বন্দি হয়ে থাকাটা হচ্ছে এক অপমানজনক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। সমাজ কারো হাতে বন্দি হলে একটা সুবিধে পাওয়া যায়। আর তা হলো যে বন্দি করে তার সাথে বাক্যালাপ করে সহজেই মত বিনিময় করা যায়। প্রয়োজন বোধে তাকে বোঝানো যায়। যুক্তি তুলে ধরা যায়। কিন্তু বন্দির সাথে যদি নিচু জাতের মত আচরণ করা যায় তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক হয়। আন্তঃনাক্ষত্রিক যাত্রাপথে চলাচলকারী নভোযান ‘লাল তীর’ এর যাত্রীরা বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী হিশেবে গণ্য করেনি জরিপ যানের সদস্যদের।
এই অচেনা-অজানা গ্রহটিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকগুলো নামতে বাধ্য হয়েছে। এক মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হবে নভোযানটি স্বাভাবিক পথ থেকে ছিটকে সরে নিয়ে মহাশূন্যের অনেক দূরের অচেনা এক অংশে চলে যায়। সেখানে লাল তীরকে অবতরণ করানোটা সম্ভবপর হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পর পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণকারীর যন্ত্রপাতি আর আয়ত্তাধীন থাকে না।
তখন নভোযান চালক বাধ্য হয়ে জরুরি ক্রু ছাড়া বাকিদেরকে নভোযান থেকে নিরাপদ দায়িত্বে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন। প্রথম মেট আলভারাজো তখন তার লোকদের সাহায্যে সম্পূর্ণ দলটিকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে আসে। আনার সাথে সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি দেখা যায়। শোনা যায় প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ। আগুন নিভে যাওয়ার পর নভোযানের চিকিৎসক ডা. নোয়েল বার্নাসকে সাথে নিয়ে আলভারাজো দুর্ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যায়। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য তারা শূন্য জায়গাটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো। বিস্ফোরণের কারণে যে গর্তটি সৃষ্টি হয়েছিলো সেখান থেকে গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ক্যাপ্টেন ও যন্ত্রকৌশলীরা গর্তের ওপরে জমাট বেধে থাকা শাদাটে মেঘের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। পঞ্চাশজন নারীপুরুষের প্রাণ কোনোমতে রক্ষা পেয়েছিলো। এরপর থেকে শুরু হলো বেঁচে থাকার জন্য তাদের প্রাণান্তকর সংগ্রাম। আলভারাজো আর ডা. নোয়েল বার্নাস একটি কমিটি গঠন করে তার সাহায্যে সেই সংগ্রামের মত কঠিন কাজটা শুরু করলেন। সেখানকার পরিবেশটি পুরোপুরিভাবে প্রতিকূল ছিল। একেবারে যেন শত্রুপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো পরিবেশ। বুঝি তাদের দলটিকে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলবে। সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৮৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সর্বদা ঝিরঝিরিয়ে উষ্ণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বাতাসে ভাসছে প্রচুর পরিমাণে ছত্রাক জীবাণু। জীবন্ত ত্বকের প্রতি কোনো ধরণের আকর্ষণ নেই সেসব জীবাণুর। ওদের আকর্ষণ হচ্ছে মৃত, অজৈব বস্তুর প্রতি। তার ওপরে ওরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। সেই বৃদ্ধির হার অবিশ্বাস্য।
সেখানে ভয়ঙ্কর জাতীয় কোনো প্রাণীর আক্রমণের আশঙ্কা নেই। ব্যাঙ জাতীয় এক ধরনের প্রাণী মাটির ওপরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। সেখানকার জলাশয়ে হাঙ্গরের আকৃতির মৎস্যজাতীয় এক ধরনের প্রাণী তরতরিয়ে ভেসে বেড়ায়।
সেখানে খাদ্যের কোনো প্রকার অভাব নেই। একজাতীয় গাছের কা-মূলে জন্মানো ব্যাঙের ছাতার মত রসালো ছত্রাক দেখা যায়। যাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বেঁচে থাকা যায়। চরম খাদ্যসঙ্কটের দরুন সেই রসালো ছত্রাকই তখন তাদের কাছে প্রধান খাবার হয়ে উঠল। বেঁচে থাকার অবলম্বন হলো। কিছু দিনের মধ্যে জাম জাতীয় ফল, গাছের শিকড়-বাকড় ইত্যাদি খাবার উপযোগী জিনিস পাওয়া গেল। যদিও সেখানকার আবহাওয়া ছিল উষ্ণ তবু সকলে আগুনের অভাব অনুভব করত। ব্যাঙজাতীয় প্রাণীগুলো ধরে আগুনে ঝলসে, পুড়িয়ে আয়েশ করে খাওয়া যেত। তাদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য সেগুলো ধরে কাচা চিবিয়ে খাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। যা দেখে অন্যেরা অবশ্য ঘৃণায় নাক কুঁচকিয়েছে।
আগুন থাকলে রান্না করা ছাড়াও বাতি জ্বালানো যেত। বৃষ্টিভেজা শরীরকে খুব সহজেই শুকিয়ে নিত। ক্যাপ্টেন আলভারাজোর ধারণা যে এই গ্রহটিতে কোথাও কোন শুকনো স্থান নেই। সারাক্ষণ ধরেই ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। পাথর ঘষে ঘষে আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি কারো জানা থাকলেও সেখানকার ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের কারণে তা কোন কাজে আসছিল না। আগুন জ্বালানোতে তারা ব্যর্থ হলো।
যতোদূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে তাতে কোথাও কোন পাহাড়-পর্বত নেই। সকলে একটা নিচু পাহাড়কে বেছে নিয়েছে বসবাসের জন্য। পাহাড় চূড়োতে গাছপালা কম। ফার্নজাতীয় গাছের বড় বড় পাতা সংগ্রহ করে আড়াল দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিন কয়েক পর লোকগুলো পৃথিবীর মত করে নিজেদের সুবিধের জন্য সেখানে একটি প্রশাসনিক পরিষদ গঠন করল। লালতীর নভোযানের প্রধান শল্যচিকিৎসক আনাতোলি নেপ্রভকে পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নির্বাচিত করা হলো। এক সময় ক্যাপ্টেন আলভারাজোর প্রতি নভোযানের বাকি যাত্রীদের অনাস্থা দেখা গেল। ক্যাপ্টেনের এমন ধারণা হলো যে নভোযানের অন্যান্য যাত্রীরা বুঝি তাদের নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য তাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে।
সেখানকার পরিষদ ভবনটি ফার্নপাতার ছাউনি দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে করা হয়েছে। বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে পরিষদের প্রথম সভা আহ্বান করা হলো। সদস্যরা অর্ধবৃত্তকারে বসেছে। বিবর্ণ শরীর। জট পাকিয়ে যাওয়া চুল। প্রধান নির্বাহী আনাতোলি নেপ্রভ বলল, আমরা এই সভায় নির্বাচিত হয়েছি। এই সভাতে এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে চাই। ক্যাপ্টেন আলভারাজোর নিকটে এখন জানতে চাইছি, এখান থেকে আমাদের উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা কতখানি?
ক্যাপ্টেন আলভারাজো উত্তরে জানাল, খুবই কম। নেমে আসার সময় যে ছোট একটি জরুরি বার্তা পাঠাতে পেরেছিলাম তা কারো কাছে পৌঁছাতে পেরেছে কি না তা জানি না। এছাড়া আমাদের সঠিক অবস্থানটাও জানানো সম্ভবপর হয়নি।
জীবতত্ত্বের দিক থেকে এই গ্রহটির অবস্থান অনেকটা আমাদের পৃথিবীর ‘কয়লা উৎপাদকী’ যুগের সাথে তুলনীয়। আমাদের উৎকৃষ্টতর অবস্থান চ্যালেঞ্জকারী কোন কিছুর অস্তিত্ব এখানে নেই। ডাইনোসর জাতীয় অতিকার প্রাণীর আবির্ভাব যতদিনে ঘটবে ততদিনে আমরা ভালোভাবে আমাদের অবস্থানকে ধরে রাখতে পারবো।
ওপাশ থেকে এক সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করল, ততদিনে তো আমরা সকলে মরে গিয়ে ভূত হয়ে যাবো। আনাতোলি বলল, আমরা হয়তো মরে যাবো কিন্তু আমাদের উত্তরাধিকারীরা অবশ্যই বেঁচে থাকবে। তাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টাকে যে আমাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য আমরা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রেখে যাব।
এক বয়স্কা মহিলা ঝাঁজালো কণ্ঠে বলে, ভাষা-টাষা তো অনেক পরের ব্যাপার। আমাদের সন্তানেরা যে এ ধরনের বিচ্ছিরি পরিবেশে ঠিকমত বেঁচে থাকতে পারবে। তারই বা নিশ্চয়তা কী?
এমন প্রশ্ন শুনে দল প্রধানের মুখটা চুপসে যায়। সে নিজে একজন শল্যচিকিৎসক। সন্তান জন্মদানের বিষয়টা এখানে হুমকির মতো।
: এ কথা জেনেছি যে এখানে মানুষের জন্য ক্ষতিকারক কোন জীবাণু নেই। থাকলে আমাদের শরীরগুলো থকথকে পুঁজে ভরে যেত। শরীর ভয়ানক পচনে আক্রান্ত হতো। অনেক আগেই তাহলে মারা যেতাম আমরা।
হঠাৎ ওপরের দিকে তাকিয়ে আলভারাজো একটা হেলিকপ্টারকে আকাশে পাক খেতে দেখলো। হেলিকপ্টারটি জানিয়ে দিচ্ছে যে সেটা পৃথিবী থেকে আসেনি। চকচকে হেলিকপ্টারটির ভেতর থেকে একটা বিশাল জাল নেমে এসে লোকজনদের আটকে ফেলছে।
আলভারাজো চাপা গোঙ্গানির মত শব্দ শুনে ছুটে গেল সঙ্গীদের উদ্ধার করার জন্য। জালটি ছড়িয়ে গিয়ে তার সাথের লোকটিকে আটকে ফেলল। জালবদ্ধ লোকটি আর্তচিৎকার করে ওঠে। এ ঘটনার অন্যেরা হতচকিত হয়ে সেদিক পানে ছুটে আসতে থাকে।
আলভারাজো চিৎকার করে ওঠে। সাবধান তোমরা কেউ এদিকে আসবে না। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ো। বিচিত্র হেলিকপ্টারটি তখন নিক্ষেপ করা বিশাল জালটিকে গোটাতে থাকে। যান্ত্রিক গুঞ্জনধ্বনি ক্রমশ বাড়তে থাকে। হেলিকপ্টারটি ওপর দিকে উঠতে শুরু করেছে।
হেলিকপ্টার থেকে নিচের মানুষগুলোকে ছুটন্ত বিন্দুর মত মনে হতে থাকে। আবার তখন হেলিকপ্টারটি নিচে নেমে এলো তখন আলাভারাজো উপত্যকার গাছগোছালির ফাঁকে একটা নভোযানের মাস্তুলকে দেখতে পায়। তার দৃষ্টিগোচর হয় ধাতব মাস্তুলটা।
হেলিকপ্টারের আটককারীরা জাল ফেলে তাদের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে খাঁচায় আটকে রেখেছে। আলভারাজোর কাছে মনে হচ্ছিল এভাবে আটক আটককারীরা সেখানে না এলে এই নতুন জায়গাটি অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক বলে মনে হতো। যে খাঁচার ভেতরে ওদের দলের সদস্যদের বন্দি করে রাখা হয়েছে তার আবহাওয়া নিপুণভাবে পূর্বের গ্রহের অনুকরণে তৈরি করা। খাঁচাটির কাঠ নির্মিত ছাদে অসংখ্য ছিদ্রপথ রয়েছে। তার ভেতর দিয়ে সবসময় উষ্ণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এক জোড়া ফার্ন গাছের বড় বড় পাতার নিচে আশ্রয় গ্রহণের চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। দিনে দুবার করে খাঁচার পেছনের ঝাপটিকে খুলে দিয়ে ব্যাঙের ছাতা ছুঁড়ে দেয়া হয় খাবারের জন্য।
প্রশস্ত পথের ওপাশে আরো অনেকগুলো খাঁচা দেখা গেল। একটি খাঁচার রয়েছে বিচিত্র ধরনের একটি প্রাণী।
বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে বসে আলভারাজো আর তার সঙ্গীরা ভারি কাচ আর গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরের প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
চিকিৎসক বার্নাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আহা ওরা যদি মানুষ হতো। ওরা দেখতে আমাদের মতো হলে এ কথা বোঝানোর জন্য চেষ্টা করা যেত যে আমারাও হলাম গিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী।
ক্যাপ্টেন আলভারাজো জানাল, ওদের গঠন প্রণালী কিন্তু এক নয়। তবু বোঝানোর জন্যে পিথাগোরাসের সূত্র দিয়ে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
তখন এক উৎসাহী যুবক ফার্নগাছের পাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সিক্ত মেঝের ওপরে বিছিয়ে সমকোণী ত্রিভুজ বানালো। আর প্রতিটি কোনার সাথে আবার চতুর্ভুজ তৈরি করল। লম্বা প্রাণীটা তার হাতের মত দেখতে চিকন, নরম একটা উজ্জ্বল রঙের মোড়ক। সেই মোড়কটি দিলো সবচাইতে ছোট প্রাণীটিকে। সে খপ করে ওটা নিয়ে মোড়কটা খুলে বের করে খেয়ে ফেলল। আলভারাজো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, শুধু যদি ওদের জীবজন্তুকে খাওয়ানোর অভ্যেস থাকত। ব্যাঙের ছাতা কচকচিয়ে খেতে খেতে জিবে একেবারে অরুচি ধরে গেছে। ড. বার্নাস বলল, এ ছাড়া যে আমাদের আর কিছু করারও নেই। আমাদের ছয়জনকে হেলিকপ্টারটি ধরে নিয়ে এসে যে খাঁচার ভেতরে পুরে দিলো সেটা কিন্তু আমাদের গুলোর চাইতে উন্নত না। ওটার জেনারেটরগুলো কি আমাদের চাইতেও অধিক শক্তিশালী?
: না, আমাদের মতোই।
: সারাটা পথে আমাদের সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করা হয়নি। অসৌজন্যমূলক আচরণ করেনি। খাবার সরবরাহ করেছে, পানি দিয়েছে। তারপর নামিয়ে নিয়ে আসা হল খাঁচাতে। মাঝপথে তিনজনকে নামিয়ে দেয়া হলো। ওদের দেখা আর পেলাম না। একজন একথা বলে আশঙ্কা প্রকাশ করল, ওদেরকে গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে শরীর ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে বোধ হয়?
ড. বার্নাসের কপালে ভাঁজ পড়ে। বলেন, আমিও সে রকমই সন্দেহ করছি। দুর্ভাগ্যের কথা হলো, ওরা ব্যবচ্ছেদ করে, কাটাকুটি করে বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারবে না।
ফিনেট আক্রোশ মেশানো গলায় বলে, ওরা হচ্ছে গিয়ে রক্ত পিশাচের দল।
আলভারাজো বলল, আরে, এতোটা রেগে যেও না। ওদের দোষারোপ করা যায় না। আমরাও আমাদের গবেষণাগারে অনেক প্রাণিদেহের ব্যবচ্ছেদ করে থাকি। ড. বার্নাস অভিমত দিলেন, আমরাও যে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজাতীয় প্রাণী সে বিষয়টা এদেরকে ভালো করে বোঝানো দরকার। বুদ্ধিমান প্রাণীর সংজ্ঞা আমাদের আর ওদের কাছে কি এক?

: আবারও তাহলে পিথাগোরাসের তত্ত্ব কাজে লাগানোর জন্যে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আলভারাজো বলল, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে আগুন জ্বালানোর ইতিহাস। হাতিরার, যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করার ইতিহাস।
ড. বার্নাস বলে উঠল, তাহলে এবার আগুন জ্বালানো থাক। কয়েকটি যন্ত্র তৈরি করে ব্যবহার করলেও হয়।
আলভারাজো জিজ্ঞেস করে, তার যন্ত্রপাতি বানাবো কী দিয়ে, কোথায় পাবো কারিগর? আমরা তো ওসব জানি না। তবে ফার্নপাতা আর ঘাসলতা দিয়ে দড়ি পাকিয়ে কিছু একটা হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি।
ড. বার্নাস বলল, তাতে অবশ্য কাজ হলেও হতে পারে। তবে এ জাতীয় কাজ কিন্তু কোনো পাখি ও জন্তু জানোয়ারও করতে পারে।
ক্যাপ্টেন আলভারাজো ফার্নগাছের পাতা ছিঁড়ে ফালি ফালি করল। খাঁচার ভেতরে ঘাসলতা পাতা পাকিয়ে একটা বাকসোর মত কাঠামো তৈরি করল। ভিন্ন একটি খাঁচা থেকে তাদের খাঁচাতে তরুণী মেরিকে এনে রাখা হয়েছে।

এক গভীর রাতে মেরির আচমকা চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় আলভারাজোর। এই গ্রহে রাত নেমে আসার পরও ঘোর অন্ধকার কখনও হয় না। ম্লান আলোর একটা ঝাপসা ভাব ছড়িয়ে থাকে।
আলভারাজো মেরির কাছে গিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
ভয়ার্ত কণ্ঠে মেরি বলে, কী যেন একটা দৌড়ে চলে গেল আমার ওপর দিয়ে। ধারাল নখের আঁচড় পেলাম।
আলভারাজো মেরিকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে ওটা বোধ হয় ইঁদুর ছিল। মেঝের ফাঁক দিয়ে খাবার খুঁজতে আসে। ওটাকে তো পোষ মানানো যেতে পারে।
মেরি নাক কুঁচকে বলে, তুমি ও রকম একটা নোংরা প্রাণীকে পুষতে বলছ? আশ্চর্য তো। ওটাকে ধরার একটা ব্যবস্থা করো। ইঁদুরজাতীয় প্রাণীটিকে ধরার ব্যবস্থা করা হলো। ঘাস লতাপাতা দিয়ে পাকানো বাসাটাকে এবার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ওটার ভেতরে এক টুকরো ব্যাঙের ছাতা এমনভাবে বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হলো, যাতে সেখানে টানপড়া মাত্র ঝাঁপটা বন্ধ হয়ে যাবে।
ভিজে বিছানাতে শুয়ে জেগে আছে আলভারাজো। হঠাৎ করে ঝপাস শব্দ শুনে সে বুঝতে পারল যে এবার ফাঁদটা আটকে গেছে। বাকসোর ওপরে নখ দিয়ে আঁচড়ানোর শব্দ শুনতে পেলো। ভেতরে আটকা পড়ে যাওয়া প্রাণীটা এখন বেরুনোর জন্য পথ খুঁজছে। আলভারাজো মেরিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলল, ওই প্রাণীটা এবার ধরা পড়েছে।
মেরি সাথে সাথে বলে, তাহলে ওটাকে মেরে ফেল। কিন্তু আটকে পড়া প্রাণীটিকে আর মারা হলো না।
খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা পুরুষদের ওটার প্রতি বিশেষ মায়া জন্মে গেছে। বহু রঙের নরম পশমে মোড়া ছোট একটি প্রাণী। সেটাকে তখন ছোট খাঁচার মধ্যে অস্থিরভাবে ছুটোছুটি করতে থাকে। মেরি ব্যাঙের ছাতার এক টুকরো ওটাকে খেতে দেয়।
সকলে মিলে তিন দিন ধরে চেষ্টা করল প্রাণীটিকে পোষ মানানোর জন্য। চার দিনের দিন কয়েকজন আটককারী এসে আলভারাজো আর আটকে পড়া ছোট প্রাণীটিকে ধরে নিয়ে যায়।
ড. বার্নাস হতাশ কণ্ঠে বলল, আমাদের বোধ হয় আর আশা করাটা উচিত হবে না। ওটাকে নিশ্চয়ই ল্যাবে নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে।
হঠাৎ খাঁচার পেছনের ঝাঁপটি খুলে যায়। ওরা তখন আঁতকে ওঠে। কোনার দিকে সরে যেতে চেষ্টা করে।
সে সময় পেছন থেকে ক্যাপ্টেন আলভারাজোর কণ্ঠ শোনা যায়।
ভয় পেয়ো না। সবাই বেরিয়ে এসো।
খাঁচায় প্রবেশ করল আলভারাজো। দাড়ি কামানো মসৃণ মুখ।
উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরনে। তাকে যথেষ্ট প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। ক্যাপ্টেন আলভারাজো তাদেরকে অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, বাইরে চলো। আমাদের অতিথি সব কিছুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। আমাদের খাওয়া-পরা, ভালোভাবে থাকার …..ব্যবস্থা করার সাথে সাথে বাকি সবাইকে এখানেই আনিয়ে নেবে। চলো।
ড. বার্নাস বলল, অতটা অস্থির হওয়ার কোনো কিছু নেই। বিষয়টাকে আমার কাছে পরিষ্কার করে বলো তো। আমরা যে বুদ্ধিমান প্রাণী, মান-সম্মান, মর্যাদার অধিকারী সেটা ওরা কিভাবে বুঝতে পারল?
আলভারাজোর মুখাবয়ব ম্লান হয়ে উঠল। কারণ সে ধরনের প্রাণীই নাকি অন্য প্রাণীকে খাঁচায় বন্দি করে রাখার ক্ষমতা রাখে।
(ব্যাটাম সগডলার এর কাহিনির ছায়া অবলম্বন)

Share.

মন্তব্য করুন