হেসে হেসে কথা বলাও ভালো কাজ! হাসি দিয়ে কারো মন খুশি করলে অপরাধ ক্ষমা হয়। বিষয়টা ভেবে অবাক হলো সুবিন। ওর টিচার বলেছে কথাটি। দুদিন হলো শুনেছে। গেলো দুদিন কথাটি ওর মনে খৈ ফুটছে। এত সহজে ভালো কাজ করা যায়! হাসতে তো কোনো খরচ নেই। পয়সাও লাগে না। কষ্টও নেই। তবে? তবে আর কী! এখন থেকে হেসে কথা বলবে মানুষের সাথে। বন্ধুদের সাথে তো বলবেই। বাবা মা ভাই বোন প্রতিবেশী সবার সাথেই হাসি। সবার সাথে হাসি মুখ। বলছেও সুবিন।
সুবিনের হাসি মুখ দেখে সবাই অবাক। যে সুবিন গোমড়া মুখো। গম্ভীর। ভালো ছাত্র বটে কিন্তু মুখ ভারী। কাতুকুতু দিয়েও হাসি আনা যেতো না। সহজে মুখ থেকে কথা বের হতো না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বেশ খানিক সময় নিয়ে জবাব দিতো। সে সুবিন কিনা কথায় কথায় হাসে। হেসে কথা বলে। হাসি দিয়েই জবাব দেয়। মুখে ধরে রাখে হাসির রেখা।
গোমড়া মুখো সুবিনের মুখে হঠাৎ এতো হাসি! কেনো? কী কারণ ঘটলো এমন! সবার মাঝে কানাঘুষা। সবার মাঝে কথা চালাচালি। কী ঘটলো সুবিনের? কেনো ও গোমড়া মুখ থেকে হঠাৎ হাসি মুখে! কেনো? কেনো? কেনো? এমনি জিজ্ঞাসা তুললো সুবিনের বন্ধু কুতুব। কুতুব বরাবরই সুবিনকে একটু বাঁকা চোখে দেখে। দেখে কারণ লেখাপড়ায় এগিয়ে সুবিন। শিক্ষকেরা সুবিনকে ভালো ছাত্র হিসেবে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। এ পছন্দ এবং ভালোবাসা ভালো লাগতো না কুতুবের। শিহাব ও মিলনকেও সঙ্গে নিলো কুতুব। ক্লাসে কুতুব, শিহাব ও মিলন এক সাথেই বসে। এক সাথেই বের হয়। আড্ডা দেয়। কানাকানি ফিসফিসানি চলতেই থাকে। এসবই সুবিনকে ঘিরে। সুযোগ পেলেই অপমান করে সুবিনকে। ছুতো নাতা ধরে চড়াও হয় সুবিনের ওপর। ছোট কারণে বড় ঘটনা ঘটিয়ে দেয়ার কাহিনী করে।
একবার তো আঘাতই করলো সুবিনকে। একটি নোট চেয়েছিলো সুবিনের কাছে। ঘটনাচক্রে নোটটি সুবিনের হাতে ছিলো না। পরে দেবো- বলেছিল সুবিন। অমনি আর যায় কোথায়। কুতুব চড়াও হলো সুবিনের ওপর। সঙ্গে কুতুবের দুই সহযোগী শিহাব ও মিলন। তিনজন মিলে এ কথা সে কথা বলে শেষ পর্যন্ত গায়ে হাত তুললো কুতুব। সুবিন বুঝে গেলো নোট চাওয়াটা ছিলো উসিলা মাত্র। একটি উপলক্ষ তো লাগবে গ-গোলের। সে উপলক্ষটি ছিলো নোট। আসলে নোটের উসিলা ধরে সুবিনকে এক হাত দেখিয়ে দেয়াই ছিলো কুতুবের লক্ষ্য।
কিন্তু কুতুবসহ সবাই অবাক হয়েছিলো- যখন সুবিন মার খেয়েও কোন বিচার দিলো না শিক্ষকের কাছে। সুবিনের বন্ধু শিমুল, হানিফ, জামাল, তুহিন সবাই বলেছিলো- বিচার দে শিক্ষকের কাছে। সুবিন এক বাক্যে বললো- না। আমি ক্ষমা করে দিলাম ওদের। থাক না। কী হয় ক্ষমা করে দিলে। ক্ষমাই তো সুন্দর। ওরা একদিন ওদের ভুল বুঝতে পারবে। বিচার দিলে তিক্ততা বাড়বে। টিচার ওদের শাস্তি দিলে ওরা প্রতিশোধ নিতে চাইবে। আবার আঘাত করবে আমাকে। কী লাভ এতে। আমার ক্ষতি আরো বাড়–ক এটি চাই না আমি। তা ছাড়া যারা অন্যায় করে ওরা না বুঝেই করে। একদিন যখন বুঝবে নিজেরাই লজ্জিত হবে।
এসব কথা শুনে সুবিনের বন্ধুরা অবাক চোখে দেখে সুবিনকে। বলে- তুই তো দেখছি একেবারে মহামানব! আমরা ভাই এতো ক্ষমা টমা শিখিনি। আমাদের কারো গায়ে হাত তুললে ওর রক্ষা নেই। নিজেরা মারবো। বিচারও দেবো।
সুবিন এ কথায় চুপ করে থাকে। উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে প্রায় মেঘ ছুঁয়ে। ভাবে সুবিন- আহা কিভাবে পাখিগুলো পাখা খোলে। আবার গুটিয়ে নেয়। কে এদের ভাসিয়ে রাখে আকাশের শূন্যতায়। কে দিয়েছে পাখা খোলা ও গুটানোর এই কৌশল।
টিপ্পনি কাটে শিমুল- আমাদের সুবিনকে দেখো; উদাস কবি। কোথায় হারিয়ে গেলো দূর দেশে। জামাল বললো- আরে ও তো চিন্তাশীল। হারাবেই তো উদাস হয়ে এক সময় হয় তো কবি টবি হয়ে যাবে। দেখিস লিখে ফেলবে কবিতার মতো নান্দনিক কিছু।
তুহিন বললো- কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়ে গেলে আমাদের ভুলিস না সুবিন। বলেই হা হা স্বরে হাসলো এক গাল।
স্কুলের মাঠেই এক কোণে বসে গল্প করেছিলো ওরা।
সুবিন বললো- চল এবার যাওয়া যাক। বাসায় ফিরতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। ওই যে দেখো আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে রোদ। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেলে বিপদ। বাসায় কারণ দর্শাতে হবে। বাবা বলবেন- কোথায় ছিলে এতক্ষণ? মা বলবেন- আজ এতো দেরি হলো কেনোরে?
হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছিস সুবিন। চল যাই বললো- হানিফ। বললো- আমার মা এক ধাপ এগিয়ে থাপ্পড় বসিয়েও দিতে পারে। মা টি আমার ভীষণ কড়া। সামান্য অনিয়মও মানেন না।
তুহিন বললো- আমার আব্বু কড়া বেশি। আম্মুকে এটা সেটা বলে ম্যানেজ করার উপায় থাকে। আব্বুকে একেবারেই না। উনার ধারণার সাথে না মিললেই হলো। ব্যাস- ধমাধম্ দু চারটে লাগিয়ে দেবেন। উল্টা পাল্টা কিছু বললেই ধরে ফেলেন। আর ধরা পড়লেই কথা নেই। হাত তেড়ে ওঠে। তার এক কথা যা করবে বলে কয়ে করবে। নো লুকোচুরি। একটা করে অন্যটা বলবে এমনটি হবে না। ভুল করলে স্বীকার করতে হবে। শুদ্ধ করলে তো করলামই। মুচকি হেসে সুবিন বললো- আমার বাবা মা কেউ তেমন কড়া নন। আবার ছেড়েও দেবেন না। তবে আমার প্রতি তাদের অনেক বিশ্বাস। তাঁদের ধারণা- আমি কোনো খারাপ কাজে জড়াবো না। অন্যায় কাজ করবো না। ঝগড়া করবো না কারো সাথে। কেউ ঝগড়া করলেও চুপ থাকবো আমি। এমন ধারণায় আমি লজ্জাও পাই। এতে অবশ্য আমার একটি বড় লাভ হয়। কখনো খারাপ কিছু করতে গেলেই বাবা মার মুখ ভেসে ওঠে মনে। ভাবি বাবা মা’র বিশ্বাস ভাঙবো আমি! এতে অনিয়ম করা থেকে বেঁচে যাই।
শিমুল বললো- হায়রে আমার সোনার ধন! এ জন্যই তুই মার খেয়েও হজম করলি। বিচার দিলি না। অপরাধীও শাস্তি পেলো না!
ওকে ওর মতো কাজ করতে দে তো শিমুল বললো- তুহিন। চল আর নয়। এবার রওয়ানা।
হ্যাঁ হ্যাঁ বলে উঠে গেলো সবাই। যে যার বাসার দিকে চললো।

ক্লাসে বসে আছে সুবিন। তার সাথে বসা শিমুল তুহিন, জামাল। শিক্ষক আসতে আরো বেশ খানিক সময় বাকি। নিজেদের মধ্যে লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করছিলো ওরা। ইংরেজি শিক্ষক গ্রামার পড়িয়ে গেলেন আগের পিরিয়ডে। গ্রামার নিয়েই চলছিলো ওদের আলোচনা। সুবিনকে জিজ্ঞেস করছে ওরা। পরিষ্কার করে জবাব দিচ্ছে সুবিন। বুঝিয়ে দিচ্ছে যার যেখানটায় সমস্যা। বোঝানোর ক্ষমতা সুবিনের দারুণ। যখন বোঝায় মনে হয় ও বেশ দক্ষ টিচার। সহপাঠী বন্ধুরা অবাক চোখে চেয়ে থাকে। বলে ওঠে কেউ কেউ- কিভাবে এতো সুন্দর করে বোঝাও। তুমি টিচার হলে খুব ভালো করবে। খানিকটা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে সুবিনের মুখ। চোখ নামিয়ে চেয়ে থাকে নিচের দিকে। তার এমন বিনয় দেখে বন্ধুরা আরো ঘনিষ্ঠ হতে চায় ওর সাথে।
আজও ক্লাসে গ্রামার বোঝাচ্ছিলো সুবিন। টিচার না আসা পর্যন্ত ওর এ বোঝাবুঝির খেলা চলতে থাকে। বন্ধুরা সহপাঠীরা নানান সমস্যা জিজ্ঞেস করছে। বেশ হাসি মুখে বুঝিয়ে দিচ্ছে ও। এক সময় গোমড়া মুখ ছিলো সুবিনের। একটার বেশি দুটো প্রশ্ন করতে ভয় করতো বন্ধুরা। এখন হাসিমুখ। যত প্রশ্ন করুক হাসি টেনে জবাব দিচ্ছে ও।
সুবিনের পেছনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে কুতুব- কারো খেয়াল নেই। সবাই ঢুকে গেলো গ্রামারের মজার পাঠে। সেই মজা সৃষ্টি করে দেয়া সুবিন সবার আকর্ষণ। কুতুব সুবিনের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে। প্রায় ঝুঁকে আছে সুবিনের দিকে। অবাক হয়ে সুবিনের কথা শুনছিলো কুতুব। দেখলো মজা করে হেসে হেসে গ্রামার বোঝাচ্ছে সুবিন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ও। এক সময় শিমুলের চোখ পড়লো কুতুবের দিকে। দেখেই চমকে গেলো শিমুল! কিন্তু মুখে বললো না কিছুই। ইশারায় তুহিনকে দেখালো। তুহিন খানিকটা বেশি সাহসী। কুতুবকে দেখেই বিদুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেলো বললো- কুতুব তুই?
কুতুব ইঙ্গিতে মুখে আঙুল চাপা দিয়ে না করলো কথা বলতে। কেনো কথা বলবে না? এই বলে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলো শিমুল। ততক্ষণে সুবিনও দেখলো- ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে কুতুব!
দাঁড়ালো না সুবিন। ঘাড় ফিরিয়ে ঠা-া মাথায় জিজ্ঞেস করলো- কোনো সমস্যা কুতুব? দু’দিকে মাথা নেড়ে কুতুব বললো- না। কোনো সমস্যা নেই।
কুতুবের মাথা নাড়ার ভঙ্গি দেখে চুপ করে গেলো সবাই। সুবিনের পেছন দিক থেকে ঘুরে এসে সামনে দাঁড়ালো কুতুব। দাঁড়িয়ে চেয়ে সুবিনের দিকে।
সুবিন মুখে হাসি টেনে বললো- কিছু বলবে? আবার মারবে আমাকে? বলে কুতুবের চোখের দিকে চেয়ে রইলো সুবিন।
হঠাৎ কুতুব দু’হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো সুবিনকে। বুকে ধরে বললো- আমাকে ক্ষমা করে দে সুবিন। আমি না বুঝে তোকে আঘাত করেছি। অন্যায় করেছি আমি। তুই মার খেয়েও যখন বিচার দিলি না- আমার মনে হলো তুই সত্যিই অন্যরকম মানুষ। বিচার না দিয়েই সব চেয়ে বড় বিচার করে দিলি আমার। তখন নিজেকে তোর তুলনায় খুব ছোট মনে হচ্ছিলো। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম ক্ষমা চাইবো তোর কাছে।
আমি ক্ষমা চাই। আমাকে ক্ষমা করে দে বন্ধু। সুবিনও জড়িয়ে নিলো কুতুবকে। পিঠে হাত বুলিয়ে বললো- আমি তো সেদিনই ক্ষমা করে দিয়েছি। দিয়েছি বলেই তো বিচার দেইনি। আর আজ থেকে আমরা বন্ধু।
সুবিনের এমন মায়ামাখা কথায় গলে গেলো কুতুব। বললো- আজ থেকে আমরা সবাই বন্ধু। শিমুল তুহিন জামাল হানিফ এদের সবার হাত টেনে বুকে চেপে রাখলো কুতুব। ওর দু’চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আনন্দের দু’ফোঁটা অশ্রু আলতো হাতে মুছে দিলো সুবিন। সবার হাত এক করে বললো- হাসি মুখে কথা বলবো আমরা সবাই।

Share.

মন্তব্য করুন