফলং প্রকৃতির কন্যা হিসাবেও পরিচিত।
জাফলংয়ের বল্লা ঘাটে জুমার নামাজ আদায় করে লাঞ্চ শেষে আমরা সিলেট শহরের উদ্দেশে রওনা দেই। ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লাকাতুরা নামক স্থানে আসরের নামাজ আদায় করে সবুজে আচ্ছাদিত চা বাগানে ঘোরা হয়।
দিন শেষে আমরা নগর সিলেটের মধ্যখানে টিলার ওপর চিরনিদ্রায় শায়িত হযরত শাহজালাল (র.) মাজারে পৌঁছাই। সালাতুল মাগরিব আদায় করে মাজারের চতুর্পাশ ঘুরে দেখি এলাহি কা-! শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ আবালবৃদ্ধবনিতা মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মুক্তির আশায় অনেকে প্রার্থনা করছেন। হজরত শাহজালাল (র.) একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর ছিলেন। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। মাজার চত্বরের উত্তর পাশের পুকুরে মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে মনের সুখে, যা আমাদেরকে বেশ আনন্দ দেয়। ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়। পশ্চিম পাশে আছে ঝরনা ও কূপ। এরপর ভাঙা ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। সালাতুল এশা এবং ডিনার শেষে হলরুমে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মহিলাদের জন্য পিলো পাস আর সকলের জন্য চলতে থাকে কেরাত, হামদ-নাত, কবিতা-গান ইত্যাদি। জেবা মাইশা, ইকবাল ভাইয়ের ছেলে জাহিন তাজ, জাকি ভাইয়ের ছেলে তাশদিক বিল জিনান এবং বৃদ্ধ পিতার পরিবেশনা সকলকে মাতিয়ে তোলে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মনকে চাঙ্গা করে দেয়। অনুষ্ঠান শেষে রাতে ফ্রেশ ঘুম।

পরদিন সকালে সিলেট শহরের বিমানবন্দর রোড ধরে বেরিয়ে পড়ি সাদা পাথরের দেশে। চিক চিক করা রূপালি বালু আর ছোট-বড় অসংখ্য সাদা পাথর মিলে এ যেন পাথরের রাজ্য। পাথর পানি আর পাহাড়, এই তিন নিয়েই সিলেটের ভোলাগঞ্জ। সাদা পাথরের আধিক্যের জন্য ভোলাগঞ্জকে সাদা পাথরের দেশ বলা হয়। নৌকায় যাওয়ার পথে নীল পানিতে ভেসে যেতে অন্য রকম আনন্দ অনুভূত হয়। ধলাই নদীর মনোলোভা রূপ সবুজ পাহাড় বন্দী এলাকা। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদের উৎস মুখে এর অবস্থান। পাঁচ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাদা সাদা পাথর। এ যেন আরেক বিছানাকান্দি। যতদূর চোখ যায় দুই দিকে কেবল সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ নীল পানি আর পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। এ যেন অপরূপ এক স্বর্গরাজ্য।
রাতারগুল : চিকন আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এরপর আমরা চলতে থাকি রাতারগুলের উদ্দেশে। পথিমধ্যে একটি মসজিদে জোহর এবং আসরের কসর নামাজ আদায় করে খোলা মাঠে লাঞ্চ করা হয়। পথ চলতে চলতে পৌঁছে যাই রাতারগুল। এটি একটি জলবন সিলেটের সুন্দরবন নামে খ্যাত। ৩০,৩২৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্মৃত এই এলাকার ৫০৪ একর জায়গায় রয়েছে বন আর বাকি জায়গা জলাশয়ে পূর্ণ। যা বাংলার আমাজন নামে পরিচিত। উত্তর মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্রােতস্বিনী গোয়াইন নদী দক্ষিণে বিশাল হাওর মাঝখানে সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবন রাতারগুল। সারা পৃথিবীতে স্বাদু পানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশে দুটি- এর মধ্যে একটি শ্রীলঙ্কায় আরেকটা আমাদের দেশের রাতারগুল। এই বনের ভিতর ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির রূপসুধা। সত্যি বলতে কী নৌকায় চড়তে আমার কেমন জানি মাথা ঘুরায়। তাই সব ভালোভাবে দেখাও যায়নি।
সন্ধ্যায় শহরে ফিরে সিলেটে কর্মরত ছোট ভাই আব্দুল্লাহর সাথে মার্কেটে ঘুরে বন্দর থেকে চা পাতি এবং আইমানের জন্য আঙ্গুর কমলা ও কলা কিনে দেয় তার ছোট চাচ্চু। সব শেষে হোটেলে ফিরে ডিনারের পর শুরু হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। ভ্রমণের সদস্য সচিব আল্লামা ইকবালের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন কবি আমিনুল ইসলাম এবং বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক কবি-শিল্পী সাংবাদিক জাকিউল হক জাকি।

রাতের ট্রেনে আবার ফিরে আসি কর্মব্যস্ত ঢাকা শহরে। পাহাড় নদী অরণ্য পাথর সবুজ চা বাগানের ভ্রমণ বাংলাদেশের সমৃদ্ধ পর্যটন কেন্দ্রের সাহিত্য সংস্কৃতির এই আয়োজন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Share.

মন্তব্য করুন